মধ্য গাজার দেইর আল-বালাহ এলাকার আল-আকসা মার্টারস হাসপাতালের সামনে আনন্দে আত্মহারা ফিলিস্তিনের এক দল শিশু- এএফপি
দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে পৌঁছেছে ইসরায়েল ও হামাস। যুদ্ধবিরতির পাশাপাশি বন্দিবিনিময় ও আংশিক সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এই সমঝোতায়। চুক্তির ঘোষণা আসতেই গাজার রাস্তায় মানুষের উল্লাস, মিষ্টি বিতরণ এবং প্রার্থনার দৃশ্য দেখা গেছে। আনন্দ প্রকাশ করেছেন ইসরায়েলবাসীও, কারণ এতে করে হামাসের হাতে থাকা জিম্মিদের মুক্তির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
এই চুক্তি এসেছে মিসরের শারম আল শেখে অনুষ্ঠিত আলোচনার তৃতীয় দিনে, যেখানে মধ্যস্থতা করেছে যুক্তরাষ্ট্র, কাতার, মিসর ও তুরস্ক। আলোচনার ভিত্তি ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত ২০ দফা ‘শান্তি পরিকল্পনা’, যা গত ২৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশ করা হয়।
চুক্তির মূল শর্তসমূহ: গাজায় সব ধরনের সামরিক কার্যক্রম স্থগিত থাকবে। হামাস ধাপে ধাপে জিম্মিদের মুক্তি দেবে; ধারণা করা হচ্ছে, বর্তমানে ২০ জন জীবিত জিম্মি রয়েছে। এর বিনিময়ে ইসরায়েল প্রায় ১,৯৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেবে, যাদের মধ্যে ২৫০ জন মৃত্যুদ-প্রাপ্ত। গাজার নির্দিষ্ট কিছু এলাকা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার করা হবে।
যদিও চুক্তির সব শর্ত এখনো প্রকাশিত হয়নি, তবে হোয়াইট হাউসের প্রকাশিত একটি মানচিত্রে বলা হয়েছে, তিন ধাপে সেনা প্রত্যাহার হবে। শুরুতে গাজার প্রায় ৫৩ শতাংশ এলাকা ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকবে, যা বর্তমানে ৮০ শতাংশের বেশি। ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা চুক্তি অনুমোদন করলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেনা প্রত্যাহার শুরু হবে এবং ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বন্দিবিনিময়ের প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: চুক্তিটিকে স্বাগত জানিয়েছে অনেক দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা। কাতার, তুরস্ক, ফ্রান্স, রাশিয়া, ভারত, সৌদি আরব, ইউএই, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, মালয়েশিয়াসহ অনেক দেশ চুক্তির প্রশংসা করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস একে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের সম্ভাব্য পথ হিসেবে দেখছেন।
প্যারিসে ইউরোপ ও আরব দেশগুলোর প্রতিনিধি দল যুদ্ধ-পরবর্তী গাজা কীভাবে পরিচালিত হবে এবং ত্রাণ কার্যক্রম কেমন হবে, তা নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে। এতে উপস্থিত ছিলেন ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, মিসর, কাতার ও সৌদি আরবের প্রতিনিধিরা।
আশা-শঙ্কার মিশ্র প্রতিক্রিয়া: গাজার বাসিন্দারা যুদ্ধবিরতির খবরে স্বস্তি পেয়েছেন, তবে একই সঙ্গে আছে ভয় ও অবিশ্বাস। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা জানেন, যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরও ইসরায়েল হামলা চালাতে পারে। যেমন, চলতি চুক্তির দিনও গাজায় হামলা চালিয়ে অন্তত ১০ জনকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী।গাজার বাসিন্দা আবুল মাজেদ বলেন, “রক্তপাত বন্ধের জন্য এই চুক্তি আল্লাহর রহমত। উপত্যকার সবাই খুশি।” অন্যদিকে আবু হাসেম বলেন, “আমরা এই শান্তিকে বিশ্বাস করতে চাই, কিন্তু ইসরায়েলের ওপর আস্থা রাখা কঠিন।”
