তিস্তায় পানি বৃদ্ধির পর বিড়ম্বনায় উত্তরাঞ্চলের একটি পরিবার -সংবাদ
ভারতের গজল ডোবা ব্রিজের সব জলকপাট খুলে দেয়া, উজানের পাহাড়ি ঢল ও কয়েকদিনের ভারী বৃষ্টিতে উত্তরাঞ্চলের নদীগুলোর পানি বেড়েছে। ইতোমধ্যে তিস্তা নদীর পানি বেড়ে বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর ফলে তিস্তা, দুধকুমার, ধরলা, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে দুধকুমার নদীর পানি বিপৎসীমার ছয় সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বাড়ায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। নদী তীরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে হাজারো মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পানিতে ডুবে গেছে চরাঞ্চলের কৃষিজমি। এদিকে আসন্ন বন্যা মোকাবিলায় বন্যাপ্রবণ বিভিন্ন উপজেলায় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খুলেছে জেলা প্রশাসন।
তিস্তা পাড়ের বাসিন্দা লালমনিরহাটের হাতিবান্দা উপজেলার নিচ গড্ডিমারী গ্রামের গৃহিণী শামসুন্নাহার আকতার। তিনি বৃহস্পতিবার,(১৪ আগস্ট ২০২৫ সন্ধ্যায় সংবাদকে বলেন, ‘এলাকার অনেকের বাড়ীতে পানি উঠে গেছে। এই যে এখন পানি আঙিনার দিকে আসতিছে। আর পানি যেভাবে বাড়তেছে তাতে বড় বন্যা হবি বলে মনে হয়চে (হচ্ছে)। আর এমনিভাবে বাড়লে হামার ঘেরোক বাড়ি ছাড়ি দিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রত যায়া থাকা নাকবি (লাগবে)।’
তিনি আরও বলেন,‘ বুধবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এক হাত (১৮ ইঞ্চি) পানি বাড়ছে।
তিস্তা পাড়ের স্থানীয় বাসিন্দা এনামুল কবির বলেন, ‘সোলার প্যানেলের কারণে পানির চাপ বেড়েছে। বাঁধ ও রাস্তা ভেঙে গেলে হাজারো পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়বে।’ হাতিবান্ধা উপজেলার পাটিকাপাড়া ইউনিয়নের দিনমজুর সামসুল আলম বলেন, ‘নিচু এলাকায় পানি ঢুকে পড়ায় তাদের পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পশুপাখি, শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের নিয়ে আমরা চরম বিপাকে আছি। এখনও কেউ খোঁজ নেয়নি, ত্রাণ পাইনি।’
আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের গোবর্ধন গ্রামের আব্দুর করিম (৭০) বলেন, ‘এ নিয়ে তিন দফা বন্যার কবলে পড়েছেন তারা। বন্যায় গবাদিপশুসহ শিশু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে।’
তিস্তায় পানি বাড়ার কারণে কারণে লালমনিরহাট সদর, পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ ও আদিতমারী উপজেলার তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকে পড়েছে। এর মধ্যে পাটগ্রামের দহগ্রাম, হাতীবান্ধার গড্ডিমারী, দোয়ানী, ছয়আনী, সানিয়াজান, সিঙ্গামারী, সিন্দুর্না, হলদিবাড়ী ও ডাউয়াবাড়ী, কালীগঞ্জের ভোটমারী, শৈলমারী, নোহালী, আদিতমারীর মহিষখোচা, গোবর্ধন, বাহাদুরপাড়া, পলাশী এবং সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, কুলাঘাট, মোগলহাট, রাজপুর, বড়বাড়ী ও গোকুন্ডা ইউনিয়নের নিচু অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
দুর্গতরা জানিয়েছেন, চরাঞ্চলের রাস্তাঘাট ও বসতবাড়ি ডুবে গেছে। গবাদি পশু, শিশু ও বৃদ্ধদের নিয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন তারা।
কালীগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ ভোটমারীর ইস্ট্রাকো সোলার প্যানেল এলাকায় ভাঙন ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, সোলার প্যানেল স্থাপনের কারণে তিস্তার মূল স্রোত বদলে গিয়ে লোকালয়ের রাস্তায় চাপ পড়ছে। ওই এলাকা ভেঙে গেলে পানি সরাসরি কালীগঞ্জ উপজেলা শহরে ঢুকে পড়তে পারে।
