পুরোনো দ্বন্দ্ব কাটিয়ে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য সম্প্রতি দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে ভারত ও চীন। কয়েক মাস ধরে দুই দেশের সম্পর্ক বেশ শান্ত। তবে হঠাৎ করেই আবার বাগবিতণ্ডায় জড়িয়েছে নয়াদিল্লি ও বেইজিং। কারণটা হলো, ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্য অরুণাচল প্রদেশের একজন নারীকে হয়রানির অভিযোগ। ভারতের অরুণাচল প্রদেশকে তিব্বতের দক্ষিণ অঞ্চলের অংশ বলে দাবি করে চীন। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বহু আগে থেকেই বিরোধ চলছে। জেনে নেওয়া যাক পুরোনো এই দ্বন্দ্বের কারণ কী, আর ওই নারীর সঙ্গে কীই–বা হয়েছে, যাতে নতুন করে এই বিরোধ শুরু হয়েছে।
কী হয়েছিল: যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন প্রেমা ওয়াংজম থংডক। ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে যুক্তরাজ্য থেকে জাপান সফর করছিলেন তিনি। পথে তিন ঘণ্টার ট্রানজিটে চীনের সাংহাই পুডং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন এই নারী। থংডক অভিযোগ করেন, তাঁর জন্মস্থান অরুণাচল প্রদেশে হওয়ার কারণে তাঁকে আটক করে ১৮ ঘণ্টা ধরে হয়রানি করেছিলেন বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা। দশকের পর দশক ধরে অরুণাচল প্রদেশে তাওয়াং নামে পরিচিত একটি অংশ নিজেদের বলে দাবি করত চীন। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পুরো রাজ্যটিকেই নিজেদের বলে দাবি করছে দেশটি। থংডক বলেন, তাঁকে যখন বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা আটক করে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি জানতে চান, কেন তাঁর সঙ্গে এমনটা করা হচ্ছে। জবাবে ওই কর্মকর্তারা বলেন, তাঁর জন্ম অরুণাচল প্রদেশে হওয়ার কারণে ভারতীয় পাসপোর্ট বৈধ নয়। ওই কর্মকর্তাদের দাবি, অরুণাচল প্রদেশ চীনের অংশ। এই দাবির প্রতিবাদ জানান থংডক।
ভারতীয় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, জাপানে যাওয়ার জন্য চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইনের উড়োজাহাজের টিকিট কিনতে থংডককে চাপ দিয়েছিলেন চীনা কর্মকর্তারা। বলেছিলেন, তাঁদের কথা শুনলেই কেবল তাঁর পাসপোর্ট ফেরত দেওয়া হবে। এ ছাড়া আটক হওয়ার কারণে ফ্লাইট ধরতে ব্যর্থ হওয়ায় এবং হোটেলে অবস্থান করায় থংডকের বাড়তি অর্থ খরচ হয়েছে।
থংডকের ভাষ্যমতে, চীনা কর্মকর্তারা বাধা দেওয়ার পর যুক্তরাজ্যে তাঁর এক বন্ধু সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন। একপর্যায়ে তিনি সাংহাইয়ে ভারতীয় কনস্যুলেটের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। পরে কনস্যুলেটের কর্মকর্তারাই তাঁকে একটি ফ্লাইটে করে সাংহাই ত্যাগ করতে সহায়তা করেন। চীনের বাঁধের প্রভাব ঠেকাতে ও বন্যা প্রতিরোধে অরুণাচল প্রদেশে একটি জলাধার প্রকল্প হাতে নেয় নয়াদিল্লি। যদিও অরুণাচল প্রদেশের এই জলাধারের কারণে ভারত ও বাংলাদেশের অনেক গ্রাম পানিতে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের খবরে বলা হয়েছে, গত অক্টোবরেও সাংহাই পুডং বিমানবন্দর ব্যবহার করে গন্তব্যে গিয়েছিলেন প্রেমা ওয়াংজম থংডক। সে সময় তাঁকে কোনো ধরনের ঝামেলা পোহাতে হয়নি। এবার কেন তাঁর সঙ্গে এমন আচরণ করা হয়েছে, তা পরিষ্কার নয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকেই অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্ত–দ্বন্দ্ব চলে আসছে। সিমলা কনভেনশনের সময় ১৯১৪ সালের মার্চ মাসে ম্যাকমোহন লাইন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ওই কনভেনশন নিয়ে আলোচনায় যুক্ত ছিল তিব্বত, চীন ও ব্রিটিশ শাসকেরা।
নয়াদিল্লি ও বেইজিংয়ের মধ্যে সম্পর্ক ২০২০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বেশ দ্বন্দ্বপূর্ণ ছিল। গত বছর তা নরম হয়েছে। আলোচনায় ব্রিটেনের পক্ষ থেকে প্রধান মধ্যস্থতাকারী ছিলেন হেনরি ম্যাকমোহন। তাঁর নামেই ম্যাকমোহন লাইন নামকরণ করা হয়েছে। সিমলা কনভেনশনের আলোচনায় চীনের প্রতিনিধিরা অংশ নিলেও মূল চুক্তিতে সই করেননি তাঁরা। বেইজিংও ম্যাকমোহন লাইনের স্বীকৃতি দেয়নি।
যাই হোক, চীনের আপত্তির পরও এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ম্যাকমোহন। তিব্বতের সঙ্গে ভারতবর্ষের একটি সীমানা তৈরি করেন। তবে চীন অভিযোগ করেছে, ভারতের সঙ্গে সীমানা নির্ধারণের বিষয়ে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নেই তিব্বতের। ১৯৫১ সালে তিব্বত দখলের পর বেইজিংয়ের এই অভিযোগ আরও জোরালো হয়। এ ছাড়া পুরোনো কিছু মানচিত্রও তুলে ধরে চীন। এর মধ্যে ব্রিটিশদের তৈরি মানচিত্রও ছিল। সেখানে ম্যাকমোহন লাইনের দক্ষিণের ভূখণ্ডগুলো চীনের অংশ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। এরই মধ্যে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভ করে ভারত। তখন থেকেই ম্যাকমোহন লাইনকে ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্ত বলে বিবেচনা করে আসছে নয়াদিল্লি।
দশকের পর দশক ধরে অরুণাচল প্রদেশে তাওয়াং নামে পরিচিত একটি অংশকে নিজেদের বলে দাবি করত চীন। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পুরো রাজ্যটিকেই নিজেদের বলে দাবি করছে দেশটি। জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির সিগুর সেন্টার ফর এশিয়ান স্টাডিজের গবেষক রাজ ভার্মা বলেন, ২০১২ সালে সি চিন পিং চীনের প্রেসিডেন্ট পদে বসার পর থেকেই মূলত উত্তেজনাটা বেড়েছে।
২০১৮ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, ‘চীনের সার্বভৌমত্ব এবং ভূখণ্ডের অখণ্ডতার বিষয়ে আমাদের অবস্থান দৃঢ় ও স্পষ্ট। আমরা আমাদের পূর্বসূরিদের কাছ থেকে পাওয়া এক ইঞ্চি জমিও হারাব না। পাশাপাশি আমরা অন্যদের কাছ থেকে কিছুই চাই না।’ এ ছাড়া বিগত বছরগুলোয় অন্যান্য প্রতিবেশীর সঙ্গে বেইজিংয়ের সম্পর্ক তিক্ত হয়েছে।
গবেষক রাজ ভার্মা বলেন, চীনের এই অবস্থার কারণে অরুণাচল প্রদেশের সীমান্ত নিয়ে এই বিরোধের সমাধান দিন দিন আরও কঠিন হয়ে উঠছে। আর সামনের দিনগুলোতে এই সমস্যা সমাধান করা অত্যন্ত কঠিন হবে।
