মিশরে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে আলোচনায় গাজায় যুদ্ধ বন্ধে শান্তি চুক্তির ঘোষণা দেয়ার পরপরই বৃহস্পতিবার, গাজায় (ওপরে) ও তেল আবিবে (নিচে) আনন্দে মেতে ওঠে দু’দেশের মানুষ
গাজায় আপাতত শান্তি প্রতিষ্ঠা এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। যে কোনো সময় বিশ্ববাসী শুনবে গাজায় যুদ্ধ বন্ধ এবং কাক্সিক্ষত শান্তি প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক ঘোষণা। ইতোমধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাজি হয়ে যুদ্ধ শেষ করার জন্য ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছে। এই চুক্তির খবরে গাজায়-ইসরায়েলে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। গাজায় প্যালেস্টাইনিরা এবং ইসরায়েলে জিম্মিদের পরিবারগুলো তীব্র আনন্দ উদযাপন করছে। আগামীকাল দুই দেশের জিম্মিরা মুক্তি পাবে বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প।
প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস বৃহস্পতিবার, (০৯ অক্টোবর ২০২৫) ঘোষণা করেছে, চলতি সপ্তাহে মিসরে ইসরায়েলের সঙ্গে পরোক্ষ আলোচনায় তারা একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে। এ চুক্তিতে গাজায় চলমান যুদ্ধের অবসান ঘটানোর কথা বলা হয়েছে।
এর আগে গতকাল বুধবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প জানান, গাজায় যুদ্ধ বন্ধ ও জিম্মি মুক্তিসংক্রান্ত তার ২০ দফা পরিকল্পনার প্রথম ধাপ বাস্তবায়নে একমত হয়েছে হামাস ও ইসরায়েল।
ট্রাম্প তার ট্রুথ সোশ্যালে দেয়া পোস্টে লেখেন, ‘আমি অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করছি, ইসরায়েল ও হামাস উভয়ে আমাদের শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপে সই করেছে।’ তিনি বলেছেন, ‘এর অর্থ হলো দ্রুতই সব জিম্মি মুক্তি পাবে এবং সমঝোতা অনুযায়ী ইসরায়েল তাদের সেনাদের একটি লাইন বরাবর প্রত্যাহার করবে। এটি হবে একটি দৃঢ়, টেকসই ও চিরস্থায়ী শান্তির প্রতি প্রথম পদক্ষেপ।’
এর আগে ট্রাম্প বলেছিলেন, একটি চুক্তি প্রায় হয়ে গেছে এবং আসছে সপ্তাহান্তে তিনি মিশরে যেতে পারেন। সম্ভবত আগামীকালই দেশ ছাড়তে পারেন। তিনি মিশরের পাশাপাশি ইসরায়েলেও যেতে পারেন বলে অ্যাক্সিওস জানিয়েছে।
হামাস এক বিবৃতিতে বলেছে, তারা এমন এক চুক্তিতে পৌঁছেছে, যা গাজায় যুদ্ধের অবসান ঘটাবে। পাশাপাশি দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী প্রত্যাহার, মানবিক সহায়তা প্রবেশ ও বন্দী বিনিময়ের পথ সুগম করবে।
হামাস মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, তিনি যেন ইসরায়েলকে এই চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়নে বাধ্য করেন। ইসরায়েলকে যেন কোনোভাবেই তা এড়িয়ে যাওয়ার বা বিলম্ব করার সুযোগ দেয়া না হয়।
আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, বার্তা আদান-প্রদানের অ্যাপ টেলিগ্রামে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে হামাস জানিয়েছে, তারা যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ইসরায়েলে বন্দী প্যালেস্টাইনিদের একটি তালিকা ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের কাছে দিয়েছে। তালিকাটি এখন চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। অনুমোদন মিললে তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে।
এরপর গাজায় যুদ্ধবিরতি ও বন্দী বিনিময় সম্পন্ন হওয়ার কথা, যা দুই বছর ধরে চলা প্রাণঘাতী যুদ্ধ শেষ করার পথ খুলে দিতে পারে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাস ও অন্য প্যালেস্টাইনি গোষ্ঠীর হামলার সময় আড়াইশ’ জনকে জিম্মি করা হয়েছিল। দুই বছরের যুদ্ধে অনেক জিম্মি মারা পড়েছে, গত বছরের শেষদিকে হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী অনেকে ছাড়াও পেয়েছে। তবে হামাসের হাতে এখনও ৪৮ ইসরায়েলি জিম্মি আছে এবং এদের মধ্যে ন্যূনতম ২০ জন জীবিত বলে অনুমান করা হচ্ছে।
যদি এই চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয় তাহলে গাজা যুদ্ধ থামানোর আগের যে কোনো প্রচেষ্টার তুলনায় এবারই দুইপক্ষ বেশি কাছাকাছি আসবে। এই যুদ্ধ এরই মধ্যে গাজা থেকে ছড়িয়ে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধে রূপ নিয়েছে। এতে ইরান, ইয়েমেন ও লেবানন জড়িয়ে পড়েছে। ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা আরও গভীর হয়েছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক চেহারা পরিবর্তিত হয়ে গেছে।
