পাথরখেকোদের আগ্রাসনে নিঃস্ব হওয়ার পথে সিলেটের মূল্যবান সাদা পাথর -সংবাদ
সাদা পাথর। এটি সিলেটের সীমান্তকেন্দ্রিক অপরূপ সৌন্দর্যের একটি পর্যটনকেন্দ্র। দেশি-বিদেশি লাখ লাখ পর্যটক সেখানে গিয়ে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলতেন। অথচ এই পর্যটন কেন্দ্রটি এখন পাথরের পরিবর্তে বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। বড় বড় গর্তে অনেকটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়েছে সাদা পাথর।
এক বছরে হাজার কোটি টাকার লুটপাট, বিএনপির সভাপতিকে অব্যাহতি
ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বালুখেকোদের বিরুদ্ধে
চিহ্নিত পাথরখেকোরা গত এক বছরে হাজার কোটি টাকার পাথর লুটপাট করে নিয়েছে। গণমাধ্যমে খবর প্রচারিত বা এলাকাবাসী মাঝে মধ্যে প্রতিবাদ করলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে লোক দেখানো অভিযান পরিচালনা হয়ে আসছে মাঝে মধ্যে। এমনকি পরিবেশ উপদেষ্টা নিজেও স্বীকার করে নিয়েছেন পাথর লুটপাট বন্ধ করতে পারেননি তিনি। এসব ঘটনার সঙ্গে সিলেট বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে যুবদলের কয়েকজন নেতা জড়িত। এরই মধ্যে চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ দলীয় নীতি ও আদর্শবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে সিলেট জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিনকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় বিএনপি।
গতকাল সোমবার বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সাহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগ যাচাই-বাছাইয়ের পর তার সব দলীয় পদ সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও উল্লেখ করা হয়, তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে বর্তমান সহ-সভাপতি হাজী আব্দুল মান্নানকে উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করবেন।
দলীয় নেতারা জানিয়েছেন, সাংগঠনিক শৃঙ্খলা রক্ষা ও দলীয় ভাবমূর্তি অক্ষু্ণ্য রাখতে কেন্দ্রীয় কমিটি এই পদক্ষেপ নিয়েছে।
সাহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে সরকারি দেড়শ’ একর ভূমি দখল, পাথর কোয়ারির জমি ভাড়া দেয়াসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ অনেকদিন ধরে উঠছে। ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারির পাশে সরকারি ২৭৫ একর উন্মুক্ত জায়গার অর্ধেকের বেশি অংশ তার দখলে ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব জমি পাথর ভাঙার মেশিন মালিকদের কাছে ভাড়া দিয়ে বিপুল অর্থ আয় করা হতো।
গত ৫ আগস্ট আবারও ভোলাগঞ্জের ১০ নম্বর সাইট এলাকায় শতাধিক সরকারি জমি দখলের অভিযোগ ওঠে সাহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে। সেখানে থেকে লাখ লাখ টাকা ভাড়া নেয়ার তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হলে দলের হাইকমান্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ হয়।
গত ১৮ মার্চ সিলেট জেলা বিএনপি তাকে শোকজ নোটিশ দিয়েছিল। জেলা সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক এমরান আহমদ চৌধুরীর স্বাক্ষরিত নোটিশে ৭ কার্যদিবসের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়। তবে গ্রহণযোগ্য জবাব না দেয়ায় সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার কথা ছিল।
সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপির নেতৃবৃন্দ সাহাব উদ্দিনের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে বারবার সমালোচনার মুখে পড়ে তারা তারেক রহমানের নির্দেশনা অনুযায়ী শৃঙ্খলাভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলতেন।
