নিউইয়র্কে ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম ‘জেটেও’র মেহদি হাসানের সঙ্গে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস -ভিডিও থেকে নেয়া
অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ কত হবে তা কেউ নির্ধারণ করে দেয়নি বলে বলছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলছেন অনেকেই তাকে দীর্ঘসময়ের জন্য চান। তিনি বলেছেন, কেউ তাকে ৫, কেউ ১০ এমনকি কেউ তাকে ৫০ বছরও জন্য চান। নির্বাচনের চেয়ে তাদের কাছে বড় গুরুত্বের বিষয় সুশাসন, এমনটাই বলেছেন ইউনূস।
‘এমন মানুষও আছে, যারা বলছে ৫ বছর থাকুন, ১০ বছর থাকুন, ৫০ বছর থাকুন। সুতরাং মানুষ সব ধরনের কথা বলছে। আপনি থাকুন, নির্বাচন কেন? কার নির্বাচন দরকার?
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্ক সফরের সময় অধিবেশনের ফাঁকে ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম ‘জেটেও’র মেহদি হাসানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে নির্বাচন ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হয়। এর একটা বড় অংশজুড়ে ছিল শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গও।
আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দল নিষিদ্ধ নয়। কার্যক্রম নিষিদ্ধ। তবে নির্বাচনে তারা অংশ নিতে পারবে না।
মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আমাদের কত দিন থাকতে হবে, তা কেউ নির্ধারণ করে দেয়নি।’ নির্বাচন দিতে দেরি হচ্ছে কেন?- জেটেওর মেহদি হাসানের এ প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে একপর্যায়ে এ কথা বলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা।
সাক্ষাৎকারে জুলাই গণঅভ্যুত্থান, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেয়া, শেখ হাসিনাকে ভারতের আশ্রয়, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা, নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন মুহাম্মদ ইউনূস।
‘নেপালে, যেখানে এই বছরে কিছুদিন আগে সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে, সেখানকার অন্তর্বর্তী নেতা মাত্র ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বাংলাদেশের একটি নির্বাচনের জন্য কেন ১৮ মাস লাগছে বা লাগবে?’, মেহদি হাসানের এমন প্রশ্নের ইউনূস বলেন, ‘এমন মানুষও আছে, যারা বলছে ৫ বছর থাকুন, ১০ বছর থাকুন, ৫০ বছর থাকুন। সুতরাং মানুষ সব ধরনের কথা বলছে।’
ইউনূস বলেন, ‘তারা কথা বলে সুশাসন নিয়ে। আমরা একটি দুর্নীতিমুক্ত শাসনব্যবস্থা দেখতে চাই, তাই আপনি থাকুন। কারণ, আমরা নির্বাচনের পর আবার বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়তে চাই না।
‘আমি যা বলতে চাই, তা হলো আপনি একটি বক্তব্য তুলে ধরেছেন, অন্য বক্তব্যও আছে।’
ইউনূস বলেন, ‘আপনি নেপালের উদাহরণ দিয়েছেন। নেপালের সরকার আমাদের পরিভাষায় এক ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। অর্থাৎ আপনার দায়িত্ব একটি নির্বাচন আয়োজন করা। তাই সম্ভবত এটাই তাদের কাজ।’
‘আমরা (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) নই। আমরা অন্তর্বর্তী সরকার। আমাদের কত দিন থাকতে হবে, তা কেউ নির্ধারণ করে দেয়নি।
‘আমরা কত দিন থাকব, সেটা আমাদের সিদ্ধান্ত। তবে আমাদের বোঝাপড়া আছে যে আমাদের তিনটি কাজ রয়েছে। একটি হলো সংস্কার, অন্যটি বিচার ও শেষটি হলো নির্বাচন।
আমরা সংস্কারের অ্যাজেন্ডা নিয়ে কাজ করছি। এটি একটি বড় অ্যাজেন্ডা,’ বলেন ইউনূস।