এই চুক্তি গাজা ভূখণ্ডে অবিলম্বে অতি প্রয়োজনীয় মানবিক ত্রাণ পাঠানোর পথও করে দিতে পারে। প্যালেস্টাইনি ছিটমহলটির পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বলে আগস্টে বৈশ্বিক এক অনাহার পর্যবেক্ষক সংস্থা জানিয়েছিল।
গাজার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দুই বছর ধরে চলা ইসরায়েলের অবিরাম নৃশংস হামলায় ভূখণ্ডটিতে ৬৭ হাজারেরও বেশি প্যালেস্টাইনি নিহত হয়েছেন এবং অব্যাহত বোমাবর্ষণে ছিটমহলটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
প্যলেস্টাইন ও ইসরাইলে আনন্দ-উল্লাস
গাজায় যুদ্ধবন্ধের চুক্তি হওয়ার কথা গণমাধ্যমে প্রচার হওয়ার পরপরই প্যালেস্টাইন ও ইসরাইলে লোকজন আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠে। গাজার তরুণরা ধ্বংস হয়ে যাওয়া রাস্তাগুলোতে নেমে আসে স্লোগান দিয়ে নেচে-গেয়ে খবরটি উদযাপন করেছে। এমনকী ছিটমহলটির কিছু অংশে ইসরায়েলি হামলা অব্যাহত থাকলেও তারা দমে যায়নি।
গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খান ইউনুসে আনন্দরত আব্দুল মজিদ আব্দ রাব্বো রয়টার্সকে বলেন, ‘এই যুদ্ধবিরতির জন্য, রক্তপাত ও হত্যাকাণ্ড বন্ধের জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ। শুধু আমিই খুশি না, পুরো গাজা ভূখণ্ড খুশি। এই রক্তপাত বন্ধ হয়ে যুদ্ধবিরতি হওয়ায় সব আরব জনগণ, পুরো বিশ্ব খুশি। আমাদের পক্ষে যারা দাঁড়িয়েছেন সবাইকে ধন্যবাদ ও ভালোবাসা।’
ইসরায়েলের তেলআবিবে তথাকথিত জিম্মি চত্বরে গাজায় হামাসের হাতে বন্দি এক জিম্মির মা আইনভ জাঙ্গাউকার অত্যন্ত আনন্দিত ছিলেন। উদযাপনের লাল অগ্নিশিখার আলোতে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘আমি দম নিতে পারছি না, আমি দম নিতে পারছি না, আমি কী অনুভব করছি ব্যাখ্যা করতে পারবো না, এতো আনন্দ হচ্ছে।’
নিজের জিম্মি ছেলের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ওকে আমি কী বলবো? আমি কী করবো? জড়িয়ে ধরবো আর চুমু খাবো। শুধু বলবো আমি ওকে ভালোবাসি, এটাই। আর তার চোখ আমার চোখে ডুবে যাওয়া দেখবো, এটা অসাধারণ, এটাই স্বস্তি।’
এই মুহূর্তে কেমন অনুভব করছেন, রয়টার্সের এমন প্রশ্নে সাবেক জিম্মি ওমের শেমটোভ বলেন, ‘এটি বর্ণনার ভাষা নেই।’
গাজায় তরুণদের একটি দল এ খবরে আনন্দ উদযাপন করছিল। এক বন্ধুর কাঁধে চড়া এক তরুণ স্লোগান দিচ্ছিল আর বাকিরা তাকে ঘিরে হাততালি দিচ্ছিল। লোকজন আনন্দে কাঁদছিল আর ‘আল্লাহু আকবর’ বলে স্লোগান দিচ্ছিল। ‘আল্লাহ মহান’ বলছিলো তারা। এই চুক্তি যুদ্ধ শেষ করবে আর তাদের বাড়িতে ফেরার সুযোগ করে দেবে বলে তারা আশা প্রকাশ করছিল।
গাজা সিটি থেকে বাস্তুচ্যুত ব্যবসায়ী তামের আল-বুরারি বলেন, ‘আমি হাসি আর কান্না থামাতে পারছি না। আমরা বেঁচে গেছি, এটা বিশ্বাস করতে পারছি না।’
রয়টার্সকে এক কথোপকথন অ্যাপের মাধ্যমে তিনি বলেন, ‘আমাদের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার অপেক্ষা আর করতে পারছি না, সেগুলো ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরও। গাজা সিটিতে ফিরতে চাই, বোমার আতঙ্ক ছাড়াই ঘুমাতে চাই, আমাদের জীবন পুননির্মাণ করতে চাই।’
হামাস শাসিত গাজা সরকারের গণমাধ্যম দপ্তর আনুষ্ঠানিভাবে চুক্তিটির বিস্তারিত খুঁটিনাটি প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত লোকজনকে নিজ নিজ এলাকায় না ফেরার জন্য আহ্বান জানিয়েছে। জনগণকে ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলো থেকে দূরে থাকতে বলেছে তারা।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীও গাজার উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দাদের নিজ নিজ এলাকায় ফিরে না আসার জন্য সতর্ক করেছে। সামাজিক মাধ্যম এক্স এ বাহিনীটি বলেছে, ‘এলাকাগুলো এখনও বিপজ্জনক যুদ্ধ অঞ্চল হয়ে আছে।’
জিম্মি ইসরায়েলিরা আগামীকাল মুক্তি পেতে পারেন
গাজায় যুদ্ধ বন্ধের জন্য মার্কিন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আগামীকালের মধ্যেই ইসরায়েলি জিম্মিরা মুক্তি পেতে পারেন। চুক্তিটির বিস্তারিত জানেন এমন একটি সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, চুক্তি স্বাক্ষরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ওই ভূখণ্ড থেকে আংশিক সেনা প্রত্যাহারের প্রথম পর্ব শেষ করবে।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু চুক্তি অনুমোদনের জন্য বৃহস্পতিবার, মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকার কথা জানিয়েছেন। নেতানিয়াহু এক বিবৃতিতে বলেন, ‘পরিকল্পনার প্রথম ধাপ অনুমোদনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সব জিম্মিকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। এটি একটি কূটনৈতিক সাফল্য এবং ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্য একটি জাতীয় ও নৈতিক বিজয়।’
