চার দিনের যুক্তরাজ্য সফর শেষে গতকাল শনিবার সকালে দেশে ফিরেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। সেই সফরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার তাকে সাক্ষাৎ দেননি। বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন মুহাম্মদ ইউনূস। যুক্তরাজ্যের সাহায্য কমে যাওয়া এবং ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের দুদকের অভিযোগ নিয়েও প্রশ্ন এসেছে বিবিসির পক্ষ থেকে।
প্রকৃতি ও পরিবেশে অবদানের জন্য মুহাম্মদ ইউনূস ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। যুক্তরাজ্য সফরে গত ১২ জুন যখন ওই পুরস্কার নিতে যান, এর আগে বিবিসির সাংবাদিক রাজিনি বৈদ্যনাথন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎকার নেন। সেই সাক্ষাৎকারের সংক্ষিপ্ত অংশ প্রচার হয়েছে বিবিসির ‘দ্য ওয়ার্ল্ড টুনাইট’ অনুষ্ঠানে। বিবিসির সঙ্গে ইংরেজিতে দেয়া প্রধান উপদেষ্টার সেই সাক্ষাৎকারটি বাংলায় অনুবাদ করে অনলাইনে তুলে ধরেছে বিবিসি বাংলা...
বিবিসি: এটি আপনার (প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস) আনুষ্ঠানিক সফর, কিন্তু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমারের সঙ্গে কেন কোনো সাক্ষাৎ হয়নি?
মুহাম্মদ ইউনূস: তার (ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী) সঙ্গে বৈঠক হলে আমরা খুব খুশি হতাম, সম্ভবত তিনি ব্যস্ত আছেন বা অন্য কিছু হতে পারে। কিন্তু এটি আমার জন্যও একটি দারুণ সুযোগ এনে দিয়েছে, এখন তিনি ব্যস্ত, আমি তাকে বাংলাদেশে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাই। তখন আমাদের হাতে সময় থাকবে এবং আমরা এখানে (বাংলাদেশে) কী ঘটেছিল, আমরা কী করতে চাইছি তা দেখাতে পারবো এবং তিনি পরিস্থিতি বুঝতে পারবেন। এবং আমরা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এটি একটি অনন্য জিনিস, যেখানে আপনি অতীতকে বাদ দিয়ে একটি নতুন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
বিবিসি: আমি এটা জিজ্ঞেস করতে চাই যে, আপনি বলছেন তিনি (ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী) ব্যস্ত, অথচ আপনি প্রধান উপদেষ্টা, রাজনৈতিকভাবে আপনারা দুইজনেই সমান পদমর্যাদার। যুক্তরাজ্যে প্রায় দশ লক্ষ বাংলাদেশি আছে। বাংলাদেশি সংস্কৃতি ব্রিটিশ জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাহলে, আপনি কতটা হতাশ যে আপনি কয়েকদিন ধরে যুক্তরাজ্যে আছেন অথচ এই কয়েকদিনের মধ্যেও তিনি আপনার জন্য সময় বের করতে পারলো না?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি জানি না আমার হতাশ হওয়া উচিত, নাকি তার হতাশ হওয়া উচিত। সুযোগটা কোন কারণে হাতছাড়া হয়ে গেছে, আমি জানি না। সেজন্যই আমি বলছি, বাংলাদেশে তার আসাটা একটা দারুণ সুযোগ হতে পারে, ধীরে-সুস্থে বাংলাদেশকে দেখার, অনুভব করার এবং তা উপলব্ধি করার জন্য ভালো সুযোগ তৈরি হতে পারে যে বাংলাদেশ কীসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
বিবিসি: ডাউনিং স্ট্রিট কেন এই বৈঠকের আয়োজন করলো না, তা নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা দিয়েছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমার মনে হয় না যে, আমরা এই ধরনের কোনো ব্যাখ্যা পেয়েছি; সম্ভবত তিনি অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্যস্ত।
টিউলিপ সিদ্দিক নিয়ে প্রশ্ন
বিবিসি: কিয়ের স্টারমারের এমপিদের একজন, লেবার এমপি টিউলিপ সিদ্দিক সম্পর্কে একটু কথা বলি। অবশ্যই, তিনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগনি। বাংলাদেশের আদালত তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে জমি গ্রহণের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে, যা তিনি অস্বীকার করেছেন। আমরা একটি চিঠি দেখেছি, যেখানে তিনি আপনাকে লিখেছেন, আপনি এখানে থাকাকালীন তিনি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন। আপনি কি তার সঙ্গে দেখা করবেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: না, দেখা করবো না। কারণ এটি একটি আইনি প্রক্রিয়া। আমি আইনি প্রক্রিয়া ব্যাহত করতে চাই না। প্রক্রিয়াটি চলতে থাকুক।
