alt

দীর্ঘমেয়াদি বন্যার কবলে লক্ষ্মীপুর, নানা দুর্ভোগে বানবাসিরা

জেলা বার্তা পরিবেশক, লক্ষ্মীপুর : রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

লক্ষ্মীপুরে বন্যায় ডুবে যাওয়া রাস্তাঘাট

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় গত দুই সপ্তাহ ধরে চলছে বন্যা। এর আগে ভারী বৃষ্টিপাতে আরও প্রায় ১০ দিনের বেশি সময় ধরেছিল ভয়াবহ জলাবদ্ধতা। আবার জেলার কমলনগর এবং রামগতি উপজেলার পূর্বাংশে গত এক মাস আগ থেকেই জলাবদ্ধতা শুরু হয়। এর সঙ্গে যোগ হয় উজানের ঢলের পানি। জেলার রায়পুর এবং রামগঞ্জেরও কিছু কিছু এলাকা বন্যাকবলিত।

এতে দেখা যায়, জেলার কোথাও এক মাসের বেশি সময় ধরে লোকজন পানিবন্দী হয়ে সীমাহীন কষ্টে বসবাস করছে। জেলা প্রশাসনের হিসাব মতে, আট লাখের বেশি লোকজন পানিবন্দীতে ছিল। এখনো পানিবন্দী প্রায় ৫ লাখের বেশি মানুষ। গত কয়েক বছর ধরে বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।

তবে এবারের জলাবদ্ধতার সঙ্গে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল যোগ হয়ে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। পানি প্রবাহ না থাকায় এবারের বন্যা আগের বন্যার চেয়েও দীর্ঘ মেয়াদি হয়েছে। ফলে অতীতের ভোগান্তির থেকেও এবারের ভোগান্তির চিত্রও বেশি। আর ক্ষয়ক্ষতিও হচ্ছে ব্যাপক আকারে। দীর্ঘমেয়াদি বন্যার পেছনে খালে পানি প্রবাহ কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন স্থানীয় লোকজন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং প্রশাসন।

আর পানি প্রবাহ কমার পেছনে খাল দখল করে স্থাপনা নির্মাণ, খালের গভীরতা কমে যাওয়া, খালে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, খালে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ, খালের ওপর অপরিকল্পিত ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণকে দায়ী করা হচ্ছে। গত কয়েকদিনে বন্যাকবলিত এলাকা, মেঘনা নদীর তীর পরিদর্শন এবং বন্যার্ত বাসিন্দা ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্যের মিল পাওয়া গেছে। মানব সৃষ্ট এসব বাধা বা প্রতিবন্ধকতা ঠিক এ মুহূর্তে দূর করাও সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

ফলে নামছে না বন্যার পানি। এতে দীর্ঘস্থায়ী রূপ পেয়েছে লক্ষ্মীপুরের বন্যা পরিস্থিতি। লক্ষ্মীপুরে মেঘনা নদীর নিকটবর্তী এলাকাগুলোতে দেখা গেছে, নদীর পানি পাড় থেকে ৮-১০ ফুট নিচে। মেঘনাপাড়ের বহু এলাকায় ফসলি জমিতে এখন পানি নেই। এর পুরো বিপরীত চিত্র একটু দূরে শুধু পানি আর পানি। মেঘনা নদী থেকে লক্ষ্মীপুরের রামগতি, কমলনগর, লক্ষ্মীপুর সদর এবং নোয়াখালীর সুবর্ণচর ও সদর উপজেলা হয়ে ছুটে আসা ভুলুয়া নদ এসে মিশেছে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ওয়াপদা খালে। অন্য অংশ ছুটে গেছে নোয়াখালীর ভেতরে। ৭৬ কিলোমিটার এ নদের প্রতি ১০০ ফুটে রয়েছে মাছ ধরার একটি করে জাল কিংবা একটি ডুবন্ত বাঁধ, বাড়ির পথ, ইটভাটার রাস্তা, নিচু ব্রিজ।