হামাসের একটি সূত্র জানিয়েছে, ইসরায়েলি সরকার চুক্তি অনুমোদনের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে জীবিত জিম্মিদের হস্তান্তর করা হবে। হামাস কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলেছেন, গাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে মৃত জিম্মিদের মরদেহ উদ্ধার করতে আরও সময় লাগবে। তাদের সংখ্যা প্রায় ২৮ জন বলে মনে করা হচ্ছে।
এখনও হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল
যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে দুইপক্ষই (হামাস ও ইসরায়েল) সম্মত হয়েছে- যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের এ ঘোষণার পরও গাজায় হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েলি বাহিনী। ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলো গাজা নগরীর পশ্চিমাঞ্চলে হামলা করেছে বলে জানিয়েছেন আল-জাজিরার স্থানীয় সাংবাদিকরা। বিমান থেকে ফেলা গোলা আল-শাতি শরণার্থীশিবিরের অন্তত একটি বাড়িতে আঘাত হানে।
এছাড়া ইসরায়েলি সেনারা গাজা নগরীর দক্ষিণে সাবরা এলাকার কিছু বাড়িঘরের কাছে একটি গাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটান। তবে ইসরায়েলি হামলা ও বিস্ফোরণে তাৎক্ষণিকভাবে হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর টেলিফোন
শান্তি প্রতিষ্ঠায় চুক্তি সম্পাদনের পর ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে তার এ নিয়ে টেলিফোনে খুবই আবেগঘন ও উষ্ণ কথাবার্তা হয়েছে। ওই ফোনালাপে তারা সব জিম্মির মুক্তি নিশ্চিত করে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি অর্জনে সফল হতে পারার জন্য পরস্পরকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, তার সব প্রচেষ্টা ও বৈশ্বিক নেতৃত্বের জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রধানমন্ত্রীকে তার দৃঢ় নেতৃত্ব এবং তার গ্রহণ করা নানা পদক্ষেপের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন।
এছাড়া দুজনই ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা অব্যাহত রাখার বিষয়ে একমত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ইসরায়েলি পার্লামেন্টে ভাষণ দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বলেও ওই বিবৃতিতে বলা হয়।
ইসরায়েল-হামাসের চুক্তি, বিশ্বনেতাদের অভিনন্দন, সহায়তার আশ্বাস
গাজায় যুদ্ধ বন্ধে ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে চুক্তি সইয়ের পর বিশ্ব নেতারা অভিনন্দন এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় আশাবাদ জানিয়েছেন, কেউ কেউ সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। পাশাপাশি তারা উভয়পক্ষকে চুক্তির অঙ্গীকারগুলো যথাযথভাবে পূরণের আহ্বান জানিয়েছেন। বিশ্ব নেতারা দুই বছর ধরে চলা গাজা যুদ্ধ বন্ধে চুক্তি হওয়াকে বড় ধরনের সাফল্য হিসেবে দেখছেন।
ইসরাইল ও হামাস নেতারা বৃহস্পতিবার, জানিয়েছেন, তারা গাজায় যুদ্ধ বন্ধ ও জিম্মি মুক্তির লক্ষ্যে চুক্তিতে সই করেছেন। এরপরই সারাবিশ্বে শান্তিকামী মানুষ আনন্দ প্রকাশ এবং নেতারা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন।
এখানে কয়েকটি দেশের নেতাদের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হলো।
যুক্তরাজ্য: ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার চুক্তির খবরকে স্বাগত জানিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে গাজায় সহায়তা প্রবেশে সব ধরনের অবরোধ তুলে নেয়ার আহ্বান জানান।
স্টারমার বলেন, এটি এমন এক মুহূর্ত, যা সারা বিশ্বে গভীর স্বস্তি এনে দেবে; বিশেষ করে জিম্মিদের পরিবার ও গাজার বেসামরিক মানুষদের জন্য। তারা গত দুই বছর অকল্পনীয় দুর্ভোগ সহ্য করেছেন।
ফ্রান্স: ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ এ চুক্তিকে ‘জিম্মি ও তাদের পরিবার, গাজার প্যালেস্টাইনি ও গোটা অঞ্চলের জন্য এক বড় আশার বার্তা’ বলে উল্লেখ করেছেন। এক্সে দেয়া বার্তায় মাখোঁ ডনাল্ড ট্রাম্প এবং কাতার, মিসর ও তুরস্কের মধ্যস্থতাকারীদের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন এবং ইসরায়েল ও হামাস দুই পক্ষকে চুক্তির শর্ত কঠোরভাবে মেনে চলার আহ্বান জানান।