অরুণাচল ঘিরে দ্বন্দ্ব যেভাবে বেড়েছে: অরুণাচল প্রদেশ ভারতের সবচেয়ে কম জনবহুল রাজ্য। ১৯৬২ সালে ইন্দো–চীন যুদ্ধক্ষেত্রের একটিতে পরিণত হয়েছিল রাজ্যটি। তখন নামকা চু নদীর দুই তীরেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবস্থানে হামলা চালিয়েছিল চীনা বাহিনী। এর জেরে তাওয়াং ছেড়ে ভারতীয় সেনারা পালিয়েছিলেন। অবশ্য যুদ্ধ জয়ের পর এই অঞ্চল ভারতকে ফিরিয়ে দিয়েছিল চীনা বাহিনী।
১৯৭৫ সালের অক্টোবরে তুলুং লা পাসে ভারত ও চীন আবার সংঘর্ষে জড়ায়। এই পথটি তিব্বত ও অরুণাচল প্রদেশকে যুক্ত করেছে। সংঘর্ষে চারজন ভারতীয় সেনা নিহত হন। ২০২০ সালে লাদাখ সংকটের আগপর্যন্ত এটিই ছিল দুই দেশের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ। লাদাখে সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন ভারতীয় সেনা ও চারজন চীনা সেনা নিহত হয়েছিলেন। প্রায় ৫০ বছর ধরে অরুণাচল প্রদেশ অনেকটা শান্ত থাকলেও এই অঞ্চলের মালিকানা নিয়ে ভারত ও চীনের দাবি প্রতিযোগিতার পর্যায়ে পৌঁছেছে। ফলে অন্য বিভিন্ন দিক দিয়ে প্রভাব এসেছে। যেমন, ২০১২ সালে রাজ্যটিতে দালাই লামার সফরের তীব্র বিরোধিতা করেছিল বেইজিং। সে বছর আর অরুণাচল প্রদেশ সফর করেননি দালাই লামা।
এ ছাড়া ২০২২ সালে তাওয়াংয়ে চীন ও ভারতের সেনাদের মধ্যে ছোটখাটো একটি বিতণ্ডা হয়েছিল। দুই পক্ষেই তখন একে–অপরের ওপর দোষ চাপিয়েছিল। চীন অভিযোগ করে বলেছিল, তাদের সেনাসদস্যদের নিয়মিত টহলে বাধা দিয়েছিল ভারতীয় বাহিনী। অপরদিকে নয়াদিল্লির অভিযোগ ছিল, চীনা সেনারা ভারতীয় ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করেছিলেন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে তিব্বতের মেডং এলাকায় একটি বাঁধ নির্মাণের অনুমতি দেয় চীন সরকার। এই বাঁধের অবস্থান ভারত সীমান্তের কাছে। চীনের এই বাঁধের প্রভাব ঠেকাতে ও বন্যা প্রতিরোধে অরুণাচল প্রদেশে একটি জলাধার প্রকল্প হাতে নেয় নয়াদিল্লি। যদিও অরুণাচল প্রদেশের এই জলাধারের কারণে ভারত ও বাংলাদেশের অনেক গ্রাম পানিতে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
সাম্প্রতিক ঘটনায় ভারত ও চীনের জবাব: সাংহাই বিমানবন্দরে ভারতীয় পাসপোর্টধারী নারী থংডককে হয়রানির অভিযোগের জবাবে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং গত মঙ্গলবার বলেন, ‘জাংনান চীনের ভূখণ্ড। ভারতের অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠা করা কথিত অরুণাচল প্রদেশের কখনোই স্বীকৃতি দেয়নি চীন।’ থংডকের সঙ্গে চীনের আইন ও নিয়মনীতি মেনে আচরণ করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
চীনের এই প্রতিক্রিয়ার জবাবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল গতকাল বলেছেন, ‘অরুণাচল প্রদেশ ভারতের অবিচ্ছেদ্য ও অখণ্ড অংশ। আর এটি একটি সুস্পষ্ট সত্য। চীন যতই তা অস্বীকার করুক না কেন, এই বাস্তবতা পরিবর্তন হবে না।’ জয়সোয়াল আরও বলেন, থংডককে আটকের বিষয়টি চীনের কাছে জোরালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে। চীনা কর্তৃপক্ষ তাদের এই আচরণের ব্যাখ্যা এখনো দিতে পারেনি। চীনের এই পদক্ষেপ তাদের নিজেদের বিধিনিষেধেরও লঙ্ঘন। কারণ, তারা সব দেশের নাগরিকদের জন্য ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত ভিসাবিহীন ট্রানজিটের অনুমতি দিয়ে রেখেছে।
