ছয় দফা দাবিতে রাজধানীতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীদের -সংবাদ
ছয় দফা দাবিতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা।
বুধবার, ১৬ এপ্রিল সকাল ১০টা থেকে রাজধানীর তেজগাঁও সাতরাস্তা মোড় অবরোধ করে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। তাদের আন্দোলনে স্থবির হয় পুরো ঢাকা। তেজগাঁও, ফার্মগেট, বিজয় সরণি, কারওয়ানবাজার, মগবাজার, এফডিসি মোড়, হাতিরঝিল, গুলশান, মালিবাগ, মৌচাকসহ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তীব্র যানজট। শুধু সড়ক নয়, তেজগাঁও, কারওয়ানবাজার, মহাখালী এলাকার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ইনকামিং রুটও স্থবির অবস্থায় দেখা যায়। দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকার পর অনেক বাস, সিএনজি ও প্রাইভেটকার থেকে যাত্রীদের নেমে হেঁটে চলে যেতে দেখা যায় গন্তব্যের উদ্দেশে।
সারাদেশে রেলপথ ব্লকেডের ঘোষণা পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের
রাজধানীতে দিনভর অবরোধ ভোগান্তি,
পৌনে ৯ ঘণ্টা পর যানচলাচল শুরু
এদিকে প্রায় পৌনে ৯ ঘণ্টা পর তেজগাঁও-মগবাজার সড়কে যান চলাচল শুরু হয়েছে। তবে এ দীর্ঘ সময়ে তৈরি হয়েছে যানজট ও যানবাহনের বাড়তি চাপ। বুধবার সন্ধ্যার দিকে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণার পর সড়কে সরব হয় ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। সাতরাস্তা মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তৎপর হতে দেখা যায়। যান চলাচল শুরু হলেও পৌনে ৯ ঘণ্টা ধরে অবরোধের কারণে যে ভোগান্তি সড়কে ছিল তার প্রভাব রয়ে গেছে সড়কেই। বুধবার দুপুর পর্যন্ত তীব্র রোদ আর গরমের ভোগান্তির পর বিকেল সাড়ে তিনটা থেকে শুরু হয় ঝড়-বৃষ্টি। এতে ভোগান্তিতে পড়েন সকাল থেকে সড়কে আটকেপড়া যাত্রীরা।
তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) রফিকুল ইসলাম বলেন, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধের কারণে দিনভর ছিল জনভোগান্তি। দিনভর রোদের পর বৃষ্টির কারণে জনভোগান্তি আরও বেড়ে যায়। তবে সন্ধ্যায় শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ ছেড়ে দিলে যান চলাচল শুরু হয়েছে। তবে স্বাভাবিক হতে একটু সময় লাগবে। ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন দ্রুত সড়ক সচল ও গতিশীল করার জন্য।
কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলা ও গুলি ছোড়ার প্রতিবাদ এবং ৬ দফা দাবি আদায়ে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে এবার ঢাকাসহ সারাদেশে রেলপথ ব্লকেডের ঘোষণা দিয়েছেন সরকারি-বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে তারা অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সাতরাস্তা মোড়ে দিনভর অবস্থান কর্মসূচি শেষে এ ঘোষণা দেন কারিগরি ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি জুবায়ের পাটোয়ারী।
তিনি বলেন, দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে। কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ বৃহস্পতিবার আমরা সারাদেশে
অসহযোগ আন্দোলন করবো। সেই সঙ্গে দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে রেলপথ ব্লকেড করা হবে। কখন থেকে এবং কোথায় এ কর্মসূচি করা হবে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে শিক্ষার্থীরা জানান, সময় ও স্থানসহ তাদের কর্মসূচির বিস্তারিত ‘কারিগরি ছাত্র আন্দোলন, বাংলাদেশ’ নামের ফেইসবুক পেইজে জানানো হবে।
কারিগরি ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম প্রতিনিধি জুবায়ের পাটোয়ারী বলেন, দিনভর আমরা ঢাকাসহ সারাদেশে সড়ক অবরোধ করেছি। বুধবার মানুষের যে ভোগান্তি, সেটাই সামনে আসছে, সমালোচনা হচ্ছে। কিন্তু যৌক্তিক দাবি নিয়ে আমরা রাস্তায় নেমেছি, অথচ আমাদের ভাইদের গুলি করা হয়েছে, রক্ত ঝরেছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর যদি কোনো ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা গুলি খেয়ে থাকে, সেটা পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীরা। এটা মেনে নেয়া যায় না।
তিনি আরও বলেন, ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটেও প্রিন্সিপালের নির্দেশে হামলা করা হয়েছে। সরকার আমাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা প্রিন্সিপালকে সরিয়ে দেয়ার দাবি করেছি। অথচ সরকার সারা দিনেও একজন প্রিন্সিপালকে সরাতে পারেনি। একজন প্রিন্সিপালকে সরাতে সারাদিন লাগলে তারা দেশ চালাবেন কীভাবে?