কেন দুদক
বিবিসি: যুক্তরাজ্য সরকারের মন্ত্রীদের মানবিষয়ক উপদেষ্টা কমিটি টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে তদন্ত করেছেন এবং তাকে খালাস দিয়েছেন। টিউলিপ সিদ্দিকও দাবি করেছেন যে, বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। এরপরও কেন দুদক এখনও তার বিরুদ্ধে তদন্ত করছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: এটি আদালতের বিষয়, আদালতের বিষয়ে আদালত সিদ্ধান্ত নেবে যে মামলাটির জন্য পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত আছে কিনা, এর প্রক্রিয়া চালু থাকবে নাকি বাতিল করা হবে।
বিবিসি: কিন্তু আপনি বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা, আপনি এসেই বলেছিলেন দুর্নীতি নির্মূল করতে চান। তাই আমি আবারও সেই প্রশ্নটি করছি, কারণ দুদকের প্রধান বলছেন যে- এটি কোনো ভিত্তিহীন তদন্ত নয়। আমি এখানে উদ্ধৃতিটিই তুলে ধরছি ‘তিনি বলেছেন যে, অভিযোগগুলো কোনোভাবেই কাউকে লক্ষ্যবস্তু করে নয় এবং ভিত্তিহীন নয়’। এরপরেও টিউলিপ সিদ্দিকের আইনজীবীরা দাবি করেছেন, তারা কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি এবং এই তদন্তের কোনো ভিত্তি নেই। এমনকি দুদক তার সঙ্গে কোনো কথাও বলেনি।
মুহাম্মদ ইউনূস: চলমান আইনি প্রক্রিয়ায় আইনজীবীদের সামনাসামনি আসতে হয়, একত্রিত হতে হয় এবং একে অপরের সঙ্গে তথ্য বিনিময় করতে হয়।
বিবিসি: তিনি (টিউলিপ সিদ্দিক) বলছেন যে, এখানে তেমনটি হয়নি।
মুহাম্মদ ইউনূস: এখনও তো খুব বেশি দেরি হয়নি, আইনি প্রক্রিয়া সর্বদা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। বাংলাদেশ তো অস্বীকার করেনি, বলেনি যে আমরা আপনাকে কিছু দেব না। তাহলেই না কোনো আইনি প্রক্রিয়া হবে না। কোর্টই এটি সিদ্ধান্ত নিবে।
পরোয়ানা
বিবিসি: কিন্তু এই নির্দিষ্ট অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তারের জন্য ইতোমধ্যেই একটি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে এবং তিনি (টিউলিপ সিদ্দিক) এবং তার আইনজীবী স্পষ্টভাবে বলছেন যে, গ্রেপ্তারি পরোয়ানার পুরো প্রক্রিয়াটিই অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও গোলমেলে। এবং মিস সিদ্দিক আরও বলেন যে, তিনি বা তার আইনজীবীদের সঙ্গেও কেউ কোনো যোগাযোগ করেনি।
মুহাম্মদ ইউনূস: দেখুন, এটি আইনজীবী বনাম আইনজীবীদের তর্ক, আমি নিশ্চিত যে বাংলাদেশের দুর্নীতি কমিশনের আইনজীবীরা এই প্রশ্নেরও যথাযথ উত্তর দিতে পাবেন।
বিবিসি: অবশ্যই, কিন্তু আমি প্রশ্নটি আরেকটু সহজভাবে করতে চাইছি, তিনি বলছেন যে তার আইনজীবীরা দুদকের কাছ থেকেও কিছু শোনেননি এবং তিনি বলছেন যে, এতে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে না।
মুহাম্মদ ইউনূস: তাহলে এখানে দুর্নীতি দমনের আইনজীবীরা ব্যাখ্যা করবেন যে কীভাবে এই আইনি প্রক্রিয়া কাজ করে।
বিবিসি: আমি বুঝতে পেরেছি, কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে আপনি কি এখন আপনার দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও স্বচ্ছ হওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন? আপনি কি এখন রেকর্ডে এটি বলবেন যে, তাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তথ্য সরবরাহ করা উচিত, যাতে এই অভিযোগগুলো সম্পর্কে কোনো সন্দেহ না থাকে, যা টিউলিপ সিদ্দিক অস্বীকার করছেন? এই বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে, দুর্নীতি কমিশনের উপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে, তারা সঠিক কাজটি করছে।
প্রত্যর্পণ
বিবিসি: অবশ্যই, টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে, যেমনটি আমরা আলোচনা করেছি। যদি এই অভিযোগের প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়, এরপর কি আপনি তাকে প্রত্যর্পণও করতে চাইবেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: আবারও বলছি, এটি আইনি প্রক্রিয়া। এটি এমন একটি বিষয় যা ধাপে ধাপে এগিয়ে যায়। একটি ধাপের পর আরেক ধাপ।
বিবিসি: এটাই তাহলে প্রক্রিয়ার অংশ?
