জয়পুরহাটে মাহালী সম্প্রদায়ের একজন নারী বাঁশ দিয়ে বুনছে গার্হস্থ্য পণ্য -সংবাদ
কোনও এক গ্রামীণ উঠোন। মাচায় শুকোচ্ছে চিকন বাঁশের শলা। পাশে বসে আছেন একদল নারী-পুরুষ, হাতে কাস্তে আর ছুরি, চোখেমুখে শ্রমের ছাপ। বাঁশের কুলি থেকে খলই, মাছ ধরার চাঁই, কিংবা কৃষিজ সরঞ্জাম এসবই একসময় তাদের হাতের জাদুতে তৈরি হতো। অথচ এখন সেই হাতগুলো অনেকটা অব্যবহৃত, কারণ বাজারে আর চাহিদা নেই। প্লাস্টিকের দাপটে টিকে থাকতে না পেরে হারিয়ে যাচ্ছে এই বাঁশশিল্প। সংকটে পড়েছে জয়পুরহাটের মাহালী সম্প্রদায়।
গ্রামবাংলার চিরায়ত জীবনে বাঁশ ছিল অনিবার্য উপাদান। সংসারের প্রতিটি কাজে বাঁশের পণ্য ব্যবহার হতো। মাহালীদের সুদক্ষ হাতের কারুকাজে তৈরি মাদুর, ডালি, দোলনা, ঝুড়ি, মাছ ধরার ফাঁদ, এমনকি ফুলদানি ও ছবির ফ্রেম এসবের চাহিদা একসময় ছিল তুঙ্গে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাঁশশিল্প ছিল তাদের একমাত্র জীবিকা। কিন্তু আধুনিকতার ঢেউ আর প্লাস্টিক শিল্পের আগ্রাসনে আজ তা কালের গর্ভে বিলীন।
পাঁচবিবি উপজেলার দমদমা গ্রামের দ্বীনেশ চন্দ্রের পরিবার এখনও মরিয়া হয়ে আঁকড়ে ধরে আছে এই পেশা। তার স্ত্রী পার্বতী রানী বলেন, ‘আমরা পরিবারের সবাই মিলে বাঁশের পণ্য বানাই। স্বামী রাস্তার পাশে দোকানে বিক্রি করে, আর আমরা পাঁচজন মিলে তৈরি করি। কিন্তু এখন আর সেই পরিশ্রমের দাম নেই। প্লাস্টিকের ভিড়ে আমাদের জিনিস বিক্রি হয় না।’
একই অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন জেলার খঞ্জনপুর গ্রামের কারিগর ধীরেন চন্দ্র। তিনি বলেন, ‘একটি বাঁশ কিনতে লাগে ১৬০ থেকে ১৮০ টাকা। সেই বাঁশ দিয়ে দুইদিনে দুটি চাঙ্গারি বানিয়ে বিক্রি হয় মাত্র ৩০০ টাকায়। এই দিয়ে সংসার চালাবো কিভাবে? বাজারে সবকিছুর দাম বাড়ছে, অথচ আমাদের জিনিসের দাম কমছে। আমরা চরম বিপদে আছি।’
জেলার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, একসময় সকাল থেকে রাতভর ব্যস্ত থাকা মাহালী পরিবারগুলো এখন প্রায় অলস সময় কাটাচ্ছে। অনেকেই বলেন, আগের দিনে প্রতি পরিবারে বাঁশশিল্পের কাজ থাকতো অন্তত দু’জন-তিনজনের হাতে। এখন চাহিদা না থাকায় সেই ব্যস্ততা নেই। ফলে অনেকে বাধ্য হয়ে অন্য পেশায় যেতে চাইলেও দক্ষতা না থাকায় টিকে থাকতে পারছেন না।
এই সম্প্রদায়ের অনেকের অভিযোগ, দেশের নানা প্রান্তে উন্নয়নের জোয়ার বইলেও তাদের জীবনে পরিবর্তন আসেনি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন বলেন, ‘দেশে কত সরকার আসে যায়, নেতারা বড়লোক হয়, কিন্তু আমাদের খবর কেউ নেয় না। ভোট এলে আমাদের দরকার হয়, সালাম দেয়। ভোট শেষ হলে আর কেউ মনে রাখে না।’