‘কারণ, আপনি যদি শুধু একটি নির্বাচন করেন, তবে সেই পুরনো জিনিসগুলো আবার ঘটবে। ভিন্ন নামে, ভিন্ন চিত্রে, আরও অনেকভাবে। আমাদের সংস্কার প্রয়োজন। আপনি যদি শুধু নির্বাচন করেন, তবে সবকিছুর একই পুনরাবৃত্তি হবে। কারণ, আইন, নিয়ম, পদ্ধতি একই থেকে যাবে,’ বলেন ইউনূস।
তিনি বলেন, ‘ছাত্রদের নেতৃত্বে জনগণের একটি দাবি ছিল সংস্কার করা। নিশ্চিত করা যেসব শিকড় উপড়ে ফেলা হয়েছে, যাতে আপনার একটি ভিন্ন ধরনের কাঠামো থাকে, যেন এ জিনিসগুলো ফিরে আসতে না পারে। ফ্যাসিবাদ যেসব পথে প্রবেশ করে, সেই পথগুলো বন্ধ করে দেয়া, যাতে তারা আর আসতে না পারে। তাই এটি আমাদের অ্যাজেন্ডা। এটি একটি বড় অ্যাজেন্ডা। তারপর বিচার। সব ঘটনার জন্য দোষী সব ব্যক্তির বিচার, যা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তাই ওই বিচার করার জন্য আমাদের একটি বিশেষ আদালত স্থাপন করতে হবে এবং যে ফলাফল আসে, তা দেখাতে হবে। আদালত ব্যবস্থা থেকে দৃশ্যমান ফলাফল আসতে হবে যে তাদের শাস্তি দেয়া হচ্ছে। তৃতীয়টি হলো নির্বাচন। তাই আমাদের এ তিন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে, শুধু একটি নয়। নেপালে তারা শুধু নির্বাচন করছে।’
আওয়ামী লীগ, হাসিনাকে নিয়ে যা বললেন
ওই সাক্ষাৎকারের একটি বড় অংশজুড়ে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা ও শেখ হাসিনাকে নিয়ে তার ভাবনা ওঠে এসেছে।
ইউনূসের কাছে জানতে চাওয়া হয় হাসিনার সরকারের পতনে তার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া কী ছিল। ইউনূস বলেন, ‘পরিস্থিতি খুবই খারাপ ছিল। তিনি দেশ ছাড়ার আগে কী ঘটেছিল, তার বিস্তারিত আমি তখন জানতাম না। তবে শেষ খবরটা ছিল, তিনি চলে গেছেন। সেটি ছিল রোমাঞ্চকর।’
মেহদি জানতে চান, হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরানোর জন্য বারবার অনুরোধের পরও ভারতের নরেন্দ্র মোদি উপেক্ষা করায় ইউনূস কী করেছেন? ভারত কখনো হাসিনাকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করবে, তা ইউনূস বিশ্বাস করেন কিনা।
জবাবে ইউনূস বলেন, ‘তারা যদি নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সম্ভবত তারা তাকে রেখে দেবে। যদি আইনি বাধ্যবাধকতা থেকে থাকে, যা তারা এড়াতে পারবে না, তখন পরিস্থিতিটা ভিন্ন হবে।’
তাকে রাখার পেছনে ভারতের স্বার্থ কী? এমন প্রশ্নে ইউনূস বলেন, ‘তারা বরাবরই তাকে সমর্থন করে আসছে। যারা তার পেছনে আছেন, তারা সম্ভবত এখনও আশা করছেন যে তিনি পূর্ণ গৌরবের সঙ্গে বাংলাদেশে ফিরে আসবেন, একজন বিজয়ী নেতা হিসেবে।’
মেহদি হাসান জানতে চান, এটা তাকে উদ্বিগ্ন করে কিনা যে ভারত তাকে ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছে এবং আবার ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা করছে?
ইউনূস বলেন, ‘আমি ঠিক এভাবে কথাগুলো বলব না। তবে এ আশঙ্কা রয়েছে যে বাইরের কিছু শক্তি তাকে বাংলাদেশে ফিরে আসতে সহায়তা করবে। আমরা সব সময় এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন।’
মেহদি বলেন, ‘হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ, তাদের নিবন্ধন স্থগিত, কার্যত পরবর্তী নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে তাদের নিষিদ্ধ করেছে। আপনার মতোই নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অমর্ত্য সেন- যিনি আপনাকে খুব ভালো করেই চেনেন, তিনি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। বলেছিলেন, এটা পূর্ববর্তী সরকারের ভুলের পুনরাবৃত্তি হবে, যারা ক্ষমতায় এসে তাদের বিরোধীদের নিষিদ্ধ করেছিল। আপনি কেবল সেই চক্রের পুনরাবৃত্তি করছেন। অমর্ত্য সেন ও অন্যদের এ ধরনের সমালোচনার কী জবাব দেবেন আপনি?’
