দেশে বিদ্যুৎ, শিল্প ও পরিবহন খাতে প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানিতে ডলার সংকট কাটছেই না। এই প্রেক্ষাপটে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দেশীয় জ্বালানি উত্তোলনের ওপর জোর দিতে চাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এজন্য দেশীয় গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে কূপ খননের পাশপাশি কয়লা উত্তোলনের বিষয়েও আলোচনা চলছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বিষয়ে আলোচনা চলছে। এ বিষয়ে জার্মানির একটি কোম্পানি আগ্রহ দেখিয়েছে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে সংবাদকে বলেন, দেশে জ্বালানির চাহিদা মেটানো হচ্ছে এলএনজির পাশাপাশি কয়লাও আমদানি করতে হচ্ছে। এতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলো থেকে আসছে অর্ধেকের (৫০ শতাংশ) মতো। এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি করে ২৫ শতাংশ জোগান দেয়া হচ্ছে। দৈনিক ২৫ শতাংশ ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে।’ এর নেতিবাচক
প্রভাব পড়ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে শিল্প উৎপাদন পর্যন্ত। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনীতি।
ভর্তুকি হাজার কোটি
জ্বালানি সচিব বলেন, ‘গ্যাস মূলত আমরা শিল্প ও বিদ্যুতে দেয়ার বিষয়ে জোর দিচ্ছি। এলএনজি আমদানির পর মিশ্রিত গ্যাসের দর পড়ছে ৩০ টাকার মতো। আর বিক্রি করা হচ্ছে ২২.৮৭ টাকা হারে। এতে বর্তমানে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে।’ তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন খরচ বেশি উল্লেখ করে সচিব বলেন, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে কম খরচ হয় গ্যাসে। এরপর খরচ কম হয় কয়লায়।’ তিনি বলেন, ‘কয়লা বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানো গেলে এলএনজি আমদানির চাপ কমতো। দেশীয় কয়লা ব্যবহার করতে পারলে একটা বড় অঙ্কের ডলার সাশ্রয় হতো। মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ফুলবাড়ীতে কয়লার মজুদ আছে। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তা তোলার বিষয়ে আলোচনা চলছে। স্থানীয়দের জনমত গঠনের চেষ্টা করা হচ্ছে। শিগিরই এ বিষয়ে বড় পরিসরে সেমিনারের আয়োজন করা হবে।’ বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির কার্যক্রম বছরখানেকের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে উল্লেখ করে জ্বালানি সচিব বলেন, ‘তখন খনির কাছে অবস্থিত বড়পুকুরিয়ায় স্বল্পমূল্যের বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে আমাদের অতিরিক্ত কয়লার প্রয়োজন হবে। ফুলবাড়ী থেকে বড়পুকুরিয়া অনেক কাছে। ফুলবাড়ীর কয়লা পেলে কেন্দ্রটি চালাতে সহজ হবে।’
*বিরোধিতা, বিতর্ক*
উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক বিরোধিতা এবং বিতর্ক আছে। এ পদ্ধতিতে কয়লা তুললে তা ফসলি জমি, জনবসতি, পানিসম্পদ ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে বলে সতর্ক করে আসছেন বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা।
২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের আমলে ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত কয়লা খনির বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। ওই আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে স্থানীয় তিন তরুণ নিহত হওয়ার পাশাপাশি দুই শতাধিক আন্দোলনকারী আহত হন। তখন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ওই আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে আন্দোলনকারীদের পক্ষ নেন।