দুধকুমার নদী পাড়ের বাসিন্দা ফরিদুল, জুলহাস ও চাঁন মিয়া জানান, যে হারে নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে দুই-এক দিনের মধ্যে সমস্ত চরাঞ্চল পানিতে তলিয়ে যাবে। তারা জানান, উপজেলার চরাঞ্চলে বসবাসরত মানুষদের জন্য এ সময়টি চরম দুশ্চিন্তার। বন্যার পাশাপাশি নদী ভাঙনের আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-পরিচালক মো. রাকিবুল হাসান বলেন, দউজানের ঢল ও বৃষ্টিপাতের কারণে জেলার সব নদ-নদীর পানি বাড়ছে। এতে নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। স্থানীয়দের সতর্ক অবস্থানে থাকতে বলা হচ্ছে।
* তিস্তায় ভাঙনে নদীগর্ভে ১০ হাজার একর আবাদি জমি, ক্ষতিগ্রস্ত ১০ হাজার পরিবার
নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার ডালিয়া তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় নিম্নাঞ্চল ও চরগুলো তলিয়ে গেছে। চরবাসীরা গবাদিপশু ও মালপত্র নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে চলে গেছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরে চতুর্থবারের মতো তিস্তার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে।
এদিকে অব্যাহত পানি বৃদ্ধির ফলে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার পশ্চিম ছাতনাই, পূর্ব ছাতনাই, খগাখাড়িবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশা চাপানি, ঝুনাগাছ চাপানি ও গয়াবাড়ি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে।
ইতোমধ্যে খালিশা চাপানি ইউনিয়নের ছোটখাতা গ্রামে সাবেক ইউপি সদস্য তফেল মেম্বারের বাড়ির পাশ দিয়ে নদীর একটি নতুন শাখা সৃষ্টি হয়ে সহস্রাধিক একর আবাদি জমি তিস্তা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এতে শতাধিক পরিবার গৃহহীন ও ভূমিহীন হয়ে পড়েছে। অনেক পরিবার বাধ্য হয়ে নিরাপদের জন্য আত্মীয়ের বাড়ি কিংবা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন।
স্থানীয়রা জানান, গত কয়েক বছরে তিস্তার ভাঙনে অসংখ্য গ্রাম মানচিত্র থেকে মুছে গেছে। স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা ও খেলার মাঠসহ অনেক স্থাপনা নদীতে বিলীন হয়েছে। এবারের ভাঙনের তীব্রতা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। প্রতিদিন গড়ে কয়েক হাজার একর ফসলি জমি ও নদীপাড় ভেঙে যাচ্ছে, যার ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজার ও ঘাট ঝুঁকিতে রয়েছে।
টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম শাহীন জানান, তার ইউনিয়নের চারটি ওয়ার্ড নদীর তীরবর্তী। সেখানে কয়েক হাজার মানুষের বসবাস করে, এর মধ্যে সহস্রাধিক পরিবারের বাড়ি-ঘরে পানি উঠেছে।
পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের ঝড়সিংহেশ্বর গ্রামের বাসিন্দা বিনোদ আলী বলেন, ‘পানি বেড়ে চরগুলো ডুবে গেছে। অধিকাংশ মানুষ লোকালয়ে চলে এসেছে, গবাদিপশুর জন্য খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে।’
খালিশা চাপানি ইউনিয়নের ছোটখাতা গ্রামের আব্দুল মালেক জানান, ‘প্রতিদিনই পানি বাড়ছে। মানুষ নৌকায় করে মালামাল সরিয়ে নিচ্ছে কেউ আত্মীয়ের বাড়িতে, কেউ ভাড়া বাসায় উঠছেন। যাদের গবাদিপশু আছে তারা বেশি বিপাকে পড়েছেন, অনেক পশু এখনও চরেই রয়ে গেছে।’
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সালামত ফকির বলেন, ‘উজানের ঢলে ও অব্যাহত প্রবল বর্ষণের কারণে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তিস্তার তীরবর্তী বাসিন্দাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে সতর্ক থাকতে। আমরাও সর্বদা সতর্ক অবস্থায় রয়েছি।
* কুড়িগ্রামে ১৬টি নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি, তিস্তার ভাঙনে ‘দিশেহারা’ মানুষ