ইউনূস বলেন, ‘এটা ভুল সমালোচনা। কারণ, আমরা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করিনি। শুধু তাদের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। এর অর্থ হলো- তারা কোনো রাজনৈতিক কর্মকা- করতে পারবে না।’
মেহদি তখন জানতে চান, ‘তবে তারা (আওয়ামী লীগ) কি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে?
উত্তরে ইউনূস বলেন- ‘না, এখন পারবে না। তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ। তারা দল হিসেবে বৈধ, তবে এখন কার্যক্রম স্থগিত। যে কোনো সময় এর কার্যক্রম চালু করা হতে পারে। তবে স্থগিতাদেশ তুলে নেয়া এখনও একটা সম্ভাবনা।’
‘কিন্তু একটি গোষ্ঠীর মানুষকে নির্বাচনে অংশ নেয়া থেকে নিষিদ্ধ করাটা কতটা গণতান্ত্রিক?’ এ প্রশ্নে ইউনূস বলেন, ‘দেখুন, নির্বাচন কমিশন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা এটা করেছে দলটির চরিত্র ও সম্ভাবনা দেখে যে তারা পুরো নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করবে। তাই তারা ভেবেছে, এটা না করাই ভালো...’
তখন মেহদি বলেন, ‘আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না যে বাংলাদেশে তাদের লাখ লাখ সমর্থক আছেন?’
উত্তরে ইউনূস বলেন, ‘আমি লাখ লাখ বলব না। তাদের সমর্থক আছে। কিন্তু কতজন অবশিষ্ট আছে, তা আমি জানি না। কারণ, সমর্থক এমন একটি বিষয় যে আপনি খুব ক্ষমতাধর, আমি সব সময় আপনার সামনে মাথা নত করি, কারণ, আপনি ক্ষমতাধর। আমি একজন সমর্থক হয়ে তা করছি না।
মেহদির প্রশ্ন, ‘আপনি এটা অস্বীকার করতে পারেন না যে বাংলাদেশে তাদের ভোটার আছে।‘ তাতে ইউনূস বলেন, ‘অবশ্যই, এটা দীর্ঘদিনের একটি দল।‘
মেহদি তখন বলেন, ‘কিন্তু এখন সেই ব্যক্তিদের কথা বলার কোনো জায়গা নেই। আপনি তাদের দলকে নিষিদ্ধ করেছেন। আমি বলতে চাচ্ছি, আপনি তাদের দলকে রাজনীতিতে অংশ নিতে বাধা দিয়েছেন।’
ইউনূসের জবাব, ‘তারা ভোটার হিসেবে ভোট দিতে পারেন। তারা বৈধ ভোটার। অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী আছেন। তারা নিজেদেরটা বেছে নেবেন। আওয়ামী লীগের মার্কাটা সেখানে থাকবে না।’
‘এটা কি ভালো হবে? পরিস্থিতিটা থাকা কি বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে, যেখানে মানুষ বলছে, নতুন সরকার পুরনো সরকারের ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে, চক্রটা চলতেই থাকল? মেহেদির এ প্রশ্নে ইউনূস বলেন, ‘অন্যথায় আমরা নির্বাচন করতে পারব না। তারা একটি রাজনৈতিক দলের মতো আচরণ করছে না। তারা যে মানুষ হত্যা করেছে, সেজন্য অনুশোচনা প্রকাশ করেনি। এ সময়ে তারা যা যা করেছে, তার কোনো কিছুরই দায় নেয়নি- একটি বিষয়েরও না। সব সময় অভিযোগ করছে যে এর জন্য অন্য কেউ দায়ী।’
নিউইয়র্কে ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম ‘জেটেও’র মেহদি হাসানের সঙ্গে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস -ভিডিও থেকে নেয়া
বুধবার, ০১ অক্টোবর ২০২৫
অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ কত হবে তা কেউ নির্ধারণ করে দেয়নি বলে বলছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলছেন অনেকেই তাকে দীর্ঘসময়ের জন্য চান। তিনি বলেছেন, কেউ তাকে ৫, কেউ ১০ এমনকি কেউ তাকে ৫০ বছরও জন্য চান। নির্বাচনের চেয়ে তাদের কাছে বড় গুরুত্বের বিষয় সুশাসন, এমনটাই বলেছেন ইউনূস।
‘এমন মানুষও আছে, যারা বলছে ৫ বছর থাকুন, ১০ বছর থাকুন, ৫০ বছর থাকুন। সুতরাং মানুষ সব ধরনের কথা বলছে। আপনি থাকুন, নির্বাচন কেন? কার নির্বাচন দরকার?
