ছবি : অনলাইন থেকে সংগৃহীত
বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নে অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণে গঠিত টাস্কফোর্স যেসব সুপারিশ করেছিল, তার বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না বলে মনে করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘সরকার শ্বেতপত্র ও অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণে টাস্কফোর্স গঠন করলেও তাদের সুপারিশের বাস্তবায়ন দেখছি না।
কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে ব্যাংক খাত, বৈদেশিক খাত ও মূল্যস্ফীতিতে
এনবিআরের ভেতরের ‘গৃহ শত্রু’ দমন করা সম্ভব হয়েছে: গভর্নর
সামাজিক নিরাপত্তা খাতে জোর দেয়ার তাগিদ আমির খসরুর
৩৬৫ দিনে ম্যাজিক্যাল কিছু দেখতে পাইনি: বিটিএমএ সভাপতি
বছরে এক লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি হচ্ছে: রাজেকুজ্জামান রতন
শ্রম খাত, গণমাধ্যম, নারী ও স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে অগ্রগতি দেখছি না। আর শিক্ষায় তো কমিশন হয়নি।’
অন্তর্বর্তী সরকারের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে সিপিডি আয়োজিত এক সংলাপে তিনি এ কথা বলেন। সিপিডির সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর মুস্তাফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ. মনসুরসহ বিভিন্ন দলের নেতা ও ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গত ১০ সেপ্টেম্বর এ টাস্কফোর্স গঠন করে যা প্রতিবেদন দেয় ৩০ জানুয়ারি। তাতে করা সুপারিশের মধ্যে রয়েছেÑ অর্থনীতির মধ্যে স্থিরতা আনা, ২০২৫-২৬ সালের বাজেট বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্পষ্ট ধারণা তৈরি করা, ২০২৫ থেকে ২৭ সালকে বিবেচনায় নিয়ে একটি মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা এবং এর সঙ্গে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার যথাযথ মূল্যায়ন করা, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সংস্কারপ্রক্রিয়া শুরু করার জন্য ভঙ্গুর ও ঝুঁকিপূর্ণ খাতকে চিহ্নিত করা, স্বল্পোন্নত দেশে থেকে অধিকতর উন্নত দেশে রূপান্তরের জন্য শক্তিশালী নীতিমালা গ্রহণ, এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য কার্যক্রম হাতে নেয়া এবং উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সংলাপের জন্য একটি ফোরাম তৈরি করা।
শ্বেতপত্রের সুপারিশের কিছুটা প্রভাব ব্যাংক খাত, বৈদেশিক খাত ও মূল্যস্ফীতিতে দেখতে পাওয়ার কথা জানিয়েছে সিপিডি। তবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি, বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবাহ, রাজস্ব আহরণ, এডিপি বাস্তবায়নে নেতিবাচক ধারা থাকার তথ্য তুলে ধরেন ফাহমিদা খাতুন।
তিনি বলেন, ‘উন্নতি দেখতে পেয়েছি- মূল্যস্ফীতিতে, যেটা দেখেছি ১০ বা তার বেশি, এখন তা কমছে। কমার হার কম, তবে কমছে।’ তবে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নয়নে একবছর সময় কম হলেও এর মধ্যে জীবন ও জীবিকায় ‘স্বস্তি’ না আসায় সমালোচনা করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
এ অবস্থায় খোলা ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে টিসিবির পণ্য সরবরাহ চালু রাখার পরামর্শ দেন তিনি। জুন মাসে কিছুটা কমার পর জুলাই মাসে খাদ্য এবং খাদ্যবহির্ভূত দুই খাতেই মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। অর্থবছরের প্রথম মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ, যা জুন মাসে ছিল ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