কুড়িগ্রাম ১৬টি নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় রাজারহাটের ঘড়িয়ালডাঙ্গা ও বিদ্যানন্দ ইউনিয়ন এবং উলিপুর উপজেলার থেতরাই ও বজরা ইউনিয়নে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এদিকে ভাঙন প্রতিরোধে বজরা ইউনিয়নে ঠিকাদার নিয়োগ করা হলেও পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় কাজ শুরু না করায় চলতি সপ্তাহে ৬টি বাড়ি নদীগর্ভে চলে গেছে। হুমকিতে রয়েছে ১০টি বাড়িসহ একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
বজরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কাইয়ুম সর্দার জানান, গত এক সপ্তাহে কালপানি বজরা ও সাধুয়াদামারহাট গ্রামের শাহজাদি, আশরাফুল, হান্নান, মুকুল, মজিদা ও রোসনার বাড়ি নদীগর্ভে চলে গেছে। এতে আরও ১০টি বাড়িসহ একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঝুঁকিতে রয়েছে।
ওই এলাকার সাতালষ্কার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আনোয়ারা জানান, কাল যে রাস্তা দিয়ে স্কুলে গেছি, আজ সেই জায়গা নদীগর্ভে চলে গেছে। যে কোনো সময় দুটি স্কুল নদীগর্ভে চলে যেতে পারে।
সাধুয়াদামারহাট গ্রামের ফুলবাবু জানান, নদী আমার ২ বিঘা জমি খেয়ে গেছে। আমার মতো মোফাজ্জল ও আশরাফুলের বসতবাড়ি নদীতে চলে গেছে। সরকারিভাবে আমরা নদী ভাঙন রোধে কাজ চাই।
এ ব্যাপারে উলিপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার নয়ন কুমার সাহা জানান, আমি ভাঙনকবলিত বজরা ও থেতরাই ইউনিয়ন পরিদর্শন করেছি। জনপ্রতিনিধিদের তালিকা তৈরির জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এদিকে দুধকুমার নদীতে পানি বৃদ্ধির ফলে নিম্নাঞ্চলে পানি প্রবেশ করা শুরু করেছে। বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত এই নদীর পানি বিপৎসীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি বৃদ্ধির ফলে নাগেশ^রী উপজেলার বল্লভের কাস ইউনিয়নের ফান্দের চরে ৪-৫টি নিচু বাড়িতে পানি উঠেছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে। একইভাবে ওই উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের কুটি বামনডাঙ্গা চরে নিচু এলাকায় অবস্থিত দুটি বাড়িতে পানি উঠছে বলে স্থানীয় যুবক আশরাফুল ও কাদের জানিয়েছে।
এ ব্যাপারে নাগেশ^রী উপজেলা নির্বাহী অফিসার সিব্বির আহমেদ জানান, আমরা বিভিন্ন এলাকায় খোঁজখবর নিচ্ছি। এখন পর্যন্ত বাড়ি তলিয়ে যাওয়ার কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে কিছু নিচু বাড়ি জলবন্দী রয়েছে বলে জেনেছি। তিনি আরও জানান, যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে।
* বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে ‘বন্যার সম্ভাবনা নেই’
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান সংবাদকে বলেন, ‘তিস্তা নদী ডালিয়া পয়েন্টে ১৫ সেন্টিমিটার এবং কুড়িগ্রামের পাটেশ্বরী পয়েন্টে বিপৎসীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দেশের সব জেলার নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে, বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এখন ভারী বৃষ্টিপাত উজানে কমে গেছে। আগামী তিন দিন পর্যন্ত উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা কম। এ কারণে আগামী ২৪ ঘণ্টা পর উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও দুধ কুমারী নদীর পানি কমে যেতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘একইভাবে ব্রহ্মপুত্র যমুনা নদীর পানি আগামী তিন দিন পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। এ সময় সব নদীর পানি সতর্ক সীমায় প্রবাহিত হওয়ার সম্ভবনা আছে। যার কারণে পদ্মা নদীর জেলাগুলোর নিম্নাঞ্চলগুলো সাময়িকভাবে প্লাবিত হতে পারে। তিন দিন পর নদীর পানি স্থিতিশীল হয়ে আবারো কমে যেতে পারে। অন্যদিকে গঙ্গা নদীর পানি স্থিতিশীল হয়ে যাওয়ার কারণে আগামীতে কমে যাবে।’