অবশেষে, গতকাল সোমবার কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তে সাহাব উদ্দিনকে পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে হাজী আব্দুল মান্নানকে নতুন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নিয়োগ দেয়া হয়। অভিযোগ আছে, সাহাব উদ্দিনের মাধ্যমে সিলেট জেলা বিএনপির সম্পাদকীয় শীর্ষ পদে থাকা এক নেতা বেশ কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। আর যখনই গণমাধ্যমে সাদা পাথর লুটপাটের বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়, ঠিক তখন নিজের গা বাঁচাতে হাইকমান্ডের মাধ্যমে সাহাব উদ্দিনের পদ স্থগিত করানো হয়।
গেল বছরের ৫ আগস্টের পর পরই বিরামহীনভাবে চলে ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্রের পাথর লুট। সিলেটের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে ভ্রমণপিপাসু মানুষের পছন্দের শীর্ষে থাকা এটি বর্তমানে লুটে ক্ষতবিক্ষত স্পটে পরিণত হয়েছে। পাথরের সঙ্গে বালুও লুট করা হচ্ছে। অথচ পর্যটনকেন্দ্রের চারদিকে বিজিবির চারটি ক্যাম্প ও পোস্ট রয়েছে।
পরিবেশকর্মী ও স্থানীয় বাসিন্দার অভিযোগ, ৫ আগস্টের আগে যত দূর চোখ যেত, দেখা যেত সাদা সাদা পাথর আর পাথর। কিন্তু এখন সেখানে ধু-ধু বালুচর। তাদের ভাষ্যে, এক বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে।
সরেজমিন গতকাল সোমবার দেখা গেছে, সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্রের ধলাই নদীর উৎসমুখ থেকে শত শত নৌকা দিয়ে পাথর লুট হচ্ছে। মূল স্পটের বাম পাশের বড় বড় পাথর নেই। কোথাও কোথাও বালুচর জেগে উঠেছে। যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়িও চলছে। বড় পাথরের পাশাপাশি ছোট ছোট পাথরও লুট হয়ে গেছে। প্রকাশ্যে দিবালোকে পাথর নিয়ে যাচ্ছে আর দায়িত্বশীলরা বসে বসে সে দৃশ্য দেখছে।
এছাড়াও পাথরবোঝাই শত শত নৌকার মাঝে পর্যটকবাহী নৌকাও ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। এতে পর্যটকরা হতাশা প্রকাশ করেছেন।
সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্রের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রশাসনের উদাসীনতা ও টিলেঢালা নজরদারির কারণে পাথরখেকোরা নির্বিঘ্নে তাদের ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। মাঝে মধ্যে অভিযান চালালেও তার প্রভাব থাকে সামান্য সময়। এরপর আবারও লুটপাট চলে। একটি প্রভাবশালী মহল সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্র ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান।
গতকাল সোমবার ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান হতাশা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, আগের চার বছর জাফলং-এ পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখতে পেরেছিলাম, এখন আমি উপদেষ্টা হয়েও পারলাম না।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পাথর উত্তোলনে সর্বদলীয় ঐক্য দেখছি। একটি সুন্দর জিনিস কী করে হাতে ধরে কেমন অসুন্দর করতে হয় সেটা শিখতে হলে বাংলাদেশে আসতে হবে। চোখের সামনে অপূর্ব সুন্দর একটি জায়গা জাফলং চোখের সামনে নষ্ট হতে দেখলাম। ধ্বংসলীলা দেখলাম।
তিনি বলেন, শুনলাম, এই পাথরগুলো নাকি তুলতেই হবে। কেন তুলতে হবে, কেন? কারও কাছে কোনো পরিসংখ্যান নেই। অথচ পরিসংখ্যান বলছে দেশের চাহিদার মাত্র ৬ ভাগ পূরণ হয় এই পাথরগুলো তুলে। বাকি ৯৪ ভাগই আমদানি করতে হয়। ৯৪ ভাগ আমদানি করতে পারলে বাকি ৬ ভাগ কেন পারলাম না!
