সংবাদ ডেস্ক

বুধবার, ১৩ আগস্ট ২০২৫

জরায়ুতে নয়, নারীর লিভারে বেড়ে উঠছে ভ্রণ!

image

জরায়ুতে নয়, নারীর লিভারে বেড়ে উঠছে ভ্রণ!

বুধবার, ১৩ আগস্ট ২০২৫
সংবাদ ডেস্ক

ভ্রণের জন্ম জরায়ুতে নয়, হয়েছে লিভারে! আশ্চর্য হওয়ার ঘটনাই। ঘটনাটি ঘটেছে ভারতের পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের নারী সর্বেশের জীবনে। ৩৫ বছরের এই নারীর তিন মাস ধরে শারীরিক অবস্থা এতটাই নাজুক হচ্ছিল যে, বিষয়টি তার পরিবারের কাছে একদিকে যেমন ছিল রহস্যের, অন্যদিকে কষ্টেরও।

‘লিভারের ডান পাশে ১২ সপ্তাহের প্রেগনেন্সি, যার মধ্যে কার্ডিয়াক পালসেশন বা হৃদস্পন্দন স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান’

গর্ভাবস্থার এই মুহূর্তটি চিকিৎসক এবং গবেষকদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু

বিশ্বে গড়ে মাত্র এক শতাংশ ইন্ট্রাহেপ্যাটিক অ্যাক্টোপিক প্রেগনেন্সির কেস দেখা যায়

এ ধরনের প্রেগনেন্সির কেস বিশ্বে ৪৫টা রিপোর্ট করা হয়েছিল, এর মধ্যে তিনটি ঘটনা ভারতের

সর্বেশ বলেছেন ‘আমি অনিয়ন্ত্রিতভাবে বমি করছিলাম। সব সময় ক্লান্ত লাগত। ভীষণ যন্ত্রণা হতো। আমার কী হয়েছে কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না।’

তিনি জানিয়েছেন, অবস্থার আরও অবনতি হতে শুরু করলে চিকিৎসক তাকে আলট্রাসনোগ্রাফি করানোর পরামর্শ দেন। কিন্তু তাতেও কিছু জানা যায়নি। তিনি পেটে ইনফেকশনের ওষুধ খাওয়া চালিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু মাসখানেক ওষুধ খাওয়ার পরেও তার স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতি না হওয়ায় দ্বিতীয়বার আলট্রাসনোগ্রাফি করান তিনি।

আর তাতেই প্রকাশ হয় এ ঘটনা। বিষয়টি এতটাই বিরল যে, চিকিৎসকদেরও তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল।

ফলে গর্ভাবস্থার এই মুহূর্তে চিকিৎসক এবং গবেষকদের মনোযোগের বিষয় হয়ে উঠেছে ভারতের পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের এই নারী।

বুলন্দশহর জেলার দস্তুরা গ্রামের বাসিন্দা সর্বেশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, তার প্রেগনেন্সির এই ঘটনাটা একেবারে অনন্য। কারণ জরায়ুর বদলে লিভারে ভ্রণকে বেড়ে উঠতে দেখা গিয়েছে।

সর্বেশকে ঘিরে বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও ব্যাপক কৌতূহল তৈরি হয়েছে।

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে জানা যায়, সর্বেশকে খাটে শুয়ে কাটাতে হচ্ছে দিন। পাশ ফেরাটাও কঠিন হয়ে পড়েছে তার পক্ষে। পেটের ডান পাশে ও ওপরের দিকে ২১টা সেলাই পড়েছে। কোনো ভারী জিনিস তুলতে মানা করেছেন চিকিৎসক। হালকা খাবার খেতে এবং যতটা সম্ভব বিশ্রাম নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তাকে।

খাটে বসা থেকে শুরু করে বাথরুমে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সব কিছুতেই সর্বেশকে তার স্বামী পরমবীরের সাহায্য নিতে হয়।

