অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ফোন করে ‘নিরপেক্ষ থাকবেন বলে আশ্বস্ত করায়’ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে জামায়াতে ইসলামী পুনরায় যোগ দিয়েছে বলে জানিয়েছেন দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।
তিনি বলেন, ‘এর মধ্যে আমাদের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের অনেকে কথা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা আমাদের মাননীয় আমিরের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। আমরা আমাদের কথা বলেছি, উনি (প্রধান উপদেষ্টা) উপলব্ধি করেছেন। উনি আশ্বস্ত করেছে, উনার সরকার নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে। কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর প্রতি ঝুঁকে যাওয়া না, তারা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবেন। ওনার সঙ্গে কথা বলার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আবার আজকে আসার সিদ্ধান্ত নিই।’
বুধবার,(১৮ জুন ২০২৫) ঢাকার ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফার সংলাপের তৃতীয় দিনে খাওয়ার বিরতিতে বেরিয়ে
জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।
তবে আগের দিন মঙ্গলবার ঐক্যমত্য কমিশনের সংলাপে জামায়াতের কোনো সদস্য অংশ নেননি। পরে জামায়াতের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা বৈঠকটি ‘বয়কট’ করেছে। কারণ হিসেবে বলা হয়, গত ৩ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের পরে যে যৌথ ঘোষণা প্রকাশ করা হয় তা ‘যথাযথ’ হয়নি।
গতকাল মঙ্গলবার ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে না আসার কারণ তুলে ধরতে গিয়ে বুধবার ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে জামায়াতের নায়েবে আমির সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা যেখানে প্রশ্ন তুলেছি, উনি (প্রধান উপদেষ্টা) জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দিয়েছেন সেই ভাষণে (নির্বাচনের) একটা তারিখ ঘোষণা করেছেন, এখানে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তারিখ পরিবর্তন হতেই পারে। বিএনপি একটি বড় দল তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে তারিখ পরিবর্তন হতেই পারে, এখানেও আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আমাদের আপত্তি হলো, এখানে ভালো হইতো, তিনি টেলিভিশনে (জাতির উদ্দেশে ভাষণ) কথা বলেছিলেন, এখন বাংলাদেশে এসে সেটাকে রিভাইস করতে পারতেন। কিন্তু সেটা উনি করেন নাই।’
সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলাম, তিনি একটি দলের সঙ্গে যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন। এটা পৃথিবীর ইতিহাসে আছে কিনা আমাদের জানা নাই। বিভিন্ন দেশে সরকার প্রধানের সঙ্গে সংসদের প্রধান বিরোধী দল বা সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলের সঙ্গে বৈঠক হয়। তখন তাদের একটা স্ট্যাটাস থাকে। এখানে বহুদলীয় গণতন্ত্রে ১০০ এর বেশি দল আছে। তাহলে তো এমন এক কালচার তৈরি হবে উনি যার সঙ্গে কথা বলবেন, একটা যৌথ বিবৃতি করতে হবে। আমরা মনে করি এটা নজিরবিহীন ছিল, শুধু জামায়াতে ইসলামী নয়, সব দলই বিব্রত হয়েছে। যৌথ বিবৃতিতে আমাদের আপত্তি, বিএনপির ব্যাপারে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই।’
প্রধান উপদেষ্টা ‘নিরপেক্ষা হারিয়ে ফেলায়’ ঐকমত্য কমিশন এগুতে পারবে না দাবি করে জামায়াতের নায়েবে আমির বলেন, ‘আমাদের সেই ধারণা হয়েছে, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, তার নিরপেক্ষতা হারিয়েছেন। এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে যে সংস্কার কমিশন আছে, এখানেও তারা খুব বেশি অগ্রসর হতে পারবে না।’
আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘এটা অনেকটা ‘পর্বতের মুষিক প্রসব’ করার মতো পরিস্থিতি দাঁড়াবে, এর কার্যকারিতা হারাবে। সে কারণে আমরা কাল আসিনি, প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে আসিনি।’
প্রধান উপদেষ্টা ফোন করার কারণে বুধবার জামায়াত ফের সংলাপে এসেছে বলে জানান তিনি।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সমালোচনা
এ সময় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার একটি বক্তব্যেরও সমালোচনা করেন আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে দেখলাম, হঠাৎ করে উনি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করবেন, যিনি এক মাসেও একটা বিল্ডিংয়ের (নগর ভবন) তালা খুলতে পারেনি, তিনি ৩০০ আসনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করবেন?’