বড় বন্যার আশঙ্কা বা সম্ভাবনা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেহেতু পানি এখানও সেভাবে বিপৎসীমা অতিক্রম করে নাই, এখনও বড় বন্যা হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’
বন্যাপ্রবণ ও নদীভাঙন এলাকায় বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ডিপিডি মো. কামরুল আহসান সংবাদকে বলেন, ‘বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের আশ্রয়ের জন্য আমরা প্রকল্প থেকে বন্যা প্রবণ এলাকায় বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেছি। তবে, এখনও আমাদের তৈরি করা বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয়ের জন্য কোনো মানুষ আসার খবর পাওয়া যায়নি। তবে, বন্যা যদি বাড়ে বা লোকজন আসতে চাইলে আশ্রয় কেন্দ্রগুলো প্রস্তত আছে।’
* টানা বর্ষণে ময়মনসিংহে তলিয়েছে শত শত একর জমির ফসল
কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলায় তলিয়ে গেছে কৃষকের শত শত একর জমির ফসল। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তারা। ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার সিধলা ইউনিয়নের বেড়াবিলের এখনকার চিত্র এমনই। যেদিকেই চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। এক সপ্তাহ ধরে এই বিলে পানিতে নিমজ্জিত। এতে তলিয়ে গেছে কৃষকের শত শত একর জমির আমন ধান। পচে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে ধানের চারাগুলো। ধার-দেনা করে ফসল লাগিয়ে এমন অবস্থায় দিশেহারা কৃষক।
কুতুবপুর গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, ‘খালে বাঁধ দিয়ে অনেকে মাছ ধরে; যার কারণে পানি প্রবাহিত ঠিক হয় না। এতে মানুষের জমির ধান পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে কয়েকদিন ধরে। খালটি খননে দ্রুত উদ্যোগ নিলে কৃষকের ফসল রক্ষার পাশাপাশি বৃদ্ধি পাবে মাছ ও জীববৈচিত্র্য।’
হাসনপুর গ্রামের হাসিম উদ্দিন বলেন, ‘কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে বেড়াবিলে গলাপানি পর্যন্ত হয়েছে। এখন পানি কিছুটা কমছে আর ক্ষতি ভেসে উঠছে। আমরা চাই, খালটি দ্রুত খনন করার উদ্যোগ নিক সরকার।’
১৫-২০ হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে রয়েছে জানিয়ে ময়মনসিংহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নাছরিন আক্তার বানু বলেন, ‘টানা কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতায় ফসল তলিয়ে রয়েছে। এখন পানি কমায় ক্ষতি ভেসে উঠছে। ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করে মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন পাঠানো হবে, সেখান থেকে সহযোগিতা করলে যথাযথভাবে কৃষকদের মাঝে বণ্টন করা হবে।’
ময়মনসিংহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আখলাক উল জামিল বলেন, ‘মূলত কৃষি অর্থনীতি চাঙ্গা হবে; কৃষকেরা সব ধরনের সুবিধা ভোগ করবে সেই বিবেচনায় গুরুত্ব দিয়ে খাল খনন করা হয়ে থাকে। গৌরীপুরে খাল খনন না হওয়ায় কৃষকের ফসল হুমকির মুখে পড়েছে- এমন বিষয়ে আমরা অবগত নই। উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে আবেদন করে স্থানীয়রা যদি আমাদের অবগত করে তাহলে খনন করতে মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করা হবে।’
প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন; নীলফামারী ডিমলার ময়েন কবীর, কুড়িগ্রাম জেলা বার্তা পরিবেশক ও ময়মনসিংহ জেলা বার্তা পরিবেশক।