চীন–ভারত সম্পর্কে এর অর্থ কী: ভারত ও চীন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভারতীয় পাসপোর্টধারী নারী থংডককে হয়রানির অভিযোগকে ছোটখাটো বিষয় বলে উল্লেখ করেছেন গবেষক রাজ ভার্মা। নয়াদিল্লি ও বেইজিংয়ের মধ্যে সম্পর্ক ২০২০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বেশ দ্বন্দ্বপূর্ণ ছিল। গত বছর তা নরম হয়েছে। দুই পক্ষই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপ করা উচ্চ শুল্কের কারণে বড় ধাক্কা খেয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই শুল্কই মূলত দুই দেশকে কাছাকাছি এনেছে। সম্পর্ক উন্নয়নের অংশ হিসেবে রাশিয়ার কাজানে দেখা করেছিলেন চীনা প্রেসিডেন্ট সি ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। পরে আগস্টে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ভারত সফর করেছিলেন। এর জেরে মোদি ‘একে–অপরের স্বার্থের প্রতি দুই দেশের সম্মান জানানোর’ প্রশংসা করেছিলেন। পরে সে মাসেই চীন সফর করে সিয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। সম্পর্কে এমন উন্নতির পরও ভারত ও চীন একে–অপরের প্রতি কৌশল বদলায়নি বলে মনে করেন গবেষক রাজ ভার্মা।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫
পুরোনো দ্বন্দ্ব কাটিয়ে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য সম্প্রতি দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে ভারত ও চীন। কয়েক মাস ধরে দুই দেশের সম্পর্ক বেশ শান্ত। তবে হঠাৎ করেই আবার বাগবিতণ্ডায় জড়িয়েছে নয়াদিল্লি ও বেইজিং। কারণটা হলো, ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্য অরুণাচল প্রদেশের একজন নারীকে হয়রানির অভিযোগ। ভারতের অরুণাচল প্রদেশকে তিব্বতের দক্ষিণ অঞ্চলের অংশ বলে দাবি করে চীন। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বহু আগে থেকেই বিরোধ চলছে। জেনে নেওয়া যাক পুরোনো এই দ্বন্দ্বের কারণ কী, আর ওই নারীর সঙ্গে কীই–বা হয়েছে, যাতে নতুন করে এই বিরোধ শুরু হয়েছে।
কী হয়েছিল: যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন প্রেমা ওয়াংজম থংডক। ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে যুক্তরাজ্য থেকে জাপান সফর করছিলেন তিনি। পথে তিন ঘণ্টার ট্রানজিটে চীনের সাংহাই পুডং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন এই নারী। থংডক অভিযোগ করেন, তাঁর জন্মস্থান অরুণাচল প্রদেশে হওয়ার কারণে তাঁকে আটক করে ১৮ ঘণ্টা ধরে হয়রানি করেছিলেন বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা। দশকের পর দশক ধরে অরুণাচল প্রদেশে তাওয়াং নামে পরিচিত একটি অংশ নিজেদের বলে দাবি করত চীন। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পুরো রাজ্যটিকেই নিজেদের বলে দাবি করছে দেশটি। থংডক বলেন, তাঁকে যখন বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা আটক করে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি জানতে চান, কেন তাঁর সঙ্গে এমনটা করা হচ্ছে। জবাবে ওই কর্মকর্তারা বলেন, তাঁর জন্ম অরুণাচল প্রদেশে হওয়ার কারণে ভারতীয় পাসপোর্ট বৈধ নয়। ওই কর্মকর্তাদের দাবি, অরুণাচল প্রদেশ চীনের অংশ। এই দাবির প্রতিবাদ জানান থংডক।
ভারতীয় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, জাপানে যাওয়ার জন্য চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইনের উড়োজাহাজের টিকিট কিনতে থংডককে চাপ দিয়েছিলেন চীনা কর্মকর্তারা। বলেছিলেন, তাঁদের কথা শুনলেই কেবল তাঁর পাসপোর্ট ফেরত দেওয়া হবে। এ ছাড়া আটক হওয়ার কারণে ফ্লাইট ধরতে ব্যর্থ হওয়ায় এবং হোটেলে অবস্থান করায় থংডকের বাড়তি অর্থ খরচ হয়েছে।
থংডকের ভাষ্যমতে, চীনা কর্মকর্তারা বাধা দেওয়ার পর যুক্তরাজ্যে তাঁর এক বন্ধু সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন। একপর্যায়ে তিনি সাংহাইয়ে ভারতীয় কনস্যুলেটের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। পরে কনস্যুলেটের কর্মকর্তারাই তাঁকে একটি ফ্লাইটে করে সাংহাই ত্যাগ করতে সহায়তা করেন। চীনের বাঁধের প্রভাব ঠেকাতে ও বন্যা প্রতিরোধে অরুণাচল প্রদেশে একটি জলাধার প্রকল্প হাতে নেয় নয়াদিল্লি। যদিও অরুণাচল প্রদেশের এই জলাধারের কারণে ভারত ও বাংলাদেশের অনেক গ্রাম পানিতে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের খবরে বলা হয়েছে, গত অক্টোবরেও সাংহাই পুডং বিমানবন্দর ব্যবহার করে গন্তব্যে গিয়েছিলেন প্রেমা ওয়াংজম থংডক। সে সময় তাঁকে কোনো ধরনের ঝামেলা পোহাতে হয়নি। এবার কেন তাঁর সঙ্গে এমন আচরণ করা হয়েছে, তা পরিষ্কার নয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকেই অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্ত–দ্বন্দ্ব চলে আসছে। সিমলা কনভেনশনের সময় ১৯১৪ সালের মার্চ মাসে ম্যাকমোহন লাইন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ওই কনভেনশন নিয়ে আলোচনায় যুক্ত ছিল তিব্বত, চীন ও ব্রিটিশ শাসকেরা।
নয়াদিল্লি ও বেইজিংয়ের মধ্যে সম্পর্ক ২০২০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বেশ দ্বন্দ্বপূর্ণ ছিল। গত বছর তা নরম হয়েছে। আলোচনায় ব্রিটেনের পক্ষ থেকে প্রধান মধ্যস্থতাকারী ছিলেন হেনরি ম্যাকমোহন। তাঁর নামেই ম্যাকমোহন লাইন নামকরণ করা হয়েছে। সিমলা কনভেনশনের আলোচনায় চীনের প্রতিনিধিরা অংশ নিলেও মূল চুক্তিতে সই করেননি তাঁরা। বেইজিংও ম্যাকমোহন লাইনের স্বীকৃতি দেয়নি।