ঐকমত্য কমিশন ‘ইফ আর যদিতে’ আছে দাবি করে জামায়াতের এই নেতা বলেন, ‘আমরা বলেছি, নারীদের জন্য ১০০ আসন সরাসরি নির্বাচনে আমাদের আপত্তি নাই, তবে সেটা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে হতে হবে। সুতরাং আগে ওইটা সমাধান না করলে এটা নিয়ে মতামত দেয়া কঠিন হবে। কারণ ইফ, যদি ইত্যাদি দিয়ে তো চূড়ান্ত কোনো সমাধান হয় না। আমাদের ঐকমত্য কমিশন এখন ‘ইফে আছে, যদিতে আছে, এর পরে কিন্তু’ হবে কিনা সেটা আল্লাহ ভালো জানে।’
উষ্ণ অভ্যর্থনা পেল জামায়াত
‘বয়কটের’ পর দিন সংলাপে যোগ দিয়ে ঐকমত্য কমিশন এবং অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছে জামায়াত। বুধবার বেলা সোয়া ১১টায় ঢাকার বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমির ‘দোয়েল মাল্টিপাস হল’ প্রবেশ করেন জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান ও হামিদুর রহমান আযাদ।
মিলনায়তনের দরজার সামনেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার জামায়াতের প্রতিনিধি দলের নেতা তাহেরকে শুভেচ্ছা জানান। তারা হাসিমুখে করমর্দন করেন। পরে জামায়াত নেতারা হেঁটে হেঁটে রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। প্রধান উপদেষ্টা বিশেষ সহকারী মনির হায়দারও জামায়াতের নায়েবের আমিরের সঙ্গে করমর্দন করেন, শুভেচ্ছা জানান।
লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান জামায়াতের নায়েবের আমিরের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে বলেন, ‘ভাই একেবারে টেনশনে ফেলে দিয়েছিলেন। ফিরে এসেছেন। আমরা সবাই একসঙ্গে নতুন বাংলাদেশ গড়ব।’ আরেক নেতার সঙ্গে কুশল বিনিময়ের সময় সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের হাসতে হাসতে বলেন, ‘এটা কিছু না আমাদের সবাই এক আছি, এক থাকব।’
বাংলাদেশ জাসদের মুশতাক হোসেন ও জাতীয় গণফ্রন্টের টিপু বিশ্বাসের কাছে গিয়ে জামায়াতের নায়েবে আমীর কুশল বিনিময় করেন। ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ফরিদুজ্জামান ফরহাদের সঙ্গে কুশল বিনিময়কালে জামায়াতের এক নেতাকে বলতে শোনা যায়, ‘এটা কিছু না, একটু মান-অভিমান আর কি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ মিলনায়তনে প্রবেশ করেন সাড়ে ১১টার কাছাকাছি সময়ে। শুরুতেই তিনি জামায়াতের নায়েবের আমির আব্দুল্লাহ তাহেরের সঙ্গে কোলাকুলি করেন।
সংলাপ : জামায়াতকে সুযোগ ‘বেশি দেয়ায়’ ওয়াকআউট সিপিবি, গণফোরামের
জামায়াতে ইসলামীকে কথা বলার সুযোগ ‘বেশি দেয়া’ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ থেকে ওয়াকআউট করেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও গণফোরাম। বুধবার ঢাকার ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে কমিশনের দ্বিতীয় দফা সংলাপের তৃতীয় দিনের আলোচনায় এ ঘটনা ঘটে। তবে কমিশনের সদস্যদের হস্তক্ষেপে ফের সংলাপে ফেরেন তারা।
এদিন বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী, জাতীয় গণফ্রন্ট, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, সিপিবিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল সংলাপে অংশ নেয় এ আলোচনায়। বিকেলে নিজের অভিযোগ উত্থাপন করে সংলাপ থেকে বের হয়ে আসেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে ‘বৈষম্য হচ্ছে’ অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘জামায়াত ইসলামীর তিনজনকে বক্তব্যের সুযোগ দেয়া হয়েছে। আরও অনেকে বক্তব্য রাখছেন, অথচ আমাদের কাউকে দেয়া হচ্ছে না।’
গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমানও সংলাপ ‘বয়কট করে’ বের হয়ে আসেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘এখানে কীসের সংলাপ হচ্ছে, কার সঙ্গে সংলাপ করব। তারা যা ইচ্ছা তাই করছে। অন্তর্বর্তী সরকার যতদিন নিরপেক্ষ থাকবে না, ততদিনের জন্য আমরা বয়কট করেছি।’
সংলাপ থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘নিরপেক্ষতার বিতর্কে আমরা সাত থেকে আটটি দল ওয়াকআউটের জন্য দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। পরে দু’টি দল বয়কট করে বের হয়ে যায়। আর আমি ব্যক্তিগত কাজের জন্য সংলাপ থেকে বের হয়ে এসেছি।’