বিবিসিকে এই দম্পতি জানিয়েছে, তিন মাস ধরে সর্বেশের শারীরিক অবস্থা তাদের পরিবারের কাছে রহস্যের চেয়ে কম কিছু ছিল না। ফলে দ্বিতীয়বার আলট্রাসনোগ্রাফি করান।

‘আপনার লিভারে ভ্রণ রয়েছে’

আলট্রাসনোগ্রাফি করার সময় উপস্থিত চিকিৎসক সানিয়া জেহরা সর্বেশকে জানান, তার লিভারে একটা ভ্রণ রয়েছে। এটা শুনে সর্বেশ এবং তার স্বামী পরমবীর দু’জনেই অবাক হয়েছেন।

নিশ্চিত হওয়ার জন্য, তারা বুলন্দশহর থেকে মিরাট যান এবং সেখানে আরও একবার আল্ট্রাসাউন্ড এবং এমআরআই করান। কিন্তু রিপোর্টে সেই একই তথ্য উঠে আসে।

সর্বেশের পক্ষে বিষয়টা বিশ্বাস করাটা কঠিন ছিল, কারণ তার মাসিক চক্র স্বাভাবিকভাবেই চলছিল।

ভারতীয় রেডিওলজিস্ট ডা. কেকে গুপ্তা তার এমআরআই করেছিলেন। বিবিসিকে ডা. গুপ্তা জানিয়েছেন, ২০ বছরের কর্মজীবনে এমন ঘটনা তিনি দেখেননি। কোনোরকম সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে, তারা বেশ কয়েকবার ওই রিপোর্ট যাচাই-বাছাই করেন। সর্বেশের কাছে বারবার জানতে চাওয়া হয়, তার মাসিক চক্র স্বাভাবিক কিনা।

ডা. কেকে গুপ্তা বলেছেন, ‘ওই নারীর লিভারের ডান পাশে ১২ সপ্তাহের প্রেগনেন্সি লক্ষ্য করা যায়, যার মধ্যে কার্ডিয়াক পালসেশন বা হৃদস্পন্দন স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান ছিল।’

চিকিৎসকদের ভাষায় এ অবস্থাকে ইন্ট্রাহেপ্যাটিক অ্যাক্টোপিক প্রেগনেন্সি বলা হয়, যা একেবারেই বিরল। এই পরিস্থিতিতে প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে পারে। এই কারণে, তার ঋতুস্রাব স্বাভাবিক রয়েছে বলে মনে করতে থাকেন এবং তিনি যে গর্ভবতী তাও বুঝতে সময় লাগে।

# সার্জারি ছাড়া বিকল্প নেই

চিকিৎসক ওই দম্পতিকে জানান, ভ্রণ বড় হলে লিভার ফেটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এই অবস্থায় মা ও শিশু কাউকে বাঁচানো সম্ভব নয়। অতএব, অস্ত্রোপচার করা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই।

পরমবীর জানিয়েছেন, যে বুলন্দশহরের কোনো চিকিৎসকই এই কেস নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। তারা মিরাটেও গিয়েছিলেন বটে, কিন্তু সেখানেও হতাশা। ডাক্তাররা এই দম্পতিকে জানান, এ জাতীয় প্রেগনেন্সির কেস অত্যন্ত জটিল

বিষয়। এক্ষেত্রে মা ও শিশু দু’জনের জীবনেরই ঝুঁকি রয়েছে। চিকিৎসকদের সবাই তাদের দিল্লি যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু পরমবীরের পক্ষে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

তিনি বলেছেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। দিল্লিতে গিয়ে খরচ চালানো আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমরা সিদ্ধান্ত নিই, এখানেই চিকিৎসা করাব।’

শেষ পর্যন্ত মিরাটের এক বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের একটা টিম সর্বেশের অস্ত্রোপচার করতে রাজি হয়।