ইতালি: ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি এ চুক্তিকে ‘অসাধারণ খবর’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘এই চুক্তি এবং ট্রাম্পের পরিকল্পনার নির্দেশিত বৃহত্তর পথ এই সংঘাত শেষ করার এক বিরল সুযোগ। এটি আমাদের কাজে লাগাতে হবে।’ মেলোনি আরও বলেন, ‘আমি সব পক্ষকে আহ্বান জানাই, তারা যেন ইতোমধ্যে গৃহীত পদক্ষেপগুলো সম্পূর্ণভাবে সম্মান জানায় এবং শান্তি পরিকল্পনার পরবর্তী ধাপগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে।’
তুরস্ক: হামাস ও ইসরায়েল- দুই পক্ষের আলোচনায় ভূমিকা রাখা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে দেয়া এক পোস্টে তিনি ট্রাম্পকে ‘প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রদর্শন করার’ জন্য ধন্যবাদ জানান। একই সঙ্গে কাতার ও মিসরকেও মধ্যস্থতায় ভূমিকা রাখার জন্য কৃতজ্ঞতা জানান। এরদোয়ান বলেন, তুরস্ক চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করবে এবং এ প্রক্রিয়ায় অবদান অব্যাহত রাখবে। তিনি আরও বলেন, ‘দুই বছর ধরে বর্ণনাতীত কষ্ট সহ্য করা আমার প্যালেস্টাইনি ভাই-বোনদের প্রতি আমি আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।’
জাতিসংঘ: জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘জাতিসংঘ এ চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে সহায়তা করবে এবং মানবিক ত্রাণ কার্যক্রম জোরদার করবে। পাশাপাশি আমরা গাজার পুনর্গঠন ও পুনরুদ্ধার কার্যক্রমও এগিয়ে নেব।’ মহাসচিব আরও বলেন, এখন এই ঐতিহাসিক সুযোগ কাজে লাগিয়ে এমন একটি রাজনৈতিক পথ তৈরির সময় এসেছে; যা দখলদারির অবসান ঘটাবে, প্যালেস্টাইনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বীকৃতি দেবে এবং দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের পথে ইসরায়েলি ও প্যালেস্টাইনিদের নিরাপদে সহাবস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে।
কানাডা: কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, ‘জিম্মিদের শিগগিরই পরিবারের সঙ্গে পুনর্মিলন ঘটবে জেনে আমি স্বস্তি পেয়েছি।’ মার্ক কার্নি আরও বলেন, অনেক বছরের তীব্র কষ্টের পর অবশেষে মনে হচ্ছে, শান্তি এখন নাগালের মধ্যে। কানাডা সব পক্ষকে আহ্বান জানায়, তারা যেন দ্রুত চুক্তির সব শর্ত বাস্তবায়ন করে একটি ন্যায়সঙ্গত ও স্থায়ী শান্তির দিকে এগিয়ে যায়।
মালয়েশিয়া: মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম এক বিবৃতিতে বলেন, মাসের পর মাস অসহনীয় কষ্ট ও ধ্বংসের পর এ চুক্তি কিছুটা হলেও আশার আলো দেখাচ্ছে। আনোয়ার ইব্রাহিম সব পক্ষকে এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে স্থায়ী ও সর্বাত্মক শান্তির পথে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।
জাপান: জাপানের চিফ কেবিনেট সেক্রেটারি ইয়োশিমাসা হায়াশি সাংবাদিকদের বলেন, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে ‘প্রথম ধাপের চুক্তি’ হওয়ায় জাপান তাকে স্বাগত জানাচ্ছে। এটি পরিস্থিতি শান্ত করার ও দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের পথে অগ্রসর হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। টোকিও গাজার মানবিক পরিস্থিতির উন্নয়ন ও পুনর্গঠনে সহায়তা অব্যাহত রাখবে বলেও জানান হায়াশি।
অস্ট্রেলিয়া: অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ চুক্তিটিকে ‘আশার আলো’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আলবানিজ বলেন, এ ঘোষণা আট দশকের সংঘাত ও সন্ত্রাসের পর সহিংসতার চক্র ভেঙে একটি ভালো ভবিষ্যৎ গড়ার আশা এনে দিয়েছে। আজকের দিনটি বিশ্বের জন্য সত্যিকারের আশার দিন।
নিউজিল্যান্ড: নিউজিল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইনস্টন পিটার্স বলেন, গত দুই বছর ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিরা প্রচণ্ড কষ্ট ভোগ করেছেন। আজকের এ চুক্তি সেই কষ্ট অবসানের প্রথম ইতিবাচক পদক্ষেপ। হামাস ও ইসরায়েলকে চুক্তির সব শর্ত বাস্তবায়নের আহ্বান জানান তিনি।
ভারত: ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক্সে লেখেন, ‘জিম্মিদের মুক্তি ও গাজার মানুষের জন্য মানবিক সহায়তা বৃদ্ধি তাদের কষ্ট কিছুটা লাঘব করবে এবং স্থায়ী শান্তির পথে অগ্রসর হতে সাহায্য করবে, আমরা সেই আশাই করি।’
পাকিস্তান: পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এক্সে লেখেন, এ চুক্তি গাজার জনগণের দুর্ভোগের অবসান ঘটানো এবং ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই শান্তির পথে অগ্রসর হওয়ার এক ঐতিহাসিক সুযোগ।