নানা প্রজাতির এ জাল ও বাঁধে পানি কোনোভাবেই নড়ছে না। রামগতির চরপোড়াগাছা ইউনিয়নের কোডেক বাজার থেকে আজাদনগর এলাকায় কয়েকজন ভূমি দস্যু ভুলুয়া দখল করে জমি বিক্রি করে দিয়েছেন। সে জমিতে ঘরবাড়ি তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া ভুলুয়ার তীরে মাছের ঘের, মুরগির খামার এবং খোদ ভুলুয়ার ভেতরের অংশে পাড় বাঁধিয়ে পুকুরও বানিয়ে ফেলা হয়েছে। ভুলুয়া তীরের রামগতি অঞ্চলের বাসিন্দারা জানান, এক সময়ের ৫০০ মিটার চওড়া ভুলুয়া এখানে এসে হয়ে গেছে ৩০ ফুট। ফলে ৭৬ কিলোমিটার দূরের পানি এই ৩০ ফুট অগভীর পথ দিয়ে বের হচ্ছে না।

যার কারণে জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে আগস্টজুড়ে তীব্র জলাবদ্ধতা থেকে সৃষ্ট বন্যায় ডুবে আছে ভুলুয়া পাড়ের কয়েক লাখ মানুষ। তারা জানায়, এ বন্যা আর কতদিন থাকবে, তার কোনো হিসেব নেই। পানি ঠিকমতো নামছে না। তাই বন্যার উন্নতি দেখছে না তারা। লক্ষ্মীপুরে রামগতি উপজেলার চর বাদাম ইউনিয়নের পশ্চিম চর কলাকোপা গ্রামের বাসিন্দা ইউনুছ মিয়া। গ্রামের বেড়িবাঁধের বাইরে পূর্ব পাশে তার ঘর। এখন তিনি পশ্চিম চর কলাকোপা হাজী বাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে থাকছেন। ইউনুছ মিয়ার বয়স ৮০ ছুঁয়েছে। হাত-পা কাঁপে। হাঁটতে গিয়ে নুয়ে পড়েন। লাঠিতে ভর দিয়ে চলাফেরা করেন। অল্প কিছু জমি আর ছোট্ট একটি ঘর নিয়ে তার সংসার।

এ বয়সে এসে সেটাও হারানোর দশা। বন্যায় তার ঘর ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, নষ্ট হয়ে যায় সব আসবাব। সব ঠিকঠাক করে আগের জীবনে ফিরতে পারবেন কি না, এখন কেবল এ দুশ্চিন্তাই তাড়া করে ফিরছে তাকে। ইউনুছ মিয়া বলেন, এবারের বন্যায় নিঃস্ব হয়ে গেছেন। তার ঘরে এখনো হাঁটুসমান পানি। তিনিসহ গ্রামের ৩০টি পরিবারের প্রত্যেকেই ঘর ছেড়েছেন। তিনি বলেন, ১২ থেকে ১৫ দিন ধরে বাড়িতে পানি উঠেছে। ডুবে থাকার কারণে ঘরের বেড়াগুলোতে পচন শুরু হয়েছে। ঘরের অনেক আসবাবপত্র নষ্ট হয়েছে। ঘরে চাল ছিল, সেগুলো ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে।

রোদ না থাকায় শুকাতে পারেননি। তাই পচে গেছে। শুধু এই ইউনুছ মিয়াই নন, বন্যার কবলে পড়ে জেলার পাঁচটি উপজেলার অনেকে মেহনতি মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন। যতই দিন যাচ্ছে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠছে। লক্ষ্মীপুরে বন্যার প্রভাবে ডায়রিয়া ও চর্মরোগসহ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে ১৩ দিনে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন এক হাজার ৬৭১ জন রোগী। বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ১০০ শয্যার সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১০৪ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী। এদের মধ্যে ৭৩ জনই শিশু।

প্রতিদিনই বন্যাকবলিত এলাকায় পানিবাহিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানায়, সদর হাসপাতাল ও পাঁচটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গত ১৩ দিনে ৯০৫ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হন ১১৮ জন। গত ১৩ দিনে সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিয়েছেন ৫৯৩ জন চর্মরোগী।