তবে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে আনার পাশাপাশি জ্বালানি সংকট নিরসনের কারণ দেখিয়ে দেশীয় খনি- ফুলবাড়ী, দীঘিপাড়া ও খালাশপীর থেকে কয়লা উত্তোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। ২০২৪ সালের শুরুর দিকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার বিষয়ে আলোচনা চলছিল। ফুলবাড়ী আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের তৎকালীন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ এবং বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সাবেক এই সদস্যসচিব। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার বিষয়ে গত বছরের শুরুতে আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা প্রসঙ্গে তখন আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘উন্মুক্ত পদ্ধতির বিরুদ্ধে ফুলবাড়ীতে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছিল। ছয় দফা চুক্তি সই হয়েছিল তৎকালীন (বিএনপি) সরকারের সঙ্গে। সেই চুক্তিতে পরিষ্কার একটা ধারা ছিল যে, প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশের জন্য বাংলাদেশের কোথাও উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন হবে না।’ আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘সেই চুক্তি সই করেছিল তৎকালীন বিএনপি সরকার এবং তা পূর্ণ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর শেখ হাসিনা একাধিকবার বলেছেন যে উন্মুক্ত খনি দেশের কৃষি, পানিসম্পদ, প্রাণ-প্রকৃতি ইত্যাদির জন্য গ্রহণযোগ্য না।’
*বিশেষজ্ঞ কমিটি*
এই অর্থনীতিবিদ জানান, ২০০৬ সালে একটি এবং ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি উন্মুক্ত খনির বিরুদ্ধে মত দিয়েছিল। আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘দুই কমিটির কোনোটিই এই উন্মুক্ত খনি প্রকল্পের বিষয়টি অনুমোদন করেনি। প্রত্যেকের রিপোর্ট থেকে যেটা এসেছে- এশিয়া এনার্জি (বর্তমান জিসিএম) তখন উন্মুক্ত খনির যে প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল, তা বাংলাদেশের জন্য আর্থিকভাবে খুবই লোকসান হবে, পরিবেশগতভাবে ধ্বংসাত্মক হবে এবং জ্বালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও এটা সহায়ক হবে না। তারা (দুটো কমিটি) এই প্রকল্পটি পুরো বাতিল করার কথা বলেছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষ কয়লা কোম্পানি জিএইচপি ফুলবাড়ীতে স্টাডি করে দেখতে পায় যে এখানে পানির স্তর, আবাদি জমি এবং ঘন জনবসতির যে প্রেক্ষাপটটা আছে, তাতে এখানে উন্মুক্ত খনি করতে গেলে যে ডিজাস্টার হবে, সেটা তাদের পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। তাদের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়বে। সুতরাং কাজ করতে এসেও তারা তখন চলে যায়।’
*কৃষি জমি, পানিসম্পদ*
ফুলবাড়ীতে কয়লা তোলার বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘কয়লা উত্তোলন করার ব্যাপারে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু উন্মুক্ত পদ্ধতি হচ্ছে পুরোপুরি ডিজাস্টার। এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য।’ তার মতে, ‘কৃষিজমি হলো নবায়নযোগ্য সম্পদ। কিন্তু কয়লা তা নয়। কৃষিজমি খাদ্য জোগায়, সম্পদ তৈরি করে। উন্মুক্ত পদ্ধতি মানে হলো এই সম্পদ ধ্বংস করে, এর ভেতরের পানিসম্পদ ধ্বংস করে কয়লা তুলে আনা। এতে কৃষিজমিও আর রিকভার করা যাবে না।’
*কয়লার মজুদ*
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দেশে এ পর্যন্ত ৫টি কয়লাক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব খনিতে সম্ভাব্য মজুদের পরিমাণ প্রায় ৭ হাজার ৮২৩ মিলিয়ন টন। এই বিপুল কয়লা দিয়ে কয়েক যুগ পর্যন্ত দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালানো সম্ভব। তবে এ পর্যন্ত বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি ছাড়া অন্য কোনো খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করেনি সরকার।
ফুলবাড়ী: খনিজসম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ১৯৯৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার কোম্পানি বিএইচপি মিনারেলস দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে কয়লা খনি আবিষ্কার করে। এই কয়লাখনিতে ৫৭২ মিলিয়ন টন কয়লা মজুদ রয়েছে। পেট্রোবাংলার একটি প্রতিবেদন বলছে, প্রতিবছর তিন মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন হিসেবে আগামী ৩০ বছরে এই খনি থেকে ৯০ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করা যাবে।