জয়পুরহাট বিসিক শিল্পনগরীর উপ-ব্যবস্থাপক লিটন চন্দ্র ঘোষ জানান, ‘এলাকার অনেক মানুষ এখনও বাঁশশিল্পের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায় তারা কষ্টে জীবন যাপন করছেন। সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ ও ঋণ সহায়তা দেয়ার সুযোগ আছে। প্রয়োজনে আমরা সহযোগিতা করবো।’
স্থানীয় সচেতন মহল মনে করেন, বাঁশশিল্প কেবল একটি পেশা নয়, এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতীক। তারা বলছেন, এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকারি উদ্যোগ, বাজার সম্প্রসারণ এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের আন্তরিক পৃষ্ঠপোষকতা এখন সময়ের দাবি।
জীবিকার তাগিদে সংগ্রামী মাহালী পরিবারগুলো এখনও আশায় বুক বাঁধে। হয়তো একদিন আবার তাদের নিপুণ হাতে তৈরি বাঁশশিল্প ফিরে আসবে মানুষের ঘরে ঘরে। প্লাস্টিকের ভিড় ঠেলে নতুন করে জায়গা করে নেবে ঐতিহ্যবাহী বাঁশের কুলি, ডালি, মাদুর কিংবা ছবির ফ্রেম। তাদের চোখে সেই আশাই প্রেরণা চিরায়ত ঐতিহ্য বাঁচুক, বাঁশশিল্প টিকে থাকুক, আর মাহালী সম্প্রদায়ের জীবন ভরে উঠুক নতুন সূর্যের আলোয়।
জয়পুরহাটে মাহালী সম্প্রদায়ের একজন নারী বাঁশ দিয়ে বুনছে গার্হস্থ্য পণ্য -সংবাদ
বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫
কোনও এক গ্রামীণ উঠোন। মাচায় শুকোচ্ছে চিকন বাঁশের শলা। পাশে বসে আছেন একদল নারী-পুরুষ, হাতে কাস্তে আর ছুরি, চোখেমুখে শ্রমের ছাপ। বাঁশের কুলি থেকে খলই, মাছ ধরার চাঁই, কিংবা কৃষিজ সরঞ্জাম এসবই একসময় তাদের হাতের জাদুতে তৈরি হতো। অথচ এখন সেই হাতগুলো অনেকটা অব্যবহৃত, কারণ বাজারে আর চাহিদা নেই। প্লাস্টিকের দাপটে টিকে থাকতে না পেরে হারিয়ে যাচ্ছে এই বাঁশশিল্প। সংকটে পড়েছে জয়পুরহাটের মাহালী সম্প্রদায়।
গ্রামবাংলার চিরায়ত জীবনে বাঁশ ছিল অনিবার্য উপাদান। সংসারের প্রতিটি কাজে বাঁশের পণ্য ব্যবহার হতো। মাহালীদের সুদক্ষ হাতের কারুকাজে তৈরি মাদুর, ডালি, দোলনা, ঝুড়ি, মাছ ধরার ফাঁদ, এমনকি ফুলদানি ও ছবির ফ্রেম এসবের চাহিদা একসময় ছিল তুঙ্গে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাঁশশিল্প ছিল তাদের একমাত্র জীবিকা। কিন্তু আধুনিকতার ঢেউ আর প্লাস্টিক শিল্পের আগ্রাসনে আজ তা কালের গর্ভে বিলীন।