মিশরে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে আলোচনায় গাজায় যুদ্ধ বন্ধে শান্তি চুক্তির ঘোষণা দেয়ার পরপরই বৃহস্পতিবার, গাজায় (ওপরে) ও তেল আবিবে (নিচে) আনন্দে মেতে ওঠে দু’দেশের মানুষ
বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৫
গাজায় আপাতত শান্তি প্রতিষ্ঠা এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। যে কোনো সময় বিশ্ববাসী শুনবে গাজায় যুদ্ধ বন্ধ এবং কাক্সিক্ষত শান্তি প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক ঘোষণা। ইতোমধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাজি হয়ে যুদ্ধ শেষ করার জন্য ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছে। এই চুক্তির খবরে গাজায়-ইসরায়েলে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। গাজায় প্যালেস্টাইনিরা এবং ইসরায়েলে জিম্মিদের পরিবারগুলো তীব্র আনন্দ উদযাপন করছে। আগামীকাল দুই দেশের জিম্মিরা মুক্তি পাবে বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প।
প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস বৃহস্পতিবার, (০৯ অক্টোবর ২০২৫) ঘোষণা করেছে, চলতি সপ্তাহে মিসরে ইসরায়েলের সঙ্গে পরোক্ষ আলোচনায় তারা একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে। এ চুক্তিতে গাজায় চলমান যুদ্ধের অবসান ঘটানোর কথা বলা হয়েছে।
এর আগে গতকাল বুধবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প জানান, গাজায় যুদ্ধ বন্ধ ও জিম্মি মুক্তিসংক্রান্ত তার ২০ দফা পরিকল্পনার প্রথম ধাপ বাস্তবায়নে একমত হয়েছে হামাস ও ইসরায়েল।
ট্রাম্প তার ট্রুথ সোশ্যালে দেয়া পোস্টে লেখেন, ‘আমি অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করছি, ইসরায়েল ও হামাস উভয়ে আমাদের শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপে সই করেছে।’ তিনি বলেছেন, ‘এর অর্থ হলো দ্রুতই সব জিম্মি মুক্তি পাবে এবং সমঝোতা অনুযায়ী ইসরায়েল তাদের সেনাদের একটি লাইন বরাবর প্রত্যাহার করবে। এটি হবে একটি দৃঢ়, টেকসই ও চিরস্থায়ী শান্তির প্রতি প্রথম পদক্ষেপ।’
এর আগে ট্রাম্প বলেছিলেন, একটি চুক্তি প্রায় হয়ে গেছে এবং আসছে সপ্তাহান্তে তিনি মিশরে যেতে পারেন। সম্ভবত আগামীকালই দেশ ছাড়তে পারেন। তিনি মিশরের পাশাপাশি ইসরায়েলেও যেতে পারেন বলে অ্যাক্সিওস জানিয়েছে।
হামাস এক বিবৃতিতে বলেছে, তারা এমন এক চুক্তিতে পৌঁছেছে, যা গাজায় যুদ্ধের অবসান ঘটাবে। পাশাপাশি দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী প্রত্যাহার, মানবিক সহায়তা প্রবেশ ও বন্দী বিনিময়ের পথ সুগম করবে।
হামাস মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, তিনি যেন ইসরায়েলকে এই চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়নে বাধ্য করেন। ইসরায়েলকে যেন কোনোভাবেই তা এড়িয়ে যাওয়ার বা বিলম্ব করার সুযোগ দেয়া না হয়।
আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, বার্তা আদান-প্রদানের অ্যাপ টেলিগ্রামে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে হামাস জানিয়েছে, তারা যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ইসরায়েলে বন্দী প্যালেস্টাইনিদের একটি তালিকা ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের কাছে দিয়েছে। তালিকাটি এখন চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। অনুমোদন মিললে তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে।
এরপর গাজায় যুদ্ধবিরতি ও বন্দী বিনিময় সম্পন্ন হওয়ার কথা, যা দুই বছর ধরে চলা প্রাণঘাতী যুদ্ধ শেষ করার পথ খুলে দিতে পারে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাস ও অন্য প্যালেস্টাইনি গোষ্ঠীর হামলার সময় আড়াইশ’ জনকে জিম্মি করা হয়েছিল। দুই বছরের যুদ্ধে অনেক জিম্মি মারা পড়েছে, গত বছরের শেষদিকে হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী অনেকে ছাড়াও পেয়েছে। তবে হামাসের হাতে এখনও ৪৮ ইসরায়েলি জিম্মি আছে এবং এদের মধ্যে ন্যূনতম ২০ জন জীবিত বলে অনুমান করা হচ্ছে।
যদি এই চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয় তাহলে গাজা যুদ্ধ থামানোর আগের যে কোনো প্রচেষ্টার তুলনায় এবারই দুইপক্ষ বেশি কাছাকাছি আসবে। এই যুদ্ধ এরই মধ্যে গাজা থেকে ছড়িয়ে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধে রূপ নিয়েছে। এতে ইরান, ইয়েমেন ও লেবানন জড়িয়ে পড়েছে। ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা আরও গভীর হয়েছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক চেহারা পরিবর্তিত হয়ে গেছে।