এরমধ্যে ২৪ ঘণ্টায় চিকিৎসা নিয়েছেন ২২১ জন। বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভুগছে বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ। গত বৃহস্পতিবার বন্যাকবলিত সদর উপজেলার দিঘলী-মান্দারী এলাকা ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে।সদরের পশ্চিম জামিরতলি গ্রামের বাসিন্দা আবদুর রহিম ও জয়নাল আবেদিন জানান, পুরো এলাকা ৩-৪ ফুট পানিতে নিমজ্জিত। প্রত্যেকটি টিউবওয়েল এখন পানির নিচে। টিউবওয়েল চাপ দিলেই ময়লা পানি উঠে আসে। বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে।

অনেকেই বাজার থেকে পানি কিনে খাচ্ছেন। আবার ত্রাণের সঙ্গে দেয়া পানিও অপ্রতুল। বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দিয়েও আশপাশের টিউবওয়েলের পানি পানে ইচ্ছা করছে না। লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ উজ জামান জানিয়েছেন, বর্তমানে লক্ষ্মীপুরে যে বন্যা হচ্ছে তার বেশিরভাগ অংশই জলাবদ্ধতা থেকে সৃষ্টি হয়েছে। কারণ লক্ষ্মীপুরের বিশাল জনগোষ্ঠী পানিবন্দী হলেও মেঘনা নদীতে পানি নেই। পূর্বাঞ্চল (ওপরের অংশ) থেকে পশ্চিম অংশ (ডাল) মেঘনায় পানি যেতে পথে পথে বাধা রয়েছে। জলাবদ্ধতার মূল কারণ দখলবাজি এবং অপরিকল্পিত উন্নয়ন।

এ কারণে বৃষ্টিপাতের পানি নদীতে নামতে পারেনি। একই সঙ্গে ওই পানিতে যুক্ত হওয়া নোয়াখালী ও ফেনীর বন্যার পানি এসে পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে। আমরা এখন এ অতিরিক্ত পানি নেমে যেতে আমাদের সব খালগুলো এবং সøুইস গেটগুলো ২৪ ঘণ্টা তদারকি করছি।

ছবি

সশস্ত্র বাহিনী দিবস উদযাপিত

ছবি

বিশেষজ্ঞের অভিমত: বড় ভূমিকম্পের সতর্কবার্তা

যারা গণভোটে ‘না’-এর পক্ষে, তারা বাংলাদেশপন্থি হতে পারে না: সারজিস

ছবি

ভুটানের প্রধানমন্ত্রী তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে শনিবার ঢাকায় আসছেন

মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে থাকা ১৭৪ বাংলাদেশি গ্রেপ্তার

‘তুলে নিয়ে’ জিজ্ঞাসাবাদ: ‘ভয়ের সংস্কৃতি অব্যাহত রাখার দৃষ্টান্ত’ বলছে টিআইবি

ছবি

ভূমিকম্পে কাঁপলো দেশ: মৃত্যু ১০, আহত ৫ শতাধিক

ছবি

রূপগঞ্জে ভূমিকম্পে দেয়াল ধসে শিশুর মৃত্যু

তীব্র ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল ঢাকাসহ সারাদেশ

সৌদিতে অপহরণ, ঢাকায় মুক্তিপণ আদায়

বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয়, আগামী সপ্তাহেই গেজেট

ছবি

পিয়াসকে ছাড়ার পর খুললো মোবাইল মার্কেট

বিদায়ের সময় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি খাদ্য মজুত থাকবে: উপদেষ্টা

রোহিঙ্গাদের মায়ানমারে ফেরাতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রস্তাব গৃহীত

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল: রাজসাক্ষীকে জেরায় উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়

দুষ্কৃতকারীদের ওপর সর্বোচ্চ বল প্রয়োগে পুলিশ দ্বিধা করবে না: ডিএমপি কমিশনার

ছবি

নিরাপত্তায় উন্মুক্ত সহযোগিতা, তবে সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ নয়: জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা

হাসিনাকে ফেরাতে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার কথা ভাবছে অন্তর্বর্তী সরকার

তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল, তবে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই

ছবি

তিন দিনের সফরে শনিবার ঢাকায় আসছেন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী

ছবি

ঝালকাঠি জেলার ২টি আসনের খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ

ছবি

সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল, পরের জাতীয় নির্বাচন থেকে কার্যকর

ছবি

২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবস

ছবি

ডেঙ্গুতে একদিনে আরও ৬ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ৭৮৮ জন

ছবি

রোজ গার্ডেন কিনে রাষ্ট্রের ‘৩৩২ কোটি টাকা ক্ষতি’, অনুসন্ধানে দুদক

ছবি

আমার মায়ের জীবন বাঁচানোয় মোদি সরকারের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ: জয়

ছবি

ওসি সায়েদ ও এএসআই বিশ্বজিৎ ৬টি মরদেহ পুড়িয়েছে: রাজসাক্ষী আফজালুল

মৃত ও ভুয়া ভোটারের সংখ্যা বাড়ছে, খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা, বললেন ডিসি

ছবি

আশুলিয়ায় ছয়জনকে গুলি ও পুড়িয়ে হত্যা: মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় সাবেক এসআই আবজালুলের রাজসাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি

ছবি

গণভোট: করণীয় ঠিক করতে অধ্যাদেশের অপেক্ষায় ইসি

ছবি

খেলাপি ঋণ অবলোপনের সময়সীমা তুলে দিলো বাংলাদেশ ব্যাংক

ছবি

একইদিনে ইসির সংলাপে বিএনপি-জামায়াত-এনসিপি, বিভিন্ন প্রস্তাব

ছবি

নির্বাচন শান্তিপূর্ণ করতে সেনা ও পুলিশের সহায়তা চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা

ছবি

।দিল্লিতে অজিত দোভালের সঙ্গে বৈঠকে খলিলুর রহমান, আলোচনায় সিএসসি ও দ্বিপক্ষীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু

ছবি

বিজয় দিবসে এবারও প্যারেড নয়: জানালেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

ছবি

সংসদ নির্বাচনের প্রচারণায় ২৫ কোটি টাকা খরচ করবে সরকার

tab

দীর্ঘমেয়াদি বন্যার কবলে লক্ষ্মীপুর, নানা দুর্ভোগে বানবাসিরা

জেলা বার্তা পরিবেশক, লক্ষ্মীপুর

লক্ষ্মীপুরে বন্যায় ডুবে যাওয়া রাস্তাঘাট

রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় গত দুই সপ্তাহ ধরে চলছে বন্যা। এর আগে ভারী বৃষ্টিপাতে আরও প্রায় ১০ দিনের বেশি সময় ধরেছিল ভয়াবহ জলাবদ্ধতা। আবার জেলার কমলনগর এবং রামগতি উপজেলার পূর্বাংশে গত এক মাস আগ থেকেই জলাবদ্ধতা শুরু হয়। এর সঙ্গে যোগ হয় উজানের ঢলের পানি। জেলার রায়পুর এবং রামগঞ্জেরও কিছু কিছু এলাকা বন্যাকবলিত।

এতে দেখা যায়, জেলার কোথাও এক মাসের বেশি সময় ধরে লোকজন পানিবন্দী হয়ে সীমাহীন কষ্টে বসবাস করছে। জেলা প্রশাসনের হিসাব মতে, আট লাখের বেশি লোকজন পানিবন্দীতে ছিল। এখনো পানিবন্দী প্রায় ৫ লাখের বেশি মানুষ। গত কয়েক বছর ধরে বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।

তবে এবারের জলাবদ্ধতার সঙ্গে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল যোগ হয়ে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। পানি প্রবাহ না থাকায় এবারের বন্যা আগের বন্যার চেয়েও দীর্ঘ মেয়াদি হয়েছে। ফলে অতীতের ভোগান্তির থেকেও এবারের ভোগান্তির চিত্রও বেশি। আর ক্ষয়ক্ষতিও হচ্ছে ব্যাপক আকারে। দীর্ঘমেয়াদি বন্যার পেছনে খালে পানি প্রবাহ কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন স্থানীয় লোকজন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং প্রশাসন।