ইতিবাচক কিছু সংস্কার হয়েছে জানিয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কিছু সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যাংক খাত সংস্কার অন্যতম উদ্যোগ। এর ফলে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বেড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একটা ভালো অবস্থায় গেছে, পতন ঠেকানো গেছে। এটা একটা অন্যতম সাফল্য। এর পাশাপাশি এটাও জানি মূল্যস্ফীতি উচ্চপর্যায়ে রয়েছে, বিনিয়োগ আসছে না, কর্মসংস্থান হচ্ছে না। রাজস্ব আহরণ বাড়ছে না। সুতরাং এই বিষয়গুলো আগামী ৬ মাস ও নতুন সরকারকে মাথায় রাখতে হবে।’
বিনিয়োগে স্থবিরতা এসেছে জানিয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘এখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের সময় নতুন করে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না। কিন্তু বিনিয়োগের ক্ষেত্রগুলো প্রস্তুত করলে আগামীতে যারা সরকারে আসবে তখন বিনিয়োগকারীরা যেন সহজেই বিনিয়োগ করতে পারেন। আমরা
এরই মধ্যে জেনে গেছি ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আগামী ৫-৬ মাসে নতুন করে সংস্কার কাজ কতটা বাস্তবায়ন হবে, সংস্কারের যে সুপারিশমালা রয়েছে তা কতটা বাস্তবায়ন হবে তা বলা যাচ্ছে না। সংস্কারের জন্য যে পদক্ষেপ এই পর্যন্ত সেটা কিন্তু ধীর গতিতে ছিল।’
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার যখন শাসন ভার গ্রহণ করলেন গতবছরের ৮ আগস্ট, তার এক সপ্তাহ পর ১৪ আগস্ট আমরা একটা আলোচনা করেছিলাম যে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা কী? তখন আমাদের অর্থনীতি বেশ বিপজ্জনক অবস্থায় ছিল। রিজার্ভের ধারাবাহিক পতন হচ্ছিল। টাকার বিনিময় হারের অবনমন হচ্ছিল খুব দ্রুত। সামষ্টিক অর্থনীতি অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। উচ্চমূল্যস্ফীতি ও বেকারত্ব বাড়ছিল, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমছিল। ২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট সিপিডির পক্ষ থেকে এসব চ্যালেঞ্জের কথা বলি। এখন এক বছর পর যখন ফিরে তাকাচ্ছি তখন মূল্যায়নের একটা সময় এসেছে, প্রয়োজনীয়তা ও দেখা দিয়েছে। নাজুক পরিস্থিতি থেকে ব্যাংকিং খাত স্থিতিশীল পরিস্থিতিতে যাওয়ার চেষ্টা আছে।’
দেশে টানা চার মাস মূল্যস্ফীতি কমার পর ফের বাড়াকে ‘স্বাভাবিক’ হিসেবে দেখছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘ইনফ্লেশন কিছু কমেছে। আরও অনেক কমাতে হবে। কিন্তু প্রতি মাসেই যে কমবে এই ধারণা করাটাও আবার ভুল হয়। দুই মাস-তিন মাস কমবে, আবার এক মাস বাড়বে এটাই স্বাভাবিক।’ তবে অর্থবছর শেষে সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার আশা প্রকাশ করেন গভর্নর।
এনবিআরের ভেতরের ‘গৃহ শত্রু’ দমন করা সম্ভব হয়েছে: গভর্নর
তবে রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মীদের আন্দোলনের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘যে জিনিসটা আমাদের খেয়াল করতে হবে, সেটা হচ্ছে, গভার্নমেন্টের যে সমস্যা, অর্থাৎ রেভিনিউ শর্টফল (রাজস্ব ঘাটতি) এবং সেটার ফলে যে বড় রিকয়ারমেন্ট, সেটাকে তো আমরা করতে পারি নাই। এখানে যে জিনিসটা হয়ে যাচ্ছে যে রিফর্ম যদি শুরুও করা হয় আজকে, রেজাল্ট আসবে তিন বছর পর। আমি সবসময় বলি এই জায়গাটায় রিফর্ম দরকার। অনেক আন্দোলন দেখবেন এনবিআর নিয়ে। কত রকমের ঝামেলা... এটা তো বিশাল ঝামেলা। যাই হোক, আমি সরকারকে সাধুবাদ অবশ্যই দেব যে দৃঢ় অবস্থানে ছিল।’