এই চুক্তি গাজা ভূখণ্ডে অবিলম্বে অতি প্রয়োজনীয় মানবিক ত্রাণ পাঠানোর পথও করে দিতে পারে। প্যালেস্টাইনি ছিটমহলটির পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বলে আগস্টে বৈশ্বিক এক অনাহার পর্যবেক্ষক সংস্থা জানিয়েছিল।
গাজার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দুই বছর ধরে চলা ইসরায়েলের অবিরাম নৃশংস হামলায় ভূখণ্ডটিতে ৬৭ হাজারেরও বেশি প্যালেস্টাইনি নিহত হয়েছেন এবং অব্যাহত বোমাবর্ষণে ছিটমহলটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
প্যলেস্টাইন ও ইসরাইলে আনন্দ-উল্লাস
গাজায় যুদ্ধবন্ধের চুক্তি হওয়ার কথা গণমাধ্যমে প্রচার হওয়ার পরপরই প্যালেস্টাইন ও ইসরাইলে লোকজন আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠে। গাজার তরুণরা ধ্বংস হয়ে যাওয়া রাস্তাগুলোতে নেমে আসে স্লোগান দিয়ে নেচে-গেয়ে খবরটি উদযাপন করেছে। এমনকী ছিটমহলটির কিছু অংশে ইসরায়েলি হামলা অব্যাহত থাকলেও তারা দমে যায়নি।
গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খান ইউনুসে আনন্দরত আব্দুল মজিদ আব্দ রাব্বো রয়টার্সকে বলেন, ‘এই যুদ্ধবিরতির জন্য, রক্তপাত ও হত্যাকাণ্ড বন্ধের জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ। শুধু আমিই খুশি না, পুরো গাজা ভূখণ্ড খুশি। এই রক্তপাত বন্ধ হয়ে যুদ্ধবিরতি হওয়ায় সব আরব জনগণ, পুরো বিশ্ব খুশি। আমাদের পক্ষে যারা দাঁড়িয়েছেন সবাইকে ধন্যবাদ ও ভালোবাসা।’
ইসরায়েলের তেলআবিবে তথাকথিত জিম্মি চত্বরে গাজায় হামাসের হাতে বন্দি এক জিম্মির মা আইনভ জাঙ্গাউকার অত্যন্ত আনন্দিত ছিলেন। উদযাপনের লাল অগ্নিশিখার আলোতে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘আমি দম নিতে পারছি না, আমি দম নিতে পারছি না, আমি কী অনুভব করছি ব্যাখ্যা করতে পারবো না, এতো আনন্দ হচ্ছে।’
নিজের জিম্মি ছেলের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ওকে আমি কী বলবো? আমি কী করবো? জড়িয়ে ধরবো আর চুমু খাবো। শুধু বলবো আমি ওকে ভালোবাসি, এটাই। আর তার চোখ আমার চোখে ডুবে যাওয়া দেখবো, এটা অসাধারণ, এটাই স্বস্তি।’
এই মুহূর্তে কেমন অনুভব করছেন, রয়টার্সের এমন প্রশ্নে সাবেক জিম্মি ওমের শেমটোভ বলেন, ‘এটি বর্ণনার ভাষা নেই।’
গাজায় তরুণদের একটি দল এ খবরে আনন্দ উদযাপন করছিল। এক বন্ধুর কাঁধে চড়া এক তরুণ স্লোগান দিচ্ছিল আর বাকিরা তাকে ঘিরে হাততালি দিচ্ছিল। লোকজন আনন্দে কাঁদছিল আর ‘আল্লাহু আকবর’ বলে স্লোগান দিচ্ছিল। ‘আল্লাহ মহান’ বলছিলো তারা। এই চুক্তি যুদ্ধ শেষ করবে আর তাদের বাড়িতে ফেরার সুযোগ করে দেবে বলে তারা আশা প্রকাশ করছিল।
গাজা সিটি থেকে বাস্তুচ্যুত ব্যবসায়ী তামের আল-বুরারি বলেন, ‘আমি হাসি আর কান্না থামাতে পারছি না। আমরা বেঁচে গেছি, এটা বিশ্বাস করতে পারছি না।’
রয়টার্সকে এক কথোপকথন অ্যাপের মাধ্যমে তিনি বলেন, ‘আমাদের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার অপেক্ষা আর করতে পারছি না, সেগুলো ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরও। গাজা সিটিতে ফিরতে চাই, বোমার আতঙ্ক ছাড়াই ঘুমাতে চাই, আমাদের জীবন পুননির্মাণ করতে চাই।’
হামাস শাসিত গাজা সরকারের গণমাধ্যম দপ্তর আনুষ্ঠানিভাবে চুক্তিটির বিস্তারিত খুঁটিনাটি প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত লোকজনকে নিজ নিজ এলাকায় না ফেরার জন্য আহ্বান জানিয়েছে। জনগণকে ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলো থেকে দূরে থাকতে বলেছে তারা।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীও গাজার উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দাদের নিজ নিজ এলাকায় ফিরে না আসার জন্য সতর্ক করেছে। সামাজিক মাধ্যম এক্স এ বাহিনীটি বলেছে, ‘এলাকাগুলো এখনও বিপজ্জনক যুদ্ধ অঞ্চল হয়ে আছে।’
জিম্মি ইসরায়েলিরা আগামীকাল মুক্তি পেতে পারেন
গাজায় যুদ্ধ বন্ধের জন্য মার্কিন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আগামীকালের মধ্যেই ইসরায়েলি জিম্মিরা মুক্তি পেতে পারেন। চুক্তিটির বিস্তারিত জানেন এমন একটি সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, চুক্তি স্বাক্ষরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ওই ভূখণ্ড থেকে আংশিক সেনা প্রত্যাহারের প্রথম পর্ব শেষ করবে।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু চুক্তি অনুমোদনের জন্য বৃহস্পতিবার, মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকার কথা জানিয়েছেন। নেতানিয়াহু এক বিবৃতিতে বলেন, ‘পরিকল্পনার প্রথম ধাপ অনুমোদনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সব জিম্মিকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। এটি একটি কূটনৈতিক সাফল্য এবং ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্য একটি জাতীয় ও নৈতিক বিজয়।’