আর পানি প্রবাহ কমার পেছনে খাল দখল করে স্থাপনা নির্মাণ, খালের গভীরতা কমে যাওয়া, খালে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, খালে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ, খালের ওপর অপরিকল্পিত ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণকে দায়ী করা হচ্ছে। গত কয়েকদিনে বন্যাকবলিত এলাকা, মেঘনা নদীর তীর পরিদর্শন এবং বন্যার্ত বাসিন্দা ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্যের মিল পাওয়া গেছে। মানব সৃষ্ট এসব বাধা বা প্রতিবন্ধকতা ঠিক এ মুহূর্তে দূর করাও সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

ফলে নামছে না বন্যার পানি। এতে দীর্ঘস্থায়ী রূপ পেয়েছে লক্ষ্মীপুরের বন্যা পরিস্থিতি। লক্ষ্মীপুরে মেঘনা নদীর নিকটবর্তী এলাকাগুলোতে দেখা গেছে, নদীর পানি পাড় থেকে ৮-১০ ফুট নিচে। মেঘনাপাড়ের বহু এলাকায় ফসলি জমিতে এখন পানি নেই। এর পুরো বিপরীত চিত্র একটু দূরে শুধু পানি আর পানি। মেঘনা নদী থেকে লক্ষ্মীপুরের রামগতি, কমলনগর, লক্ষ্মীপুর সদর এবং নোয়াখালীর সুবর্ণচর ও সদর উপজেলা হয়ে ছুটে আসা ভুলুয়া নদ এসে মিশেছে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ওয়াপদা খালে। অন্য অংশ ছুটে গেছে নোয়াখালীর ভেতরে। ৭৬ কিলোমিটার এ নদের প্রতি ১০০ ফুটে রয়েছে মাছ ধরার একটি করে জাল কিংবা একটি ডুবন্ত বাঁধ, বাড়ির পথ, ইটভাটার রাস্তা, নিচু ব্রিজ।

নানা প্রজাতির এ জাল ও বাঁধে পানি কোনোভাবেই নড়ছে না। রামগতির চরপোড়াগাছা ইউনিয়নের কোডেক বাজার থেকে আজাদনগর এলাকায় কয়েকজন ভূমি দস্যু ভুলুয়া দখল করে জমি বিক্রি করে দিয়েছেন। সে জমিতে ঘরবাড়ি তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া ভুলুয়ার তীরে মাছের ঘের, মুরগির খামার এবং খোদ ভুলুয়ার ভেতরের অংশে পাড় বাঁধিয়ে পুকুরও বানিয়ে ফেলা হয়েছে। ভুলুয়া তীরের রামগতি অঞ্চলের বাসিন্দারা জানান, এক সময়ের ৫০০ মিটার চওড়া ভুলুয়া এখানে এসে হয়ে গেছে ৩০ ফুট। ফলে ৭৬ কিলোমিটার দূরের পানি এই ৩০ ফুট অগভীর পথ দিয়ে বের হচ্ছে না।

যার কারণে জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে আগস্টজুড়ে তীব্র জলাবদ্ধতা থেকে সৃষ্ট বন্যায় ডুবে আছে ভুলুয়া পাড়ের কয়েক লাখ মানুষ। তারা জানায়, এ বন্যা আর কতদিন থাকবে, তার কোনো হিসেব নেই। পানি ঠিকমতো নামছে না। তাই বন্যার উন্নতি দেখছে না তারা। লক্ষ্মীপুরে রামগতি উপজেলার চর বাদাম ইউনিয়নের পশ্চিম চর কলাকোপা গ্রামের বাসিন্দা ইউনুছ মিয়া। গ্রামের বেড়িবাঁধের বাইরে পূর্ব পাশে তার ঘর। এখন তিনি পশ্চিম চর কলাকোপা হাজী বাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে থাকছেন। ইউনুছ মিয়ার বয়স ৮০ ছুঁয়েছে। হাত-পা কাঁপে। হাঁটতে গিয়ে নুয়ে পড়েন। লাঠিতে ভর দিয়ে চলাফেরা করেন। অল্প কিছু জমি আর ছোট্ট একটি ঘর নিয়ে তার সংসার।

