গত বছর ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঠেকানোর পরিকল্পনা করেছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকার। ওই কর্মসূচি মোকাবিলা করতে আগের দিন (৪ আগস্ট) দুই দফায় উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধানী প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।বুধবার প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়।
প্রতিবেদনে ৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি দমনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে অবশ্য এ কর্মসূচির নাম লেখা হয়েছে ‘মার্চ অন ঢাকা’।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘সেদিন (৫ আগস্ট) সকাল থেকেই সেনাবাহিনী জানতো, শেখ হাসিনার পতন হয়ে গেছে। কিন্তু পুলিশ জানতো না। তাই পুলিশ তখনও সরকারকে রক্ষা করতে সর্বাত্মকভাবে মাঠে ছিল।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ আগস্ট বিকেলে যখন জনতা শেখ হাসিনার বিদায় উযাপন শুরু করেছিলেন, তখনও কিছু পুলিশ তাদের ওপর প্রাণঘাতী গুলি ছুড়ছিল। হতাহত ব্যক্তিদের মধ্যে বেশ কয়েকটি শিশুও ছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্দোলনরত নেতাদের প্রকাশ্য ঘোষণা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব জানতে পারেন, ৫ আগস্ট ঢাকার কেন্দ্রস্থলে বড় প্রতিবাদ মিছিলের পরিকল্পনা করছেন আন্দোলনকারীরা।
দফায় দফায় বৈঠক
৪ আগস্ট সকালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। অংশগ্রহণকারীদের তথ্যমতে, বৈঠকে সেনা, বিমান, নৌ, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই, পুলিশ ও পুলিশের বিশেষ শাখার প্রধানরা অংশ নেন। বৈঠকে হাসিনা সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিলেন। তারা ‘মার্চ অন ঢাকা’ প্রতিরোধের জন্য আবার কারফিউ জারি ও তা বলবৎ করার বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা দেয়, কোনো বিরতি ছাড়াই অনির্দিষ্টকালের জন্য কঠোর কারফিউ চলবে। আন্দোলনকারীদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী একটি বিবৃতি দেন। তিনি দেশবাসীকে ‘এই সন্ত্রাসীদের শক্ত হাতে দমন’ করার আহ্বান জানান।
৪ আগস্ট সন্ধ্যার পর প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে (গণভবন) আরেকটি বৈঠক হয়। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নিজে অংশ নেন। অন্য অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, র্যাব ও আনসার/ভিডিপির প্রধান, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার ও সেনাবাহিনীর কোয়ার্টারমাস্টার জেনারেল। জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, বৈঠকে সেনাপ্রধান ও অন্যান্য নিরাপত্তা কর্মকর্তা ঢাকা রক্ষার বিষয়ে আবারও প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেছিলেন।
বৈঠকগুলোতে অংশ নেয়া ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, বৈঠকে একটি পরিকল্পনার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছিল যে, প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করে বিক্ষোভকারীদের ঢাকার কেন্দ্রস্থলে প্রবেশে বাধা দিতে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েন করা হবে। সেনাবাহিনী ও বিজিবি সাঁজোয়া যান ও সেনা মোতায়েন করে ঢাকার প্রবেশের পথগুলো অবরুদ্ধ করবে, বিক্ষোভকারীদের প্রবেশে বাধা দেবে। অন্যদিকে পুলিশ ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে নিয়ন্ত্রণ’ করবে।
এসএসএফ ডিজির বার্তা
শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনী স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) তৎকালীন মহাপরিচালক (ডিজি) ৫ আগস্ট প্রথম প্রহরে (রাত ১২টা ৫৫ মিনিট) বিজিবির মহাপরিচালককে পরপর দুটি হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা পাঠান। সেই বার্তাগুলোর হার্ডকপি পেয়েছে ওএইচসিএইচআর।
