ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমরা ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন আয়োজনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করছি যাতে জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়।’
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘আমরা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে এবং ক্ষমতার প্রকৃত মালিক জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
বুধবার,(১৩ আগস্ট ২০২৫) প্রধান উপদেষ্টার মালয়েশিয়া সফরের শেষ দিনে কুয়ালালামপুরে মালয়েশিয়া ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় (ইউকেএম) থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি গ্রহণ করে দেয়া বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা এ কথা বলেন।
বিশ্ববিদ্যালয় অডিটরিয়ামে আয়োজিত অনুষ্ঠানে চ্যান্সেলর ও নেগেরি সেমবিলান দারুল খুসুস রাজ্যের সুলতান তুংকু মুহরিজ ইবনি আলমারহুম তুংকু মুনাওয়িরর কাছ থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রির সনদ গ্রহণ করেন মুহাম্মদ ইউনূস। সামাজিক ব্যবসা প্রসারে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তাকে এই সম্মাননা দেয়া হয়।
সম্মাননা প্রসঙ্গে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘এই স্বীকৃতি আমাকে তরুণ প্রজন্মের স্বপ্ন পূরণে আমার দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। গত বছর বাংলাদেশের অনেক তরুণ সাহসিকতার সঙ্গে একটি ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। শত শত ছাত্র-যুবক একটি উন্নত ভবিষ্যৎতের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছে যেখানে প্রত্যকে মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারবে এবং ভয়, বৈষম্য ও অবিচার থেকে মুক্ত থাকবে।’
নতুন বাংলাদেশ গড়তে অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করছে বলে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসে তরুণদের নেতৃত্বে সংঘটিত অভ্যুত্থান আমাদের জাতীয় পরিচয় ও ভবিষ্যৎ আশার নতুন অর্থ তৈরি করেছে। আজ আমরা এক নতুন বাংলাদেশ গড়তে কাজ করছি, যেখানে শাসনব্যবস্থা হবে ন্যায়সংগত, অর্থনীতি হবে সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রত্যেকে সমান সুযোগ পাবে সফল হওয়ার জন্য। আমাদের সরকার শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার দিকে মনোযোগী রয়েছে।’
সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে সংস্কারের কথা উল্লেখ করেন মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘আমাদের সুস্পষ্ট লক্ষ্য বিস্তৃত পরিকল্পনা এবং এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ়প্রত্যয়। একটি শক্তিশালী ও সহনশীল বাংলাদেশ গড়তে আমাদের অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে উদ্যোক্তাদের সহায়তা, শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে বেশি বিনিয়োগ এবং আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক অংশীদারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা।’
বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘তোমরা আগামী দিনের নির্মাতা। তোমাদের ভাবনা, সৃজনশীলতা ও দায়িত্ববোধই ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে শুধু মালয়েশিয়ার নয়, সমগ্র বিশ্বের। স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যেতে গিয়ে সব সময় মনে রেখো, প্রকৃত সাফল্য শুধু নিজের জন্য অর্জনের মধেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং কীভাবে তুমি অন্যদেরও তোমার সঙ্গে উন্নতির পথে নিয়ে যাচ্ছ, সেটিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যে সেরা উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারি, তা হলো এমন এক পৃথিবী, যেখানে কাউকে পেছনে ফেলে রাখা হবে না।’
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘তোমাদের সিদ্ধান্ত, কাজ ও মূল্যবোধই নির্ধারণ করবে আমরা কোথায় যাব। তাই আমি তোমাদের অনুরোধ করছি, বড় স্বপ্ন দেখো, সাহসীভাবে চিন্তা করো এবং সেই অনুযায়ী কাজ করো। ভয় পেয়ো না, প্রত্যেক ব্যর্থতাই সাফল্যের পথে একটি ধাপমাত্র।’
পৃথিবীকে বদলে দেয়ার জন্য প্রয়োজন প্রকৃত নেতার, প্রয়োজন সমস্যা সমাধানকারীর এ কথা উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকের ক্ষমতা রয়েছে অসাধারণ কিছু করার, মানুষের সেবায় ব্যবসা গড়ে তোলার, জীবন বদলে দেয়ার মতো নতুন ধারণা সৃষ্টির, অথবা এমন নীতি প্রণয়নের, যা গোটা একটি সম্প্রদায়কে উন্নতির পথে নিয়ে যাবে।’