তিস্তায় পানি বৃদ্ধির পর বিড়ম্বনায় উত্তরাঞ্চলের একটি পরিবার -সংবাদ
বৃহস্পতিবার, ১৪ আগস্ট ২০২৫
ভারতের গজল ডোবা ব্রিজের সব জলকপাট খুলে দেয়া, উজানের পাহাড়ি ঢল ও কয়েকদিনের ভারী বৃষ্টিতে উত্তরাঞ্চলের নদীগুলোর পানি বেড়েছে। ইতোমধ্যে তিস্তা নদীর পানি বেড়ে বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর ফলে তিস্তা, দুধকুমার, ধরলা, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে দুধকুমার নদীর পানি বিপৎসীমার ছয় সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বাড়ায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। নদী তীরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে হাজারো মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পানিতে ডুবে গেছে চরাঞ্চলের কৃষিজমি। এদিকে আসন্ন বন্যা মোকাবিলায় বন্যাপ্রবণ বিভিন্ন উপজেলায় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খুলেছে জেলা প্রশাসন।
তিস্তা পাড়ের বাসিন্দা লালমনিরহাটের হাতিবান্দা উপজেলার নিচ গড্ডিমারী গ্রামের গৃহিণী শামসুন্নাহার আকতার। তিনি বৃহস্পতিবার,(১৪ আগস্ট ২০২৫ সন্ধ্যায় সংবাদকে বলেন, ‘এলাকার অনেকের বাড়ীতে পানি উঠে গেছে। এই যে এখন পানি আঙিনার দিকে আসতিছে। আর পানি যেভাবে বাড়তেছে তাতে বড় বন্যা হবি বলে মনে হয়চে (হচ্ছে)। আর এমনিভাবে বাড়লে হামার ঘেরোক বাড়ি ছাড়ি দিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রত যায়া থাকা নাকবি (লাগবে)।’
তিনি আরও বলেন,‘ বুধবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এক হাত (১৮ ইঞ্চি) পানি বাড়ছে।
তিস্তা পাড়ের স্থানীয় বাসিন্দা এনামুল কবির বলেন, ‘সোলার প্যানেলের কারণে পানির চাপ বেড়েছে। বাঁধ ও রাস্তা ভেঙে গেলে হাজারো পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়বে।’ হাতিবান্ধা উপজেলার পাটিকাপাড়া ইউনিয়নের দিনমজুর সামসুল আলম বলেন, ‘নিচু এলাকায় পানি ঢুকে পড়ায় তাদের পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পশুপাখি, শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের নিয়ে আমরা চরম বিপাকে আছি। এখনও কেউ খোঁজ নেয়নি, ত্রাণ পাইনি।’
আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের গোবর্ধন গ্রামের আব্দুর করিম (৭০) বলেন, ‘এ নিয়ে তিন দফা বন্যার কবলে পড়েছেন তারা। বন্যায় গবাদিপশুসহ শিশু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে।’
তিস্তায় পানি বাড়ার কারণে কারণে লালমনিরহাট সদর, পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ ও আদিতমারী উপজেলার তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকে পড়েছে। এর মধ্যে পাটগ্রামের দহগ্রাম, হাতীবান্ধার গড্ডিমারী, দোয়ানী, ছয়আনী, সানিয়াজান, সিঙ্গামারী, সিন্দুর্না, হলদিবাড়ী ও ডাউয়াবাড়ী, কালীগঞ্জের ভোটমারী, শৈলমারী, নোহালী, আদিতমারীর মহিষখোচা, গোবর্ধন, বাহাদুরপাড়া, পলাশী এবং সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, কুলাঘাট, মোগলহাট, রাজপুর, বড়বাড়ী ও গোকুন্ডা ইউনিয়নের নিচু অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
দুর্গতরা জানিয়েছেন, চরাঞ্চলের রাস্তাঘাট ও বসতবাড়ি ডুবে গেছে। গবাদি পশু, শিশু ও বৃদ্ধদের নিয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন তারা।
কালীগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ ভোটমারীর ইস্ট্রাকো সোলার প্যানেল এলাকায় ভাঙন ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, সোলার প্যানেল স্থাপনের কারণে তিস্তার মূল স্রোত বদলে গিয়ে লোকালয়ের রাস্তায় চাপ পড়ছে। ওই এলাকা ভেঙে গেলে পানি সরাসরি কালীগঞ্জ উপজেলা শহরে ঢুকে পড়তে পারে।