ডাক্তারদের ওই টিমের একজন সদস্য ছিলেন ডা. পারুল দাহিয়া। বিবিসির প্রতিবেদনে তিনি বলেছেন, ‘রোগী যখন আমার কাছে আসেন, তখন জানান তিন মাস ধরে সমানে ভুগছেন তিনি। তাদের কাছে আল্ট্রাসনোগ্রাফি এবং এমআরআইয়ের রিপোর্টও ছিল। সেখানে স্পষ্ট বোঝা যায় এটা ইন্ট্রাহেপ্যাটিক অ্যাক্টোপিক প্রেগনেন্সির একটা কেস।’

পারুল দাহিয়া বলেন, ‘আমরা এই কেস সম্পর্কে সিনিয়র সার্জন ডা. সুনীল কানওয়ালের সঙ্গে আলোচনা করি। কারণ এ জাতীয় ক্ষেত্রে একজন শল্যচিকিৎসকের দরকার পড়ে। তিনিও রাজি হয়ে যান এবং তারপর রোগীর অস্ত্রোপচার করা হয়।’

ভ্রণটি অপসারণে দেড় ঘণ্টা ধরে চলে অস্ত্রোপচার।

# ইন্ট্রাহেপ্যাটিক অ্যাক্টোপিক প্রেগনেন্সি কী?

সাধারণত, একজন নারী তখন গর্ভধারণ করেন যখন ডিম্বাশয় থেকে নিঃসৃত ডিম্বাণু শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয়। এই নিষিক্ত ডিম্বাণু ফ্যালোপিয়ান টিউবের মধ্য দিয়ে জরায়ুর দিকে চলে যায়। তারপর জরায়ুতেই ভ্রণের বিকাশ হতে থাকে। কিন্তু ইন্ট্রাহেপ্যাটিক অ্যাক্টোপিক প্রেগনেন্সির ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়।

‘বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেস’-এর অধ্যাপক ডা. মমতা ব্যাখ্যা করেছেন, কিছু ক্ষেত্রে নিষিক্ত ডিম্বাণু জরায়ুতে পৌঁছানোর বদলে ফ্যালোপিয়ান টিউবে থেকে যায় বা অন্যান্য অঙ্গের পৃষ্ঠে লেগে থাকে। যেমন এই ক্ষেত্রে লিভারে ভ্রণ দেখা গিয়েছে।

ডা. মমতা জানিয়েছেন, লিভারে রক্ত সরবরাহ ভালো হয়। তাই প্রাথমিক সময়ে ভ্রণের জন্য এটা ‘ঊর্বর জমি’ হিসেবে কাজ করে এবং তার বিকাশ দেখা যায়।

কিন্তু কিছু সময় পর মা এবং শিশু দু’জনের জন্যই একটা বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হয়। তাই অস্ত্রোপচার করা ছাড়া আর অন্য কোনো বিকল্প থাকে না।

# ভারতে এমন ঘটনা আগে দেখা গেছে?

অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেস, পাটনার প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের অধ্যাপিকা ডা. মনিকা অনন্তের মতে, গোটা বিশ্বে গড়ে মাত্র এক শতাংশ ইন্ট্রাহেপ্যাটিক অ্যাক্টোপিক প্রেগনেন্সির কেস দেখা যায়। এই সমস্ত ক্ষেত্রে জরায়ুর বদলে ভ্রণ অন্যত্র দেখা যায়।

ডা. মনিকা অনন্তের কথায়, ‘অনুমান করা হয় যে সাত থেকে আট মিলিয়ন (৭০ থেকে ৮০ লক্ষ) গর্ভাবস্থার মধ্যে একটা ইন্ট্রাহেপ্যাটিক অ্যাক্টোপিক প্রেগনেন্সি দেখা যেতে পারে।’