বেলা সাড়ে ১১টায় শুরুর পর রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা চলে দুপুর ২টা পর্যন্ত। এরপর দুপুরের খাবারের বিরতির পর দুপুর ৩টায় ফের সংলাপ শুরু হয়।
বিকেল পৌনে চারটার দিকে দোয়েল মাল্টিপারপাস হলের ভেতরে তাদের ‘কথা বলতে দেয়া হচ্ছে না বলে’ দাঁড়িয়ে অভিযোগ করেন সিপিবি ও গণফোরাম নেতারা। ওই সময়ে ভেতরে অন্যান্য দলের রাজনৈতিক নেতারা বসে ছিলেন।
সিপিবি ও গণফোরামের দুই নেতা সংলাপস্থলের বাইরে বের হয়ে আসার পর কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার এবং উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে ভেতরে ফিরিয়ে নিয়ে যান।
বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত সংলাপ চলবে বলে শুরুতে ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে জানিয়েছিল। শাহাদাত হোসেন সেলিম সংলাপ থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর পর সাড়ে ৪টার দিকে বের হয়ে যান গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি। তবে তিনি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাননি।
জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রীয়াজ এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। বৈঠকে ছিলেন কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, আইয়ুর মিয়া, ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দার।
আগের দিন মঙ্গলবার (দ্বিতীয় দিনের) সংলাপ ‘বয়কট’ করেছিল জামায়াতে ইসলামী। তবে বুধবার সংলাপে যোগ দিয়ে দলের নায়েবে আমির সাংবাদিকদের বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ফোন করে ‘নিরপেক্ষ থাকবেন বলে আশ্বস্ত করায়’ জামায়াত সংলাপে পুনরায় যোগ দিয়েছে।
বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ফোন করে ‘নিরপেক্ষ থাকবেন বলে আশ্বস্ত করায়’ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে জামায়াতে ইসলামী পুনরায় যোগ দিয়েছে বলে জানিয়েছেন দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।
তিনি বলেন, ‘এর মধ্যে আমাদের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের অনেকে কথা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা আমাদের মাননীয় আমিরের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। আমরা আমাদের কথা বলেছি, উনি (প্রধান উপদেষ্টা) উপলব্ধি করেছেন। উনি আশ্বস্ত করেছে, উনার সরকার নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে। কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর প্রতি ঝুঁকে যাওয়া না, তারা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবেন। ওনার সঙ্গে কথা বলার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আবার আজকে আসার সিদ্ধান্ত নিই।’
বুধবার,(১৮ জুন ২০২৫) ঢাকার ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফার সংলাপের তৃতীয় দিনে খাওয়ার বিরতিতে বেরিয়ে
জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।
তবে আগের দিন মঙ্গলবার ঐক্যমত্য কমিশনের সংলাপে জামায়াতের কোনো সদস্য অংশ নেননি। পরে জামায়াতের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা বৈঠকটি ‘বয়কট’ করেছে। কারণ হিসেবে বলা হয়, গত ৩ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের পরে যে যৌথ ঘোষণা প্রকাশ করা হয় তা ‘যথাযথ’ হয়নি।
গতকাল মঙ্গলবার ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে না আসার কারণ তুলে ধরতে গিয়ে বুধবার ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে জামায়াতের নায়েবে আমির সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা যেখানে প্রশ্ন তুলেছি, উনি (প্রধান উপদেষ্টা) জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দিয়েছেন সেই ভাষণে (নির্বাচনের) একটা তারিখ ঘোষণা করেছেন, এখানে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তারিখ পরিবর্তন হতেই পারে। বিএনপি একটি বড় দল তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে তারিখ পরিবর্তন হতেই পারে, এখানেও আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আমাদের আপত্তি হলো, এখানে ভালো হইতো, তিনি টেলিভিশনে (জাতির উদ্দেশে ভাষণ) কথা বলেছিলেন, এখন বাংলাদেশে এসে সেটাকে রিভাইস করতে পারতেন। কিন্তু সেটা উনি করেন নাই।’
সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলাম, তিনি একটি দলের সঙ্গে যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন। এটা পৃথিবীর ইতিহাসে আছে কিনা আমাদের জানা নাই। বিভিন্ন দেশে সরকার প্রধানের সঙ্গে সংসদের প্রধান বিরোধী দল বা সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলের সঙ্গে বৈঠক হয়। তখন তাদের একটা স্ট্যাটাস থাকে। এখানে বহুদলীয় গণতন্ত্রে ১০০ এর বেশি দল আছে। তাহলে তো এমন এক কালচার তৈরি হবে উনি যার সঙ্গে কথা বলবেন, একটা যৌথ বিবৃতি করতে হবে। আমরা মনে করি এটা নজিরবিহীন ছিল, শুধু জামায়াতে ইসলামী নয়, সব দলই বিব্রত হয়েছে। যৌথ বিবৃতিতে আমাদের আপত্তি, বিএনপির ব্যাপারে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই।’
প্রধান উপদেষ্টা ‘নিরপেক্ষা হারিয়ে ফেলায়’ ঐকমত্য কমিশন এগুতে পারবে না দাবি করে জামায়াতের নায়েবে আমির বলেন, ‘আমাদের সেই ধারণা হয়েছে, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, তার নিরপেক্ষতা হারিয়েছেন। এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে যে সংস্কার কমিশন আছে, এখানেও তারা খুব বেশি অগ্রসর হতে পারবে না।’
আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘এটা অনেকটা ‘পর্বতের মুষিক প্রসব’ করার মতো পরিস্থিতি দাঁড়াবে, এর কার্যকারিতা হারাবে। সে কারণে আমরা কাল আসিনি, প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে আসিনি।’
প্রধান উপদেষ্টা ফোন করার কারণে বুধবার জামায়াত ফের সংলাপে এসেছে বলে জানান তিনি।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সমালোচনা
এ সময় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার একটি বক্তব্যেরও সমালোচনা করেন আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে দেখলাম, হঠাৎ করে উনি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড করবেন, যিনি এক মাসেও একটা বিল্ডিংয়ের (নগর ভবন) তালা খুলতে পারেনি, তিনি ৩০০ আসনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করবেন?’
ঐকমত্য কমিশন ‘ইফ আর যদিতে’ আছে দাবি করে জামায়াতের এই নেতা বলেন, ‘আমরা বলেছি, নারীদের জন্য ১০০ আসন সরাসরি নির্বাচনে আমাদের আপত্তি নাই, তবে সেটা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে হতে হবে। সুতরাং আগে ওইটা সমাধান না করলে এটা নিয়ে মতামত দেয়া কঠিন হবে। কারণ ইফ, যদি ইত্যাদি দিয়ে তো চূড়ান্ত কোনো সমাধান হয় না। আমাদের ঐকমত্য কমিশন এখন ‘ইফে আছে, যদিতে আছে, এর পরে কিন্তু’ হবে কিনা সেটা আল্লাহ ভালো জানে।’
উষ্ণ অভ্যর্থনা পেল জামায়াত
‘বয়কটের’ পর দিন সংলাপে যোগ দিয়ে ঐকমত্য কমিশন এবং অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছে জামায়াত। বুধবার বেলা সোয়া ১১টায় ঢাকার বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমির ‘দোয়েল মাল্টিপাস হল’ প্রবেশ করেন জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান ও হামিদুর রহমান আযাদ।
মিলনায়তনের দরজার সামনেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার জামায়াতের প্রতিনিধি দলের নেতা তাহেরকে শুভেচ্ছা জানান। তারা হাসিমুখে করমর্দন করেন। পরে জামায়াত নেতারা হেঁটে হেঁটে রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। প্রধান উপদেষ্টা বিশেষ সহকারী মনির হায়দারও জামায়াতের নায়েবের আমিরের সঙ্গে করমর্দন করেন, শুভেচ্ছা জানান।
লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান জামায়াতের নায়েবের আমিরের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে বলেন, ‘ভাই একেবারে টেনশনে ফেলে দিয়েছিলেন। ফিরে এসেছেন। আমরা সবাই একসঙ্গে নতুন বাংলাদেশ গড়ব।’ আরেক নেতার সঙ্গে কুশল বিনিময়ের সময় সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের হাসতে হাসতে বলেন, ‘এটা কিছু না আমাদের সবাই এক আছি, এক থাকব।’