বাস্তবায়নে নজরদারির দাবি: বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও এটি কতটা স্থায়ী হবে, তা নির্ভর করছে ইসরায়েলের আচরণ ও চুক্তির শর্ত মেনে চলার ওপর। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, যুদ্ধবিরতির পর যেন ইসরায়েল আবার হামলা, অবরোধ কিংবা সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ কড়াকড়ি না করে, তা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নজরদারির আওতায় আনতে হবে। গাজায় এই যুদ্ধবিরতি একটি বড় পদক্ষেপ হলেও সামনে আরও অনেক প্রশ্নের জবাব বাকি। হামাসের অস্ত্র সমর্পণ, অন্তর্বর্তী সরকার গঠন এবং চূড়ান্ত শান্তিচুক্তি কবে হবে এসব নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। তবুও, এই চুক্তি দীর্ঘদিনের সহিংসতা থেকে মুক্তির সম্ভাব্য শুরু বলেই আশাবাদী ফিলিস্তিনি জনগণ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
ট্রাম্পের পরিকল্পনার প্রথম ধাপ অনুযায়ী যুদ্ধবিরতি চুক্তি হলেও বেশ কিছু প্রশ্নের জবাব এখনো পাওয়া যায়নি। হামাস যে অন্তর্বর্তী সরকার এবং অস্ত্রসমর্পণ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে, তার এখনো কোনো সুরাহা হতে দেখা যায়নি। ফলে প্রথম ধাপের পর যুদ্ধবিরতি কীভাবে এগিয়ে নেওয়া হবে, সে বিষয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। আর ইসরায়েল আগের মতো যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করবে—এমন শঙ্কা তো আছেই।
যেমন নেতানিয়াহু এই চুক্তিকে ইসরায়েলের বিজয় হিসেবে উল্লেখ করলেও তাঁর অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোতরিচ বলেছেন, জিম্মিরা ইসরায়েলে ফেরার পর হামাসকে নির্মূল করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভায় এমন ধ্যানধারণার সদস্য আরও আছেন।
এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্তগুলো ইসরায়েল মেনে চলছে কি না, তা নজরদারিতে রাখতে হবে বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অধিকার সংগঠন ডনের ফিলিস্তিন-ইসরায়েলবিষয়ক পরিচালক মাইকেল শেফের ওমের-মান। তিনি বলেন, যুদ্ধবিরতির পর ইসরায়েল যেন আবার গাজায় হামলা শুরু না করে, অবরোধ আরোপ না করে, সীমান্ত দিয়ে ত্রাণের পাশাপাশি বাণিজ্যিক পণ্য ও মানুষের চলাচলে বাধা সৃষ্টি না করে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
মধ্য গাজার দেইর আল-বালাহ এলাকার আল-আকসা মার্টারস হাসপাতালের সামনে আনন্দে আত্মহারা ফিলিস্তিনের এক দল শিশু- এএফপি
শুক্রবার, ১০ অক্টোবর ২০২৫
দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে পৌঁছেছে ইসরায়েল ও হামাস। যুদ্ধবিরতির পাশাপাশি বন্দিবিনিময় ও আংশিক সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এই সমঝোতায়। চুক্তির ঘোষণা আসতেই গাজার রাস্তায় মানুষের উল্লাস, মিষ্টি বিতরণ এবং প্রার্থনার দৃশ্য দেখা গেছে। আনন্দ প্রকাশ করেছেন ইসরায়েলবাসীও, কারণ এতে করে হামাসের হাতে থাকা জিম্মিদের মুক্তির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
এই চুক্তি এসেছে মিসরের শারম আল শেখে অনুষ্ঠিত আলোচনার তৃতীয় দিনে, যেখানে মধ্যস্থতা করেছে যুক্তরাষ্ট্র, কাতার, মিসর ও তুরস্ক। আলোচনার ভিত্তি ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত ২০ দফা ‘শান্তি পরিকল্পনা’, যা গত ২৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশ করা হয়।
চুক্তির মূল শর্তসমূহ: গাজায় সব ধরনের সামরিক কার্যক্রম স্থগিত থাকবে। হামাস ধাপে ধাপে জিম্মিদের মুক্তি দেবে; ধারণা করা হচ্ছে, বর্তমানে ২০ জন জীবিত জিম্মি রয়েছে। এর বিনিময়ে ইসরায়েল প্রায় ১,৯৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেবে, যাদের মধ্যে ২৫০ জন মৃত্যুদ-প্রাপ্ত। গাজার নির্দিষ্ট কিছু এলাকা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার করা হবে।