চিকিৎসকদের মতে, বুন্দেলশহরের বাসিন্দা সর্বেশের আগে, সারা বিশ্বে ৪৫টা ইন্ট্রাহেপ্যাটিক অ্যাক্টোপিক প্রেগনেন্সির কেস রিপোর্ট করা হয়েছিল। এর মধ্যে তিনটে ঘটনা ভারতের।

ভারতে এই জাতীয় ঘটনা প্রথম ধরা পড়েছিল ২০১২ সালে, দিল্লির লেডি হার্ডিঞ্জ মেডিকেল কলেজে। এরপর ২০২২ সালে গোয়া মেডিকেল কলেজে এবং তার পরের বছর পাটনাস্থিত অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেস-এ তৃতীয় ঘটনাটা প্রকাশ্যে আসে।

ডা. অনন্ত এবং তার টিম পাটনার অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেসের ওই ইন্ট্রাহেপ্যাটিক অ্যাক্টোপিক প্রেগনেন্সির কেসের দায়িত্বে ছিলেন।

ওই বিরল কেসটা ‘পাবমেড’-এ ভারতের তৃতীয় ইন্ট্রাহেপ্যাটিক অ্যাক্টোপিক প্রেগনেন্সির ঘটনা হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। পাবমেড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় মেডিকেল গবেষণা ডাটাবেস।

সর্বেশের কেসটিও নথিভুক্ত করার কাজ শুরু হয়েছে, আর শেষ হলেই তা আন্তর্জাতিক মেডিকেল জার্নালে প্রকাশ করার জন্য পাঠানো হবে।

‘জাতীয়’ : আরও খবর

» ‘সঞ্জীবন প্রকল্পে’ উৎপাদনমুখী সামাজিক বিনিয়োগ আত্মনির্ভরশীলতা বৃদ্ধিতে মাইলফলক: আনসার প্রধান

» সিইসির আগামীকালের ভাষণ রেকর্ডের প্রস্তুতি নিতে নির্বাচন কমিশনের চিঠি

» প্রবাসী ভোটার নিবন্ধন ২ লাখ ৫৯ হাজার ছাড়ালো

» বেগম রোকেয়া দিবস

» কিছু ব্যবসায়ী ও আমলা নবায়নযোগ্য জ্বালানি রূপান্তরের ক্ষেত্রে বাধা: জ্বালানি উপদেষ্টা

» ডেঙ্গু: হাসপাতালে ভর্তি ৯৮ হাজার ছাড়িয়েছে, মৃত্যু ৩৯৮ জন

» খালেদা জিয়ার লন্ডন যাত্রা অনিশ্চিত

» কারাগারে শওকত মাহমুদ, রিমান্ড শুনানি বৃহস্পতিবার

» বেক্সিমকো এভিয়েশনের সালমান ও সোহেলসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা

» রোজা ও পূজা বিতর্ক : শিশির মনিরের বিরুদ্ধে মামলা

» মার্কিন নাগরিকের মামলায় শওকত মাহমুদ গ্রেপ্তার

» ডেঙ্গু: আরও ৫১৬ জন হাসপাতালে, মৃত্যু ২

» খাদ্যদূষণ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার উদ্বেগ, সংকট মোকাবিলায় সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান

» ‘মিনেসোটা প্রটোকল’ মেনেই জুলাই শহীদদের শনাক্ত করা হবে: সিআইডি

» দুর্নীতি আছে, দখল-চাঁদাবাজিও চলছে, সরকারের অভ্যন্তরেও দুর্নীতি হয়েছে

» প্রান্তিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী মারাত্মক বৈষম্যের শিকার

» গুম: ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ গঠন নিয়ে আসামিপক্ষের শুনানি কাল

» বিদেশে নেয়ার অবস্থায় নেই খালেদা জিয়া

» ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের জন্য ‘সম্পূর্ণ প্রস্তুত’ ইসি, ‘সন্তুষ্ট’ প্রধান উপদেষ্টা

» বাংলাদেশে আমরা ভিন্ন মতকে প্রতিষ্ঠা করতে চাই-উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান