যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর শুক্রবার থেকে গাজায় ইসরায়েলি সৈন্য প্রত্যাহার শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ভিটেমাটিতে ফিরতে শুরু করেছে গাজাবাসী
ইসরায়েল ও হামাসের সই করা চুক্তি অনুযায়ী গাজায় যুদ্ধবিরতি কর্যকর হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রথম ধাপে ইসরায়েলি সেনা সদস্যদের গাজা থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। গাজার কিছু বাসিন্দাও ইতোমধ্যে বিধ্বস্ত এলাকায় ফিরে এসেছেন। তবে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি চুক্তি এখনও অনিশ্চিত। ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে ভবিষ্যৎ আলোচনায় প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠন এবং প্যালেস্টাইন কর্তৃপক্ষের ভূমিকা বড় ইস্যু হিসেবে রয়ে গেছে।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, সমঝোতা অনুযায়ী গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা ছাড়াই মানবিক সহায়তা প্রবেশ করতে পারবে। শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা (বাংলাদেশ সময় বিকেল ৩টা) থেকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এক বিবৃতিতে আইডিএফ বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সেনারা ‘সমঝোতা অনুযায়ী নির্ধারিত নতুন অবস্থানে মোতায়েন সম্পন্ন করেছে।’
ইসরায়েলি বাহিনী প্রথম ধাপের সেনা প্রত্যাহার সম্পন্ন করেছে, যা আলোচনায় নির্ধারিত সীমান্তরেখা পর্যন্ত সীমিত থাকবে। সমঝোতা অনুযায়ী, সেনা প্রত্যাহারের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে অবশিষ্ট সব ইসরায়েলি জিম্মি ও প্রায় ১৭০০ প্যালেস্টাইনি বন্দিকে মুক্তি দেয়া হবে। হামাসের জন্য এই সময়সীমা আগামী সোমবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত। তবে ঠিক কখন এবং কোথায় বন্দিমুক্তি কার্যক্রম হবে, তা এখনও জানা যায়নি।
মাত্র ১২ ঘণ্টা আগে ইসরায়েল নিশ্চিত করে যে তারা যুদ্ধবিরতি ও বন্দিমুক্তি চুক্তি মেনে নিয়েছে, যা গাজা যুদ্ধের সম্ভাব্য সমাপ্তির ইঙ্গিত দেয়। এরপরই সেনারা গাজা উপত্যকার ভেতরে সমঝোতাকৃত অবস্থানে ফিরে যায় এবং কিচুক্ষণ আগে আইডিএফ আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার ঘোষণা দেয়।
মধ্যরাতের পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি।’ ইসরায়েল সরকার শুক্রবার সকালে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তির চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। এতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গাজায় সহিংসতা থামানো সম্ভব হবে, এরপর ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আটক ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি দেয়া হবে।
যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, তারা অপারেশন সমন্বয়ে সহায়তার জন্য ২০০ সেনা পাঠিয়েছে, তবে তারা গাজায় প্রবেশ করবে না। এদিকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা ইতোমধ্যে সহায়তা কার্যক্রমের প্রস্তুতি নিয়েছে।
গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মিদের মুক্তি দেয়ার বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের পরিকল্পনায় অনুমোদন দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তার কার্যালয় থেকে প্রকাশিত বিবৃতিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে। যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত এই পরিকল্পনাকে একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি’ বলে অভিহিত করে তিনি ডনাল্ড ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
পাশাপাশি মার্কিন প্রেসিডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফ এবং মি. ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনারকেও ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এরা দু’জনেই প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে ইসরায়েলি মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানিয়েছেন তিনি আশা করছেন যে, আগামী সোম অথবা মঙ্গলবার বাকি জিম্মিদের মুক্তি দেয়া হবে।