যাই হোক, চীনের আপত্তির পরও এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ম্যাকমোহন। তিব্বতের সঙ্গে ভারতবর্ষের একটি সীমানা তৈরি করেন। তবে চীন অভিযোগ করেছে, ভারতের সঙ্গে সীমানা নির্ধারণের বিষয়ে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নেই তিব্বতের। ১৯৫১ সালে তিব্বত দখলের পর বেইজিংয়ের এই অভিযোগ আরও জোরালো হয়। এ ছাড়া পুরোনো কিছু মানচিত্রও তুলে ধরে চীন। এর মধ্যে ব্রিটিশদের তৈরি মানচিত্রও ছিল। সেখানে ম্যাকমোহন লাইনের দক্ষিণের ভূখণ্ডগুলো চীনের অংশ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। এরই মধ্যে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভ করে ভারত। তখন থেকেই ম্যাকমোহন লাইনকে ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্ত বলে বিবেচনা করে আসছে নয়াদিল্লি।
দশকের পর দশক ধরে অরুণাচল প্রদেশে তাওয়াং নামে পরিচিত একটি অংশকে নিজেদের বলে দাবি করত চীন। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পুরো রাজ্যটিকেই নিজেদের বলে দাবি করছে দেশটি। জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির সিগুর সেন্টার ফর এশিয়ান স্টাডিজের গবেষক রাজ ভার্মা বলেন, ২০১২ সালে সি চিন পিং চীনের প্রেসিডেন্ট পদে বসার পর থেকেই মূলত উত্তেজনাটা বেড়েছে।
২০১৮ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, ‘চীনের সার্বভৌমত্ব এবং ভূখণ্ডের অখণ্ডতার বিষয়ে আমাদের অবস্থান দৃঢ় ও স্পষ্ট। আমরা আমাদের পূর্বসূরিদের কাছ থেকে পাওয়া এক ইঞ্চি জমিও হারাব না। পাশাপাশি আমরা অন্যদের কাছ থেকে কিছুই চাই না।’ এ ছাড়া বিগত বছরগুলোয় অন্যান্য প্রতিবেশীর সঙ্গে বেইজিংয়ের সম্পর্ক তিক্ত হয়েছে।
গবেষক রাজ ভার্মা বলেন, চীনের এই অবস্থার কারণে অরুণাচল প্রদেশের সীমান্ত নিয়ে এই বিরোধের সমাধান দিন দিন আরও কঠিন হয়ে উঠছে। আর সামনের দিনগুলোতে এই সমস্যা সমাধান করা অত্যন্ত কঠিন হবে।
অরুণাচল ঘিরে দ্বন্দ্ব যেভাবে বেড়েছে: অরুণাচল প্রদেশ ভারতের সবচেয়ে কম জনবহুল রাজ্য। ১৯৬২ সালে ইন্দো–চীন যুদ্ধক্ষেত্রের একটিতে পরিণত হয়েছিল রাজ্যটি। তখন নামকা চু নদীর দুই তীরেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবস্থানে হামলা চালিয়েছিল চীনা বাহিনী। এর জেরে তাওয়াং ছেড়ে ভারতীয় সেনারা পালিয়েছিলেন। অবশ্য যুদ্ধ জয়ের পর এই অঞ্চল ভারতকে ফিরিয়ে দিয়েছিল চীনা বাহিনী।
১৯৭৫ সালের অক্টোবরে তুলুং লা পাসে ভারত ও চীন আবার সংঘর্ষে জড়ায়। এই পথটি তিব্বত ও অরুণাচল প্রদেশকে যুক্ত করেছে। সংঘর্ষে চারজন ভারতীয় সেনা নিহত হন। ২০২০ সালে লাদাখ সংকটের আগপর্যন্ত এটিই ছিল দুই দেশের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ। লাদাখে সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন ভারতীয় সেনা ও চারজন চীনা সেনা নিহত হয়েছিলেন। প্রায় ৫০ বছর ধরে অরুণাচল প্রদেশ অনেকটা শান্ত থাকলেও এই অঞ্চলের মালিকানা নিয়ে ভারত ও চীনের দাবি প্রতিযোগিতার পর্যায়ে পৌঁছেছে। ফলে অন্য বিভিন্ন দিক দিয়ে প্রভাব এসেছে। যেমন, ২০১২ সালে রাজ্যটিতে দালাই লামার সফরের তীব্র বিরোধিতা করেছিল বেইজিং। সে বছর আর অরুণাচল প্রদেশ সফর করেননি দালাই লামা।