তিনি আরও বলেন, কেন আমরা ভিয়েতনামে গিয়ে ওদের নদীর ইকো ট্যুরিজম দেখি, কেন আমরা জাফলং-এ একটা ইকো ট্যুরিজম করতে পারলাম না! আমরা যেমন সৌন্দর্যমণ্ডিত জাফলং দেখেছি, কেন নতুন প্রজন্ম সেই জাফলং দেখতে পারল না! সেখানে আবার রাজনৈতিক ঐক্য দেখলাম।
উপদেষ্টা বলেন, ‘সিলেটে দুজন উপদেষ্টা গেলাম, সেখানে পাথর তুলতে সর্বদলীয় ঐক্য দেখলাম। আগের চার বছর জাফলং-এ পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখতে পেরেছিলাম, এখন আমি উপদেষ্টা হয়েও পারছি না। জাফলং রক্ষা করব বলে কোনো ঐক্য দেখলাম না। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের বাস্তবতা। জাফলংটা ধ্বংস করে দিয়ে কীসের উন্নয়ন, কার উন্নয়ন হচ্ছে? আমরা যদি পাথর না তুলে ইকো ট্যুরিজম করি, হিসাব করে দেখুন পাথর তুলে কত আয় হয় আর ইকো ট্যুরিজম থেকে কত আয় হয়! এই কম্পারেটিভ অ্যানালাইসিস কি কেউ করেছে? একজন ডিসি বলেছিলেন, ইকো ট্যুরিজমে আমরা পাথর তোলা থেকে বেশি আয় করতে পারব। একটা মানুষ সারাদিন পানিতে নেমে পাথর তোলেন, এটাকে আপনার এমপ্লয়মেন্ট বলেন! এটা এক্সপ্লয়েটেশন। এটা একদম ক্লিয়ার কেস অব এক্সপ্লয়েটেশন।’
এদিকে কোম্পানীগঞ্জের স্থানীয় মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাদা পাথর রক্ষার আন্দোলন করলেও বন্ধ হয়নি পাথর ও ধলাই সেতুর আশপাশ থেকে বালু লুট। ইতোমধ্যে পাথর লুটপাটের ঘটনায় স্থানীয় বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিনকে বালু লুটের নেতৃত্বে রয়েছেন দলীয় পথ থেকে অব্যাহতি দিলেও বালু লুটপাটের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
‘ধলাই সেতু রক্ষা আন্দোলন কমিটির’ নেতারা ও স্থানীয় বিএনপির নেতারা দাবি করেছেন, বালু লুটের পেছনে রয়েছেন ‘বালু দরবেশ’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া সিলেট জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মকসুদ আহমদ।
ধলাই সেতু রক্ষা আন্দোলনের সদস্য-সচিব নিজাম উদ্দিন মাস্টার জানান, গত ১৩ জুলাই থেকে এলাকাবাসী ধলাই সেতু রক্ষায় ব্রিজের নিচ থেকে বেআইনি বালু উত্তোলন বন্ধের জন্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু হয়।
তিনি আরও জানান, ১৬ জুলাই প্রথম প্রতিবাদ সভা থেকে ধলাই সেতু রক্ষার জন্য আন্দোলন জোরদার করার লক্ষ্যে কমিটি গঠন করা হয়। ওইদিন আলমগীর আলম চেয়ারম্যানকে আহ্বায়ক ও নিজাম উদ্দিন মাস্টারকে সদস্য-সচিব করে ধলাই সেতু রক্ষা কমিটি গঠন করা হয়। ১৭ জুলাই কমিটি নিয়ে এলাকাবাসী ব্রিজের নিচ ও আশপাশে ড্রেজার দিয়ে বালি উত্তোলন প্রতিরোধে নদীতে নামেন। স্থানীয়দের প্রতিরোধে ড্রেজার মেশিন নিয়ে আলফু মিয়ার লোকজন ব্রিজের গোড়া থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়।
ওইদিন প্রথমবার পর্দার পেছন থেকে সামনে আসেন সিলেট জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মকসুদ আহমদ। তিনি ২০টির বেশি মোটরসাইকেল নিয়ে সিলেট নগরী থেকে মোটরসাইকেল মহড়া করে মোট ৪০ জন যুবদল কর্মী নিয়ে ধলাই সেতুর পাশে যান।
সেখানে গিয়ে আন্দোলনকারী নেতাদের একে একে বুঝিয়ে, পরে লোভ দেখিয়ে, সর্বশেষ হুমকি দিয়ে আন্দোলনকারীদের সরিয়ে আনার চেষ্টা চালান।
ব্রিজ রক্ষায় গঠিত আন্দোলন কমিটি আন্দোলন চালিয়ে গেলে বিষয়টি দেশের প্রায় সব সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়। এতে বিভিন্ন বিশিষ্ট সংগঠনও যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেয়। তবুও বালু লুট বন্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
আন্দোলন আরও তীব্র হলে গত রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ‘বালু দরবেশ’ মকসুদ আহমদের বাহিনী সিলেট নগরীতে ‘ধলাই রক্ষা আন্দোলন কমিটির’ সদস্য-সচিব নিজাম উদ্দিন মাস্টারের বাসায় হামলার চেষ্টা করে। তখন নিজাম উদ্দিন মাস্টার বাসায় ছিলেন না। তারা তালাবদ্ধ বাসার গেটে ও গ্রিলে আঘাত করে তাকে খুঁজে না পেয়ে গালাগাল করে চলে যায় বলে নিজাম উদ্দিন মাস্টার জানান।
সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও পেশিশক্তি প্রদর্শনের এ ঘটনায় কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির অব্যাহতিপ্রাপ্ত সভাপতি সাহাব উদ্দিন জানান, ‘মকসুদ আহমদ জেলাপ্রশাসক, পুলিশ সুপার, ইউএনও ও কোম্পানীগঞ্জ থানা পুলিশকে ঐক্যবদ্ধ করে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আলফু মিয়ার নেতৃত্বে বালুখেকো চক্রের সঙ্গে যৌথ মুনাফায় কোম্পানীগঞ্জের সম্পদ ও এম সাইফুর রহমান স্মৃতিবিজড়িত ধলাই সেতুকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন।’
তিনি বলেন, ‘ব্রিজটির ৫০০ মিটার বা ১৬০০ ফুট দূরে ধলাই সেতু দক্ষিণ বালু মহাল অবস্থিত। সেখানে দীর্ঘদিন বালু উত্তোলন করায় বালুশূন্য হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা আলফু মিয়া চক্র যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মকসুদ আহমদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে ড্রেজার দিয়ে সেতুর নিচ ও আশপাশ থেকে দিনে-রাতে বেআইনিভাবে বালু উত্তোলন করছেন। তাদের বালু লুটের ফলে স্থানীয় কবরস্থানও ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছে।’
তিনি জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মকসুদ আহমদকে ‘বালু দরবেশ’ বলে অভিহিত করেছেন।
এ সেতু রক্ষায় অসহায় এলাকাবাসী শেষ পর্যন্ত ব্যানারে জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদকের নামোল্লেখ করে তাকে প্রতিরোধে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সহযোগিতা কামনা করে মানববন্ধন করেছেন। গতকাল সোমবার ধলাই নদীর পাড়ে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মকসুদ আহমদ জানান, ‘আলফুর ভায়রাভাই আব্দুল্লাহ আল মামুন তার দুঃসম্পর্কের তালতোভাই। এজন্য স্থানীয় বিএনপি মনে করছে, এই বালু উত্তোলনের সঙ্গে তিনি জড়িত। আসলে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি এই বালুমহাল থেকে আগেও টাকা নিয়েছেন। নতুন করে টাকার পরিমাণ বাড়াতে এখন এই বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।’
নিজে এ বালুমহালের সঙ্গে সরাসরি জড়িত নয় বলে দাবি করেন মকসুদ। এ সময় তিনি এই সংবাদটি প্রকাশ না করার জন্যও অনুরোধ করেন।
কোম্পানীগঞ্জের মানুষ একযোগে প্রতিবাদ করার পরও একদিনের জন্যও সেতুর গোড়া থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ হয়নি। এর পেছেনে ‘বালু দরবেশ’ মকসুদ আহমদ জড়িত বলে মনে করছেন এলাকাবাসী। বেআইনিভাবে বালু উত্তোলনের ফলে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ধলাই সেতু মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়েছে। সেতুর পিলার ঘেঁষে অবাধে বালু উত্তোলনের কারণে এই আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
ধলাই সেতু সিলেট বিভাগের দ্বিতীয় দীর্ঘতম সেতু। ভারতের মেঘালয়ের মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ এবং জনপ্রিয় উৎমাছড়া পর্যটন স্পটে যাওয়ার একমাত্র পথ এটি। পাশাপাশি কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ভারত সীমান্তঘেঁষা তিনটি ইউনিয়নের প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষের সড়ক যোগাযোগের মূল ভরসাও এই সেতু।
২০০৩ সালে ধলাই সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। ৪৩৪.৩৫ মিটার দীর্ঘ ও ৯.৫ মিটার প্রস্থের এই সেতু নির্মাণের পর পূর্ব ইসলামপুর ও উত্তর রণিখাই ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক গ্রামের মানুষ সরাসরি সড়ক যোগাযোগে আসেন। একইসঙ্গে ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি থেকে পাথর পরিবহনও সহজ হয়।
কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনান বলেন, সাদা পাথরকে কেন্দ্র করে ১৫টি মামলা হয়েছে। ৭০ জনের মতো আসামি গ্রেপ্তারও হয়েছে। স্থায়ীভাবে সাদা পাথর লুটপাট ঠেকাতে বড় অভিযানের প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
পাথরখেকোদের আগ্রাসনে নিঃস্ব হওয়ার পথে সিলেটের মূল্যবান সাদা পাথর -সংবাদ
মঙ্গলবার, ১২ আগস্ট ২০২৫
সাদা পাথর। এটি সিলেটের সীমান্তকেন্দ্রিক অপরূপ সৌন্দর্যের একটি পর্যটনকেন্দ্র। দেশি-বিদেশি লাখ লাখ পর্যটক সেখানে গিয়ে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলতেন। অথচ এই পর্যটন কেন্দ্রটি এখন পাথরের পরিবর্তে বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। বড় বড় গর্তে অনেকটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়েছে সাদা পাথর।
এক বছরে হাজার কোটি টাকার লুটপাট, বিএনপির সভাপতিকে অব্যাহতি
ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বালুখেকোদের বিরুদ্ধে
চিহ্নিত পাথরখেকোরা গত এক বছরে হাজার কোটি টাকার পাথর লুটপাট করে নিয়েছে। গণমাধ্যমে খবর প্রচারিত বা এলাকাবাসী মাঝে মধ্যে প্রতিবাদ করলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে লোক দেখানো অভিযান পরিচালনা হয়ে আসছে মাঝে মধ্যে। এমনকি পরিবেশ উপদেষ্টা নিজেও স্বীকার করে নিয়েছেন পাথর লুটপাট বন্ধ করতে পারেননি তিনি। এসব ঘটনার সঙ্গে সিলেট বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে যুবদলের কয়েকজন নেতা জড়িত। এরই মধ্যে চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ দলীয় নীতি ও আদর্শবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে সিলেট জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিনকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় বিএনপি।
গতকাল সোমবার বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সাহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগ যাচাই-বাছাইয়ের পর তার সব দলীয় পদ সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও উল্লেখ করা হয়, তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে বর্তমান সহ-সভাপতি হাজী আব্দুল মান্নানকে উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করবেন।
দলীয় নেতারা জানিয়েছেন, সাংগঠনিক শৃঙ্খলা রক্ষা ও দলীয় ভাবমূর্তি অক্ষু্ণ্য রাখতে কেন্দ্রীয় কমিটি এই পদক্ষেপ নিয়েছে।
সাহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে সরকারি দেড়শ’ একর ভূমি দখল, পাথর কোয়ারির জমি ভাড়া দেয়াসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ অনেকদিন ধরে উঠছে। ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারির পাশে সরকারি ২৭৫ একর উন্মুক্ত জায়গার অর্ধেকের বেশি অংশ তার দখলে ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব জমি পাথর ভাঙার মেশিন মালিকদের কাছে ভাড়া দিয়ে বিপুল অর্থ আয় করা হতো।
গত ৫ আগস্ট আবারও ভোলাগঞ্জের ১০ নম্বর সাইট এলাকায় শতাধিক সরকারি জমি দখলের অভিযোগ ওঠে সাহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে। সেখানে থেকে লাখ লাখ টাকা ভাড়া নেয়ার তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হলে দলের হাইকমান্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ হয়।
গত ১৮ মার্চ সিলেট জেলা বিএনপি তাকে শোকজ নোটিশ দিয়েছিল। জেলা সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক এমরান আহমদ চৌধুরীর স্বাক্ষরিত নোটিশে ৭ কার্যদিবসের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়। তবে গ্রহণযোগ্য জবাব না দেয়ায় সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার কথা ছিল।
সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপির নেতৃবৃন্দ সাহাব উদ্দিনের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে বারবার সমালোচনার মুখে পড়ে তারা তারেক রহমানের নির্দেশনা অনুযায়ী শৃঙ্খলাভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলতেন।
অবশেষে, গতকাল সোমবার কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তে সাহাব উদ্দিনকে পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে হাজী আব্দুল মান্নানকে নতুন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নিয়োগ দেয়া হয়। অভিযোগ আছে, সাহাব উদ্দিনের মাধ্যমে সিলেট জেলা বিএনপির সম্পাদকীয় শীর্ষ পদে থাকা এক নেতা বেশ কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। আর যখনই গণমাধ্যমে সাদা পাথর লুটপাটের বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়, ঠিক তখন নিজের গা বাঁচাতে হাইকমান্ডের মাধ্যমে সাহাব উদ্দিনের পদ স্থগিত করানো হয়।
গেল বছরের ৫ আগস্টের পর পরই বিরামহীনভাবে চলে ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্রের পাথর লুট। সিলেটের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে ভ্রমণপিপাসু মানুষের পছন্দের শীর্ষে থাকা এটি বর্তমানে লুটে ক্ষতবিক্ষত স্পটে পরিণত হয়েছে। পাথরের সঙ্গে বালুও লুট করা হচ্ছে। অথচ পর্যটনকেন্দ্রের চারদিকে বিজিবির চারটি ক্যাম্প ও পোস্ট রয়েছে।
পরিবেশকর্মী ও স্থানীয় বাসিন্দার অভিযোগ, ৫ আগস্টের আগে যত দূর চোখ যেত, দেখা যেত সাদা সাদা পাথর আর পাথর। কিন্তু এখন সেখানে ধু-ধু বালুচর। তাদের ভাষ্যে, এক বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে।
সরেজমিন গতকাল সোমবার দেখা গেছে, সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্রের ধলাই নদীর উৎসমুখ থেকে শত শত নৌকা দিয়ে পাথর লুট হচ্ছে। মূল স্পটের বাম পাশের বড় বড় পাথর নেই। কোথাও কোথাও বালুচর জেগে উঠেছে। যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়িও চলছে। বড় পাথরের পাশাপাশি ছোট ছোট পাথরও লুট হয়ে গেছে। প্রকাশ্যে দিবালোকে পাথর নিয়ে যাচ্ছে আর দায়িত্বশীলরা বসে বসে সে দৃশ্য দেখছে।
এছাড়াও পাথরবোঝাই শত শত নৌকার মাঝে পর্যটকবাহী নৌকাও ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। এতে পর্যটকরা হতাশা প্রকাশ করেছেন।
সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্রের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রশাসনের উদাসীনতা ও টিলেঢালা নজরদারির কারণে পাথরখেকোরা নির্বিঘ্নে তাদের ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। মাঝে মধ্যে অভিযান চালালেও তার প্রভাব থাকে সামান্য সময়। এরপর আবারও লুটপাট চলে। একটি প্রভাবশালী মহল সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্র ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান।
গতকাল সোমবার ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান হতাশা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, আগের চার বছর জাফলং-এ পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখতে পেরেছিলাম, এখন আমি উপদেষ্টা হয়েও পারলাম না।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পাথর উত্তোলনে সর্বদলীয় ঐক্য দেখছি। একটি সুন্দর জিনিস কী করে হাতে ধরে কেমন অসুন্দর করতে হয় সেটা শিখতে হলে বাংলাদেশে আসতে হবে। চোখের সামনে অপূর্ব সুন্দর একটি জায়গা জাফলং চোখের সামনে নষ্ট হতে দেখলাম। ধ্বংসলীলা দেখলাম।
তিনি বলেন, শুনলাম, এই পাথরগুলো নাকি তুলতেই হবে। কেন তুলতে হবে, কেন? কারও কাছে কোনো পরিসংখ্যান নেই। অথচ পরিসংখ্যান বলছে দেশের চাহিদার মাত্র ৬ ভাগ পূরণ হয় এই পাথরগুলো তুলে। বাকি ৯৪ ভাগই আমদানি করতে হয়। ৯৪ ভাগ আমদানি করতে পারলে বাকি ৬ ভাগ কেন পারলাম না!