বড়পুকুরিয়া: দিনাজপুরের পার্বতীপুরে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি আবিষ্কার হয় ১৯৮৫ সালে। খনিটিতে ৪১০ মিলিয়ন টন কয়লা মজুদের কথা জানানো হয়েছিল। ২০০৫ সাল থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে এই খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। বিসিএমসিএলের (বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এই পদ্ধতিতে খনি থেকে খুব বেশি কয়লা ওঠানো যায় না। সর্বোচ্চ দশ ভাগ তোলা যায়, নব্বইভাগই থেকে যায়। গত চব্বিশ বছরে (২০০৫-২০২৩) এখান থেকে মোট কয়লা উত্তোলন করা হয়েছে ১৩.৮৯ মিলিয়ন টন। কর্মকর্তাদের দাবি, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে অনেক বেশি কয়লা তোলা যায়। মন্ত্রণালয়ের কাছে এ সংক্রান্ত প্রস্তাবও দেয়া আছে। বর্তমানে যে পরিমাণ কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে তা বড়পুকুরিয়ার ৬২৫ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাহিদার তুলনায় কম। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ৩টি ইউনিট চালু রেখে স্বাভাবিক উৎপাদনের জন্য দৈনিক প্রায় ৪ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন কয়লার প্রয়োজন।
বর্তমানে বড়পুকুরিয়া খনিটির ১৩৫০ ফেইজ থেকে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। দৈনিক গড়ে আড়াই থেকে তিন হাজার টন কয়লা উৎপাদন হয় এই ফেইজ থেকে। আগামী জুন পর্যন্ত এই ফেইজ থেকে কয়লা উৎপাদন করা যাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এরপর পরবর্তী ফেইজের কার্যক্রম। জানা গেছে, ২০২৭ সালের পর বিসিএমসিএলের কয়লা উত্তোলনের অনুমোদিত কোনো পরিকল্পনা নেই।
নবাবগঞ্জ: দিনাজপুরের নবাবগঞ্জে ১৯৯৫ সালে দীঘিপাড়া কয়লাখনি আবিষ্কৃত হয়। সেই খনিতে প্রায় ৭০৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা মজুদ রয়েছে।
খালাসপীর: রংপুরের পীরগঞ্জের খালাসপীর এলাকায় ১৯৮৯ সালে আরেকটি কয়লাখনি আবিষ্কার হয়। এই খনিতে প্রায় ৬৮৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লার সম্ভাব্য মজুদ রয়েছে।
জামালগঞ্জ: জয়পুরহাটে জামালগঞ্জ খনি আবিষ্কার করা হয় ১৯৬২ সালে। এই খনিতে একটি বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, এখানে প্রায় ৫৪৫০ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লার মজুদ রয়েছে।
মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
দেশে বিদ্যুৎ, শিল্প ও পরিবহন খাতে প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানিতে ডলার সংকট কাটছেই না। এই প্রেক্ষাপটে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দেশীয় জ্বালানি উত্তোলনের ওপর জোর দিতে চাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এজন্য দেশীয় গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে কূপ খননের পাশপাশি কয়লা উত্তোলনের বিষয়েও আলোচনা চলছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বিষয়ে আলোচনা চলছে। এ বিষয়ে জার্মানির একটি কোম্পানি আগ্রহ দেখিয়েছে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে সংবাদকে বলেন, দেশে জ্বালানির চাহিদা মেটানো হচ্ছে এলএনজির পাশাপাশি কয়লাও আমদানি করতে হচ্ছে। এতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলো থেকে আসছে অর্ধেকের (৫০ শতাংশ) মতো। এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি করে ২৫ শতাংশ জোগান দেয়া হচ্ছে। দৈনিক ২৫ শতাংশ ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে।’ এর নেতিবাচক
প্রভাব পড়ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে শিল্প উৎপাদন পর্যন্ত। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনীতি।
ভর্তুকি হাজার কোটি
জ্বালানি সচিব বলেন, ‘গ্যাস মূলত আমরা শিল্প ও বিদ্যুতে দেয়ার বিষয়ে জোর দিচ্ছি। এলএনজি আমদানির পর মিশ্রিত গ্যাসের দর পড়ছে ৩০ টাকার মতো। আর বিক্রি করা হচ্ছে ২২.৮৭ টাকা হারে। এতে বর্তমানে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে।’ তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন খরচ বেশি উল্লেখ করে সচিব বলেন, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে কম খরচ হয় গ্যাসে। এরপর খরচ কম হয় কয়লায়।’ তিনি বলেন, ‘কয়লা বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানো গেলে এলএনজি আমদানির চাপ কমতো। দেশীয় কয়লা ব্যবহার করতে পারলে একটা বড় অঙ্কের ডলার সাশ্রয় হতো। মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ফুলবাড়ীতে কয়লার মজুদ আছে। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তা তোলার বিষয়ে আলোচনা চলছে। স্থানীয়দের জনমত গঠনের চেষ্টা করা হচ্ছে। শিগিরই এ বিষয়ে বড় পরিসরে সেমিনারের আয়োজন করা হবে।’ বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির কার্যক্রম বছরখানেকের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে উল্লেখ করে জ্বালানি সচিব বলেন, ‘তখন খনির কাছে অবস্থিত বড়পুকুরিয়ায় স্বল্পমূল্যের বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে আমাদের অতিরিক্ত কয়লার প্রয়োজন হবে। ফুলবাড়ী থেকে বড়পুকুরিয়া অনেক কাছে। ফুলবাড়ীর কয়লা পেলে কেন্দ্রটি চালাতে সহজ হবে।’
*বিরোধিতা, বিতর্ক*
উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক বিরোধিতা এবং বিতর্ক আছে। এ পদ্ধতিতে কয়লা তুললে তা ফসলি জমি, জনবসতি, পানিসম্পদ ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে বলে সতর্ক করে আসছেন বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা।
২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের আমলে ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত কয়লা খনির বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। ওই আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে স্থানীয় তিন তরুণ নিহত হওয়ার পাশাপাশি দুই শতাধিক আন্দোলনকারী আহত হন। তখন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ওই আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে আন্দোলনকারীদের পক্ষ নেন।
তবে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে আনার পাশাপাশি জ্বালানি সংকট নিরসনের কারণ দেখিয়ে দেশীয় খনি- ফুলবাড়ী, দীঘিপাড়া ও খালাশপীর থেকে কয়লা উত্তোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। ২০২৪ সালের শুরুর দিকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার বিষয়ে আলোচনা চলছিল। ফুলবাড়ী আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের তৎকালীন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ এবং বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সাবেক এই সদস্যসচিব। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার বিষয়ে গত বছরের শুরুতে আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা প্রসঙ্গে তখন আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘উন্মুক্ত পদ্ধতির বিরুদ্ধে ফুলবাড়ীতে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছিল। ছয় দফা চুক্তি সই হয়েছিল তৎকালীন (বিএনপি) সরকারের সঙ্গে। সেই চুক্তিতে পরিষ্কার একটা ধারা ছিল যে, প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশের জন্য বাংলাদেশের কোথাও উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন হবে না।’ আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘সেই চুক্তি সই করেছিল তৎকালীন বিএনপি সরকার এবং তা পূর্ণ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর শেখ হাসিনা একাধিকবার বলেছেন যে উন্মুক্ত খনি দেশের কৃষি, পানিসম্পদ, প্রাণ-প্রকৃতি ইত্যাদির জন্য গ্রহণযোগ্য না।’
*বিশেষজ্ঞ কমিটি*
এই অর্থনীতিবিদ জানান, ২০০৬ সালে একটি এবং ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি উন্মুক্ত খনির বিরুদ্ধে মত দিয়েছিল। আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘দুই কমিটির কোনোটিই এই উন্মুক্ত খনি প্রকল্পের বিষয়টি অনুমোদন করেনি। প্রত্যেকের রিপোর্ট থেকে যেটা এসেছে- এশিয়া এনার্জি (বর্তমান জিসিএম) তখন উন্মুক্ত খনির যে প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল, তা বাংলাদেশের জন্য আর্থিকভাবে খুবই লোকসান হবে, পরিবেশগতভাবে ধ্বংসাত্মক হবে এবং জ্বালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও এটা সহায়ক হবে না। তারা (দুটো কমিটি) এই প্রকল্পটি পুরো বাতিল করার কথা বলেছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষ কয়লা কোম্পানি জিএইচপি ফুলবাড়ীতে স্টাডি করে দেখতে পায় যে এখানে পানির স্তর, আবাদি জমি এবং ঘন জনবসতির যে প্রেক্ষাপটটা আছে, তাতে এখানে উন্মুক্ত খনি করতে গেলে যে ডিজাস্টার হবে, সেটা তাদের পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। তাদের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়বে। সুতরাং কাজ করতে এসেও তারা তখন চলে যায়।’