এ ছাড়া ২০২২ সালে তাওয়াংয়ে চীন ও ভারতের সেনাদের মধ্যে ছোটখাটো একটি বিতণ্ডা হয়েছিল। দুই পক্ষেই তখন একে–অপরের ওপর দোষ চাপিয়েছিল। চীন অভিযোগ করে বলেছিল, তাদের সেনাসদস্যদের নিয়মিত টহলে বাধা দিয়েছিল ভারতীয় বাহিনী। অপরদিকে নয়াদিল্লির অভিযোগ ছিল, চীনা সেনারা ভারতীয় ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করেছিলেন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে তিব্বতের মেডং এলাকায় একটি বাঁধ নির্মাণের অনুমতি দেয় চীন সরকার। এই বাঁধের অবস্থান ভারত সীমান্তের কাছে। চীনের এই বাঁধের প্রভাব ঠেকাতে ও বন্যা প্রতিরোধে অরুণাচল প্রদেশে একটি জলাধার প্রকল্প হাতে নেয় নয়াদিল্লি। যদিও অরুণাচল প্রদেশের এই জলাধারের কারণে ভারত ও বাংলাদেশের অনেক গ্রাম পানিতে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
সাম্প্রতিক ঘটনায় ভারত ও চীনের জবাব: সাংহাই বিমানবন্দরে ভারতীয় পাসপোর্টধারী নারী থংডককে হয়রানির অভিযোগের জবাবে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং গত মঙ্গলবার বলেন, ‘জাংনান চীনের ভূখণ্ড। ভারতের অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠা করা কথিত অরুণাচল প্রদেশের কখনোই স্বীকৃতি দেয়নি চীন।’ থংডকের সঙ্গে চীনের আইন ও নিয়মনীতি মেনে আচরণ করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
চীনের এই প্রতিক্রিয়ার জবাবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল গতকাল বলেছেন, ‘অরুণাচল প্রদেশ ভারতের অবিচ্ছেদ্য ও অখণ্ড অংশ। আর এটি একটি সুস্পষ্ট সত্য। চীন যতই তা অস্বীকার করুক না কেন, এই বাস্তবতা পরিবর্তন হবে না।’ জয়সোয়াল আরও বলেন, থংডককে আটকের বিষয়টি চীনের কাছে জোরালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে। চীনা কর্তৃপক্ষ তাদের এই আচরণের ব্যাখ্যা এখনো দিতে পারেনি। চীনের এই পদক্ষেপ তাদের নিজেদের বিধিনিষেধেরও লঙ্ঘন। কারণ, তারা সব দেশের নাগরিকদের জন্য ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত ভিসাবিহীন ট্রানজিটের অনুমতি দিয়ে রেখেছে।
চীন–ভারত সম্পর্কে এর অর্থ কী: ভারত ও চীন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভারতীয় পাসপোর্টধারী নারী থংডককে হয়রানির অভিযোগকে ছোটখাটো বিষয় বলে উল্লেখ করেছেন গবেষক রাজ ভার্মা। নয়াদিল্লি ও বেইজিংয়ের মধ্যে সম্পর্ক ২০২০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বেশ দ্বন্দ্বপূর্ণ ছিল। গত বছর তা নরম হয়েছে। দুই পক্ষই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপ করা উচ্চ শুল্কের কারণে বড় ধাক্কা খেয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই শুল্কই মূলত দুই দেশকে কাছাকাছি এনেছে। সম্পর্ক উন্নয়নের অংশ হিসেবে রাশিয়ার কাজানে দেখা করেছিলেন চীনা প্রেসিডেন্ট সি ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। পরে আগস্টে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ভারত সফর করেছিলেন। এর জেরে মোদি ‘একে–অপরের স্বার্থের প্রতি দুই দেশের সম্মান জানানোর’ প্রশংসা করেছিলেন। পরে সে মাসেই চীন সফর করে সিয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। সম্পর্কে এমন উন্নতির পরও ভারত ও চীন একে–অপরের প্রতি কৌশল বদলায়নি বলে মনে করেন গবেষক রাজ ভার্মা।