এদিকে গাজায় যুদ্ধবিরতির বিষয়ে নজর রাখতে বহুজাতিক সেনা মোতায়েন করা হবে বলে মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তবে তারা গাজায় প্রবেশ করবে না। যুদ্ধবিরতি এবং অন্য লঙ্ঘন হচ্ছে কি না সেই বিষয়ে নজর রাখবে।
তবে প্যালেস্টাইনের অধিবাসীরা বিবিসিকে জানিয়েছেন, যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরও গাজার অনেক জায়গায় বিমান হামলা অব্যাহত রয়েছে।
গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মিদের মুক্তির পরিকল্পনায় হামাস ও ইসরায়েলের সম্মতির বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ঘোষণার পর প্রায় ২৪ ঘণ্টা কেটে গেছে। বিষয়টিকে বড় ধরনের কূটনৈতিক অগ্রগতি বলেই মনে করা হচ্ছে। এই তথ্য প্রকাশ্যে আসার পর যুদ্ধবিদ্ধস্ত গাজায় আনন্দের মুহূর্ত চোখে পড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আনন্দের বার্তা এসেছে।
ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা বৈঠকের পর নিশ্চিত করে যে, তারা রাত ৯টা ৩০ মিনিটের (বিএসটি) ঠিক আগে জিম্মি মুক্তির পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, গাজায় যুদ্ধবিরতি হবে এবং সেখান থেকে ইসরায়েলি সেনাদের ধাপে ধাপে একটি নির্দিষ্ট এলাকা পর্যন্ত প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। গাজায় সহায়তা ও ত্রাণ সামগ্রীবাহী ট্রাক ঢুকতে দেয়া হবে। হামাসের হাতে থাকা জিম্মি ও ইসরায়েলের হেফাজতে থাকা প্যালেস্টাইনি বন্দীদের মুক্তি দেয়া হবে। দু’পক্ষই মৃতদেহ ফিরিয়ে দেবে। গাজায় রয়েছেন এমন ৪৮ জন জিম্মিকে মুক্তি দেয়া হবে, যাদের মধ্যে ২০ জন এখনও জীবিত রয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। এই পরিকল্পনার হাত ধরেই ইসরায়েল ১৭০০ ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি দেবে। এই খবর প্রকাশ্যে আসার পরই বিশ্বজুড়ে স্বস্তির ছাপ দেখা যায়।
বিবিসির প্রধান আন্তর্জাতিক সংবাদদাতা লাইস ডুসেট জানিয়েছেন, গাজার ধ্বংসস্তূপে ভরা রাস্তা এবং ইসরায়েলের হোস্টেজেস স্কোয়ারে উল্লাসের মুহূর্তও দেখা যায়। তবে ডনাল্ড ট্রাম্পের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে এখনও অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে।
হামাসের নির্বাসিত গাজা প্রধান খলিল আল-হাইয়া বলেছেন যে, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যস্থতাকারীদের কাছ থেকে এই বিষয়ে নিশ্চয়তা পেয়েছেন যে যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছে।
এর আগে ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদিয়ন সার ফক্স নিউজকে বলেছেন যে, ইসরায়েলি সরকার চুক্তি অনুমোদনের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর অবিলম্বেই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে।
কিন্তু প্যালেস্টাইনি তথ্য কেন্দ্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এরপরেও গাজায় সামরিক তৎপরতা দেখা গেছে। পশ্চিম গাজার আল-নাসর এলাকায় ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়, বোমা নিক্ষেপ করা হয়। গাজা সিটিতে বিমান হামলাও হয়েছে বলে জানানো হয়েছিল।
শুক্রবার সকালেও হামলার একাধিক খবর পেয়েছে বিবিসি। প্রত্যক্ষদর্শীরা বিবিসিকে জানিয়েছেন, শুক্রবার সকালে খান ইউনিসে বিমান হামলা হয়েছে। উত্তরে নেটজারিম করিডোরের আশপাশেও হামলার খবর মিলেছে। প্যালেস্টাইনি সংবাদ সংস্থা ওয়াফার সংবাদদাতারা শুক্রবার ভোরে খান ইউনিসে বোমা হামলার খবর জানিয়েছেন।
গাজা শহরে আরও হামলার খবর পাওয়া গিয়েছে যেখানে প্রত্যক্ষদর্শীরা সিএনএনকে আল-সাব্রা এবং তাল আল-হাওয়া এলাকায় গোলাবর্ষণের কথা জানিয়েছেন। রয়টার্সের ফুটেজে স্থানীয় সময় আনুমানিক ভোর ৫টা ৫৫ মিনিটের দিকে আলোর ঝলক এবং একটি বিস্ফোরণের দৃশ্য ধরা পড়েছে। এই বিষয়ে মন্তব্যের জন্য বিবিসি ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখছে বলে জানানো হয়েছে।
এদিকে, বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন গাজায় যুদ্ধবিরতি ও জিম্মিদের মুক্তি সংক্রান্ত চুক্তির পরবর্তী পর্যায়ে আলোচনার সময় একাধিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। এর কারণগুলো হলো- একমাত্র প্যালেস্টাইনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেই নিরস্ত্রীকরণের বিষয়ে সম্মত হবে, নচেৎ নয়। যুদ্ধবিরতি নিয়ে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় সামাস নিরস্ত্রীকরণের বিষয়ে কোনো উল্লেখ করেনি, যা এই জল্পনাকে আরও উসকে দিয়েছে যে তাদের অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি।