যদিও চুক্তির সব শর্ত এখনো প্রকাশিত হয়নি, তবে হোয়াইট হাউসের প্রকাশিত একটি মানচিত্রে বলা হয়েছে, তিন ধাপে সেনা প্রত্যাহার হবে। শুরুতে গাজার প্রায় ৫৩ শতাংশ এলাকা ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকবে, যা বর্তমানে ৮০ শতাংশের বেশি। ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা চুক্তি অনুমোদন করলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেনা প্রত্যাহার শুরু হবে এবং ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বন্দিবিনিময়ের প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: চুক্তিটিকে স্বাগত জানিয়েছে অনেক দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা। কাতার, তুরস্ক, ফ্রান্স, রাশিয়া, ভারত, সৌদি আরব, ইউএই, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, মালয়েশিয়াসহ অনেক দেশ চুক্তির প্রশংসা করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস একে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের সম্ভাব্য পথ হিসেবে দেখছেন।
প্যারিসে ইউরোপ ও আরব দেশগুলোর প্রতিনিধি দল যুদ্ধ-পরবর্তী গাজা কীভাবে পরিচালিত হবে এবং ত্রাণ কার্যক্রম কেমন হবে, তা নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে। এতে উপস্থিত ছিলেন ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, মিসর, কাতার ও সৌদি আরবের প্রতিনিধিরা।
আশা-শঙ্কার মিশ্র প্রতিক্রিয়া: গাজার বাসিন্দারা যুদ্ধবিরতির খবরে স্বস্তি পেয়েছেন, তবে একই সঙ্গে আছে ভয় ও অবিশ্বাস। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা জানেন, যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরও ইসরায়েল হামলা চালাতে পারে। যেমন, চলতি চুক্তির দিনও গাজায় হামলা চালিয়ে অন্তত ১০ জনকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী।গাজার বাসিন্দা আবুল মাজেদ বলেন, “রক্তপাত বন্ধের জন্য এই চুক্তি আল্লাহর রহমত। উপত্যকার সবাই খুশি।” অন্যদিকে আবু হাসেম বলেন, “আমরা এই শান্তিকে বিশ্বাস করতে চাই, কিন্তু ইসরায়েলের ওপর আস্থা রাখা কঠিন।”
বাস্তবায়নে নজরদারির দাবি: বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও এটি কতটা স্থায়ী হবে, তা নির্ভর করছে ইসরায়েলের আচরণ ও চুক্তির শর্ত মেনে চলার ওপর। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, যুদ্ধবিরতির পর যেন ইসরায়েল আবার হামলা, অবরোধ কিংবা সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ কড়াকড়ি না করে, তা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নজরদারির আওতায় আনতে হবে। গাজায় এই যুদ্ধবিরতি একটি বড় পদক্ষেপ হলেও সামনে আরও অনেক প্রশ্নের জবাব বাকি। হামাসের অস্ত্র সমর্পণ, অন্তর্বর্তী সরকার গঠন এবং চূড়ান্ত শান্তিচুক্তি কবে হবে এসব নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। তবুও, এই চুক্তি দীর্ঘদিনের সহিংসতা থেকে মুক্তির সম্ভাব্য শুরু বলেই আশাবাদী ফিলিস্তিনি জনগণ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
ট্রাম্পের পরিকল্পনার প্রথম ধাপ অনুযায়ী যুদ্ধবিরতি চুক্তি হলেও বেশ কিছু প্রশ্নের জবাব এখনো পাওয়া যায়নি। হামাস যে অন্তর্বর্তী সরকার এবং অস্ত্রসমর্পণ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে, তার এখনো কোনো সুরাহা হতে দেখা যায়নি। ফলে প্রথম ধাপের পর যুদ্ধবিরতি কীভাবে এগিয়ে নেওয়া হবে, সে বিষয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। আর ইসরায়েল আগের মতো যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করবে—এমন শঙ্কা তো আছেই।
যেমন নেতানিয়াহু এই চুক্তিকে ইসরায়েলের বিজয় হিসেবে উল্লেখ করলেও তাঁর অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোতরিচ বলেছেন, জিম্মিরা ইসরায়েলে ফেরার পর হামাসকে নির্মূল করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভায় এমন ধ্যানধারণার সদস্য আরও আছেন।
এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্তগুলো ইসরায়েল মেনে চলছে কি না, তা নজরদারিতে রাখতে হবে বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অধিকার সংগঠন ডনের ফিলিস্তিন-ইসরায়েলবিষয়ক পরিচালক মাইকেল শেফের ওমের-মান। তিনি বলেন, যুদ্ধবিরতির পর ইসরায়েল যেন আবার গাজায় হামলা শুরু না করে, অবরোধ আরোপ না করে, সীমান্ত দিয়ে ত্রাণের পাশাপাশি বাণিজ্যিক পণ্য ও মানুষের চলাচলে বাধা সৃষ্টি না করে, তা নিশ্চিত করতে হবে।