দুধকুমার নদী পাড়ের বাসিন্দা ফরিদুল, জুলহাস ও চাঁন মিয়া জানান, যে হারে নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে দুই-এক দিনের মধ্যে সমস্ত চরাঞ্চল পানিতে তলিয়ে যাবে। তারা জানান, উপজেলার চরাঞ্চলে বসবাসরত মানুষদের জন্য এ সময়টি চরম দুশ্চিন্তার। বন্যার পাশাপাশি নদী ভাঙনের আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-পরিচালক মো. রাকিবুল হাসান বলেন, দউজানের ঢল ও বৃষ্টিপাতের কারণে জেলার সব নদ-নদীর পানি বাড়ছে। এতে নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। স্থানীয়দের সতর্ক অবস্থানে থাকতে বলা হচ্ছে।
* তিস্তায় ভাঙনে নদীগর্ভে ১০ হাজার একর আবাদি জমি, ক্ষতিগ্রস্ত ১০ হাজার পরিবার
নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার ডালিয়া তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় নিম্নাঞ্চল ও চরগুলো তলিয়ে গেছে। চরবাসীরা গবাদিপশু ও মালপত্র নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে চলে গেছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরে চতুর্থবারের মতো তিস্তার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে।
এদিকে অব্যাহত পানি বৃদ্ধির ফলে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার পশ্চিম ছাতনাই, পূর্ব ছাতনাই, খগাখাড়িবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশা চাপানি, ঝুনাগাছ চাপানি ও গয়াবাড়ি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে।
ইতোমধ্যে খালিশা চাপানি ইউনিয়নের ছোটখাতা গ্রামে সাবেক ইউপি সদস্য তফেল মেম্বারের বাড়ির পাশ দিয়ে নদীর একটি নতুন শাখা সৃষ্টি হয়ে সহস্রাধিক একর আবাদি জমি তিস্তা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এতে শতাধিক পরিবার গৃহহীন ও ভূমিহীন হয়ে পড়েছে। অনেক পরিবার বাধ্য হয়ে নিরাপদের জন্য আত্মীয়ের বাড়ি কিংবা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন।
স্থানীয়রা জানান, গত কয়েক বছরে তিস্তার ভাঙনে অসংখ্য গ্রাম মানচিত্র থেকে মুছে গেছে। স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা ও খেলার মাঠসহ অনেক স্থাপনা নদীতে বিলীন হয়েছে। এবারের ভাঙনের তীব্রতা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। প্রতিদিন গড়ে কয়েক হাজার একর ফসলি জমি ও নদীপাড় ভেঙে যাচ্ছে, যার ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজার ও ঘাট ঝুঁকিতে রয়েছে।
টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম শাহীন জানান, তার ইউনিয়নের চারটি ওয়ার্ড নদীর তীরবর্তী। সেখানে কয়েক হাজার মানুষের বসবাস করে, এর মধ্যে সহস্রাধিক পরিবারের বাড়ি-ঘরে পানি উঠেছে।
পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের ঝড়সিংহেশ্বর গ্রামের বাসিন্দা বিনোদ আলী বলেন, ‘পানি বেড়ে চরগুলো ডুবে গেছে। অধিকাংশ মানুষ লোকালয়ে চলে এসেছে, গবাদিপশুর জন্য খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে।’
খালিশা চাপানি ইউনিয়নের ছোটখাতা গ্রামের আব্দুল মালেক জানান, ‘প্রতিদিনই পানি বাড়ছে। মানুষ নৌকায় করে মালামাল সরিয়ে নিচ্ছে কেউ আত্মীয়ের বাড়িতে, কেউ ভাড়া বাসায় উঠছেন। যাদের গবাদিপশু আছে তারা বেশি বিপাকে পড়েছেন, অনেক পশু এখনও চরেই রয়ে গেছে।’
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সালামত ফকির বলেন, ‘উজানের ঢলে ও অব্যাহত প্রবল বর্ষণের কারণে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তিস্তার তীরবর্তী বাসিন্দাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে সতর্ক থাকতে। আমরাও সর্বদা সতর্ক অবস্থায় রয়েছি।
* কুড়িগ্রামে ১৬টি নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি, তিস্তার ভাঙনে ‘দিশেহারা’ মানুষ