বরং হামাসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তারা, ঐক্যবদ্ধ প্যালেস্টাইনি আন্দোলনের অংশ হিসেবে ভবিষ্যতে গাজায় ইতিবাচক ভূমিকা পালন করার বিষয়ে আশাবাদী।
প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু গাজায় যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত পূর্ণ পরিকল্পনায় সম্মতি জানালেও যুদ্ধ-পরবর্তী গাজায় প্যালেস্টাইনি কর্তৃপক্ষের সম্পৃক্ততার বিরুদ্ধে। এই বিষয়টি তিনি আবার স্পষ্ট করে দেন। গত সপ্তাহে তাকে জোর দিয়ে বলতে শোনা যায় যে, প্যালেস্টাইনি কর্তৃপক্ষ এই অঞ্চল পরিচালনায় কোনো ভূমিকা পালন করবে না।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ধাপে ধাপে গাজা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করার কথা। এই বিষয়ে ইসরায়েল জানিয়েছে প্রথম ধাপে সেনা প্রত্যাহারের পর গাজার প্রায় ৫৩ শতাংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। যদিও হোয়াইট হাউজের পরিকল্পনায় ধাপে ধাপে আরও ৪০ শতাংশ, তারপর আরও ১৫ শতাংশ এলাকার সেনাদের সরিয়ে নেয়ার ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল। এরপর চূড়ান্ত পর্যায়ে একটি “নিরাপত্তা পরিধির” মধ্যে থাকবে যা “যতক্ষণ না গাজা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা সন্ত্রাসের ঝুঁকি থেকে সঠিকভাবে সুরক্ষিত না হচ্ছে” ততক্ষণ পর্যন্ত থাকবে।
এখানে বেশ কিছু অস্পষ্ট রয়েছে। যেমন ইসরায়েলি সেনাদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের জন্য কোনো স্পষ্ট সময়সীমা উল্লেখ করা হয়নি। হামাস এ বিষয়ে স্পষ্টতা চাইতে পারে।
যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণকারী বহুজাতিক বাহিনী সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য জানিয়েছেন বিবিসির মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সংবাদদাতা টম বেটম্যান। তিনি জানিয়েছেন, মার্কিন সামরিক বাহিনী ইসরায়েলে একটি বেসামরিক-সামরিক সমন্বয় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করবে, যার মধ্যে প্রায় ২০০ ট্রুপ সেনা থাকবে। এতে মিশর, কাতার এবং তুরস্ক সহ আরব ও মুসলিম দেশগুলোর বাহিনী অন্তর্ভুক্ত থাকবে যারা যুদ্ধবিরতি পালন এবং যে কোনো ধরনের লঙ্ঘনের খবর দেবে।
এদিকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরপরই গাজায় আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে লোকজন। গাজার বাসিন্দা ২২ বছর বয়সী লায়লা এজ্জাত আল শানা জানিয়েছেন, যুদ্ধ বিরতির খবরে তিনি আনন্দিত। কিন্তু একইসঙ্গে তিনি শোকেও আচ্ছন্ন। গাজার এই মা বলেছেন, ‘আজ দিনটি খুব সুন্দর ছিল, কারণ তারা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছে। লোকে চিৎকার করছিলো, গান গাইছিলো। কিছু মানুষ আনন্দের জন্য আকাশে বন্দুক ছুঁড়ছিল, কয়েকজন নারী কাঁদছিল।’ এই উদযাপনের কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, দুই বছর পরও আমরা বেঁচে আছি! আমরা এই গণহত্যা থেকে বেঁচে গেছি।
গাজার বাস্তুহারা পরিবারগুলোও পশ্চিমের আবাসিক এলাকা থেকে গাজার মূল অংশে ফিরতে শুরু করেছেন, যেখান থেকে তাদের জোর করে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল। আল জাজিরা লিখেছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কিছু ব্রিগেড ও ডিভিশনকে গাজার কেন্দ্রীয় অংশ থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। গাজার কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নুসেইরাত আশ্রয় শিবির থেকে প্যালেস্টাইনি পরিবারগুলো উত্তর দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছে। তবে তারা এখনও নেতজারিম করিডোরে প্রবেশ করতে পারেনি, যেখানে আগে ইসরায়েলি সেনারা অবরোধ করে রেখেছিল। পরিবারগুলো অপেক্ষায় আছে, ওই অঞ্চল থেকে ইসরায়েলের শেষ ট্যাংকটি চলে যাওয়ার পর তারা সেখানে প্রবেশ করতে চায়।
জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক প্রধান টম ফ্লেচার বর্তমানে রিয়াদে রয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা যেন সমগ্র অঞ্চলে জীবন রক্ষাকারী কাজের এবং লাখো মানুষের জীবন বাঁচানোর ভিত্তি হয়ে ওঠে। তার কথায়, “এই মুহূর্তকে আমাদের সম্মিলিত ইচ্ছাশক্তি, দৃঢ় সংকল্প এবং উদারতার সঙ্গে কাজে লাগাতে হবে।”
মি. ফ্লেচার জানিয়েছেন, গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর জন্য তাদের ২০ শতাংশেরও কম ত্রাণ সরবরাহের অনুমতি আছে।
তার মতে যুদ্ধবিরতির পরিকল্পনা ফলপ্রসূ তখনই হবে যখন অবরোধ তুলে নেয়া এবং ত্রাণ পৌঁছে দেয়ার জন্য নিরাপদ রুটসহ উপত্যকায় প্রবেশের সব পথ খুলে দেয়া হবে। তিনি জানিয়েছেন সীমান্তে এক লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন খাদ্য, ওষুধ এবং অন্য সরবরাহ মজুত রাখা হয়েছে। গাজায় ২১ লাখ মানুষের মুখে খাবার তুলে দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
হামাসের নির্বাসিত গাজাপ্রধান খলিল আল-হায়া বলেছেন, যুদ্ধ যে শেষ হয়েছে সে ব্যাপারে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য মধ্যস্থতাকারীদের কাছ থেকে নিশ্চয়তা পেয়েছেন।
গাজা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, দুই বছরের ইসরায়েলি হামলায় ৬৭ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়েছে ওই অঞ্চল, দেখা দিয়েছে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ।
জিম্মি-বন্দী বিনিময় কার্যকর হওয়ার মধ্যেই খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা বহন করা অসংখ্য ট্রাকের গাজায় প্রবেশ করার কথা রয়েছে। এই সহায়তার জন্য অপেক্ষায় রয়েছে গাজার লাখ লাখ মানুষ, ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়ে যাদের বেশিরভাগই এখন বিভিন্ন তাঁবুতে আশ্রয় নিয়ে আছেন।
এদিকে ইসরায়েলি মন্ত্রিসভা হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তি চুক্তি অনুমোদন করার পরও গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার খবর পাওয়া গেছে। গাজা সিটির পূর্ব দিকে একটি স্থাপনা লক্ষ্য করে শুক্রবার ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টার হামলা চালায় বলে আল জাজিরা জানিয়েছে। সেখানে কামানের গোলা ছোড়া হয়েছে বলেও খবর পাওয়া গেছে। এর কিছুক্ষণ আগে গাজার দক্ষিণের খান ইউনিস এলাকায় বিমান হামলারও খবর মিলেছে, জানিয়েছে তারা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনার প্রথম পর্যায় বাস্তবায়নে ইসরায়েলি সরকার অনুমোদনের দেয়ার পর প্রথম খান ইউনিসে ওই হামলা হয়।
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এ যুদ্ধ ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিকভাবে আরও বিচ্ছিন্ন করেছে, মধ্যপ্রাচ্যকে ওলট-পালট করেছে। এমন এক আঞ্চলিক সংঘাত উসকে দিয়েছে যাতে ইরান, ইয়েমেন, লেবাননও জড়িয়ে পড়েছে। এই যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সম্পর্কেরও পরীক্ষা নিয়েছে। ট্রাম্পকে নেতানিয়াহুর ওপর ধৈর্যও হারাতে এবং চুক্তিতে পৌঁছাতে চাপ দিতেও দেখা গেছে।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর ট্রাম্প তার ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনা প্রস্তাব উন্মোচন করতে নেতানিয়াহুকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানান। এ সময় তিনি প্রকাশ্যে নেতানিয়াহুকে পুরোপুরি সমর্থন দিচ্ছেন বলে দেখানোর চেষ্টা করেন। ট্রাম্প বলেন, হামাস যদি পরিকল্পনা মেনে না নেয় তবে ইসরায়েলকে তাদের কার্যসিদ্ধি করতে ও হামাসকে ধ্বংস করে দিতে পূর্ণ সমর্থন দেবেন। কিন্তু গোপনে ট্রাম্প আসলে নেতানিয়াহুকে চাপ দিয়ে আসছিলেন।
এ সময় ট্রাম্প নজিরবিহীন একটি কাজ করে বসেন। ওয়াশিংটন যাকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছিল, সেই হামাসের বিবৃতিটি তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন। তিনি ইসরায়েল, হামাস ও মধ্যস্থতাকারীদের দ্রুত চুক্তির বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে চাপ দেন।
ট্রাম্প মার্কিন সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওসকে বলেন, তিনি নেতানিয়াহুকে বলেছেন, ‘বিবি (বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সংক্ষেপ) এটা তোমার জয়ের সুযোগ। তিনি এটা মেনে নিয়েছিলেন। তাকে এটা মেনে নিতেই হতো। তার হাতে কোনো উপায় ছিল না। আমার সঙ্গে থাকতে হলে মেনে নিতেই হবে।’
যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর শুক্রবার থেকে গাজায় ইসরায়েলি সৈন্য প্রত্যাহার শুরু হয়েছে। সেই সঙ্গে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ভিটেমাটিতে ফিরতে শুরু করেছে গাজাবাসী
শুক্রবার, ১০ অক্টোবর ২০২৫
ইসরায়েল ও হামাসের সই করা চুক্তি অনুযায়ী গাজায় যুদ্ধবিরতি কর্যকর হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রথম ধাপে ইসরায়েলি সেনা সদস্যদের গাজা থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। গাজার কিছু বাসিন্দাও ইতোমধ্যে বিধ্বস্ত এলাকায় ফিরে এসেছেন। তবে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি চুক্তি এখনও অনিশ্চিত। ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে ভবিষ্যৎ আলোচনায় প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠন এবং প্যালেস্টাইন কর্তৃপক্ষের ভূমিকা বড় ইস্যু হিসেবে রয়ে গেছে।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, সমঝোতা অনুযায়ী গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা ছাড়াই মানবিক সহায়তা প্রবেশ করতে পারবে। শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা (বাংলাদেশ সময় বিকেল ৩টা) থেকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এক বিবৃতিতে আইডিএফ বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সেনারা ‘সমঝোতা অনুযায়ী নির্ধারিত নতুন অবস্থানে মোতায়েন সম্পন্ন করেছে।’
ইসরায়েলি বাহিনী প্রথম ধাপের সেনা প্রত্যাহার সম্পন্ন করেছে, যা আলোচনায় নির্ধারিত সীমান্তরেখা পর্যন্ত সীমিত থাকবে। সমঝোতা অনুযায়ী, সেনা প্রত্যাহারের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে অবশিষ্ট সব ইসরায়েলি জিম্মি ও প্রায় ১৭০০ প্যালেস্টাইনি বন্দিকে মুক্তি দেয়া হবে। হামাসের জন্য এই সময়সীমা আগামী সোমবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত। তবে ঠিক কখন এবং কোথায় বন্দিমুক্তি কার্যক্রম হবে, তা এখনও জানা যায়নি।
মাত্র ১২ ঘণ্টা আগে ইসরায়েল নিশ্চিত করে যে তারা যুদ্ধবিরতি ও বন্দিমুক্তি চুক্তি মেনে নিয়েছে, যা গাজা যুদ্ধের সম্ভাব্য সমাপ্তির ইঙ্গিত দেয়। এরপরই সেনারা গাজা উপত্যকার ভেতরে সমঝোতাকৃত অবস্থানে ফিরে যায় এবং কিচুক্ষণ আগে আইডিএফ আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার ঘোষণা দেয়।
মধ্যরাতের পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি।’ ইসরায়েল সরকার শুক্রবার সকালে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তির চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। এতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গাজায় সহিংসতা থামানো সম্ভব হবে, এরপর ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আটক ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি দেয়া হবে।
যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, তারা অপারেশন সমন্বয়ে সহায়তার জন্য ২০০ সেনা পাঠিয়েছে, তবে তারা গাজায় প্রবেশ করবে না। এদিকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা ইতোমধ্যে সহায়তা কার্যক্রমের প্রস্তুতি নিয়েছে।
গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মিদের মুক্তি দেয়ার বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের পরিকল্পনায় অনুমোদন দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তার কার্যালয় থেকে প্রকাশিত বিবৃতিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে। যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত এই পরিকল্পনাকে একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি’ বলে অভিহিত করে তিনি ডনাল্ড ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
পাশাপাশি মার্কিন প্রেসিডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফ এবং মি. ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনারকেও ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এরা দু’জনেই প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে ইসরায়েলি মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানিয়েছেন তিনি আশা করছেন যে, আগামী সোম অথবা মঙ্গলবার বাকি জিম্মিদের মুক্তি দেয়া হবে।