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্ক সফরের সময় অধিবেশনের ফাঁকে ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম ‘জেটেও’র মেহদি হাসানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে নির্বাচন ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হয়। এর একটা বড় অংশজুড়ে ছিল শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গও।
আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দল নিষিদ্ধ নয়। কার্যক্রম নিষিদ্ধ। তবে নির্বাচনে তারা অংশ নিতে পারবে না।
মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আমাদের কত দিন থাকতে হবে, তা কেউ নির্ধারণ করে দেয়নি।’ নির্বাচন দিতে দেরি হচ্ছে কেন?- জেটেওর মেহদি হাসানের এ প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে একপর্যায়ে এ কথা বলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা।
সাক্ষাৎকারে জুলাই গণঅভ্যুত্থান, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেয়া, শেখ হাসিনাকে ভারতের আশ্রয়, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা, নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন মুহাম্মদ ইউনূস।
‘নেপালে, যেখানে এই বছরে কিছুদিন আগে সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে, সেখানকার অন্তর্বর্তী নেতা মাত্র ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বাংলাদেশের একটি নির্বাচনের জন্য কেন ১৮ মাস লাগছে বা লাগবে?’, মেহদি হাসানের এমন প্রশ্নের ইউনূস বলেন, ‘এমন মানুষও আছে, যারা বলছে ৫ বছর থাকুন, ১০ বছর থাকুন, ৫০ বছর থাকুন। সুতরাং মানুষ সব ধরনের কথা বলছে।’
ইউনূস বলেন, ‘তারা কথা বলে সুশাসন নিয়ে। আমরা একটি দুর্নীতিমুক্ত শাসনব্যবস্থা দেখতে চাই, তাই আপনি থাকুন। কারণ, আমরা নির্বাচনের পর আবার বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়তে চাই না।
‘আমি যা বলতে চাই, তা হলো আপনি একটি বক্তব্য তুলে ধরেছেন, অন্য বক্তব্যও আছে।’
ইউনূস বলেন, ‘আপনি নেপালের উদাহরণ দিয়েছেন। নেপালের সরকার আমাদের পরিভাষায় এক ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। অর্থাৎ আপনার দায়িত্ব একটি নির্বাচন আয়োজন করা। তাই সম্ভবত এটাই তাদের কাজ।’
‘আমরা (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) নই। আমরা অন্তর্বর্তী সরকার। আমাদের কত দিন থাকতে হবে, তা কেউ নির্ধারণ করে দেয়নি।
‘আমরা কত দিন থাকব, সেটা আমাদের সিদ্ধান্ত। তবে আমাদের বোঝাপড়া আছে যে আমাদের তিনটি কাজ রয়েছে। একটি হলো সংস্কার, অন্যটি বিচার ও শেষটি হলো নির্বাচন।
আমরা সংস্কারের অ্যাজেন্ডা নিয়ে কাজ করছি। এটি একটি বড় অ্যাজেন্ডা,’ বলেন ইউনূস।