জুবায়ের পাটোয়ারী বলেন, দেশের উন্নয়নে কারিগরি শিক্ষার্থীদের ভূমিকা অনেক। আমরা সরকারকে স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, আমাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবেন না। যদি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন, তাহলে সামাল দিতে পারবেন না। দাবি আদায় করেই আমরা রাজপথ ছাড়বো।
বুধবার সকাল ১০টার দিকে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীরা ৬ দফা দাবি আদায়ে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সাতরাস্তা মোড়ে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। ঢাকার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে সারাদেশে জেলায় জেলায় সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। বিকেল সোয়া ৪টার দিকে সাতরাস্তা মোড়ে যান কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) শোয়াইব আহমাদ খান। তিনি শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দেন। একই সঙ্গে পদোন্নতিতে ‘ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরদের’ কোনো কোটা রাখা হবে না বলেও জানান।
ডিজি ও অধ্যক্ষের আশ্বাসের পরও সাতরাস্তা মোড়ে অবস্থান অব্যাহত রাখেন শিক্ষার্থীরা। তারা দাবি করেন, প্রত্যেকটি দাবি পূরণে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তা লিখিতভাবে জানাতে হবে। সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা বাস্তবায়নের লিখিত প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। তবে আশ্বাস দেয়ার পরও শিক্ষার্থীরা রাস্তা না ছাড়ায় কারিগরি অধিদপ্তরের ডিজি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষের কার্যালয়ে চলে যান। সন্ধ্যার দিকে সেখান থেকে কর্মকর্তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান।
বিকেল ৪টার দিকে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলাম বলেন, ৬ দফা দাবির মধ্যে পদোন্নতিতে (জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে) ৩০ শতাংশ কোটা (ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরদের) রয়েছে বা আদালতের নির্দেশনা আছে বলে ওরা বলছে, এটা সত্য নয়। তারা ভুল তথ্যের ওপর আন্দোলন করছেন। আমরা বলেছি, ওখানে ৩০ শতাংশ কোটা থাকবে না। তাহলে তো হয়ে গেল।
‘আরেকটা দাবি আছে, যেখানে ওরা বলছে- কারিগরির বাইরের সবাইকে সরিয়ে দিতে হবে। ওটা তো হুট করে সম্ভব নয়। এটা ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন হবে। ওই পথ চলাটা আমরা শুরু করে দিয়ে যাবো।’ বাকি চারটি দাবি পূরণে কাজ শুরু হয়ে গেছে জানিয়ে কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগের সচিব বলেন, ‘বাকি যেগুলো আছে, সেগুলো নিয়ে কাজ শুরু হয়ে গেছে। ওরা তো নিজের ভালো-মন্দ খুব বেশি বোঝে না। ওদের জন্য আরও বড় বড় কাজ করছি আমরা। যে কাজগুলো হাতে নেয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়ন হলে দেশের কারিগরি শিক্ষা অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যাবে।’
শিক্ষার্থীদের ৬ দফা দাবি- ১. জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরদের ৩০ শতাংশ প্রমোশন কোটা অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। ২. জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর (টেক) পদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বাধ্যতামূলক ডিপ্লোমা প্রকৌশল ডিগ্রি থাকতে হবে। ৩. ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরসহ দেশের কারিগরি সব পদে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত জনবল নিয়োগ দিতে হবে। ৪. কারিগরি (পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ছাত্রদের জন্য) সব বিভাগীয় শহরগুলোতে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। ৫. কারিগরি শিক্ষা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কারিগরি শিক্ষা চালু ও শিক্ষক পদে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের চাকরির আবেদনের সুযোগ বাস্তবায়ন করতে হবে। ৬. ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের জন্য প্রাইভেট সেক্টরে সর্বনিম্ন বেতন স্কেল নির্ধারণ করে দিতে হবে।