সংস্কারে বাধা প্রসঙ্গে এনবিআরের মধ্যে ‘গৃহ শত্রু’র কথা বলেন গভর্নর। তিনি বলেন, ‘এখনই দ্রুততার সাথে এই রিফর্মগুলো (এনবিআরের) বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ যে প্রতিপক্ষটা ছিল ভেতরের, যেটা ‘গৃহ শত্রু’, সেটাকে কিন্তু এখন অনেকখানি দমন করা সম্ভব হয়েছে। তাদের রেখে এটা করা সম্ভব ছিল না। রেজিস্ট্যান্স ফ্রম উইদিন এনবিআর, হিউজ অ্যান্ড ভেরি স্ট্রং। ভেরি স্ট্রং। কানেক্টিভিটি টু হোল পলিটিক্যাল অ্যাফিলিয়েশন। এ বিষয়ে আমাদের বুঝতে হবে।’
সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে বাজেট দেয়া উচিত ছিল: আমীর খসরু
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান দায়িত্ব জনগণের মালিকানা ফিরিয়ে দেয়া। অর্থনীতি স্থিতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে এই সময় অনেক কাজ হয়েছে। বড় বিষয় হচ্ছে মানিলন্ডারিং বন্ধ হয়ে গেছে। যারা লন্ডারিং করতো তারা তো পালিয়ে গেছে। যারা দেশে আছে তাদের হাতে টাকা নেই। মানিলন্ডারিং বন্ধ হওয়ার কারণে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পেয়েছে। রপ্তানিও বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের উচিত ছিল স্বৈরাচারের বাজেট চালিয়ে না যাওয়া। ওই বাজেট বাদ দিয়ে সামাজিক বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে নতুন বাজেট দিতে পারতাম। আমি মনে করি এটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।’
৩৬৫ দিনে ম্যাজিক্যাল কিছু দেখতে পাইনি: বিটিএমএ সভাপতি
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) বর্তমান সভাপতি হলেন শওকত আজিজ রাসেল বলেন, ‘গভর্নর বলে গেলেন বিপদের সময় জনশক্তি ও গার্মেন্টস খাত তাদের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন গত ৩৬৫ দিনে আমাদের জন্য কী করেছেন? অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে টেক্সটাইল খাতে কর্পোরেট কর ১৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ৩৭ শতাংশ করা হয়েছে। ফিনিশড প্রোডাক্ট আসবে শুল্ক ছাড়া কিন্তু কাঁচামাল তুলা ২ শতাংশ শুল্কারোপ করা হয়েছে। তার ওপর চাঁদাবাজ তো আছেই। গ্যাস ও বিদ্যুৎ নেই। গত ৩৬৫ দিনে ম্যাজিক্যাল আমি কিছু দেখতে পাইনি। আমি গঠনমূলক সমালোচনা করছি, এটাকে তিরস্কার ভাববেন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘জনশক্তির জন্য কোনো ট্রেনিং সেন্টার করেছেন? মালয়েশিয়ায় দেখেছি ভারতীয় দক্ষ শ্রমিক যা নিজের দেশ থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসে বেশি বেতনে কাজ করছে। আমাদের শ্রমিক ঘরমোছার কাজ করে নিম্ন বেতনে। বাজেটে ওই সেক্টরের জন্য কিছুই রাখা হয়নি। আমার সেক্টরে ১৮৫০টি কারখানা রয়েছে। সেখান থেকে ৩৬৫ দিনে ১৮৫১টি হয়নি। বরং কিছু কমেছে। এটাই বাস্তবতা। পলিসি সংস্কার হয়নি।’
বছরে এক লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি হচ্ছে: রাজেকুজ্জামান রতন
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) কেন্দ্রীয় সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, ‘আগের সরকারের সময়ে সমালোচনা করলে বলা হতো স্বাধীনতাবিরোধী। আর এখন বলা হয় ফ্যাসিবাদের দোসর। শুধু দোসর খোঁজেন, ভাশুরকে আড়াল করছেন কেন? একই পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করে ভিন্ন ফল আশা করেন কীভাবে? বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে চাঁদাবাজির প্রভাব এটা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। বছরে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়। সেটা রাজনীতি ও সাধারণ মানুষের কেমন প্রভাব পড়ে। আলোচনা করা দরকার।’