‘কারণ, আপনি যদি শুধু একটি নির্বাচন করেন, তবে সেই পুরনো জিনিসগুলো আবার ঘটবে। ভিন্ন নামে, ভিন্ন চিত্রে, আরও অনেকভাবে। আমাদের সংস্কার প্রয়োজন। আপনি যদি শুধু নির্বাচন করেন, তবে সবকিছুর একই পুনরাবৃত্তি হবে। কারণ, আইন, নিয়ম, পদ্ধতি একই থেকে যাবে,’ বলেন ইউনূস।
তিনি বলেন, ‘ছাত্রদের নেতৃত্বে জনগণের একটি দাবি ছিল সংস্কার করা। নিশ্চিত করা যেসব শিকড় উপড়ে ফেলা হয়েছে, যাতে আপনার একটি ভিন্ন ধরনের কাঠামো থাকে, যেন এ জিনিসগুলো ফিরে আসতে না পারে। ফ্যাসিবাদ যেসব পথে প্রবেশ করে, সেই পথগুলো বন্ধ করে দেয়া, যাতে তারা আর আসতে না পারে। তাই এটি আমাদের অ্যাজেন্ডা। এটি একটি বড় অ্যাজেন্ডা। তারপর বিচার। সব ঘটনার জন্য দোষী সব ব্যক্তির বিচার, যা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তাই ওই বিচার করার জন্য আমাদের একটি বিশেষ আদালত স্থাপন করতে হবে এবং যে ফলাফল আসে, তা দেখাতে হবে। আদালত ব্যবস্থা থেকে দৃশ্যমান ফলাফল আসতে হবে যে তাদের শাস্তি দেয়া হচ্ছে। তৃতীয়টি হলো নির্বাচন। তাই আমাদের এ তিন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে, শুধু একটি নয়। নেপালে তারা শুধু নির্বাচন করছে।’
আওয়ামী লীগ, হাসিনাকে নিয়ে যা বললেন
ওই সাক্ষাৎকারের একটি বড় অংশজুড়ে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা ও শেখ হাসিনাকে নিয়ে তার ভাবনা ওঠে এসেছে।
ইউনূসের কাছে জানতে চাওয়া হয় হাসিনার সরকারের পতনে তার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া কী ছিল। ইউনূস বলেন, ‘পরিস্থিতি খুবই খারাপ ছিল। তিনি দেশ ছাড়ার আগে কী ঘটেছিল, তার বিস্তারিত আমি তখন জানতাম না। তবে শেষ খবরটা ছিল, তিনি চলে গেছেন। সেটি ছিল রোমাঞ্চকর।’
মেহদি জানতে চান, হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরানোর জন্য বারবার অনুরোধের পরও ভারতের নরেন্দ্র মোদি উপেক্ষা করায় ইউনূস কী করেছেন? ভারত কখনো হাসিনাকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করবে, তা ইউনূস বিশ্বাস করেন কিনা।
জবাবে ইউনূস বলেন, ‘তারা যদি নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সম্ভবত তারা তাকে রেখে দেবে। যদি আইনি বাধ্যবাধকতা থেকে থাকে, যা তারা এড়াতে পারবে না, তখন পরিস্থিতিটা ভিন্ন হবে।’
তাকে রাখার পেছনে ভারতের স্বার্থ কী? এমন প্রশ্নে ইউনূস বলেন, ‘তারা বরাবরই তাকে সমর্থন করে আসছে। যারা তার পেছনে আছেন, তারা সম্ভবত এখনও আশা করছেন যে তিনি পূর্ণ গৌরবের সঙ্গে বাংলাদেশে ফিরে আসবেন, একজন বিজয়ী নেতা হিসেবে।’
মেহদি হাসান জানতে চান, এটা তাকে উদ্বিগ্ন করে কিনা যে ভারত তাকে ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছে এবং আবার ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা করছে?