তিনি আরও বলেন, কেন আমরা ভিয়েতনামে গিয়ে ওদের নদীর ইকো ট্যুরিজম দেখি, কেন আমরা জাফলং-এ একটা ইকো ট্যুরিজম করতে পারলাম না! আমরা যেমন সৌন্দর্যমণ্ডিত জাফলং দেখেছি, কেন নতুন প্রজন্ম সেই জাফলং দেখতে পারল না! সেখানে আবার রাজনৈতিক ঐক্য দেখলাম।
উপদেষ্টা বলেন, ‘সিলেটে দুজন উপদেষ্টা গেলাম, সেখানে পাথর তুলতে সর্বদলীয় ঐক্য দেখলাম। আগের চার বছর জাফলং-এ পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখতে পেরেছিলাম, এখন আমি উপদেষ্টা হয়েও পারছি না। জাফলং রক্ষা করব বলে কোনো ঐক্য দেখলাম না। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের বাস্তবতা। জাফলংটা ধ্বংস করে দিয়ে কীসের উন্নয়ন, কার উন্নয়ন হচ্ছে? আমরা যদি পাথর না তুলে ইকো ট্যুরিজম করি, হিসাব করে দেখুন পাথর তুলে কত আয় হয় আর ইকো ট্যুরিজম থেকে কত আয় হয়! এই কম্পারেটিভ অ্যানালাইসিস কি কেউ করেছে? একজন ডিসি বলেছিলেন, ইকো ট্যুরিজমে আমরা পাথর তোলা থেকে বেশি আয় করতে পারব। একটা মানুষ সারাদিন পানিতে নেমে পাথর তোলেন, এটাকে আপনার এমপ্লয়মেন্ট বলেন! এটা এক্সপ্লয়েটেশন। এটা একদম ক্লিয়ার কেস অব এক্সপ্লয়েটেশন।’
এদিকে কোম্পানীগঞ্জের স্থানীয় মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাদা পাথর রক্ষার আন্দোলন করলেও বন্ধ হয়নি পাথর ও ধলাই সেতুর আশপাশ থেকে বালু লুট। ইতোমধ্যে পাথর লুটপাটের ঘটনায় স্থানীয় বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিনকে বালু লুটের নেতৃত্বে রয়েছেন দলীয় পথ থেকে অব্যাহতি দিলেও বালু লুটপাটের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
‘ধলাই সেতু রক্ষা আন্দোলন কমিটির’ নেতারা ও স্থানীয় বিএনপির নেতারা দাবি করেছেন, বালু লুটের পেছনে রয়েছেন ‘বালু দরবেশ’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া সিলেট জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মকসুদ আহমদ।
ধলাই সেতু রক্ষা আন্দোলনের সদস্য-সচিব নিজাম উদ্দিন মাস্টার জানান, গত ১৩ জুলাই থেকে এলাকাবাসী ধলাই সেতু রক্ষায় ব্রিজের নিচ থেকে বেআইনি বালু উত্তোলন বন্ধের জন্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু হয়।
তিনি আরও জানান, ১৬ জুলাই প্রথম প্রতিবাদ সভা থেকে ধলাই সেতু রক্ষার জন্য আন্দোলন জোরদার করার লক্ষ্যে কমিটি গঠন করা হয়। ওইদিন আলমগীর আলম চেয়ারম্যানকে আহ্বায়ক ও নিজাম উদ্দিন মাস্টারকে সদস্য-সচিব করে ধলাই সেতু রক্ষা কমিটি গঠন করা হয়। ১৭ জুলাই কমিটি নিয়ে এলাকাবাসী ব্রিজের নিচ ও আশপাশে ড্রেজার দিয়ে বালি উত্তোলন প্রতিরোধে নদীতে নামেন। স্থানীয়দের প্রতিরোধে ড্রেজার মেশিন নিয়ে আলফু মিয়ার লোকজন ব্রিজের গোড়া থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়।
ওইদিন প্রথমবার পর্দার পেছন থেকে সামনে আসেন সিলেট জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মকসুদ আহমদ। তিনি ২০টির বেশি মোটরসাইকেল নিয়ে সিলেট নগরী থেকে মোটরসাইকেল মহড়া করে মোট ৪০ জন যুবদল কর্মী নিয়ে ধলাই সেতুর পাশে যান।
সেখানে গিয়ে আন্দোলনকারী নেতাদের একে একে বুঝিয়ে, পরে লোভ দেখিয়ে, সর্বশেষ হুমকি দিয়ে আন্দোলনকারীদের সরিয়ে আনার চেষ্টা চালান।
ব্রিজ রক্ষায় গঠিত আন্দোলন কমিটি আন্দোলন চালিয়ে গেলে বিষয়টি দেশের প্রায় সব সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়। এতে বিভিন্ন বিশিষ্ট সংগঠনও যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেয়। তবুও বালু লুট বন্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
আন্দোলন আরও তীব্র হলে গত রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ‘বালু দরবেশ’ মকসুদ আহমদের বাহিনী সিলেট নগরীতে ‘ধলাই রক্ষা আন্দোলন কমিটির’ সদস্য-সচিব নিজাম উদ্দিন মাস্টারের বাসায় হামলার চেষ্টা করে। তখন নিজাম উদ্দিন মাস্টার বাসায় ছিলেন না। তারা তালাবদ্ধ বাসার গেটে ও গ্রিলে আঘাত করে তাকে খুঁজে না পেয়ে গালাগাল করে চলে যায় বলে নিজাম উদ্দিন মাস্টার জানান।
সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও পেশিশক্তি প্রদর্শনের এ ঘটনায় কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির অব্যাহতিপ্রাপ্ত সভাপতি সাহাব উদ্দিন জানান, ‘মকসুদ আহমদ জেলাপ্রশাসক, পুলিশ সুপার, ইউএনও ও কোম্পানীগঞ্জ থানা পুলিশকে ঐক্যবদ্ধ করে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আলফু মিয়ার নেতৃত্বে বালুখেকো চক্রের সঙ্গে যৌথ মুনাফায় কোম্পানীগঞ্জের সম্পদ ও এম সাইফুর রহমান স্মৃতিবিজড়িত ধলাই সেতুকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন।’
তিনি বলেন, ‘ব্রিজটির ৫০০ মিটার বা ১৬০০ ফুট দূরে ধলাই সেতু দক্ষিণ বালু মহাল অবস্থিত। সেখানে দীর্ঘদিন বালু উত্তোলন করায় বালুশূন্য হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা আলফু মিয়া চক্র যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মকসুদ আহমদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে ড্রেজার দিয়ে সেতুর নিচ ও আশপাশ থেকে দিনে-রাতে বেআইনিভাবে বালু উত্তোলন করছেন। তাদের বালু লুটের ফলে স্থানীয় কবরস্থানও ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছে।’
তিনি জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মকসুদ আহমদকে ‘বালু দরবেশ’ বলে অভিহিত করেছেন।
এ সেতু রক্ষায় অসহায় এলাকাবাসী শেষ পর্যন্ত ব্যানারে জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদকের নামোল্লেখ করে তাকে প্রতিরোধে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সহযোগিতা কামনা করে মানববন্ধন করেছেন। গতকাল সোমবার ধলাই নদীর পাড়ে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মকসুদ আহমদ জানান, ‘আলফুর ভায়রাভাই আব্দুল্লাহ আল মামুন তার দুঃসম্পর্কের তালতোভাই। এজন্য স্থানীয় বিএনপি মনে করছে, এই বালু উত্তোলনের সঙ্গে তিনি জড়িত। আসলে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি এই বালুমহাল থেকে আগেও টাকা নিয়েছেন। নতুন করে টাকার পরিমাণ বাড়াতে এখন এই বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।’
নিজে এ বালুমহালের সঙ্গে সরাসরি জড়িত নয় বলে দাবি করেন মকসুদ। এ সময় তিনি এই সংবাদটি প্রকাশ না করার জন্যও অনুরোধ করেন।
কোম্পানীগঞ্জের মানুষ একযোগে প্রতিবাদ করার পরও একদিনের জন্যও সেতুর গোড়া থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ হয়নি। এর পেছেনে ‘বালু দরবেশ’ মকসুদ আহমদ জড়িত বলে মনে করছেন এলাকাবাসী। বেআইনিভাবে বালু উত্তোলনের ফলে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ধলাই সেতু মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়েছে। সেতুর পিলার ঘেঁষে অবাধে বালু উত্তোলনের কারণে এই আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
ধলাই সেতু সিলেট বিভাগের দ্বিতীয় দীর্ঘতম সেতু। ভারতের মেঘালয়ের মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ এবং জনপ্রিয় উৎমাছড়া পর্যটন স্পটে যাওয়ার একমাত্র পথ এটি। পাশাপাশি কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ভারত সীমান্তঘেঁষা তিনটি ইউনিয়নের প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষের সড়ক যোগাযোগের মূল ভরসাও এই সেতু।
২০০৩ সালে ধলাই সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। ৪৩৪.৩৫ মিটার দীর্ঘ ও ৯.৫ মিটার প্রস্থের এই সেতু নির্মাণের পর পূর্ব ইসলামপুর ও উত্তর রণিখাই ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক গ্রামের মানুষ সরাসরি সড়ক যোগাযোগে আসেন। একইসঙ্গে ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি থেকে পাথর পরিবহনও সহজ হয়।
কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনান বলেন, সাদা পাথরকে কেন্দ্র করে ১৫টি মামলা হয়েছে। ৭০ জনের মতো আসামি গ্রেপ্তারও হয়েছে। স্থায়ীভাবে সাদা পাথর লুটপাট ঠেকাতে বড় অভিযানের প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।