মুহাম্মদ ইউনূস: যদি এটা আইনি প্রক্রিয়ার অংশ হয়, তাহলে অবশ্যই তাই।
বিবিসি: তাহলে, যথেষ্ট প্রমাণ থাকলে, দুদক তাকে প্রত্যর্পণের জন্য আবেদন করতে পারে।
মুহাম্মদ ইউনূস: যদি আইন অনুসারে তা প্রয়োজন হয়।
যুক্তরাজ্যের সাহায্য
বিবিসি: বাংলাদেশ যুক্তরাজ্যের সাহায্যের শীর্ষ ১০টি সহায়তাপ্রাপ্ত দেশের একটি। আমরা সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ব্রিটিশ সরকারের ব্যয় পর্যালোচনায় শুনেছি যে, বাজেট অনুসারে বৈদেশিক সাহায্য নাটকীয়ভাবে হ্রাস করা হবে। এটি বাংলাদেশের জনগণের ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলবে?
মুহাম্মদ ইউনূস: প্রথমত, আমরা আমাদের এই সংকটকালে কিছু সাহায্য পেলে খুব খুশি হব। কিন্তু যদি তা না পাই, তবুও আমরা আমাদের নিজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব।
বিবিসি: এটা কতটা ধাক্কা, অধ্যাপক (মুহাম্মদ ইউনূস)?
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা কতটা বড় ধাক্কা? আসলে এটা জীবনের একটা অংশ, যেখানে উত্থান-পতন চলতে থাকে। আজ সহায়তা কমেছে, পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে কাল বাড়বে। পরিস্থিতির যাচাই করে আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। যেমন, হঠাৎ আমরা শুনতে পেলাম যে, ইউএসএ আইডি সহায়তা ১০০% বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা দেখতে পাই যে, আমাদের দেশে অনেক বড় ঘটনা ঘটছে, এর মধ্যে আছে আমাদের কাছে থাকা রোহিঙ্গা সমস্যা। অথচ তাদের জন্য বরাদ্দকৃত সমস্ত অর্থ কেটে ফেলা হয়েছে। একেবারে শূন্য। পুরো রোহিঙ্গা সমস্যা হঠাৎ আমাদের জন্য আরও প্রকট হয়ে উঠল। এত মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। কিন্তু আমাদের এটি মোকাবিলা করতে হবে। সহায়তার অর্থ উধাও হয়ে যেতে পারে, কিন্তু রোহিঙ্গারা তো উধাও হয়নি।
টিউলিপের বিবৃতি
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎকারে টিউলিপ সিদ্দিকের সম্পর্কে করা মন্তব্যের বিষয়ে কথা বলতে বিবিসি মিস টিউলিপের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। জবাবে টিউলিপ সিদ্দিক একটি লিখিত বিবৃতি পাঠান।
তাতে টিউলিপ লিখেছেন, ‘আমি হতাশ যে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তার সফরের সময় আমার সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করেছেন। তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে কল্পনাপ্রসূত অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন, যার কোনো প্রমাণ গণমাধ্যমের কাছেও উপস্থাপন করা হয়নি। আমি আশা করি, তিনি এখন সংবাদমাধ্যমে আমার বদনাম ছড়ানোর অভ্যাস বন্ধ করবেন এবং আদালতে এটি প্রমাণের সুযোগ দিবে যে আমার বিরুদ্ধে তাদের চলমান তদন্তের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’
রোববার, ১৫ জুন ২০২৫
চার দিনের যুক্তরাজ্য সফর শেষে গতকাল শনিবার সকালে দেশে ফিরেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। সেই সফরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার তাকে সাক্ষাৎ দেননি। বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন মুহাম্মদ ইউনূস। যুক্তরাজ্যের সাহায্য কমে যাওয়া এবং ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের দুদকের অভিযোগ নিয়েও প্রশ্ন এসেছে বিবিসির পক্ষ থেকে।
প্রকৃতি ও পরিবেশে অবদানের জন্য মুহাম্মদ ইউনূস ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। যুক্তরাজ্য সফরে গত ১২ জুন যখন ওই পুরস্কার নিতে যান, এর আগে বিবিসির সাংবাদিক রাজিনি বৈদ্যনাথন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎকার নেন। সেই সাক্ষাৎকারের সংক্ষিপ্ত অংশ প্রচার হয়েছে বিবিসির ‘দ্য ওয়ার্ল্ড টুনাইট’ অনুষ্ঠানে। বিবিসির সঙ্গে ইংরেজিতে দেয়া প্রধান উপদেষ্টার সেই সাক্ষাৎকারটি বাংলায় অনুবাদ করে অনলাইনে তুলে ধরেছে বিবিসি বাংলা...