হামাসের একটি সূত্র জানিয়েছে, ইসরায়েলি সরকার চুক্তি অনুমোদনের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে জীবিত জিম্মিদের হস্তান্তর করা হবে। হামাস কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলেছেন, গাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে মৃত জিম্মিদের মরদেহ উদ্ধার করতে আরও সময় লাগবে। তাদের সংখ্যা প্রায় ২৮ জন বলে মনে করা হচ্ছে।
এখনও হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল
যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে দুইপক্ষই (হামাস ও ইসরায়েল) সম্মত হয়েছে- যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের এ ঘোষণার পরও গাজায় হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েলি বাহিনী। ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলো গাজা নগরীর পশ্চিমাঞ্চলে হামলা করেছে বলে জানিয়েছেন আল-জাজিরার স্থানীয় সাংবাদিকরা। বিমান থেকে ফেলা গোলা আল-শাতি শরণার্থীশিবিরের অন্তত একটি বাড়িতে আঘাত হানে।
এছাড়া ইসরায়েলি সেনারা গাজা নগরীর দক্ষিণে সাবরা এলাকার কিছু বাড়িঘরের কাছে একটি গাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটান। তবে ইসরায়েলি হামলা ও বিস্ফোরণে তাৎক্ষণিকভাবে হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর টেলিফোন
শান্তি প্রতিষ্ঠায় চুক্তি সম্পাদনের পর ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে তার এ নিয়ে টেলিফোনে খুবই আবেগঘন ও উষ্ণ কথাবার্তা হয়েছে। ওই ফোনালাপে তারা সব জিম্মির মুক্তি নিশ্চিত করে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি অর্জনে সফল হতে পারার জন্য পরস্পরকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, তার সব প্রচেষ্টা ও বৈশ্বিক নেতৃত্বের জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রধানমন্ত্রীকে তার দৃঢ় নেতৃত্ব এবং তার গ্রহণ করা নানা পদক্ষেপের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন।
এছাড়া দুজনই ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা অব্যাহত রাখার বিষয়ে একমত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ইসরায়েলি পার্লামেন্টে ভাষণ দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বলেও ওই বিবৃতিতে বলা হয়।
ইসরায়েল-হামাসের চুক্তি, বিশ্বনেতাদের অভিনন্দন, সহায়তার আশ্বাস
গাজায় যুদ্ধ বন্ধে ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে চুক্তি সইয়ের পর বিশ্ব নেতারা অভিনন্দন এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় আশাবাদ জানিয়েছেন, কেউ কেউ সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। পাশাপাশি তারা উভয়পক্ষকে চুক্তির অঙ্গীকারগুলো যথাযথভাবে পূরণের আহ্বান জানিয়েছেন। বিশ্ব নেতারা দুই বছর ধরে চলা গাজা যুদ্ধ বন্ধে চুক্তি হওয়াকে বড় ধরনের সাফল্য হিসেবে দেখছেন।
ইসরাইল ও হামাস নেতারা বৃহস্পতিবার, জানিয়েছেন, তারা গাজায় যুদ্ধ বন্ধ ও জিম্মি মুক্তির লক্ষ্যে চুক্তিতে সই করেছেন। এরপরই সারাবিশ্বে শান্তিকামী মানুষ আনন্দ প্রকাশ এবং নেতারা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন।
এখানে কয়েকটি দেশের নেতাদের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হলো।
যুক্তরাজ্য: ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার চুক্তির খবরকে স্বাগত জানিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে গাজায় সহায়তা প্রবেশে সব ধরনের অবরোধ তুলে নেয়ার আহ্বান জানান।
স্টারমার বলেন, এটি এমন এক মুহূর্ত, যা সারা বিশ্বে গভীর স্বস্তি এনে দেবে; বিশেষ করে জিম্মিদের পরিবার ও গাজার বেসামরিক মানুষদের জন্য। তারা গত দুই বছর অকল্পনীয় দুর্ভোগ সহ্য করেছেন।
ফ্রান্স: ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ এ চুক্তিকে ‘জিম্মি ও তাদের পরিবার, গাজার প্যালেস্টাইনি ও গোটা অঞ্চলের জন্য এক বড় আশার বার্তা’ বলে উল্লেখ করেছেন। এক্সে দেয়া বার্তায় মাখোঁ ডনাল্ড ট্রাম্প এবং কাতার, মিসর ও তুরস্কের মধ্যস্থতাকারীদের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন এবং ইসরায়েল ও হামাস দুই পক্ষকে চুক্তির শর্ত কঠোরভাবে মেনে চলার আহ্বান জানান।