ছবি : অনলাইন থেকে সংগৃহীত
রোববার, ১০ আগস্ট ২০২৫
বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নে অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণে গঠিত টাস্কফোর্স যেসব সুপারিশ করেছিল, তার বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না বলে মনে করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘সরকার শ্বেতপত্র ও অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণে টাস্কফোর্স গঠন করলেও তাদের সুপারিশের বাস্তবায়ন দেখছি না।
কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে ব্যাংক খাত, বৈদেশিক খাত ও মূল্যস্ফীতিতে
এনবিআরের ভেতরের ‘গৃহ শত্রু’ দমন করা সম্ভব হয়েছে: গভর্নর
সামাজিক নিরাপত্তা খাতে জোর দেয়ার তাগিদ আমির খসরুর
৩৬৫ দিনে ম্যাজিক্যাল কিছু দেখতে পাইনি: বিটিএমএ সভাপতি
বছরে এক লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি হচ্ছে: রাজেকুজ্জামান রতন
শ্রম খাত, গণমাধ্যম, নারী ও স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে অগ্রগতি দেখছি না। আর শিক্ষায় তো কমিশন হয়নি।’
অন্তর্বর্তী সরকারের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে সিপিডি আয়োজিত এক সংলাপে তিনি এ কথা বলেন। সিপিডির সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর মুস্তাফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ. মনসুরসহ বিভিন্ন দলের নেতা ও ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গত ১০ সেপ্টেম্বর এ টাস্কফোর্স গঠন করে যা প্রতিবেদন দেয় ৩০ জানুয়ারি। তাতে করা সুপারিশের মধ্যে রয়েছেÑ অর্থনীতির মধ্যে স্থিরতা আনা, ২০২৫-২৬ সালের বাজেট বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্পষ্ট ধারণা তৈরি করা, ২০২৫ থেকে ২৭ সালকে বিবেচনায় নিয়ে একটি মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা এবং এর সঙ্গে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার যথাযথ মূল্যায়ন করা, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সংস্কারপ্রক্রিয়া শুরু করার জন্য ভঙ্গুর ও ঝুঁকিপূর্ণ খাতকে চিহ্নিত করা, স্বল্পোন্নত দেশে থেকে অধিকতর উন্নত দেশে রূপান্তরের জন্য শক্তিশালী নীতিমালা গ্রহণ, এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য কার্যক্রম হাতে নেয়া এবং উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সংলাপের জন্য একটি ফোরাম তৈরি করা।
শ্বেতপত্রের সুপারিশের কিছুটা প্রভাব ব্যাংক খাত, বৈদেশিক খাত ও মূল্যস্ফীতিতে দেখতে পাওয়ার কথা জানিয়েছে সিপিডি। তবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি, বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবাহ, রাজস্ব আহরণ, এডিপি বাস্তবায়নে নেতিবাচক ধারা থাকার তথ্য তুলে ধরেন ফাহমিদা খাতুন।
তিনি বলেন, ‘উন্নতি দেখতে পেয়েছি- মূল্যস্ফীতিতে, যেটা দেখেছি ১০ বা তার বেশি, এখন তা কমছে। কমার হার কম, তবে কমছে।’ তবে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নয়নে একবছর সময় কম হলেও এর মধ্যে জীবন ও জীবিকায় ‘স্বস্তি’ না আসায় সমালোচনা করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
এ অবস্থায় খোলা ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে টিসিবির পণ্য সরবরাহ চালু রাখার পরামর্শ দেন তিনি। জুন মাসে কিছুটা কমার পর জুলাই মাসে খাদ্য এবং খাদ্যবহির্ভূত দুই খাতেই মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। অর্থবছরের প্রথম মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ, যা জুন মাসে ছিল ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