বিবিসি: এটি আপনার (প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস) আনুষ্ঠানিক সফর, কিন্তু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমারের সঙ্গে কেন কোনো সাক্ষাৎ হয়নি?
মুহাম্মদ ইউনূস: তার (ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী) সঙ্গে বৈঠক হলে আমরা খুব খুশি হতাম, সম্ভবত তিনি ব্যস্ত আছেন বা অন্য কিছু হতে পারে। কিন্তু এটি আমার জন্যও একটি দারুণ সুযোগ এনে দিয়েছে, এখন তিনি ব্যস্ত, আমি তাকে বাংলাদেশে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাই। তখন আমাদের হাতে সময় থাকবে এবং আমরা এখানে (বাংলাদেশে) কী ঘটেছিল, আমরা কী করতে চাইছি তা দেখাতে পারবো এবং তিনি পরিস্থিতি বুঝতে পারবেন। এবং আমরা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এটি একটি অনন্য জিনিস, যেখানে আপনি অতীতকে বাদ দিয়ে একটি নতুন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
বিবিসি: আমি এটা জিজ্ঞেস করতে চাই যে, আপনি বলছেন তিনি (ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী) ব্যস্ত, অথচ আপনি প্রধান উপদেষ্টা, রাজনৈতিকভাবে আপনারা দুইজনেই সমান পদমর্যাদার। যুক্তরাজ্যে প্রায় দশ লক্ষ বাংলাদেশি আছে। বাংলাদেশি সংস্কৃতি ব্রিটিশ জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাহলে, আপনি কতটা হতাশ যে আপনি কয়েকদিন ধরে যুক্তরাজ্যে আছেন অথচ এই কয়েকদিনের মধ্যেও তিনি আপনার জন্য সময় বের করতে পারলো না?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমি জানি না আমার হতাশ হওয়া উচিত, নাকি তার হতাশ হওয়া উচিত। সুযোগটা কোন কারণে হাতছাড়া হয়ে গেছে, আমি জানি না। সেজন্যই আমি বলছি, বাংলাদেশে তার আসাটা একটা দারুণ সুযোগ হতে পারে, ধীরে-সুস্থে বাংলাদেশকে দেখার, অনুভব করার এবং তা উপলব্ধি করার জন্য ভালো সুযোগ তৈরি হতে পারে যে বাংলাদেশ কীসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
বিবিসি: ডাউনিং স্ট্রিট কেন এই বৈঠকের আয়োজন করলো না, তা নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা দিয়েছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: আমার মনে হয় না যে, আমরা এই ধরনের কোনো ব্যাখ্যা পেয়েছি; সম্ভবত তিনি অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্যস্ত।
টিউলিপ সিদ্দিক নিয়ে প্রশ্ন
বিবিসি: কিয়ের স্টারমারের এমপিদের একজন, লেবার এমপি টিউলিপ সিদ্দিক সম্পর্কে একটু কথা বলি। অবশ্যই, তিনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগনি। বাংলাদেশের আদালত তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে জমি গ্রহণের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে, যা তিনি অস্বীকার করেছেন। আমরা একটি চিঠি দেখেছি, যেখানে তিনি আপনাকে লিখেছেন, আপনি এখানে থাকাকালীন তিনি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন। আপনি কি তার সঙ্গে দেখা করবেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: না, দেখা করবো না। কারণ এটি একটি আইনি প্রক্রিয়া। আমি আইনি প্রক্রিয়া ব্যাহত করতে চাই না। প্রক্রিয়াটি চলতে থাকুক।
কেন দুদক
বিবিসি: যুক্তরাজ্য সরকারের মন্ত্রীদের মানবিষয়ক উপদেষ্টা কমিটি টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে তদন্ত করেছেন এবং তাকে খালাস দিয়েছেন। টিউলিপ সিদ্দিকও দাবি করেছেন যে, বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। এরপরও কেন দুদক এখনও তার বিরুদ্ধে তদন্ত করছে?