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আজকের অন্যতম বড় বিপদ হলো সম্পদ ক্রমে কয়েকজন মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। এর ফলে বৈষম্য ও অবিচার সৃষ্টি হয়। আমাদের যা দরকার, তা হলো একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি যেখানে সম্পদ ন্যায্যভাবে ভাগ হবে এবং প্রত্যেক মানুষ মর্যাদা ও উদ্দেশ্য নিয়ে বাঁচার সুযোগ পাবে।’
বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্বের কথা স্মরণ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, দুই দেশ সব সময়ই দৃঢ় সম্পর্ক ভাগাভাগি করেছে, যা গড়ে উঠেছে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সাংস্কৃতিক বিনিময় ও উন্নতির যৌথ স্বপ্নের ওপর।
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে মালয়েশিয়ার উচ্চ শিক্ষামন্ত্রী জাম্ব্রি আবদুল কাদির ও ইউকেএমের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক সুফিয়ান জুসোহ উপস্থিত ছিলেন।
‘হালাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক’ স্থাপনে সহায়তা
ক্রমবিকাশমান বৈশ্বিক হালাল পণ্যের বাজারে প্রবেশের জন্য ‘হালাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক’ গড়ে তুলতে মালয়েশিয়ার সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। গতকাল মঙ্গলবার মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে একটি হোটেলে দেশটির হালাল শিল্প খাতের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে এ আবেদন জানান বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘চলুন, এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিই।’
মালয়েশিয়ার প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের হালালবিষয়ক সমন্বয়ক দাতিন পদুকা হাজাহ হাকিমাহ বিনতি মোহাম্মদ ইউসুফ।
বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন- মালয়েশিয়ার ইসলামি উন্নয়ন বিভাগের (জেএকেআইএম) মহাপরিচালক সিরাজউদ্দিন বিন সুহাইমি এবং হালাল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের (এইচডিসি) প্রধান নির্বাহী হাইরল আরিফেইন সাহারি।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টাকে জানানো হয়, বর্তমানে বিশ্বে হালাল পণ্যের বাজারমূল্য ৩ ট্রিলিয়ন বা ৩ লাখ কোটি ডলার। ২০৩০ সালের মধ্যে তা ৫ ট্রিলিয়ন বা ৫ লাখ কোটি ডলারে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। অন্তত ১৪টি হালাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের মাধ্যমে এ বিরাট বৈশ্বিক বাজারের উল্লেখযোগ্য অংশীদার মালয়েশিয়া। এ খাতের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো।
প্রধান উপদেষ্টার উপপ্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বুধবার বলেন, বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ হিসেবে বাংলাদেশে অবকাঠামো ও সার্টিফিকেশন ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে পারলে এ বাজারে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
দেশে বর্তমানে ইসলামিক ফাউন্ডেশন একমাত্র সংস্থা, যারা হালাল পণ্যের আনুষ্ঠানিক সনদ দেয়। এখন পর্যন্ত মাত্র ১২৪টি প্রতিষ্ঠান এ সনদ পেয়েছে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন মালয়েশিয়ার প্রতিনিধিদলকে দেশে হালাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা চিহ্নিত করতে সহায়তার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘হালাল পণ্যের শিল্প গড়ে তোলার জন্য কী কী দরকার, আমরা একসঙ্গে বসে তা নির্ধারণ করতে পারি।’ অনেক বাংলাদেশি কোম্পানি হালাল সার্টিফায়েড পণ্য রপ্তানিতে আগ্রহী বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন- পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী এবং প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজি–বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ।
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ‘গ্র্যাজুয়েট প্লাস ভিসা’
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য দেশটির ‘গ্র্যাজুয়েট প্লাস ভিসা’ চালুর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। এই ভিসা চালু হলে মালয়েশিয়ায় পড়ালেখা করার পর বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সেখানেই কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।