এই হার্ডকপির তথ্যানুসারে, প্রথমটি ছিল একটি ফরোয়ার্ড করা সম্প্রচারিত বার্তা, যা আন্দোলনের নেতাদের বলে মনে হয়। এতে তারা ঢাকায় প্রবেশের পথগুলো সম্পর্কে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে
জানিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বার্তাটি প্রতিরক্ষা আদেশের রূপরেখার একটি ভিডিও রয়েছে বলে মনে হয়। এতে প্রতিরক্ষার প্রথম ও দ্বিতীয় লাইন, একটি তৃতীয় দূরপাল্লার ইউনিট, একটি ব্যাকআপ ইউনিট, একটি পশ্চাৎ ভাগের বাহিনীর কথা বলা হয়েছে।
৫ আগস্ট সকালে সেনাবাহিনী ও বিজিবির সদস্যরা মূলত দাঁড়িয়েছিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, তারা তাদের ওপর অর্পিত ভূমিকা পালন করেননি।
একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সাক্ষ্য দিয়েছেন, সেনাবাহিনী যে বাহিনী মোতায়েনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেটা তারা মোতায়েন করেনি। আরেকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, বিজিবি প্রতি ঘণ্টায় বিভিন্ন প্রবেশপথ দিয়ে প্রায় ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার বিক্ষোভকারীকে ঢুকতে দিয়েছে, যা তাদের নিয়ন্ত্রণ করার কথা ছিল।
তৃতীয় একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা তখনকার পরিস্থিতি স্মরণ করে বলেছেন, সিসিটিভি ফুটেজে ৫০০ থেকে ৬০০ বিক্ষোভকারীকে সেনাবাহিনীর বাধা ছাড়াই উত্তরা থেকে ঢাকার কেন্দ্রস্থলের দিকে আসতে দেখে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কিছু একটা গড়বড় হচ্ছে। চতুর্থ আরেকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে জানিয়েছিলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না।
প্রাণঘাতী গুলি
‘মার্চ অন ঢাকা’ থামাতে, বিক্ষোভকারীদের শহরের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছাতে বাধা দিতে তখনও পুলিশ অনেক জায়গায় বিক্ষোভকারীদের ওপর প্রাণঘাতী গুলি চালাচ্ছিল। পুলিশের একজন কমান্ডার ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, ‘সেদিন সকাল থেকেই সেনাবাহিনী জানতো, শেখ হাসিনার পতন হয়ে গেছে। কিন্তু পুলিশ জানতো না। তাই, পুলিশ তখনও সরকারকে রক্ষা করতে সর্বাত্মকভাবে মাঠে ছিল।’
ওএইচসিএইচআর বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের গুলি করার ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। সবকটির ধরন ছিল একই। উদাহরণস্বরূপ, চানখাঁরপুলে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের কর্মকর্তারা ও অন্যান্য পুলিশ রাইফেল থেকে প্রাণঘাতী গুলি করেছে। তবে শাহবাগের দিকে অগ্রসর হতে চেষ্টা করা বিক্ষোভকারীদের থামাতে তারা কম প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেছে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, পুলিশ যাকে দেখেছিল, তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছিল।
রামপুরা ব্রিজ পার হয়ে বাড্ডায় যাওয়ার চেষ্টাকালে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে পুলিশ ধাতব গুলি ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। এতে শিক্ষার্থী বিক্ষোভকারীরা আহত হন। ওই এলাকায় সকালে গুলিতে আহত বেশ কয়েকজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
আজমপুরে পুলিশের গুলিতে আহত ১২ বছর বয়সী এক বালক বলেছে, পুলিশ ‘সব জায়গায় বৃষ্টির মতো গুলি চালাচ্ছিল।’ কীভাবে সে ওই স্থানে অন্তত এক ডজন মৃতদেহ দেখেছিল, সেই বর্ণনা করেছিল।
সাভারের আশুলিয়ায় পুলিশ বিক্ষোভকারীদের নিবৃত্ত ও আটক করতে প্রাথমিকভাবে তল্লাশিকেন্দ্র (চেকপোস্ট) বসিয়েছিল। যখন আরও বেশি বিক্ষোভকারী দেখা যায়, তখন অন্তত প্রথম দিকে পুলিশ কম প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেছিল। পরে প্রাণঘাতী গুলি ছোড়ে।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী অন্য আহত বিক্ষোভকারীদের সাহায্য করতে গিয়ে ধাতব গুলিতে আহত হন। আওয়ামী লীগের সমর্থকরাও বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালান।