ইতালি: ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি এ চুক্তিকে ‘অসাধারণ খবর’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘এই চুক্তি এবং ট্রাম্পের পরিকল্পনার নির্দেশিত বৃহত্তর পথ এই সংঘাত শেষ করার এক বিরল সুযোগ। এটি আমাদের কাজে লাগাতে হবে।’ মেলোনি আরও বলেন, ‘আমি সব পক্ষকে আহ্বান জানাই, তারা যেন ইতোমধ্যে গৃহীত পদক্ষেপগুলো সম্পূর্ণভাবে সম্মান জানায় এবং শান্তি পরিকল্পনার পরবর্তী ধাপগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে।’
তুরস্ক: হামাস ও ইসরায়েল- দুই পক্ষের আলোচনায় ভূমিকা রাখা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে দেয়া এক পোস্টে তিনি ট্রাম্পকে ‘প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রদর্শন করার’ জন্য ধন্যবাদ জানান। একই সঙ্গে কাতার ও মিসরকেও মধ্যস্থতায় ভূমিকা রাখার জন্য কৃতজ্ঞতা জানান। এরদোয়ান বলেন, তুরস্ক চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করবে এবং এ প্রক্রিয়ায় অবদান অব্যাহত রাখবে। তিনি আরও বলেন, ‘দুই বছর ধরে বর্ণনাতীত কষ্ট সহ্য করা আমার প্যালেস্টাইনি ভাই-বোনদের প্রতি আমি আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।’
জাতিসংঘ: জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘জাতিসংঘ এ চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে সহায়তা করবে এবং মানবিক ত্রাণ কার্যক্রম জোরদার করবে। পাশাপাশি আমরা গাজার পুনর্গঠন ও পুনরুদ্ধার কার্যক্রমও এগিয়ে নেব।’ মহাসচিব আরও বলেন, এখন এই ঐতিহাসিক সুযোগ কাজে লাগিয়ে এমন একটি রাজনৈতিক পথ তৈরির সময় এসেছে; যা দখলদারির অবসান ঘটাবে, প্যালেস্টাইনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বীকৃতি দেবে এবং দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের পথে ইসরায়েলি ও প্যালেস্টাইনিদের নিরাপদে সহাবস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে।
কানাডা: কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, ‘জিম্মিদের শিগগিরই পরিবারের সঙ্গে পুনর্মিলন ঘটবে জেনে আমি স্বস্তি পেয়েছি।’ মার্ক কার্নি আরও বলেন, অনেক বছরের তীব্র কষ্টের পর অবশেষে মনে হচ্ছে, শান্তি এখন নাগালের মধ্যে। কানাডা সব পক্ষকে আহ্বান জানায়, তারা যেন দ্রুত চুক্তির সব শর্ত বাস্তবায়ন করে একটি ন্যায়সঙ্গত ও স্থায়ী শান্তির দিকে এগিয়ে যায়।
মালয়েশিয়া: মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম এক বিবৃতিতে বলেন, মাসের পর মাস অসহনীয় কষ্ট ও ধ্বংসের পর এ চুক্তি কিছুটা হলেও আশার আলো দেখাচ্ছে। আনোয়ার ইব্রাহিম সব পক্ষকে এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে স্থায়ী ও সর্বাত্মক শান্তির পথে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।
জাপান: জাপানের চিফ কেবিনেট সেক্রেটারি ইয়োশিমাসা হায়াশি সাংবাদিকদের বলেন, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে ‘প্রথম ধাপের চুক্তি’ হওয়ায় জাপান তাকে স্বাগত জানাচ্ছে। এটি পরিস্থিতি শান্ত করার ও দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের পথে অগ্রসর হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। টোকিও গাজার মানবিক পরিস্থিতির উন্নয়ন ও পুনর্গঠনে সহায়তা অব্যাহত রাখবে বলেও জানান হায়াশি।
অস্ট্রেলিয়া: অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ চুক্তিটিকে ‘আশার আলো’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আলবানিজ বলেন, এ ঘোষণা আট দশকের সংঘাত ও সন্ত্রাসের পর সহিংসতার চক্র ভেঙে একটি ভালো ভবিষ্যৎ গড়ার আশা এনে দিয়েছে। আজকের দিনটি বিশ্বের জন্য সত্যিকারের আশার দিন।
নিউজিল্যান্ড: নিউজিল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইনস্টন পিটার্স বলেন, গত দুই বছর ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিরা প্রচণ্ড কষ্ট ভোগ করেছেন। আজকের এ চুক্তি সেই কষ্ট অবসানের প্রথম ইতিবাচক পদক্ষেপ। হামাস ও ইসরায়েলকে চুক্তির সব শর্ত বাস্তবায়নের আহ্বান জানান তিনি।
ভারত: ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক্সে লেখেন, ‘জিম্মিদের মুক্তি ও গাজার মানুষের জন্য মানবিক সহায়তা বৃদ্ধি তাদের কষ্ট কিছুটা লাঘব করবে এবং স্থায়ী শান্তির পথে অগ্রসর হতে সাহায্য করবে, আমরা সেই আশাই করি।’
পাকিস্তান: পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এক্সে লেখেন, এ চুক্তি গাজার জনগণের দুর্ভোগের অবসান ঘটানো এবং ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই শান্তির পথে অগ্রসর হওয়ার এক ঐতিহাসিক সুযোগ।