মুহাম্মদ ইউনূস: এটি আদালতের বিষয়, আদালতের বিষয়ে আদালত সিদ্ধান্ত নেবে যে মামলাটির জন্য পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত আছে কিনা, এর প্রক্রিয়া চালু থাকবে নাকি বাতিল করা হবে।
বিবিসি: কিন্তু আপনি বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা, আপনি এসেই বলেছিলেন দুর্নীতি নির্মূল করতে চান। তাই আমি আবারও সেই প্রশ্নটি করছি, কারণ দুদকের প্রধান বলছেন যে- এটি কোনো ভিত্তিহীন তদন্ত নয়। আমি এখানে উদ্ধৃতিটিই তুলে ধরছি ‘তিনি বলেছেন যে, অভিযোগগুলো কোনোভাবেই কাউকে লক্ষ্যবস্তু করে নয় এবং ভিত্তিহীন নয়’। এরপরেও টিউলিপ সিদ্দিকের আইনজীবীরা দাবি করেছেন, তারা কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি এবং এই তদন্তের কোনো ভিত্তি নেই। এমনকি দুদক তার সঙ্গে কোনো কথাও বলেনি।
মুহাম্মদ ইউনূস: চলমান আইনি প্রক্রিয়ায় আইনজীবীদের সামনাসামনি আসতে হয়, একত্রিত হতে হয় এবং একে অপরের সঙ্গে তথ্য বিনিময় করতে হয়।
বিবিসি: তিনি (টিউলিপ সিদ্দিক) বলছেন যে, এখানে তেমনটি হয়নি।
মুহাম্মদ ইউনূস: এখনও তো খুব বেশি দেরি হয়নি, আইনি প্রক্রিয়া সর্বদা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। বাংলাদেশ তো অস্বীকার করেনি, বলেনি যে আমরা আপনাকে কিছু দেব না। তাহলেই না কোনো আইনি প্রক্রিয়া হবে না। কোর্টই এটি সিদ্ধান্ত নিবে।
পরোয়ানা
বিবিসি: কিন্তু এই নির্দিষ্ট অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তারের জন্য ইতোমধ্যেই একটি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে এবং তিনি (টিউলিপ সিদ্দিক) এবং তার আইনজীবী স্পষ্টভাবে বলছেন যে, গ্রেপ্তারি পরোয়ানার পুরো প্রক্রিয়াটিই অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও গোলমেলে। এবং মিস সিদ্দিক আরও বলেন যে, তিনি বা তার আইনজীবীদের সঙ্গেও কেউ কোনো যোগাযোগ করেনি।
মুহাম্মদ ইউনূস: দেখুন, এটি আইনজীবী বনাম আইনজীবীদের তর্ক, আমি নিশ্চিত যে বাংলাদেশের দুর্নীতি কমিশনের আইনজীবীরা এই প্রশ্নেরও যথাযথ উত্তর দিতে পাবেন।
বিবিসি: অবশ্যই, কিন্তু আমি প্রশ্নটি আরেকটু সহজভাবে করতে চাইছি, তিনি বলছেন যে তার আইনজীবীরা দুদকের কাছ থেকেও কিছু শোনেননি এবং তিনি বলছেন যে, এতে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে না।
মুহাম্মদ ইউনূস: তাহলে এখানে দুর্নীতি দমনের আইনজীবীরা ব্যাখ্যা করবেন যে কীভাবে এই আইনি প্রক্রিয়া কাজ করে।
বিবিসি: আমি বুঝতে পেরেছি, কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে আপনি কি এখন আপনার দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও স্বচ্ছ হওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন? আপনি কি এখন রেকর্ডে এটি বলবেন যে, তাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তথ্য সরবরাহ করা উচিত, যাতে এই অভিযোগগুলো সম্পর্কে কোনো সন্দেহ না থাকে, যা টিউলিপ সিদ্দিক অস্বীকার করছেন? এই বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে, দুর্নীতি কমিশনের উপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে, তারা সঠিক কাজটি করছে।
প্রত্যর্পণ
বিবিসি: অবশ্যই, টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে, যেমনটি আমরা আলোচনা করেছি। যদি এই অভিযোগের প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়, এরপর কি আপনি তাকে প্রত্যর্পণও করতে চাইবেন?