সাভার বাসস্ট্যান্ডের আশপাশে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালালে এতে বিপুলসংখ্যক হতাহত হন। একজন সাংবাদিক এলাকাটির বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তারা তাকে বলেছিলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের জোর করে মোতায়েন করেছেন। কিন্তু সেই সাধারণ পুলিশ সদস্যরা আরও হতাহতের ঘটনা ঘটাতে চাননি।
ওই এলাকায় গুলি চালানোর ঘটনার আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শীও একটি ছেলের মৃতদেহ দেখেছেন। ছেলেটি ৫ আগস্ট নিহত হয়েছিল। এই প্রত্যক্ষদর্শী ওএইচসিএইচআরকে বলেছেন, ৫ আগস্ট ছিল ‘আমাদের (বিক্ষোভকারীদের) জন্য সবচেয়ে আনন্দের দিন, কিন্তু ছেলেটির মায়ের জন্য সবচেয়ে দুঃখের দিন।’
৫ আগস্ট সকালে যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ ও আনসার সদস্যরা থানা ও এর কর্মকর্তাদের রক্ষায় বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি করার নির্দেশ পান। তারা থানার ভেতর এবং আশপাশে অবস্থান নিয়ে বিপুলসংখ্যক বিক্ষোভকারীর ওপর প্রাণঘাতী রাইফেল ও শটগান দিয়ে গুলি চালায়। এই জনতা ঢাকা মার্চের জন্য জড়ো হয়েছিলেন। তারা থানার কাছে জড়ো হয়েছিলেন।
ঘটনাস্থলে মোতায়েন থাকা কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, কিছু বিক্ষোভকারী পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করছিলেন। বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারী নিহত হন। বহুসংখ্যক আহত হয়। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন অটিস্টিক ব্যক্তিও ছিলেন, তার শরীরে দুটি গুলি লেগেছিল।
ওই এলাকায় মোতায়েন সেনা ইউনিটগুলো বিকেলের দিকে অল্প সময়ের জন্য পরিস্থিতি শান্ত করলেও পরে তারা সরে যায়। কিছুক্ষণ পরে থানার ফটকের বাইরে অবস্থানরত বিক্ষোভকারীদের ওপর একটি সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। তারপর রাইফেল ও শটগান দিয়ে গুলি চালায়।
ভিডিও প্রমাণসহ সাক্ষীর সাক্ষ্যে এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, বাঁচার উপায় খুঁজতে গিয়ে বা পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ কর্মকর্তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বেশ কিছু নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীকে কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করেছেন। পুলিশ জনতাকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালাচ্ছিল।
৫ আগস্ট বিকেলে যখন জনতা শেখ হাসিনার বিদায় উদ্?যাপন শুরু করেছিলেন, তখনও কিছু পুলিশ তাদের ওপর প্রাণঘাতী গুলি ছুড়ছিল। হতাহত ব্যক্তিদের মধ্যে বেশ কয়েকটি শিশুও ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য ও চিকিৎসার নথিতে এই বিষয় নিশ্চিত করা হয়েছে যে উত্তরায় মা-বাবার সঙ্গে ‘বিজয় মিছিলে’ আসা ৬ বছর বয়সী একটি ছেলেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়লে ভিডিও ও ছবিতে আনন্দের মুহূর্তগুলো দেখা যায়।
তবে সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলির শব্দে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, যার ফলে জনতা পালিয়ে যায়। শিশুটির ঊরুতে গুলি লেগেছিল। পরে আহতাবস্থায় হাসপাতালে সে মারা যায়।
শিশুটিকে কে গুলি করেছে, তা দেখতে পাননি প্রত্যক্ষদর্শীরা। তবে একজন প্রত্যক্ষদর্শী একটি বিশৃঙ্খল দৃশ্যের বর্ণনা দিয়েছেন। সেখানে নিরাপত্তা বাহিনী সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করছিলে। তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সমর্থকরা থাকতে পারেন বলে ধারণা করা হয়।