ইতিবাচক কিছু সংস্কার হয়েছে জানিয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কিছু সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যাংক খাত সংস্কার অন্যতম উদ্যোগ। এর ফলে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বেড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একটা ভালো অবস্থায় গেছে, পতন ঠেকানো গেছে। এটা একটা অন্যতম সাফল্য। এর পাশাপাশি এটাও জানি মূল্যস্ফীতি উচ্চপর্যায়ে রয়েছে, বিনিয়োগ আসছে না, কর্মসংস্থান হচ্ছে না। রাজস্ব আহরণ বাড়ছে না। সুতরাং এই বিষয়গুলো আগামী ৬ মাস ও নতুন সরকারকে মাথায় রাখতে হবে।’
বিনিয়োগে স্থবিরতা এসেছে জানিয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘এখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের সময় নতুন করে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না। কিন্তু বিনিয়োগের ক্ষেত্রগুলো প্রস্তুত করলে আগামীতে যারা সরকারে আসবে তখন বিনিয়োগকারীরা যেন সহজেই বিনিয়োগ করতে পারেন। আমরা
এরই মধ্যে জেনে গেছি ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আগামী ৫-৬ মাসে নতুন করে সংস্কার কাজ কতটা বাস্তবায়ন হবে, সংস্কারের যে সুপারিশমালা রয়েছে তা কতটা বাস্তবায়ন হবে তা বলা যাচ্ছে না। সংস্কারের জন্য যে পদক্ষেপ এই পর্যন্ত সেটা কিন্তু ধীর গতিতে ছিল।’
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার যখন শাসন ভার গ্রহণ করলেন গতবছরের ৮ আগস্ট, তার এক সপ্তাহ পর ১৪ আগস্ট আমরা একটা আলোচনা করেছিলাম যে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা কী? তখন আমাদের অর্থনীতি বেশ বিপজ্জনক অবস্থায় ছিল। রিজার্ভের ধারাবাহিক পতন হচ্ছিল। টাকার বিনিময় হারের অবনমন হচ্ছিল খুব দ্রুত। সামষ্টিক অর্থনীতি অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। উচ্চমূল্যস্ফীতি ও বেকারত্ব বাড়ছিল, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমছিল। ২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট সিপিডির পক্ষ থেকে এসব চ্যালেঞ্জের কথা বলি। এখন এক বছর পর যখন ফিরে তাকাচ্ছি তখন মূল্যায়নের একটা সময় এসেছে, প্রয়োজনীয়তা ও দেখা দিয়েছে। নাজুক পরিস্থিতি থেকে ব্যাংকিং খাত স্থিতিশীল পরিস্থিতিতে যাওয়ার চেষ্টা আছে।’
দেশে টানা চার মাস মূল্যস্ফীতি কমার পর ফের বাড়াকে ‘স্বাভাবিক’ হিসেবে দেখছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘ইনফ্লেশন কিছু কমেছে। আরও অনেক কমাতে হবে। কিন্তু প্রতি মাসেই যে কমবে এই ধারণা করাটাও আবার ভুল হয়। দুই মাস-তিন মাস কমবে, আবার এক মাস বাড়বে এটাই স্বাভাবিক।’ তবে অর্থবছর শেষে সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার আশা প্রকাশ করেন গভর্নর।
এনবিআরের ভেতরের ‘গৃহ শত্রু’ দমন করা সম্ভব হয়েছে: গভর্নর
তবে রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মীদের আন্দোলনের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘যে জিনিসটা আমাদের খেয়াল করতে হবে, সেটা হচ্ছে, গভার্নমেন্টের যে সমস্যা, অর্থাৎ রেভিনিউ শর্টফল (রাজস্ব ঘাটতি) এবং সেটার ফলে যে বড় রিকয়ারমেন্ট, সেটাকে তো আমরা করতে পারি নাই। এখানে যে জিনিসটা হয়ে যাচ্ছে যে রিফর্ম যদি শুরুও করা হয় আজকে, রেজাল্ট আসবে তিন বছর পর। আমি সবসময় বলি এই জায়গাটায় রিফর্ম দরকার। অনেক আন্দোলন দেখবেন এনবিআর নিয়ে। কত রকমের ঝামেলা... এটা তো বিশাল ঝামেলা। যাই হোক, আমি সরকারকে সাধুবাদ অবশ্যই দেব যে দৃঢ় অবস্থানে ছিল।’