এদিকে গাজায় যুদ্ধবিরতির বিষয়ে নজর রাখতে বহুজাতিক সেনা মোতায়েন করা হবে বলে মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তবে তারা গাজায় প্রবেশ করবে না। যুদ্ধবিরতি এবং অন্য লঙ্ঘন হচ্ছে কি না সেই বিষয়ে নজর রাখবে।
তবে প্যালেস্টাইনের অধিবাসীরা বিবিসিকে জানিয়েছেন, যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরও গাজার অনেক জায়গায় বিমান হামলা অব্যাহত রয়েছে।
গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মিদের মুক্তির পরিকল্পনায় হামাস ও ইসরায়েলের সম্মতির বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ঘোষণার পর প্রায় ২৪ ঘণ্টা কেটে গেছে। বিষয়টিকে বড় ধরনের কূটনৈতিক অগ্রগতি বলেই মনে করা হচ্ছে। এই তথ্য প্রকাশ্যে আসার পর যুদ্ধবিদ্ধস্ত গাজায় আনন্দের মুহূর্ত চোখে পড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আনন্দের বার্তা এসেছে।
ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা বৈঠকের পর নিশ্চিত করে যে, তারা রাত ৯টা ৩০ মিনিটের (বিএসটি) ঠিক আগে জিম্মি মুক্তির পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, গাজায় যুদ্ধবিরতি হবে এবং সেখান থেকে ইসরায়েলি সেনাদের ধাপে ধাপে একটি নির্দিষ্ট এলাকা পর্যন্ত প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। গাজায় সহায়তা ও ত্রাণ সামগ্রীবাহী ট্রাক ঢুকতে দেয়া হবে। হামাসের হাতে থাকা জিম্মি ও ইসরায়েলের হেফাজতে থাকা প্যালেস্টাইনি বন্দীদের মুক্তি দেয়া হবে। দু’পক্ষই মৃতদেহ ফিরিয়ে দেবে। গাজায় রয়েছেন এমন ৪৮ জন জিম্মিকে মুক্তি দেয়া হবে, যাদের মধ্যে ২০ জন এখনও জীবিত রয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। এই পরিকল্পনার হাত ধরেই ইসরায়েল ১৭০০ ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি দেবে। এই খবর প্রকাশ্যে আসার পরই বিশ্বজুড়ে স্বস্তির ছাপ দেখা যায়।
বিবিসির প্রধান আন্তর্জাতিক সংবাদদাতা লাইস ডুসেট জানিয়েছেন, গাজার ধ্বংসস্তূপে ভরা রাস্তা এবং ইসরায়েলের হোস্টেজেস স্কোয়ারে উল্লাসের মুহূর্তও দেখা যায়। তবে ডনাল্ড ট্রাম্পের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে এখনও অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে।
হামাসের নির্বাসিত গাজা প্রধান খলিল আল-হাইয়া বলেছেন যে, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যস্থতাকারীদের কাছ থেকে এই বিষয়ে নিশ্চয়তা পেয়েছেন যে যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছে।
এর আগে ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদিয়ন সার ফক্স নিউজকে বলেছেন যে, ইসরায়েলি সরকার চুক্তি অনুমোদনের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর অবিলম্বেই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে।
কিন্তু প্যালেস্টাইনি তথ্য কেন্দ্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এরপরেও গাজায় সামরিক তৎপরতা দেখা গেছে। পশ্চিম গাজার আল-নাসর এলাকায় ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়, বোমা নিক্ষেপ করা হয়। গাজা সিটিতে বিমান হামলাও হয়েছে বলে জানানো হয়েছিল।
শুক্রবার সকালেও হামলার একাধিক খবর পেয়েছে বিবিসি। প্রত্যক্ষদর্শীরা বিবিসিকে জানিয়েছেন, শুক্রবার সকালে খান ইউনিসে বিমান হামলা হয়েছে। উত্তরে নেটজারিম করিডোরের আশপাশেও হামলার খবর মিলেছে। প্যালেস্টাইনি সংবাদ সংস্থা ওয়াফার সংবাদদাতারা শুক্রবার ভোরে খান ইউনিসে বোমা হামলার খবর জানিয়েছেন।
গাজা শহরে আরও হামলার খবর পাওয়া গিয়েছে যেখানে প্রত্যক্ষদর্শীরা সিএনএনকে আল-সাব্রা এবং তাল আল-হাওয়া এলাকায় গোলাবর্ষণের কথা জানিয়েছেন। রয়টার্সের ফুটেজে স্থানীয় সময় আনুমানিক ভোর ৫টা ৫৫ মিনিটের দিকে আলোর ঝলক এবং একটি বিস্ফোরণের দৃশ্য ধরা পড়েছে। এই বিষয়ে মন্তব্যের জন্য বিবিসি ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখছে বলে জানানো হয়েছে।
এদিকে, বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন গাজায় যুদ্ধবিরতি ও জিম্মিদের মুক্তি সংক্রান্ত চুক্তির পরবর্তী পর্যায়ে আলোচনার সময় একাধিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। এর কারণগুলো হলো- একমাত্র প্যালেস্টাইনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেই নিরস্ত্রীকরণের বিষয়ে সম্মত হবে, নচেৎ নয়। যুদ্ধবিরতি নিয়ে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় সামাস নিরস্ত্রীকরণের বিষয়ে কোনো উল্লেখ করেনি, যা এই জল্পনাকে আরও উসকে দিয়েছে যে তাদের অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি।