কুড়িগ্রাম ১৬টি নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় রাজারহাটের ঘড়িয়ালডাঙ্গা ও বিদ্যানন্দ ইউনিয়ন এবং উলিপুর উপজেলার থেতরাই ও বজরা ইউনিয়নে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এদিকে ভাঙন প্রতিরোধে বজরা ইউনিয়নে ঠিকাদার নিয়োগ করা হলেও পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় কাজ শুরু না করায় চলতি সপ্তাহে ৬টি বাড়ি নদীগর্ভে চলে গেছে। হুমকিতে রয়েছে ১০টি বাড়িসহ একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
বজরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কাইয়ুম সর্দার জানান, গত এক সপ্তাহে কালপানি বজরা ও সাধুয়াদামারহাট গ্রামের শাহজাদি, আশরাফুল, হান্নান, মুকুল, মজিদা ও রোসনার বাড়ি নদীগর্ভে চলে গেছে। এতে আরও ১০টি বাড়িসহ একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঝুঁকিতে রয়েছে।
ওই এলাকার সাতালষ্কার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আনোয়ারা জানান, কাল যে রাস্তা দিয়ে স্কুলে গেছি, আজ সেই জায়গা নদীগর্ভে চলে গেছে। যে কোনো সময় দুটি স্কুল নদীগর্ভে চলে যেতে পারে।
সাধুয়াদামারহাট গ্রামের ফুলবাবু জানান, নদী আমার ২ বিঘা জমি খেয়ে গেছে। আমার মতো মোফাজ্জল ও আশরাফুলের বসতবাড়ি নদীতে চলে গেছে। সরকারিভাবে আমরা নদী ভাঙন রোধে কাজ চাই।
এ ব্যাপারে উলিপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার নয়ন কুমার সাহা জানান, আমি ভাঙনকবলিত বজরা ও থেতরাই ইউনিয়ন পরিদর্শন করেছি। জনপ্রতিনিধিদের তালিকা তৈরির জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এদিকে দুধকুমার নদীতে পানি বৃদ্ধির ফলে নিম্নাঞ্চলে পানি প্রবেশ করা শুরু করেছে। বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত এই নদীর পানি বিপৎসীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি বৃদ্ধির ফলে নাগেশ^রী উপজেলার বল্লভের কাস ইউনিয়নের ফান্দের চরে ৪-৫টি নিচু বাড়িতে পানি উঠেছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে। একইভাবে ওই উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের কুটি বামনডাঙ্গা চরে নিচু এলাকায় অবস্থিত দুটি বাড়িতে পানি উঠছে বলে স্থানীয় যুবক আশরাফুল ও কাদের জানিয়েছে।
এ ব্যাপারে নাগেশ^রী উপজেলা নির্বাহী অফিসার সিব্বির আহমেদ জানান, আমরা বিভিন্ন এলাকায় খোঁজখবর নিচ্ছি। এখন পর্যন্ত বাড়ি তলিয়ে যাওয়ার কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে কিছু নিচু বাড়ি জলবন্দী রয়েছে বলে জেনেছি। তিনি আরও জানান, যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে।
* বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে ‘বন্যার সম্ভাবনা নেই’
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান সংবাদকে বলেন, ‘তিস্তা নদী ডালিয়া পয়েন্টে ১৫ সেন্টিমিটার এবং কুড়িগ্রামের পাটেশ্বরী পয়েন্টে বিপৎসীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দেশের সব জেলার নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে, বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এখন ভারী বৃষ্টিপাত উজানে কমে গেছে। আগামী তিন দিন পর্যন্ত উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা কম। এ কারণে আগামী ২৪ ঘণ্টা পর উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও দুধ কুমারী নদীর পানি কমে যেতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘একইভাবে ব্রহ্মপুত্র যমুনা নদীর পানি আগামী তিন দিন পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। এ সময় সব নদীর পানি সতর্ক সীমায় প্রবাহিত হওয়ার সম্ভবনা আছে। যার কারণে পদ্মা নদীর জেলাগুলোর নিম্নাঞ্চলগুলো সাময়িকভাবে প্লাবিত হতে পারে। তিন দিন পর নদীর পানি স্থিতিশীল হয়ে আবারো কমে যেতে পারে। অন্যদিকে গঙ্গা নদীর পানি স্থিতিশীল হয়ে যাওয়ার কারণে আগামীতে কমে যাবে।’