চট্টগ্রামে সড়ক অবরোধ : পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের দু’ঘণ্টা বিক্ষোভ
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানান, চট্টগ্রাম নগরীতে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে সড়ক অবরোধ করে প্রায় দু’ঘণ্টা বিক্ষোভ করেছেন বিভিন্ন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে নগরীর ২ নম্বর গেট এলাকায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এতে যানবাহন আটকে দেয়ায় সড়কের উভয়পাশে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। বিক্ষোভের কারণে সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকায় সাধারণ যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। পরে সরে গেলেন শিক্ষার্থীরা, দু’ঘণ্টা পর যান চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে।
এ দিন দুপুর আড়াইটার দিকে যানবাহন চালকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বাকবিতণ্ডা ও হাতাহাতি হয়। একপর্যায়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা সড়ক ছাড়তে বাধ্য হন। এরপর শিক্ষার্থীরা ২ নম্বর গেটের বিপ্লব উদ্যানে গিয়ে অবস্থান নেন।
ক্রাফট ইন্সট্রাক্টর নিয়োগবিধি সংশোধন, ব্যবহারিক ক্লাসের প্রশিক্ষক পদের নাম ‘ক্রাফট ইন্সট্রাক্টর’ না করাসহ ছয় দফা দাবিতে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা এ কর্মসূচি শুরু করেন। চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, শ্যামলী, এমআইটিসহ বিভিন্ন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের দুই শতাধিক শিক্ষার্থীরা এ কর্মসূচিতে যোগ দেন।
এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘নন টেক, মুক্ত করো, কারিগরি পথ খুলো, ২৪ আমার অহঙ্কার, কারিগরি আন্দোলন আমার অহঙ্কার, মামা এখন মাস্টার, মামার বাড়ির আবদার; এক, দুই, তিন, চার, কারিগরিতে দুর্নীতি ছাড়’- সহ বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দেন। চলতি বছরের ২০ মার্চও একই দাবিতে বিভিন্ন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা আড়াই ঘণ্টা সড়ক ও রেললাইন অবরোধ করে আন্দোলন করেছিলেন।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উত্তর বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পলিটেকনিক শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি নিয়ে সড়ক অবরোধ করেছিল। পুলিশ তাদের সড়ক ছাড়ার জন্য অনুরোধ করলেও তারা সেটা মান ছিল না। দুই ঘণ্টা পর তারা সড়ক ছেড়েছেন। এখন যান চলাচল স্বাভাবিক আছে।
যশোরে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ, যানজট
যশোর অফিস থেকে জানা যায়, ছয় দফা দাবিতে সেখানেও সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। বুধবার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে শহরের মণিহার এলাকা অবরোধ করে রাখেন শিক্ষার্থীরা। এতে ওই এলাকায় যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায় এবং ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। এর আগে সকাল থেকে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা জড়ো হয় ক্যাম্পাসে। পরে মিছিলসহকারে মনিহার চত্বরে জড়ো হয়।
শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, তাদের ৬ দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণভাবে সড়ক থেকে সরিয়ে দিতে সেনাবাহিনী ও পুলিশের সদস্য ঘটনাস্থলে থাকতে দেখা গেছে। পরে প্রশাসন আলোচনার ভিত্তিতে অবরোধ তুলে দেয়। কয়েক ঘণ্টা ঘরে চলা এই অবরোধে বাসসহ সব ধরণের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দুর্ভোগ পোহাতে হয় যাত্রী সাধারণের।
যশোর কোতোয়ালি থানার ওসি (তদন্ত) কাজী বাবুল হোসেন বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ছয় দাবিতে মণিহার এলাকা অবরোধ করে। এতে চারটি সড়কে লম্বা যানজট সৃষ্টি হয়।
ছয় দফা দাবিতে রাজধানীতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীদের -সংবাদ
বুধবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৫
ছয় দফা দাবিতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা।
বুধবার, ১৬ এপ্রিল সকাল ১০টা থেকে রাজধানীর তেজগাঁও সাতরাস্তা মোড় অবরোধ করে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। তাদের আন্দোলনে স্থবির হয় পুরো ঢাকা। তেজগাঁও, ফার্মগেট, বিজয় সরণি, কারওয়ানবাজার, মগবাজার, এফডিসি মোড়, হাতিরঝিল, গুলশান, মালিবাগ, মৌচাকসহ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তীব্র যানজট। শুধু সড়ক নয়, তেজগাঁও, কারওয়ানবাজার, মহাখালী এলাকার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ইনকামিং রুটও স্থবির অবস্থায় দেখা যায়। দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকার পর অনেক বাস, সিএনজি ও প্রাইভেটকার থেকে যাত্রীদের নেমে হেঁটে চলে যেতে দেখা যায় গন্তব্যের উদ্দেশে।
সারাদেশে রেলপথ ব্লকেডের ঘোষণা পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের
রাজধানীতে দিনভর অবরোধ ভোগান্তি,
পৌনে ৯ ঘণ্টা পর যানচলাচল শুরু
এদিকে প্রায় পৌনে ৯ ঘণ্টা পর তেজগাঁও-মগবাজার সড়কে যান চলাচল শুরু হয়েছে। তবে এ দীর্ঘ সময়ে তৈরি হয়েছে যানজট ও যানবাহনের বাড়তি চাপ। বুধবার সন্ধ্যার দিকে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণার পর সড়কে সরব হয় ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। সাতরাস্তা মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তৎপর হতে দেখা যায়। যান চলাচল শুরু হলেও পৌনে ৯ ঘণ্টা ধরে অবরোধের কারণে যে ভোগান্তি সড়কে ছিল তার প্রভাব রয়ে গেছে সড়কেই। বুধবার দুপুর পর্যন্ত তীব্র রোদ আর গরমের ভোগান্তির পর বিকেল সাড়ে তিনটা থেকে শুরু হয় ঝড়-বৃষ্টি। এতে ভোগান্তিতে পড়েন সকাল থেকে সড়কে আটকেপড়া যাত্রীরা।
তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) রফিকুল ইসলাম বলেন, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধের কারণে দিনভর ছিল জনভোগান্তি। দিনভর রোদের পর বৃষ্টির কারণে জনভোগান্তি আরও বেড়ে যায়। তবে সন্ধ্যায় শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ ছেড়ে দিলে যান চলাচল শুরু হয়েছে। তবে স্বাভাবিক হতে একটু সময় লাগবে। ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন দ্রুত সড়ক সচল ও গতিশীল করার জন্য।
কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলা ও গুলি ছোড়ার প্রতিবাদ এবং ৬ দফা দাবি আদায়ে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে এবার ঢাকাসহ সারাদেশে রেলপথ ব্লকেডের ঘোষণা দিয়েছেন সরকারি-বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে তারা অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সাতরাস্তা মোড়ে দিনভর অবস্থান কর্মসূচি শেষে এ ঘোষণা দেন কারিগরি ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি জুবায়ের পাটোয়ারী।
তিনি বলেন, দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে। কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ বৃহস্পতিবার আমরা সারাদেশে
অসহযোগ আন্দোলন করবো। সেই সঙ্গে দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে রেলপথ ব্লকেড করা হবে। কখন থেকে এবং কোথায় এ কর্মসূচি করা হবে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে শিক্ষার্থীরা জানান, সময় ও স্থানসহ তাদের কর্মসূচির বিস্তারিত ‘কারিগরি ছাত্র আন্দোলন, বাংলাদেশ’ নামের ফেইসবুক পেইজে জানানো হবে।
কারিগরি ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম প্রতিনিধি জুবায়ের পাটোয়ারী বলেন, দিনভর আমরা ঢাকাসহ সারাদেশে সড়ক অবরোধ করেছি। বুধবার মানুষের যে ভোগান্তি, সেটাই সামনে আসছে, সমালোচনা হচ্ছে। কিন্তু যৌক্তিক দাবি নিয়ে আমরা রাস্তায় নেমেছি, অথচ আমাদের ভাইদের গুলি করা হয়েছে, রক্ত ঝরেছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর যদি কোনো ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা গুলি খেয়ে থাকে, সেটা পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীরা। এটা মেনে নেয়া যায় না।
তিনি আরও বলেন, ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটেও প্রিন্সিপালের নির্দেশে হামলা করা হয়েছে। সরকার আমাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা প্রিন্সিপালকে সরিয়ে দেয়ার দাবি করেছি। অথচ সরকার সারা দিনেও একজন প্রিন্সিপালকে সরাতে পারেনি। একজন প্রিন্সিপালকে সরাতে সারাদিন লাগলে তারা দেশ চালাবেন কীভাবে?
জুবায়ের পাটোয়ারী বলেন, দেশের উন্নয়নে কারিগরি শিক্ষার্থীদের ভূমিকা অনেক। আমরা সরকারকে স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, আমাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবেন না। যদি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন, তাহলে সামাল দিতে পারবেন না। দাবি আদায় করেই আমরা রাজপথ ছাড়বো।
বুধবার সকাল ১০টার দিকে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীরা ৬ দফা দাবি আদায়ে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সাতরাস্তা মোড়ে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। ঢাকার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে সারাদেশে জেলায় জেলায় সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। বিকেল সোয়া ৪টার দিকে সাতরাস্তা মোড়ে যান কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) শোয়াইব আহমাদ খান। তিনি শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দেন। একই সঙ্গে পদোন্নতিতে ‘ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরদের’ কোনো কোটা রাখা হবে না বলেও জানান।
ডিজি ও অধ্যক্ষের আশ্বাসের পরও সাতরাস্তা মোড়ে অবস্থান অব্যাহত রাখেন শিক্ষার্থীরা। তারা দাবি করেন, প্রত্যেকটি দাবি পূরণে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তা লিখিতভাবে জানাতে হবে। সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা বাস্তবায়নের লিখিত প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। তবে আশ্বাস দেয়ার পরও শিক্ষার্থীরা রাস্তা না ছাড়ায় কারিগরি অধিদপ্তরের ডিজি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষের কার্যালয়ে চলে যান। সন্ধ্যার দিকে সেখান থেকে কর্মকর্তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান।
বিকেল ৪টার দিকে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলাম বলেন, ৬ দফা দাবির মধ্যে পদোন্নতিতে (জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে) ৩০ শতাংশ কোটা (ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরদের) রয়েছে বা আদালতের নির্দেশনা আছে বলে ওরা বলছে, এটা সত্য নয়। তারা ভুল তথ্যের ওপর আন্দোলন করছেন। আমরা বলেছি, ওখানে ৩০ শতাংশ কোটা থাকবে না। তাহলে তো হয়ে গেল।
‘আরেকটা দাবি আছে, যেখানে ওরা বলছে- কারিগরির বাইরের সবাইকে সরিয়ে দিতে হবে। ওটা তো হুট করে সম্ভব নয়। এটা ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন হবে। ওই পথ চলাটা আমরা শুরু করে দিয়ে যাবো।’ বাকি চারটি দাবি পূরণে কাজ শুরু হয়ে গেছে জানিয়ে কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগের সচিব বলেন, ‘বাকি যেগুলো আছে, সেগুলো নিয়ে কাজ শুরু হয়ে গেছে। ওরা তো নিজের ভালো-মন্দ খুব বেশি বোঝে না। ওদের জন্য আরও বড় বড় কাজ করছি আমরা। যে কাজগুলো হাতে নেয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়ন হলে দেশের কারিগরি শিক্ষা অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যাবে।’
শিক্ষার্থীদের ৬ দফা দাবি- ১. জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরদের ৩০ শতাংশ প্রমোশন কোটা অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। ২. জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর (টেক) পদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বাধ্যতামূলক ডিপ্লোমা প্রকৌশল ডিগ্রি থাকতে হবে। ৩. ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরসহ দেশের কারিগরি সব পদে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত জনবল নিয়োগ দিতে হবে। ৪. কারিগরি (পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ছাত্রদের জন্য) সব বিভাগীয় শহরগুলোতে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। ৫. কারিগরি শিক্ষা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কারিগরি শিক্ষা চালু ও শিক্ষক পদে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের চাকরির আবেদনের সুযোগ বাস্তবায়ন করতে হবে। ৬. ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের জন্য প্রাইভেট সেক্টরে সর্বনিম্ন বেতন স্কেল নির্ধারণ করে দিতে হবে।
চট্টগ্রামে সড়ক অবরোধ : পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের দু’ঘণ্টা বিক্ষোভ
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানান, চট্টগ্রাম নগরীতে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে সড়ক অবরোধ করে প্রায় দু’ঘণ্টা বিক্ষোভ করেছেন বিভিন্ন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে নগরীর ২ নম্বর গেট এলাকায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এতে যানবাহন আটকে দেয়ায় সড়কের উভয়পাশে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। বিক্ষোভের কারণে সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকায় সাধারণ যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। পরে সরে গেলেন শিক্ষার্থীরা, দু’ঘণ্টা পর যান চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে।
এ দিন দুপুর আড়াইটার দিকে যানবাহন চালকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বাকবিতণ্ডা ও হাতাহাতি হয়। একপর্যায়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা সড়ক ছাড়তে বাধ্য হন। এরপর শিক্ষার্থীরা ২ নম্বর গেটের বিপ্লব উদ্যানে গিয়ে অবস্থান নেন।
ক্রাফট ইন্সট্রাক্টর নিয়োগবিধি সংশোধন, ব্যবহারিক ক্লাসের প্রশিক্ষক পদের নাম ‘ক্রাফট ইন্সট্রাক্টর’ না করাসহ ছয় দফা দাবিতে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা এ কর্মসূচি শুরু করেন। চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, শ্যামলী, এমআইটিসহ বিভিন্ন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের দুই শতাধিক শিক্ষার্থীরা এ কর্মসূচিতে যোগ দেন।
এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘নন টেক, মুক্ত করো, কারিগরি পথ খুলো, ২৪ আমার অহঙ্কার, কারিগরি আন্দোলন আমার অহঙ্কার, মামা এখন মাস্টার, মামার বাড়ির আবদার; এক, দুই, তিন, চার, কারিগরিতে দুর্নীতি ছাড়’- সহ বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দেন। চলতি বছরের ২০ মার্চও একই দাবিতে বিভিন্ন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা আড়াই ঘণ্টা সড়ক ও রেললাইন অবরোধ করে আন্দোলন করেছিলেন।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উত্তর বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পলিটেকনিক শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি নিয়ে সড়ক অবরোধ করেছিল। পুলিশ তাদের সড়ক ছাড়ার জন্য অনুরোধ করলেও তারা সেটা মান ছিল না। দুই ঘণ্টা পর তারা সড়ক ছেড়েছেন। এখন যান চলাচল স্বাভাবিক আছে।
যশোরে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ, যানজট
যশোর অফিস থেকে জানা যায়, ছয় দফা দাবিতে সেখানেও সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। বুধবার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে শহরের মণিহার এলাকা অবরোধ করে রাখেন শিক্ষার্থীরা। এতে ওই এলাকায় যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায় এবং ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। এর আগে সকাল থেকে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা জড়ো হয় ক্যাম্পাসে। পরে মিছিলসহকারে মনিহার চত্বরে জড়ো হয়।
শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, তাদের ৬ দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণভাবে সড়ক থেকে সরিয়ে দিতে সেনাবাহিনী ও পুলিশের সদস্য ঘটনাস্থলে থাকতে দেখা গেছে। পরে প্রশাসন আলোচনার ভিত্তিতে অবরোধ তুলে দেয়। কয়েক ঘণ্টা ঘরে চলা এই অবরোধে বাসসহ সব ধরণের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দুর্ভোগ পোহাতে হয় যাত্রী সাধারণের।
যশোর কোতোয়ালি থানার ওসি (তদন্ত) কাজী বাবুল হোসেন বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ছয় দাবিতে মণিহার এলাকা অবরোধ করে। এতে চারটি সড়কে লম্বা যানজট সৃষ্টি হয়।