ইউনূস বলেন, ‘আমি ঠিক এভাবে কথাগুলো বলব না। তবে এ আশঙ্কা রয়েছে যে বাইরের কিছু শক্তি তাকে বাংলাদেশে ফিরে আসতে সহায়তা করবে। আমরা সব সময় এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন।’
মেহদি বলেন, ‘হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ, তাদের নিবন্ধন স্থগিত, কার্যত পরবর্তী নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে তাদের নিষিদ্ধ করেছে। আপনার মতোই নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অমর্ত্য সেন- যিনি আপনাকে খুব ভালো করেই চেনেন, তিনি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। বলেছিলেন, এটা পূর্ববর্তী সরকারের ভুলের পুনরাবৃত্তি হবে, যারা ক্ষমতায় এসে তাদের বিরোধীদের নিষিদ্ধ করেছিল। আপনি কেবল সেই চক্রের পুনরাবৃত্তি করছেন। অমর্ত্য সেন ও অন্যদের এ ধরনের সমালোচনার কী জবাব দেবেন আপনি?’
ইউনূস বলেন, ‘এটা ভুল সমালোচনা। কারণ, আমরা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করিনি। শুধু তাদের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। এর অর্থ হলো- তারা কোনো রাজনৈতিক কর্মকা- করতে পারবে না।’
মেহদি তখন জানতে চান, ‘তবে তারা (আওয়ামী লীগ) কি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে?
উত্তরে ইউনূস বলেন- ‘না, এখন পারবে না। তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ। তারা দল হিসেবে বৈধ, তবে এখন কার্যক্রম স্থগিত। যে কোনো সময় এর কার্যক্রম চালু করা হতে পারে। তবে স্থগিতাদেশ তুলে নেয়া এখনও একটা সম্ভাবনা।’
‘কিন্তু একটি গোষ্ঠীর মানুষকে নির্বাচনে অংশ নেয়া থেকে নিষিদ্ধ করাটা কতটা গণতান্ত্রিক?’ এ প্রশ্নে ইউনূস বলেন, ‘দেখুন, নির্বাচন কমিশন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা এটা করেছে দলটির চরিত্র ও সম্ভাবনা দেখে যে তারা পুরো নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করবে। তাই তারা ভেবেছে, এটা না করাই ভালো...’
তখন মেহদি বলেন, ‘আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না যে বাংলাদেশে তাদের লাখ লাখ সমর্থক আছেন?’
উত্তরে ইউনূস বলেন, ‘আমি লাখ লাখ বলব না। তাদের সমর্থক আছে। কিন্তু কতজন অবশিষ্ট আছে, তা আমি জানি না। কারণ, সমর্থক এমন একটি বিষয় যে আপনি খুব ক্ষমতাধর, আমি সব সময় আপনার সামনে মাথা নত করি, কারণ, আপনি ক্ষমতাধর। আমি একজন সমর্থক হয়ে তা করছি না।
মেহদির প্রশ্ন, ‘আপনি এটা অস্বীকার করতে পারেন না যে বাংলাদেশে তাদের ভোটার আছে।‘ তাতে ইউনূস বলেন, ‘অবশ্যই, এটা দীর্ঘদিনের একটি দল।‘
মেহদি তখন বলেন, ‘কিন্তু এখন সেই ব্যক্তিদের কথা বলার কোনো জায়গা নেই। আপনি তাদের দলকে নিষিদ্ধ করেছেন। আমি বলতে চাচ্ছি, আপনি তাদের দলকে রাজনীতিতে অংশ নিতে বাধা দিয়েছেন।’
ইউনূসের জবাব, ‘তারা ভোটার হিসেবে ভোট দিতে পারেন। তারা বৈধ ভোটার। অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী আছেন। তারা নিজেদেরটা বেছে নেবেন। আওয়ামী লীগের মার্কাটা সেখানে থাকবে না।’
‘এটা কি ভালো হবে? পরিস্থিতিটা থাকা কি বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে, যেখানে মানুষ বলছে, নতুন সরকার পুরনো সরকারের ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে, চক্রটা চলতেই থাকল? মেহেদির এ প্রশ্নে ইউনূস বলেন, ‘অন্যথায় আমরা নির্বাচন করতে পারব না। তারা একটি রাজনৈতিক দলের মতো আচরণ করছে না। তারা যে মানুষ হত্যা করেছে, সেজন্য অনুশোচনা প্রকাশ করেনি। এ সময়ে তারা যা যা করেছে, তার কোনো কিছুরই দায় নেয়নি- একটি বিষয়েরও না। সব সময় অভিযোগ করছে যে এর জন্য অন্য কেউ দায়ী।’