এ বয়সে এসে সেটাও হারানোর দশা। বন্যায় তার ঘর ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, নষ্ট হয়ে যায় সব আসবাব। সব ঠিকঠাক করে আগের জীবনে ফিরতে পারবেন কি না, এখন কেবল এ দুশ্চিন্তাই তাড়া করে ফিরছে তাকে। ইউনুছ মিয়া বলেন, এবারের বন্যায় নিঃস্ব হয়ে গেছেন। তার ঘরে এখনো হাঁটুসমান পানি। তিনিসহ গ্রামের ৩০টি পরিবারের প্রত্যেকেই ঘর ছেড়েছেন। তিনি বলেন, ১২ থেকে ১৫ দিন ধরে বাড়িতে পানি উঠেছে। ডুবে থাকার কারণে ঘরের বেড়াগুলোতে পচন শুরু হয়েছে। ঘরের অনেক আসবাবপত্র নষ্ট হয়েছে। ঘরে চাল ছিল, সেগুলো ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে।

রোদ না থাকায় শুকাতে পারেননি। তাই পচে গেছে। শুধু এই ইউনুছ মিয়াই নন, বন্যার কবলে পড়ে জেলার পাঁচটি উপজেলার অনেকে মেহনতি মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন। যতই দিন যাচ্ছে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠছে। লক্ষ্মীপুরে বন্যার প্রভাবে ডায়রিয়া ও চর্মরোগসহ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে ১৩ দিনে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন এক হাজার ৬৭১ জন রোগী। বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ১০০ শয্যার সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১০৪ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী। এদের মধ্যে ৭৩ জনই শিশু।

প্রতিদিনই বন্যাকবলিত এলাকায় পানিবাহিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানায়, সদর হাসপাতাল ও পাঁচটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গত ১৩ দিনে ৯০৫ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হন ১১৮ জন। গত ১৩ দিনে সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিয়েছেন ৫৯৩ জন চর্মরোগী।

এরমধ্যে ২৪ ঘণ্টায় চিকিৎসা নিয়েছেন ২২১ জন। বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভুগছে বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ। গত বৃহস্পতিবার বন্যাকবলিত সদর উপজেলার দিঘলী-মান্দারী এলাকা ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে।সদরের পশ্চিম জামিরতলি গ্রামের বাসিন্দা আবদুর রহিম ও জয়নাল আবেদিন জানান, পুরো এলাকা ৩-৪ ফুট পানিতে নিমজ্জিত। প্রত্যেকটি টিউবওয়েল এখন পানির নিচে। টিউবওয়েল চাপ দিলেই ময়লা পানি উঠে আসে। বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে।

অনেকেই বাজার থেকে পানি কিনে খাচ্ছেন। আবার ত্রাণের সঙ্গে দেয়া পানিও অপ্রতুল। বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দিয়েও আশপাশের টিউবওয়েলের পানি পানে ইচ্ছা করছে না। লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ উজ জামান জানিয়েছেন, বর্তমানে লক্ষ্মীপুরে যে বন্যা হচ্ছে তার বেশিরভাগ অংশই জলাবদ্ধতা থেকে সৃষ্টি হয়েছে। কারণ লক্ষ্মীপুরের বিশাল জনগোষ্ঠী পানিবন্দী হলেও মেঘনা নদীতে পানি নেই। পূর্বাঞ্চল (ওপরের অংশ) থেকে পশ্চিম অংশ (ডাল) মেঘনায় পানি যেতে পথে পথে বাধা রয়েছে। জলাবদ্ধতার মূল কারণ দখলবাজি এবং অপরিকল্পিত উন্নয়ন।

এ কারণে বৃষ্টিপাতের পানি নদীতে নামতে পারেনি। একই সঙ্গে ওই পানিতে যুক্ত হওয়া নোয়াখালী ও ফেনীর বন্যার পানি এসে পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে। আমরা এখন এ অতিরিক্ত পানি নেমে যেতে আমাদের সব খালগুলো এবং সøুইস গেটগুলো ২৪ ঘণ্টা তদারকি করছি।

back to top