*কৃষি জমি, পানিসম্পদ*
ফুলবাড়ীতে কয়লা তোলার বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘কয়লা উত্তোলন করার ব্যাপারে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু উন্মুক্ত পদ্ধতি হচ্ছে পুরোপুরি ডিজাস্টার। এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য।’ তার মতে, ‘কৃষিজমি হলো নবায়নযোগ্য সম্পদ। কিন্তু কয়লা তা নয়। কৃষিজমি খাদ্য জোগায়, সম্পদ তৈরি করে। উন্মুক্ত পদ্ধতি মানে হলো এই সম্পদ ধ্বংস করে, এর ভেতরের পানিসম্পদ ধ্বংস করে কয়লা তুলে আনা। এতে কৃষিজমিও আর রিকভার করা যাবে না।’
*কয়লার মজুদ*
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দেশে এ পর্যন্ত ৫টি কয়লাক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব খনিতে সম্ভাব্য মজুদের পরিমাণ প্রায় ৭ হাজার ৮২৩ মিলিয়ন টন। এই বিপুল কয়লা দিয়ে কয়েক যুগ পর্যন্ত দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালানো সম্ভব। তবে এ পর্যন্ত বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি ছাড়া অন্য কোনো খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করেনি সরকার।
ফুলবাড়ী: খনিজসম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ১৯৯৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার কোম্পানি বিএইচপি মিনারেলস দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে কয়লা খনি আবিষ্কার করে। এই কয়লাখনিতে ৫৭২ মিলিয়ন টন কয়লা মজুদ রয়েছে। পেট্রোবাংলার একটি প্রতিবেদন বলছে, প্রতিবছর তিন মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন হিসেবে আগামী ৩০ বছরে এই খনি থেকে ৯০ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করা যাবে।
বড়পুকুরিয়া: দিনাজপুরের পার্বতীপুরে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি আবিষ্কার হয় ১৯৮৫ সালে। খনিটিতে ৪১০ মিলিয়ন টন কয়লা মজুদের কথা জানানো হয়েছিল। ২০০৫ সাল থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে এই খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। বিসিএমসিএলের (বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এই পদ্ধতিতে খনি থেকে খুব বেশি কয়লা ওঠানো যায় না। সর্বোচ্চ দশ ভাগ তোলা যায়, নব্বইভাগই থেকে যায়। গত চব্বিশ বছরে (২০০৫-২০২৩) এখান থেকে মোট কয়লা উত্তোলন করা হয়েছে ১৩.৮৯ মিলিয়ন টন। কর্মকর্তাদের দাবি, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে অনেক বেশি কয়লা তোলা যায়। মন্ত্রণালয়ের কাছে এ সংক্রান্ত প্রস্তাবও দেয়া আছে। বর্তমানে যে পরিমাণ কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে তা বড়পুকুরিয়ার ৬২৫ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাহিদার তুলনায় কম। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ৩টি ইউনিট চালু রেখে স্বাভাবিক উৎপাদনের জন্য দৈনিক প্রায় ৪ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন কয়লার প্রয়োজন।
বর্তমানে বড়পুকুরিয়া খনিটির ১৩৫০ ফেইজ থেকে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। দৈনিক গড়ে আড়াই থেকে তিন হাজার টন কয়লা উৎপাদন হয় এই ফেইজ থেকে। আগামী জুন পর্যন্ত এই ফেইজ থেকে কয়লা উৎপাদন করা যাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এরপর পরবর্তী ফেইজের কার্যক্রম। জানা গেছে, ২০২৭ সালের পর বিসিএমসিএলের কয়লা উত্তোলনের অনুমোদিত কোনো পরিকল্পনা নেই।
নবাবগঞ্জ: দিনাজপুরের নবাবগঞ্জে ১৯৯৫ সালে দীঘিপাড়া কয়লাখনি আবিষ্কৃত হয়। সেই খনিতে প্রায় ৭০৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা মজুদ রয়েছে।
খালাসপীর: রংপুরের পীরগঞ্জের খালাসপীর এলাকায় ১৯৮৯ সালে আরেকটি কয়লাখনি আবিষ্কার হয়। এই খনিতে প্রায় ৬৮৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লার সম্ভাব্য মজুদ রয়েছে।
জামালগঞ্জ: জয়পুরহাটে জামালগঞ্জ খনি আবিষ্কার করা হয় ১৯৬২ সালে। এই খনিতে একটি বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, এখানে প্রায় ৫৪৫০ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লার মজুদ রয়েছে।