মুহাম্মদ ইউনূস: আবারও বলছি, এটি আইনি প্রক্রিয়া। এটি এমন একটি বিষয় যা ধাপে ধাপে এগিয়ে যায়। একটি ধাপের পর আরেক ধাপ।
বিবিসি: এটাই তাহলে প্রক্রিয়ার অংশ?
মুহাম্মদ ইউনূস: যদি এটা আইনি প্রক্রিয়ার অংশ হয়, তাহলে অবশ্যই তাই।
বিবিসি: তাহলে, যথেষ্ট প্রমাণ থাকলে, দুদক তাকে প্রত্যর্পণের জন্য আবেদন করতে পারে।
মুহাম্মদ ইউনূস: যদি আইন অনুসারে তা প্রয়োজন হয়।
যুক্তরাজ্যের সাহায্য
বিবিসি: বাংলাদেশ যুক্তরাজ্যের সাহায্যের শীর্ষ ১০টি সহায়তাপ্রাপ্ত দেশের একটি। আমরা সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ব্রিটিশ সরকারের ব্যয় পর্যালোচনায় শুনেছি যে, বাজেট অনুসারে বৈদেশিক সাহায্য নাটকীয়ভাবে হ্রাস করা হবে। এটি বাংলাদেশের জনগণের ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলবে?
মুহাম্মদ ইউনূস: প্রথমত, আমরা আমাদের এই সংকটকালে কিছু সাহায্য পেলে খুব খুশি হব। কিন্তু যদি তা না পাই, তবুও আমরা আমাদের নিজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব।
বিবিসি: এটা কতটা ধাক্কা, অধ্যাপক (মুহাম্মদ ইউনূস)?
মুহাম্মদ ইউনূস: এটা কতটা বড় ধাক্কা? আসলে এটা জীবনের একটা অংশ, যেখানে উত্থান-পতন চলতে থাকে। আজ সহায়তা কমেছে, পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে কাল বাড়বে। পরিস্থিতির যাচাই করে আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। যেমন, হঠাৎ আমরা শুনতে পেলাম যে, ইউএসএ আইডি সহায়তা ১০০% বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা দেখতে পাই যে, আমাদের দেশে অনেক বড় ঘটনা ঘটছে, এর মধ্যে আছে আমাদের কাছে থাকা রোহিঙ্গা সমস্যা। অথচ তাদের জন্য বরাদ্দকৃত সমস্ত অর্থ কেটে ফেলা হয়েছে। একেবারে শূন্য। পুরো রোহিঙ্গা সমস্যা হঠাৎ আমাদের জন্য আরও প্রকট হয়ে উঠল। এত মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। কিন্তু আমাদের এটি মোকাবিলা করতে হবে। সহায়তার অর্থ উধাও হয়ে যেতে পারে, কিন্তু রোহিঙ্গারা তো উধাও হয়নি।
টিউলিপের বিবৃতি
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎকারে টিউলিপ সিদ্দিকের সম্পর্কে করা মন্তব্যের বিষয়ে কথা বলতে বিবিসি মিস টিউলিপের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। জবাবে টিউলিপ সিদ্দিক একটি লিখিত বিবৃতি পাঠান।
তাতে টিউলিপ লিখেছেন, ‘আমি হতাশ যে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তার সফরের সময় আমার সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করেছেন। তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে কল্পনাপ্রসূত অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন, যার কোনো প্রমাণ গণমাধ্যমের কাছেও উপস্থাপন করা হয়নি। আমি আশা করি, তিনি এখন সংবাদমাধ্যমে আমার বদনাম ছড়ানোর অভ্যাস বন্ধ করবেন এবং আদালতে এটি প্রমাণের সুযোগ দিবে যে আমার বিরুদ্ধে তাদের চলমান তদন্তের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’