বরং হামাসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তারা, ঐক্যবদ্ধ প্যালেস্টাইনি আন্দোলনের অংশ হিসেবে ভবিষ্যতে গাজায় ইতিবাচক ভূমিকা পালন করার বিষয়ে আশাবাদী।
প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু গাজায় যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত পূর্ণ পরিকল্পনায় সম্মতি জানালেও যুদ্ধ-পরবর্তী গাজায় প্যালেস্টাইনি কর্তৃপক্ষের সম্পৃক্ততার বিরুদ্ধে। এই বিষয়টি তিনি আবার স্পষ্ট করে দেন। গত সপ্তাহে তাকে জোর দিয়ে বলতে শোনা যায় যে, প্যালেস্টাইনি কর্তৃপক্ষ এই অঞ্চল পরিচালনায় কোনো ভূমিকা পালন করবে না।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ধাপে ধাপে গাজা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করার কথা। এই বিষয়ে ইসরায়েল জানিয়েছে প্রথম ধাপে সেনা প্রত্যাহারের পর গাজার প্রায় ৫৩ শতাংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। যদিও হোয়াইট হাউজের পরিকল্পনায় ধাপে ধাপে আরও ৪০ শতাংশ, তারপর আরও ১৫ শতাংশ এলাকার সেনাদের সরিয়ে নেয়ার ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল। এরপর চূড়ান্ত পর্যায়ে একটি “নিরাপত্তা পরিধির” মধ্যে থাকবে যা “যতক্ষণ না গাজা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা সন্ত্রাসের ঝুঁকি থেকে সঠিকভাবে সুরক্ষিত না হচ্ছে” ততক্ষণ পর্যন্ত থাকবে।
এখানে বেশ কিছু অস্পষ্ট রয়েছে। যেমন ইসরায়েলি সেনাদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের জন্য কোনো স্পষ্ট সময়সীমা উল্লেখ করা হয়নি। হামাস এ বিষয়ে স্পষ্টতা চাইতে পারে।
যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণকারী বহুজাতিক বাহিনী সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য জানিয়েছেন বিবিসির মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সংবাদদাতা টম বেটম্যান। তিনি জানিয়েছেন, মার্কিন সামরিক বাহিনী ইসরায়েলে একটি বেসামরিক-সামরিক সমন্বয় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করবে, যার মধ্যে প্রায় ২০০ ট্রুপ সেনা থাকবে। এতে মিশর, কাতার এবং তুরস্ক সহ আরব ও মুসলিম দেশগুলোর বাহিনী অন্তর্ভুক্ত থাকবে যারা যুদ্ধবিরতি পালন এবং যে কোনো ধরনের লঙ্ঘনের খবর দেবে।
এদিকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরপরই গাজায় আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে লোকজন। গাজার বাসিন্দা ২২ বছর বয়সী লায়লা এজ্জাত আল শানা জানিয়েছেন, যুদ্ধ বিরতির খবরে তিনি আনন্দিত। কিন্তু একইসঙ্গে তিনি শোকেও আচ্ছন্ন। গাজার এই মা বলেছেন, ‘আজ দিনটি খুব সুন্দর ছিল, কারণ তারা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছে। লোকে চিৎকার করছিলো, গান গাইছিলো। কিছু মানুষ আনন্দের জন্য আকাশে বন্দুক ছুঁড়ছিল, কয়েকজন নারী কাঁদছিল।’ এই উদযাপনের কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, দুই বছর পরও আমরা বেঁচে আছি! আমরা এই গণহত্যা থেকে বেঁচে গেছি।
গাজার বাস্তুহারা পরিবারগুলোও পশ্চিমের আবাসিক এলাকা থেকে গাজার মূল অংশে ফিরতে শুরু করেছেন, যেখান থেকে তাদের জোর করে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল। আল জাজিরা লিখেছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কিছু ব্রিগেড ও ডিভিশনকে গাজার কেন্দ্রীয় অংশ থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। গাজার কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নুসেইরাত আশ্রয় শিবির থেকে প্যালেস্টাইনি পরিবারগুলো উত্তর দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছে। তবে তারা এখনও নেতজারিম করিডোরে প্রবেশ করতে পারেনি, যেখানে আগে ইসরায়েলি সেনারা অবরোধ করে রেখেছিল। পরিবারগুলো অপেক্ষায় আছে, ওই অঞ্চল থেকে ইসরায়েলের শেষ ট্যাংকটি চলে যাওয়ার পর তারা সেখানে প্রবেশ করতে চায়।
জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক প্রধান টম ফ্লেচার বর্তমানে রিয়াদে রয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা যেন সমগ্র অঞ্চলে জীবন রক্ষাকারী কাজের এবং লাখো মানুষের জীবন বাঁচানোর ভিত্তি হয়ে ওঠে। তার কথায়, “এই মুহূর্তকে আমাদের সম্মিলিত ইচ্ছাশক্তি, দৃঢ় সংকল্প এবং উদারতার সঙ্গে কাজে লাগাতে হবে।”
মি. ফ্লেচার জানিয়েছেন, গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর জন্য তাদের ২০ শতাংশেরও কম ত্রাণ সরবরাহের অনুমতি আছে।
তার মতে যুদ্ধবিরতির পরিকল্পনা ফলপ্রসূ তখনই হবে যখন অবরোধ তুলে নেয়া এবং ত্রাণ পৌঁছে দেয়ার জন্য নিরাপদ রুটসহ উপত্যকায় প্রবেশের সব পথ খুলে দেয়া হবে। তিনি জানিয়েছেন সীমান্তে এক লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন খাদ্য, ওষুধ এবং অন্য সরবরাহ মজুত রাখা হয়েছে। গাজায় ২১ লাখ মানুষের মুখে খাবার তুলে দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
হামাসের নির্বাসিত গাজাপ্রধান খলিল আল-হায়া বলেছেন, যুদ্ধ যে শেষ হয়েছে সে ব্যাপারে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য মধ্যস্থতাকারীদের কাছ থেকে নিশ্চয়তা পেয়েছেন।
গাজা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, দুই বছরের ইসরায়েলি হামলায় ৬৭ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়েছে ওই অঞ্চল, দেখা দিয়েছে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ।
জিম্মি-বন্দী বিনিময় কার্যকর হওয়ার মধ্যেই খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা বহন করা অসংখ্য ট্রাকের গাজায় প্রবেশ করার কথা রয়েছে। এই সহায়তার জন্য অপেক্ষায় রয়েছে গাজার লাখ লাখ মানুষ, ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়ে যাদের বেশিরভাগই এখন বিভিন্ন তাঁবুতে আশ্রয় নিয়ে আছেন।
এদিকে ইসরায়েলি মন্ত্রিসভা হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তি চুক্তি অনুমোদন করার পরও গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার খবর পাওয়া গেছে। গাজা সিটির পূর্ব দিকে একটি স্থাপনা লক্ষ্য করে শুক্রবার ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টার হামলা চালায় বলে আল জাজিরা জানিয়েছে। সেখানে কামানের গোলা ছোড়া হয়েছে বলেও খবর পাওয়া গেছে। এর কিছুক্ষণ আগে গাজার দক্ষিণের খান ইউনিস এলাকায় বিমান হামলারও খবর মিলেছে, জানিয়েছে তারা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনার প্রথম পর্যায় বাস্তবায়নে ইসরায়েলি সরকার অনুমোদনের দেয়ার পর প্রথম খান ইউনিসে ওই হামলা হয়।
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এ যুদ্ধ ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিকভাবে আরও বিচ্ছিন্ন করেছে, মধ্যপ্রাচ্যকে ওলট-পালট করেছে। এমন এক আঞ্চলিক সংঘাত উসকে দিয়েছে যাতে ইরান, ইয়েমেন, লেবাননও জড়িয়ে পড়েছে। এই যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সম্পর্কেরও পরীক্ষা নিয়েছে। ট্রাম্পকে নেতানিয়াহুর ওপর ধৈর্যও হারাতে এবং চুক্তিতে পৌঁছাতে চাপ দিতেও দেখা গেছে।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর ট্রাম্প তার ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনা প্রস্তাব উন্মোচন করতে নেতানিয়াহুকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানান। এ সময় তিনি প্রকাশ্যে নেতানিয়াহুকে পুরোপুরি সমর্থন দিচ্ছেন বলে দেখানোর চেষ্টা করেন। ট্রাম্প বলেন, হামাস যদি পরিকল্পনা মেনে না নেয় তবে ইসরায়েলকে তাদের কার্যসিদ্ধি করতে ও হামাসকে ধ্বংস করে দিতে পূর্ণ সমর্থন দেবেন। কিন্তু গোপনে ট্রাম্প আসলে নেতানিয়াহুকে চাপ দিয়ে আসছিলেন।
এ সময় ট্রাম্প নজিরবিহীন একটি কাজ করে বসেন। ওয়াশিংটন যাকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছিল, সেই হামাসের বিবৃতিটি তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন। তিনি ইসরায়েল, হামাস ও মধ্যস্থতাকারীদের দ্রুত চুক্তির বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে চাপ দেন।
ট্রাম্প মার্কিন সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওসকে বলেন, তিনি নেতানিয়াহুকে বলেছেন, ‘বিবি (বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সংক্ষেপ) এটা তোমার জয়ের সুযোগ। তিনি এটা মেনে নিয়েছিলেন। তাকে এটা মেনে নিতেই হতো। তার হাতে কোনো উপায় ছিল না। আমার সঙ্গে থাকতে হলে মেনে নিতেই হবে।’