বড় বন্যার আশঙ্কা বা সম্ভাবনা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেহেতু পানি এখানও সেভাবে বিপৎসীমা অতিক্রম করে নাই, এখনও বড় বন্যা হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’
বন্যাপ্রবণ ও নদীভাঙন এলাকায় বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ডিপিডি মো. কামরুল আহসান সংবাদকে বলেন, ‘বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের আশ্রয়ের জন্য আমরা প্রকল্প থেকে বন্যা প্রবণ এলাকায় বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেছি। তবে, এখনও আমাদের তৈরি করা বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয়ের জন্য কোনো মানুষ আসার খবর পাওয়া যায়নি। তবে, বন্যা যদি বাড়ে বা লোকজন আসতে চাইলে আশ্রয় কেন্দ্রগুলো প্রস্তত আছে।’
* টানা বর্ষণে ময়মনসিংহে তলিয়েছে শত শত একর জমির ফসল
কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলায় তলিয়ে গেছে কৃষকের শত শত একর জমির ফসল। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তারা। ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার সিধলা ইউনিয়নের বেড়াবিলের এখনকার চিত্র এমনই। যেদিকেই চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। এক সপ্তাহ ধরে এই বিলে পানিতে নিমজ্জিত। এতে তলিয়ে গেছে কৃষকের শত শত একর জমির আমন ধান। পচে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে ধানের চারাগুলো। ধার-দেনা করে ফসল লাগিয়ে এমন অবস্থায় দিশেহারা কৃষক।
কুতুবপুর গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, ‘খালে বাঁধ দিয়ে অনেকে মাছ ধরে; যার কারণে পানি প্রবাহিত ঠিক হয় না। এতে মানুষের জমির ধান পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে কয়েকদিন ধরে। খালটি খননে দ্রুত উদ্যোগ নিলে কৃষকের ফসল রক্ষার পাশাপাশি বৃদ্ধি পাবে মাছ ও জীববৈচিত্র্য।’
হাসনপুর গ্রামের হাসিম উদ্দিন বলেন, ‘কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে বেড়াবিলে গলাপানি পর্যন্ত হয়েছে। এখন পানি কিছুটা কমছে আর ক্ষতি ভেসে উঠছে। আমরা চাই, খালটি দ্রুত খনন করার উদ্যোগ নিক সরকার।’
১৫-২০ হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে রয়েছে জানিয়ে ময়মনসিংহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নাছরিন আক্তার বানু বলেন, ‘টানা কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতায় ফসল তলিয়ে রয়েছে। এখন পানি কমায় ক্ষতি ভেসে উঠছে। ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করে মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন পাঠানো হবে, সেখান থেকে সহযোগিতা করলে যথাযথভাবে কৃষকদের মাঝে বণ্টন করা হবে।’
ময়মনসিংহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আখলাক উল জামিল বলেন, ‘মূলত কৃষি অর্থনীতি চাঙ্গা হবে; কৃষকেরা সব ধরনের সুবিধা ভোগ করবে সেই বিবেচনায় গুরুত্ব দিয়ে খাল খনন করা হয়ে থাকে। গৌরীপুরে খাল খনন না হওয়ায় কৃষকের ফসল হুমকির মুখে পড়েছে- এমন বিষয়ে আমরা অবগত নই। উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে আবেদন করে স্থানীয়রা যদি আমাদের অবগত করে তাহলে খনন করতে মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করা হবে।’
প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন; নীলফামারী ডিমলার ময়েন কবীর, কুড়িগ্রাম জেলা বার্তা পরিবেশক ও ময়মনসিংহ জেলা বার্তা পরিবেশক।