কাছাকাছি একটি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন স্টেশন ছিল। এক প্রত্যক্ষদর্শী বর্ণনা দিয়েছেন, কীভাবে কর্মকর্তারা বিক্ষোভ মিছিলের দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম দিকে অবস্থান নিয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিটি অন্যান্য লোকজনকে আহত হতে, রাস্তায় পড়ে যেতে দেখেছেন। এর মধ্যে মাথায় গুলিবিদ্ধ আরেকটি ছেলে ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষ্য ও চিকিৎসা-সংক্রান্ত তথ্যানুযায়ী, মিরপুরে উদ্যাপনকালে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ১২ বছর বয়সী একটি ছেলে নিহত হয়। ৫ আগস্ট বিকেলে বিক্ষোভকারীরা আশুলিয়া থানাকে নিশানা করলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বিপুলসংখ্যক জনতা থানাটি ঘেরাও করে। পুলিশ বারবার পিছু হটার চেষ্টা করলেও তারা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে করতে অগ্রসর হতে থাকে। জবাবে পুলিশ প্রাণঘাতী গুলিভর্তি সামরিক রাইফেল ব্যবহার করে নির্বিচার গুলি চালায়।
পুলিশ যখন নিজেদের সরে যাওয়ার পথ পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছিল, তখন এলোপাতাড়ি গুলি চলছিল। বিশেষভাবে সহিংস ব্যক্তিদের নিশানা করার পরিবর্তে জনতাকে ভয় দেখানোর জন্য তা বেশি করে করা হচ্ছিল বলে মনে হয়।
এর ফলে বিক্ষোভকারী ও পথচারীদের মধ্যে হতাহতের ঘটনা ঘটে। ১৬ বছর বয়সী এক ছাত্রকে খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়, তার মেরুদণ্ডে গুরুতর আঘাত লেগেছিল, তাকে অবশ করে দেয়।
ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশে পুলিশ পরে গুলিবিদ্ধ মৃতদেহগুলো একটি ভ্যানে স্তূপ করে। তারা গাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মনে হচ্ছিল, তারা কাজটি করেছে এই আশায় যে, মরদেহ পোড়ানোর বিষয়টি এই মিথ্যা ধারণা তৈরি করবে যে, এসব লোক আন্দোলনকারীদের হাতে নিহত হয়েছেন।
৫ আগস্ট বিকেলে গাজীপুরে ১৪ বছর বয়সী একটি ছেলেকে ইচ্ছাকৃতভাবে গুলিকরে পঙ্গু করা হয়েছিল। ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার বিক্ষোভকারীর মূলত একটি শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিল করার সময় তার ডান হাতে গুলি করা হয়েছিল।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, বিক্ষোভকারীরা নিরস্ত্র ছিলেন। তারা কোনো গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করেননি। নিরাপত্তা বাহিনী কোনো সতর্কতা ছাড়াই গুলি চালাতে শুরু করলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়। আনসার ফটকের কাছের রাস্তা অবরোধকারী জনতা আতঙ্কিত হয়ে পালিয়ে যান।
ফরেনসিক প্রমাণে দেখা যায়, ছেলেটিকে শটগানের পেলেট দিয়ে খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছিল। পাথর নিক্ষেপের অভিযোগে তাকে শায়েস্তা করার লক্ষ্য ছিল বন্দুকধারীর। তিনি বলেছিল, ‘তুমি আর পাথর ছুড়তে এই হাত ব্যবহার করতে পারবে না।’ ভুক্তভোগীর ডান হাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৪০টির বেশি শটগানের প্লেটে বিদ্ধ হয়। হাড় ও কোষের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়।
আরেকটি ঘটনা ঘটেছে গাজীপুরে। সেখানে পুলিশ কর্মকর্তারা একজন নিরস্ত্র রিকশাচালককে আটক করে তাকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করেন। পুলিশ মরদেহটি টেনে নিয়ে যায়। তারা সেই মরদেহটি আর ফেরত দেয়নি। পরিবার তাদের প্রিয়জনকে দাফন করতে, শোক পালন করতে পারেনি।
ওই রিকশাচালককে গুলি করা পুলিশ কর্মকর্তাকে গত সেপ্টেম্বরে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভুক্তভোগী ব্যক্তির পরিবারের এক সদস্য ওএইচসিএইচআর-এর কাছে আবেদন জানিয়ে বলেছেন, ‘আমি ন্যায়বিচার, স্বাধীন তদন্ত ও মরদেহ ফেরত চাই।’
বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
গত বছর ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঠেকানোর পরিকল্পনা করেছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকার। ওই কর্মসূচি মোকাবিলা করতে আগের দিন (৪ আগস্ট) দুই দফায় উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধানী প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।বুধবার প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়।
প্রতিবেদনে ৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি দমনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে অবশ্য এ কর্মসূচির নাম লেখা হয়েছে ‘মার্চ অন ঢাকা’।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘সেদিন (৫ আগস্ট) সকাল থেকেই সেনাবাহিনী জানতো, শেখ হাসিনার পতন হয়ে গেছে। কিন্তু পুলিশ জানতো না। তাই পুলিশ তখনও সরকারকে রক্ষা করতে সর্বাত্মকভাবে মাঠে ছিল।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ আগস্ট বিকেলে যখন জনতা শেখ হাসিনার বিদায় উযাপন শুরু করেছিলেন, তখনও কিছু পুলিশ তাদের ওপর প্রাণঘাতী গুলি ছুড়ছিল। হতাহত ব্যক্তিদের মধ্যে বেশ কয়েকটি শিশুও ছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্দোলনরত নেতাদের প্রকাশ্য ঘোষণা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব জানতে পারেন, ৫ আগস্ট ঢাকার কেন্দ্রস্থলে বড় প্রতিবাদ মিছিলের পরিকল্পনা করছেন আন্দোলনকারীরা।
দফায় দফায় বৈঠক
৪ আগস্ট সকালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। অংশগ্রহণকারীদের তথ্যমতে, বৈঠকে সেনা, বিমান, নৌ, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই, পুলিশ ও পুলিশের বিশেষ শাখার প্রধানরা অংশ নেন। বৈঠকে হাসিনা সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিলেন। তারা ‘মার্চ অন ঢাকা’ প্রতিরোধের জন্য আবার কারফিউ জারি ও তা বলবৎ করার বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা দেয়, কোনো বিরতি ছাড়াই অনির্দিষ্টকালের জন্য কঠোর কারফিউ চলবে। আন্দোলনকারীদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী একটি বিবৃতি দেন। তিনি দেশবাসীকে ‘এই সন্ত্রাসীদের শক্ত হাতে দমন’ করার আহ্বান জানান।
৪ আগস্ট সন্ধ্যার পর প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে (গণভবন) আরেকটি বৈঠক হয়। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নিজে অংশ নেন। অন্য অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, র্যাব ও আনসার/ভিডিপির প্রধান, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার ও সেনাবাহিনীর কোয়ার্টারমাস্টার জেনারেল। জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, বৈঠকে সেনাপ্রধান ও অন্যান্য নিরাপত্তা কর্মকর্তা ঢাকা রক্ষার বিষয়ে আবারও প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেছিলেন।
বৈঠকগুলোতে অংশ নেয়া ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, বৈঠকে একটি পরিকল্পনার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছিল যে, প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করে বিক্ষোভকারীদের ঢাকার কেন্দ্রস্থলে প্রবেশে বাধা দিতে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েন করা হবে। সেনাবাহিনী ও বিজিবি সাঁজোয়া যান ও সেনা মোতায়েন করে ঢাকার প্রবেশের পথগুলো অবরুদ্ধ করবে, বিক্ষোভকারীদের প্রবেশে বাধা দেবে। অন্যদিকে পুলিশ ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে নিয়ন্ত্রণ’ করবে।
এসএসএফ ডিজির বার্তা
শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনী স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) তৎকালীন মহাপরিচালক (ডিজি) ৫ আগস্ট প্রথম প্রহরে (রাত ১২টা ৫৫ মিনিট) বিজিবির মহাপরিচালককে পরপর দুটি হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা পাঠান। সেই বার্তাগুলোর হার্ডকপি পেয়েছে ওএইচসিএইচআর।
এই হার্ডকপির তথ্যানুসারে, প্রথমটি ছিল একটি ফরোয়ার্ড করা সম্প্রচারিত বার্তা, যা আন্দোলনের নেতাদের বলে মনে হয়। এতে তারা ঢাকায় প্রবেশের পথগুলো সম্পর্কে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে
জানিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বার্তাটি প্রতিরক্ষা আদেশের রূপরেখার একটি ভিডিও রয়েছে বলে মনে হয়। এতে প্রতিরক্ষার প্রথম ও দ্বিতীয় লাইন, একটি তৃতীয় দূরপাল্লার ইউনিট, একটি ব্যাকআপ ইউনিট, একটি পশ্চাৎ ভাগের বাহিনীর কথা বলা হয়েছে।
৫ আগস্ট সকালে সেনাবাহিনী ও বিজিবির সদস্যরা মূলত দাঁড়িয়েছিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, তারা তাদের ওপর অর্পিত ভূমিকা পালন করেননি।
একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সাক্ষ্য দিয়েছেন, সেনাবাহিনী যে বাহিনী মোতায়েনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেটা তারা মোতায়েন করেনি। আরেকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, বিজিবি প্রতি ঘণ্টায় বিভিন্ন প্রবেশপথ দিয়ে প্রায় ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার বিক্ষোভকারীকে ঢুকতে দিয়েছে, যা তাদের নিয়ন্ত্রণ করার কথা ছিল।
তৃতীয় একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা তখনকার পরিস্থিতি স্মরণ করে বলেছেন, সিসিটিভি ফুটেজে ৫০০ থেকে ৬০০ বিক্ষোভকারীকে সেনাবাহিনীর বাধা ছাড়াই উত্তরা থেকে ঢাকার কেন্দ্রস্থলের দিকে আসতে দেখে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কিছু একটা গড়বড় হচ্ছে। চতুর্থ আরেকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে জানিয়েছিলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না।
প্রাণঘাতী গুলি
‘মার্চ অন ঢাকা’ থামাতে, বিক্ষোভকারীদের শহরের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছাতে বাধা দিতে তখনও পুলিশ অনেক জায়গায় বিক্ষোভকারীদের ওপর প্রাণঘাতী গুলি চালাচ্ছিল। পুলিশের একজন কমান্ডার ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, ‘সেদিন সকাল থেকেই সেনাবাহিনী জানতো, শেখ হাসিনার পতন হয়ে গেছে। কিন্তু পুলিশ জানতো না। তাই, পুলিশ তখনও সরকারকে রক্ষা করতে সর্বাত্মকভাবে মাঠে ছিল।’
ওএইচসিএইচআর বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের গুলি করার ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। সবকটির ধরন ছিল একই। উদাহরণস্বরূপ, চানখাঁরপুলে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের কর্মকর্তারা ও অন্যান্য পুলিশ রাইফেল থেকে প্রাণঘাতী গুলি করেছে। তবে শাহবাগের দিকে অগ্রসর হতে চেষ্টা করা বিক্ষোভকারীদের থামাতে তারা কম প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেছে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, পুলিশ যাকে দেখেছিল, তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছিল।
রামপুরা ব্রিজ পার হয়ে বাড্ডায় যাওয়ার চেষ্টাকালে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে পুলিশ ধাতব গুলি ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। এতে শিক্ষার্থী বিক্ষোভকারীরা আহত হন। ওই এলাকায় সকালে গুলিতে আহত বেশ কয়েকজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
আজমপুরে পুলিশের গুলিতে আহত ১২ বছর বয়সী এক বালক বলেছে, পুলিশ ‘সব জায়গায় বৃষ্টির মতো গুলি চালাচ্ছিল।’ কীভাবে সে ওই স্থানে অন্তত এক ডজন মৃতদেহ দেখেছিল, সেই বর্ণনা করেছিল।
সাভারের আশুলিয়ায় পুলিশ বিক্ষোভকারীদের নিবৃত্ত ও আটক করতে প্রাথমিকভাবে তল্লাশিকেন্দ্র (চেকপোস্ট) বসিয়েছিল। যখন আরও বেশি বিক্ষোভকারী দেখা যায়, তখন অন্তত প্রথম দিকে পুলিশ কম প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেছিল। পরে প্রাণঘাতী গুলি ছোড়ে।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী অন্য আহত বিক্ষোভকারীদের সাহায্য করতে গিয়ে ধাতব গুলিতে আহত হন। আওয়ামী লীগের সমর্থকরাও বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালান।
সাভার বাসস্ট্যান্ডের আশপাশে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালালে এতে বিপুলসংখ্যক হতাহত হন। একজন সাংবাদিক এলাকাটির বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তারা তাকে বলেছিলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের জোর করে মোতায়েন করেছেন। কিন্তু সেই সাধারণ পুলিশ সদস্যরা আরও হতাহতের ঘটনা ঘটাতে চাননি।
ওই এলাকায় গুলি চালানোর ঘটনার আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শীও একটি ছেলের মৃতদেহ দেখেছেন। ছেলেটি ৫ আগস্ট নিহত হয়েছিল। এই প্রত্যক্ষদর্শী ওএইচসিএইচআরকে বলেছেন, ৫ আগস্ট ছিল ‘আমাদের (বিক্ষোভকারীদের) জন্য সবচেয়ে আনন্দের দিন, কিন্তু ছেলেটির মায়ের জন্য সবচেয়ে দুঃখের দিন।’
৫ আগস্ট সকালে যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ ও আনসার সদস্যরা থানা ও এর কর্মকর্তাদের রক্ষায় বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি করার নির্দেশ পান। তারা থানার ভেতর এবং আশপাশে অবস্থান নিয়ে বিপুলসংখ্যক বিক্ষোভকারীর ওপর প্রাণঘাতী রাইফেল ও শটগান দিয়ে গুলি চালায়। এই জনতা ঢাকা মার্চের জন্য জড়ো হয়েছিলেন। তারা থানার কাছে জড়ো হয়েছিলেন।
ঘটনাস্থলে মোতায়েন থাকা কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, কিছু বিক্ষোভকারী পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করছিলেন। বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারী নিহত হন। বহুসংখ্যক আহত হয়। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন অটিস্টিক ব্যক্তিও ছিলেন, তার শরীরে দুটি গুলি লেগেছিল।
ওই এলাকায় মোতায়েন সেনা ইউনিটগুলো বিকেলের দিকে অল্প সময়ের জন্য পরিস্থিতি শান্ত করলেও পরে তারা সরে যায়। কিছুক্ষণ পরে থানার ফটকের বাইরে অবস্থানরত বিক্ষোভকারীদের ওপর একটি সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। তারপর রাইফেল ও শটগান দিয়ে গুলি চালায়।
ভিডিও প্রমাণসহ সাক্ষীর সাক্ষ্যে এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, বাঁচার উপায় খুঁজতে গিয়ে বা পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ কর্মকর্তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বেশ কিছু নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীকে কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করেছেন। পুলিশ জনতাকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালাচ্ছিল।
৫ আগস্ট বিকেলে যখন জনতা শেখ হাসিনার বিদায় উদ্?যাপন শুরু করেছিলেন, তখনও কিছু পুলিশ তাদের ওপর প্রাণঘাতী গুলি ছুড়ছিল। হতাহত ব্যক্তিদের মধ্যে বেশ কয়েকটি শিশুও ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য ও চিকিৎসার নথিতে এই বিষয় নিশ্চিত করা হয়েছে যে উত্তরায় মা-বাবার সঙ্গে ‘বিজয় মিছিলে’ আসা ৬ বছর বয়সী একটি ছেলেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়লে ভিডিও ও ছবিতে আনন্দের মুহূর্তগুলো দেখা যায়।
তবে সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলির শব্দে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, যার ফলে জনতা পালিয়ে যায়। শিশুটির ঊরুতে গুলি লেগেছিল। পরে আহতাবস্থায় হাসপাতালে সে মারা যায়।
শিশুটিকে কে গুলি করেছে, তা দেখতে পাননি প্রত্যক্ষদর্শীরা। তবে একজন প্রত্যক্ষদর্শী একটি বিশৃঙ্খল দৃশ্যের বর্ণনা দিয়েছেন। সেখানে নিরাপত্তা বাহিনী সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করছিলে। তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সমর্থকরা থাকতে পারেন বলে ধারণা করা হয়।