সংস্কারে বাধা প্রসঙ্গে এনবিআরের মধ্যে ‘গৃহ শত্রু’র কথা বলেন গভর্নর। তিনি বলেন, ‘এখনই দ্রুততার সাথে এই রিফর্মগুলো (এনবিআরের) বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ যে প্রতিপক্ষটা ছিল ভেতরের, যেটা ‘গৃহ শত্রু’, সেটাকে কিন্তু এখন অনেকখানি দমন করা সম্ভব হয়েছে। তাদের রেখে এটা করা সম্ভব ছিল না। রেজিস্ট্যান্স ফ্রম উইদিন এনবিআর, হিউজ অ্যান্ড ভেরি স্ট্রং। ভেরি স্ট্রং। কানেক্টিভিটি টু হোল পলিটিক্যাল অ্যাফিলিয়েশন। এ বিষয়ে আমাদের বুঝতে হবে।’
সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে বাজেট দেয়া উচিত ছিল: আমীর খসরু
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান দায়িত্ব জনগণের মালিকানা ফিরিয়ে দেয়া। অর্থনীতি স্থিতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে এই সময় অনেক কাজ হয়েছে। বড় বিষয় হচ্ছে মানিলন্ডারিং বন্ধ হয়ে গেছে। যারা লন্ডারিং করতো তারা তো পালিয়ে গেছে। যারা দেশে আছে তাদের হাতে টাকা নেই। মানিলন্ডারিং বন্ধ হওয়ার কারণে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পেয়েছে। রপ্তানিও বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের উচিত ছিল স্বৈরাচারের বাজেট চালিয়ে না যাওয়া। ওই বাজেট বাদ দিয়ে সামাজিক বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে নতুন বাজেট দিতে পারতাম। আমি মনে করি এটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।’
৩৬৫ দিনে ম্যাজিক্যাল কিছু দেখতে পাইনি: বিটিএমএ সভাপতি
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) বর্তমান সভাপতি হলেন শওকত আজিজ রাসেল বলেন, ‘গভর্নর বলে গেলেন বিপদের সময় জনশক্তি ও গার্মেন্টস খাত তাদের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন গত ৩৬৫ দিনে আমাদের জন্য কী করেছেন? অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে টেক্সটাইল খাতে কর্পোরেট কর ১৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ৩৭ শতাংশ করা হয়েছে। ফিনিশড প্রোডাক্ট আসবে শুল্ক ছাড়া কিন্তু কাঁচামাল তুলা ২ শতাংশ শুল্কারোপ করা হয়েছে। তার ওপর চাঁদাবাজ তো আছেই। গ্যাস ও বিদ্যুৎ নেই। গত ৩৬৫ দিনে ম্যাজিক্যাল আমি কিছু দেখতে পাইনি। আমি গঠনমূলক সমালোচনা করছি, এটাকে তিরস্কার ভাববেন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘জনশক্তির জন্য কোনো ট্রেনিং সেন্টার করেছেন? মালয়েশিয়ায় দেখেছি ভারতীয় দক্ষ শ্রমিক যা নিজের দেশ থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসে বেশি বেতনে কাজ করছে। আমাদের শ্রমিক ঘরমোছার কাজ করে নিম্ন বেতনে। বাজেটে ওই সেক্টরের জন্য কিছুই রাখা হয়নি। আমার সেক্টরে ১৮৫০টি কারখানা রয়েছে। সেখান থেকে ৩৬৫ দিনে ১৮৫১টি হয়নি। বরং কিছু কমেছে। এটাই বাস্তবতা। পলিসি সংস্কার হয়নি।’
বছরে এক লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি হচ্ছে: রাজেকুজ্জামান রতন
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) কেন্দ্রীয় সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, ‘আগের সরকারের সময়ে সমালোচনা করলে বলা হতো স্বাধীনতাবিরোধী। আর এখন বলা হয় ফ্যাসিবাদের দোসর। শুধু দোসর খোঁজেন, ভাশুরকে আড়াল করছেন কেন? একই পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করে ভিন্ন ফল আশা করেন কীভাবে? বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে চাঁদাবাজির প্রভাব এটা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। বছরে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়। সেটা রাজনীতি ও সাধারণ মানুষের কেমন প্রভাব পড়ে। আলোচনা করা দরকার।’