বাংলাদেশ জাসদের মুশতাক হোসেন ও জাতীয় গণফ্রন্টের টিপু বিশ্বাসের কাছে গিয়ে জামায়াতের নায়েবে আমীর কুশল বিনিময় করেন। ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ফরিদুজ্জামান ফরহাদের সঙ্গে কুশল বিনিময়কালে জামায়াতের এক নেতাকে বলতে শোনা যায়, ‘এটা কিছু না, একটু মান-অভিমান আর কি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ মিলনায়তনে প্রবেশ করেন সাড়ে ১১টার কাছাকাছি সময়ে। শুরুতেই তিনি জামায়াতের নায়েবের আমির আব্দুল্লাহ তাহেরের সঙ্গে কোলাকুলি করেন।
সংলাপ : জামায়াতকে সুযোগ ‘বেশি দেয়ায়’ ওয়াকআউট সিপিবি, গণফোরামের
জামায়াতে ইসলামীকে কথা বলার সুযোগ ‘বেশি দেয়া’ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ থেকে ওয়াকআউট করেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও গণফোরাম। বুধবার ঢাকার ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে কমিশনের দ্বিতীয় দফা সংলাপের তৃতীয় দিনের আলোচনায় এ ঘটনা ঘটে। তবে কমিশনের সদস্যদের হস্তক্ষেপে ফের সংলাপে ফেরেন তারা।
এদিন বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী, জাতীয় গণফ্রন্ট, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, সিপিবিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল সংলাপে অংশ নেয় এ আলোচনায়। বিকেলে নিজের অভিযোগ উত্থাপন করে সংলাপ থেকে বের হয়ে আসেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে ‘বৈষম্য হচ্ছে’ অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘জামায়াত ইসলামীর তিনজনকে বক্তব্যের সুযোগ দেয়া হয়েছে। আরও অনেকে বক্তব্য রাখছেন, অথচ আমাদের কাউকে দেয়া হচ্ছে না।’
গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমানও সংলাপ ‘বয়কট করে’ বের হয়ে আসেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘এখানে কীসের সংলাপ হচ্ছে, কার সঙ্গে সংলাপ করব। তারা যা ইচ্ছা তাই করছে। অন্তর্বর্তী সরকার যতদিন নিরপেক্ষ থাকবে না, ততদিনের জন্য আমরা বয়কট করেছি।’
সংলাপ থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘নিরপেক্ষতার বিতর্কে আমরা সাত থেকে আটটি দল ওয়াকআউটের জন্য দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। পরে দু’টি দল বয়কট করে বের হয়ে যায়। আর আমি ব্যক্তিগত কাজের জন্য সংলাপ থেকে বের হয়ে এসেছি।’
বেলা সাড়ে ১১টায় শুরুর পর রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা চলে দুপুর ২টা পর্যন্ত। এরপর দুপুরের খাবারের বিরতির পর দুপুর ৩টায় ফের সংলাপ শুরু হয়।
বিকেল পৌনে চারটার দিকে দোয়েল মাল্টিপারপাস হলের ভেতরে তাদের ‘কথা বলতে দেয়া হচ্ছে না বলে’ দাঁড়িয়ে অভিযোগ করেন সিপিবি ও গণফোরাম নেতারা। ওই সময়ে ভেতরে অন্যান্য দলের রাজনৈতিক নেতারা বসে ছিলেন।
সিপিবি ও গণফোরামের দুই নেতা সংলাপস্থলের বাইরে বের হয়ে আসার পর কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার এবং উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে ভেতরে ফিরিয়ে নিয়ে যান।
বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত সংলাপ চলবে বলে শুরুতে ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে জানিয়েছিল। শাহাদাত হোসেন সেলিম সংলাপ থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর পর সাড়ে ৪টার দিকে বের হয়ে যান গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি। তবে তিনি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাননি।
জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রীয়াজ এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। বৈঠকে ছিলেন কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, আইয়ুর মিয়া, ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দার।
আগের দিন মঙ্গলবার (দ্বিতীয় দিনের) সংলাপ ‘বয়কট’ করেছিল জামায়াতে ইসলামী। তবে বুধবার সংলাপে যোগ দিয়ে দলের নায়েবে আমির সাংবাদিকদের বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ফোন করে ‘নিরপেক্ষ থাকবেন বলে আশ্বস্ত করায়’ জামায়াত সংলাপে পুনরায় যোগ দিয়েছে।