কাছাকাছি একটি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন স্টেশন ছিল। এক প্রত্যক্ষদর্শী বর্ণনা দিয়েছেন, কীভাবে কর্মকর্তারা বিক্ষোভ মিছিলের দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম দিকে অবস্থান নিয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিটি অন্যান্য লোকজনকে আহত হতে, রাস্তায় পড়ে যেতে দেখেছেন। এর মধ্যে মাথায় গুলিবিদ্ধ আরেকটি ছেলে ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষ্য ও চিকিৎসা-সংক্রান্ত তথ্যানুযায়ী, মিরপুরে উদ্যাপনকালে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ১২ বছর বয়সী একটি ছেলে নিহত হয়। ৫ আগস্ট বিকেলে বিক্ষোভকারীরা আশুলিয়া থানাকে নিশানা করলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বিপুলসংখ্যক জনতা থানাটি ঘেরাও করে। পুলিশ বারবার পিছু হটার চেষ্টা করলেও তারা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে করতে অগ্রসর হতে থাকে। জবাবে পুলিশ প্রাণঘাতী গুলিভর্তি সামরিক রাইফেল ব্যবহার করে নির্বিচার গুলি চালায়।
পুলিশ যখন নিজেদের সরে যাওয়ার পথ পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছিল, তখন এলোপাতাড়ি গুলি চলছিল। বিশেষভাবে সহিংস ব্যক্তিদের নিশানা করার পরিবর্তে জনতাকে ভয় দেখানোর জন্য তা বেশি করে করা হচ্ছিল বলে মনে হয়।
এর ফলে বিক্ষোভকারী ও পথচারীদের মধ্যে হতাহতের ঘটনা ঘটে। ১৬ বছর বয়সী এক ছাত্রকে খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়, তার মেরুদণ্ডে গুরুতর আঘাত লেগেছিল, তাকে অবশ করে দেয়।
ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশে পুলিশ পরে গুলিবিদ্ধ মৃতদেহগুলো একটি ভ্যানে স্তূপ করে। তারা গাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মনে হচ্ছিল, তারা কাজটি করেছে এই আশায় যে, মরদেহ পোড়ানোর বিষয়টি এই মিথ্যা ধারণা তৈরি করবে যে, এসব লোক আন্দোলনকারীদের হাতে নিহত হয়েছেন।
৫ আগস্ট বিকেলে গাজীপুরে ১৪ বছর বয়সী একটি ছেলেকে ইচ্ছাকৃতভাবে গুলিকরে পঙ্গু করা হয়েছিল। ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার বিক্ষোভকারীর মূলত একটি শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিল করার সময় তার ডান হাতে গুলি করা হয়েছিল।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, বিক্ষোভকারীরা নিরস্ত্র ছিলেন। তারা কোনো গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করেননি। নিরাপত্তা বাহিনী কোনো সতর্কতা ছাড়াই গুলি চালাতে শুরু করলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়। আনসার ফটকের কাছের রাস্তা অবরোধকারী জনতা আতঙ্কিত হয়ে পালিয়ে যান।
ফরেনসিক প্রমাণে দেখা যায়, ছেলেটিকে শটগানের পেলেট দিয়ে খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছিল। পাথর নিক্ষেপের অভিযোগে তাকে শায়েস্তা করার লক্ষ্য ছিল বন্দুকধারীর। তিনি বলেছিল, ‘তুমি আর পাথর ছুড়তে এই হাত ব্যবহার করতে পারবে না।’ ভুক্তভোগীর ডান হাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৪০টির বেশি শটগানের প্লেটে বিদ্ধ হয়। হাড় ও কোষের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়।
আরেকটি ঘটনা ঘটেছে গাজীপুরে। সেখানে পুলিশ কর্মকর্তারা একজন নিরস্ত্র রিকশাচালককে আটক করে তাকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করেন। পুলিশ মরদেহটি টেনে নিয়ে যায়। তারা সেই মরদেহটি আর ফেরত দেয়নি। পরিবার তাদের প্রিয়জনকে দাফন করতে, শোক পালন করতে পারেনি।
ওই রিকশাচালককে গুলি করা পুলিশ কর্মকর্তাকে গত সেপ্টেম্বরে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভুক্তভোগী ব্যক্তির পরিবারের এক সদস্য ওএইচসিএইচআর-এর কাছে আবেদন জানিয়ে বলেছেন, ‘আমি ন্যায়বিচার, স্বাধীন তদন্ত ও মরদেহ ফেরত চাই।’