মালয়েশিয়ায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বুধবার কুয়ালালামপুরে ইউনিভার্সিটি কেবাংসান মালয়েশিয়ায় দেশটির উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী জাম্ব্রি আবদুল কাদিরের সঙ্গে বৈঠকে এ বিষয়টি উত্থাপন করেন।
ওই বৈঠকে উপস্থিত বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ নজরুল পরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘মন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। নীতিগতভাবে তিনি মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য গ্র্যাজুয়েট প্লাস ভিসা দেয়ার বিষয়ে সম্মতি দিয়েছেন। তবে নীতি কার্যকর হওয়ার আগে উভয়পক্ষকে কিছু আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হবে।’
উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ছাড়াও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী মালয়েশিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। অন্য দেশের শিক্ষার্থীরা যেখানে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে প্রবেশের সুযোগ পায়, সেখানে এতদিন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল।
মালয়েশিয়ার শিক্ষা মন্ত্রী ফাদলিনা বিনতি সিদেক বুধবার কুয়ালা লামপুরের একটি হোটেলে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি বাড়ানোসহ শিক্ষা সহযোগিতা জোরদারের বিষয়ে আলোচনা করেন। অধ্যাপক ইউনূস শিক্ষার্থী ও শিক্ষক বিনিময় কর্মসূচি সম্প্রসারণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষ ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বাংলাদেশের ডিগ্রির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিও চান।
মালয়েশিয়ার মন্ত্রী অধ্যাপক ইউনূসের দীর্ঘদিনের ‘থ্রি জিরো’ ধারণার বিষয়ে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেন, যার লক্ষ্য বিশ্ব থেকে দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনা। অধ্যাপক ইউনূস মালয়েশিয়ার শিক্ষা মন্ত্রীকে ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ জানান, যাতে দুই দেশের মধ্যে শিক্ষা সহযোগিতা আরও জোরদার হয়।
অন্যদের মধ্যে জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী এবং এসডিজি বিষয়ক সিনিয়র সচিব লামিয়া মোরশেদ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
বুধবার, ১৩ আগস্ট ২০২৫
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমরা ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন আয়োজনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করছি যাতে জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়।’
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘আমরা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে এবং ক্ষমতার প্রকৃত মালিক জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
বুধবার,(১৩ আগস্ট ২০২৫) প্রধান উপদেষ্টার মালয়েশিয়া সফরের শেষ দিনে কুয়ালালামপুরে মালয়েশিয়া ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় (ইউকেএম) থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি গ্রহণ করে দেয়া বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা এ কথা বলেন।
বিশ্ববিদ্যালয় অডিটরিয়ামে আয়োজিত অনুষ্ঠানে চ্যান্সেলর ও নেগেরি সেমবিলান দারুল খুসুস রাজ্যের সুলতান তুংকু মুহরিজ ইবনি আলমারহুম তুংকু মুনাওয়িরর কাছ থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রির সনদ গ্রহণ করেন মুহাম্মদ ইউনূস। সামাজিক ব্যবসা প্রসারে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তাকে এই সম্মাননা দেয়া হয়।
সম্মাননা প্রসঙ্গে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘এই স্বীকৃতি আমাকে তরুণ প্রজন্মের স্বপ্ন পূরণে আমার দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। গত বছর বাংলাদেশের অনেক তরুণ সাহসিকতার সঙ্গে একটি ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। শত শত ছাত্র-যুবক একটি উন্নত ভবিষ্যৎতের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছে যেখানে প্রত্যকে মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারবে এবং ভয়, বৈষম্য ও অবিচার থেকে মুক্ত থাকবে।’
নতুন বাংলাদেশ গড়তে অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করছে বলে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসে তরুণদের নেতৃত্বে সংঘটিত অভ্যুত্থান আমাদের জাতীয় পরিচয় ও ভবিষ্যৎ আশার নতুন অর্থ তৈরি করেছে। আজ আমরা এক নতুন বাংলাদেশ গড়তে কাজ করছি, যেখানে শাসনব্যবস্থা হবে ন্যায়সংগত, অর্থনীতি হবে সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রত্যেকে সমান সুযোগ পাবে সফল হওয়ার জন্য। আমাদের সরকার শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার দিকে মনোযোগী রয়েছে।’
সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে সংস্কারের কথা উল্লেখ করেন মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘আমাদের সুস্পষ্ট লক্ষ্য বিস্তৃত পরিকল্পনা এবং এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ়প্রত্যয়। একটি শক্তিশালী ও সহনশীল বাংলাদেশ গড়তে আমাদের অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে উদ্যোক্তাদের সহায়তা, শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে বেশি বিনিয়োগ এবং আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক অংশীদারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা।’
বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘তোমরা আগামী দিনের নির্মাতা। তোমাদের ভাবনা, সৃজনশীলতা ও দায়িত্ববোধই ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে শুধু মালয়েশিয়ার নয়, সমগ্র বিশ্বের। স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যেতে গিয়ে সব সময় মনে রেখো, প্রকৃত সাফল্য শুধু নিজের জন্য অর্জনের মধেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং কীভাবে তুমি অন্যদেরও তোমার সঙ্গে উন্নতির পথে নিয়ে যাচ্ছ, সেটিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যে সেরা উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারি, তা হলো এমন এক পৃথিবী, যেখানে কাউকে পেছনে ফেলে রাখা হবে না।’
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘তোমাদের সিদ্ধান্ত, কাজ ও মূল্যবোধই নির্ধারণ করবে আমরা কোথায় যাব। তাই আমি তোমাদের অনুরোধ করছি, বড় স্বপ্ন দেখো, সাহসীভাবে চিন্তা করো এবং সেই অনুযায়ী কাজ করো। ভয় পেয়ো না, প্রত্যেক ব্যর্থতাই সাফল্যের পথে একটি ধাপমাত্র।’
পৃথিবীকে বদলে দেয়ার জন্য প্রয়োজন প্রকৃত নেতার, প্রয়োজন সমস্যা সমাধানকারীর এ কথা উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকের ক্ষমতা রয়েছে অসাধারণ কিছু করার, মানুষের সেবায় ব্যবসা গড়ে তোলার, জীবন বদলে দেয়ার মতো নতুন ধারণা সৃষ্টির, অথবা এমন নীতি প্রণয়নের, যা গোটা একটি সম্প্রদায়কে উন্নতির পথে নিয়ে যাবে।’
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আজকের অন্যতম বড় বিপদ হলো সম্পদ ক্রমে কয়েকজন মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। এর ফলে বৈষম্য ও অবিচার সৃষ্টি হয়। আমাদের যা দরকার, তা হলো একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি যেখানে সম্পদ ন্যায্যভাবে ভাগ হবে এবং প্রত্যেক মানুষ মর্যাদা ও উদ্দেশ্য নিয়ে বাঁচার সুযোগ পাবে।’
বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্বের কথা স্মরণ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, দুই দেশ সব সময়ই দৃঢ় সম্পর্ক ভাগাভাগি করেছে, যা গড়ে উঠেছে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সাংস্কৃতিক বিনিময় ও উন্নতির যৌথ স্বপ্নের ওপর।
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে মালয়েশিয়ার উচ্চ শিক্ষামন্ত্রী জাম্ব্রি আবদুল কাদির ও ইউকেএমের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক সুফিয়ান জুসোহ উপস্থিত ছিলেন।
‘হালাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক’ স্থাপনে সহায়তা
ক্রমবিকাশমান বৈশ্বিক হালাল পণ্যের বাজারে প্রবেশের জন্য ‘হালাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক’ গড়ে তুলতে মালয়েশিয়ার সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। গতকাল মঙ্গলবার মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে একটি হোটেলে দেশটির হালাল শিল্প খাতের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে এ আবেদন জানান বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘চলুন, এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিই।’
মালয়েশিয়ার প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের হালালবিষয়ক সমন্বয়ক দাতিন পদুকা হাজাহ হাকিমাহ বিনতি মোহাম্মদ ইউসুফ।
বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন- মালয়েশিয়ার ইসলামি উন্নয়ন বিভাগের (জেএকেআইএম) মহাপরিচালক সিরাজউদ্দিন বিন সুহাইমি এবং হালাল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের (এইচডিসি) প্রধান নির্বাহী হাইরল আরিফেইন সাহারি।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টাকে জানানো হয়, বর্তমানে বিশ্বে হালাল পণ্যের বাজারমূল্য ৩ ট্রিলিয়ন বা ৩ লাখ কোটি ডলার। ২০৩০ সালের মধ্যে তা ৫ ট্রিলিয়ন বা ৫ লাখ কোটি ডলারে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। অন্তত ১৪টি হালাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের মাধ্যমে এ বিরাট বৈশ্বিক বাজারের উল্লেখযোগ্য অংশীদার মালয়েশিয়া। এ খাতের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো।
প্রধান উপদেষ্টার উপপ্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বুধবার বলেন, বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ হিসেবে বাংলাদেশে অবকাঠামো ও সার্টিফিকেশন ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে পারলে এ বাজারে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
দেশে বর্তমানে ইসলামিক ফাউন্ডেশন একমাত্র সংস্থা, যারা হালাল পণ্যের আনুষ্ঠানিক সনদ দেয়। এখন পর্যন্ত মাত্র ১২৪টি প্রতিষ্ঠান এ সনদ পেয়েছে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন মালয়েশিয়ার প্রতিনিধিদলকে দেশে হালাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা চিহ্নিত করতে সহায়তার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘হালাল পণ্যের শিল্প গড়ে তোলার জন্য কী কী দরকার, আমরা একসঙ্গে বসে তা নির্ধারণ করতে পারি।’ অনেক বাংলাদেশি কোম্পানি হালাল সার্টিফায়েড পণ্য রপ্তানিতে আগ্রহী বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন- পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী এবং প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজি–বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ।
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ‘গ্র্যাজুয়েট প্লাস ভিসা’
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য দেশটির ‘গ্র্যাজুয়েট প্লাস ভিসা’ চালুর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। এই ভিসা চালু হলে মালয়েশিয়ায় পড়ালেখা করার পর বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সেখানেই কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।
মালয়েশিয়ায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বুধবার কুয়ালালামপুরে ইউনিভার্সিটি কেবাংসান মালয়েশিয়ায় দেশটির উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী জাম্ব্রি আবদুল কাদিরের সঙ্গে বৈঠকে এ বিষয়টি উত্থাপন করেন।
ওই বৈঠকে উপস্থিত বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ নজরুল পরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘মন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। নীতিগতভাবে তিনি মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য গ্র্যাজুয়েট প্লাস ভিসা দেয়ার বিষয়ে সম্মতি দিয়েছেন। তবে নীতি কার্যকর হওয়ার আগে উভয়পক্ষকে কিছু আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হবে।’
উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ছাড়াও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী মালয়েশিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। অন্য দেশের শিক্ষার্থীরা যেখানে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে প্রবেশের সুযোগ পায়, সেখানে এতদিন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল।
মালয়েশিয়ার শিক্ষা মন্ত্রী ফাদলিনা বিনতি সিদেক বুধবার কুয়ালা লামপুরের একটি হোটেলে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি বাড়ানোসহ শিক্ষা সহযোগিতা জোরদারের বিষয়ে আলোচনা করেন। অধ্যাপক ইউনূস শিক্ষার্থী ও শিক্ষক বিনিময় কর্মসূচি সম্প্রসারণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষ ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বাংলাদেশের ডিগ্রির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিও চান।
মালয়েশিয়ার মন্ত্রী অধ্যাপক ইউনূসের দীর্ঘদিনের ‘থ্রি জিরো’ ধারণার বিষয়ে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেন, যার লক্ষ্য বিশ্ব থেকে দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনা। অধ্যাপক ইউনূস মালয়েশিয়ার শিক্ষা মন্ত্রীকে ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ জানান, যাতে দুই দেশের মধ্যে শিক্ষা সহযোগিতা আরও জোরদার হয়।
অন্যদের মধ্যে জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী এবং এসডিজি বিষয়ক সিনিয়র সচিব লামিয়া মোরশেদ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।