পাঁচবিবি উপজেলার দমদমা গ্রামের দ্বীনেশ চন্দ্রের পরিবার এখনও মরিয়া হয়ে আঁকড়ে ধরে আছে এই পেশা। তার স্ত্রী পার্বতী রানী বলেন, ‘আমরা পরিবারের সবাই মিলে বাঁশের পণ্য বানাই। স্বামী রাস্তার পাশে দোকানে বিক্রি করে, আর আমরা পাঁচজন মিলে তৈরি করি। কিন্তু এখন আর সেই পরিশ্রমের দাম নেই। প্লাস্টিকের ভিড়ে আমাদের জিনিস বিক্রি হয় না।’
একই অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন জেলার খঞ্জনপুর গ্রামের কারিগর ধীরেন চন্দ্র। তিনি বলেন, ‘একটি বাঁশ কিনতে লাগে ১৬০ থেকে ১৮০ টাকা। সেই বাঁশ দিয়ে দুইদিনে দুটি চাঙ্গারি বানিয়ে বিক্রি হয় মাত্র ৩০০ টাকায়। এই দিয়ে সংসার চালাবো কিভাবে? বাজারে সবকিছুর দাম বাড়ছে, অথচ আমাদের জিনিসের দাম কমছে। আমরা চরম বিপদে আছি।’
জেলার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, একসময় সকাল থেকে রাতভর ব্যস্ত থাকা মাহালী পরিবারগুলো এখন প্রায় অলস সময় কাটাচ্ছে। অনেকেই বলেন, আগের দিনে প্রতি পরিবারে বাঁশশিল্পের কাজ থাকতো অন্তত দু’জন-তিনজনের হাতে। এখন চাহিদা না থাকায় সেই ব্যস্ততা নেই। ফলে অনেকে বাধ্য হয়ে অন্য পেশায় যেতে চাইলেও দক্ষতা না থাকায় টিকে থাকতে পারছেন না।
এই সম্প্রদায়ের অনেকের অভিযোগ, দেশের নানা প্রান্তে উন্নয়নের জোয়ার বইলেও তাদের জীবনে পরিবর্তন আসেনি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন বলেন, ‘দেশে কত সরকার আসে যায়, নেতারা বড়লোক হয়, কিন্তু আমাদের খবর কেউ নেয় না। ভোট এলে আমাদের দরকার হয়, সালাম দেয়। ভোট শেষ হলে আর কেউ মনে রাখে না।’
জয়পুরহাট বিসিক শিল্পনগরীর উপ-ব্যবস্থাপক লিটন চন্দ্র ঘোষ জানান, ‘এলাকার অনেক মানুষ এখনও বাঁশশিল্পের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায় তারা কষ্টে জীবন যাপন করছেন। সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ ও ঋণ সহায়তা দেয়ার সুযোগ আছে। প্রয়োজনে আমরা সহযোগিতা করবো।’
স্থানীয় সচেতন মহল মনে করেন, বাঁশশিল্প কেবল একটি পেশা নয়, এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতীক। তারা বলছেন, এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকারি উদ্যোগ, বাজার সম্প্রসারণ এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের আন্তরিক পৃষ্ঠপোষকতা এখন সময়ের দাবি।
জীবিকার তাগিদে সংগ্রামী মাহালী পরিবারগুলো এখনও আশায় বুক বাঁধে। হয়তো একদিন আবার তাদের নিপুণ হাতে তৈরি বাঁশশিল্প ফিরে আসবে মানুষের ঘরে ঘরে। প্লাস্টিকের ভিড় ঠেলে নতুন করে জায়গা করে নেবে ঐতিহ্যবাহী বাঁশের কুলি, ডালি, মাদুর কিংবা ছবির ফ্রেম। তাদের চোখে সেই আশাই প্রেরণা চিরায়ত ঐতিহ্য বাঁচুক, বাঁশশিল্প টিকে থাকুক, আর মাহালী সম্প্রদায়ের জীবন ভরে উঠুক নতুন সূর্যের আলোয়।