শুক্রবার জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই সনদ সইয়ের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কমিশনের পক্ষ থেকে ৩২টি রাজনৈতিক দল ও একটি জোটের কাছে চূড়ান্ত জুলাই জাতীয় সনদের কপি পাঠানো হয়েছে।
এদিকে জুলাই সনদ সইয়ের বিষয় নিয়ে বুধবার,(১৫ অক্টোবর ২০২৫) দিনভর প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের বৈঠক করেছে ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা।
গত কিছুদিনের একাধিক বৈঠকে জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একাধিক বৈঠক হলেও জুলাই সনদ সম্পর্কে একমত হতে পারেনি দলগুলো।
প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক
বুধবার দুপুরে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস জুলাই সনদ সইয়ের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
মতভিন্নতা মিটিয়ে জুলাই জাতীয় সনদ সই নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটাতে রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেছেন ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার পর রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এ বৈঠক শুরু হয়। কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, সফর রাজ হোসেন, ইফতেখারুজ্জামান, বদিউল আলম মজুমদার, মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারও বৈঠকে উপস্থিত আছেন।
রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক সচিব ইসমাইল জবিউল্লাহ, জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মতিউর রহমান আকন্দ, জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন, বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ, বাসদ মার্কসবাদীর সমন্বয়ক মাসুদ রানা, ১২ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জুসহ ৩১টি দল ও জোটের নেতারা বৈঠকে উপস্থিত আছেন।
বৈঠকে বক্তৃতায় আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন হবেই বলে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন হবেই। এটা এই যে ঐকমত্য কমিশনের যে সনদ, এটা সনদেরই অংশ এখন। এটার সঙ্গে এটা জড়িত। এই যে ঘোষণা আমরা করলাম এটা আমাদের রক্ষা করতে হবে। এটা এমন না যে কথার কথা বলে ফেলেছি। ওই রকম না। এটা ফেব্রুয়ারিতে হবে এবং ওই যে বারবার বলেছি, এটা উৎসবমুখর নির্বাচন হবে।’
রাজনৈতিক দলের নেতাদের উদ্দেশে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আপনারা যেমন সবাই মিলে সনদ তৈরি করেছেন। আমাদের সরকারের দায়িত্ব হলো সবাই মিলে উৎসবমুখর নির্বাচনটা করে দেয়া। তাহলেই আমাদের কাজ পরিণত হলো।’
রাজনৈতিক দল ও ঐকমত্য কমিশনকে একান্তভাবে ধন্যবাদ দেয়ার জন্য তিনি এই বৈঠকে যোগ দিয়েছেন বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে, কঠিন কঠিন বিষয়ে আলোচনা করা এবং সন্তোষজনকভাবে রাজনৈতিক দল ও ঐকমত্য কমিশন মিলে এর সমাপ্তি আনায় তিনি ব্যক্তিগতভাবে তাদের ধন্যবাদ জানান। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘যে অসম্ভবকে আপনারা সম্ভব করেছেন এটা শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, পৃথিবীর পলিটিক্যাল সিস্টেমের (রাজনৈতিক ব্যবস্থার) ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে।’
জুলাই সনদ রচনাকে ছাত্র জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী অধ্যায় হিসেবে উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘ছাত্র-জনতার যে অভ্যুত্থান, এই অভ্যুত্থানের এটাই আমার মনে হয় পরবর্তী অধ্যায় সঠিকভাবে রচিত হলো। যে সংস্কারের কথা আমরা মুখে বলে যাচ্ছিলাম, আপনারা সেই সংস্কার, প্রকৃতপক্ষে যে সংস্কার হবে তা করে দেখিয়ে দিয়েছেন। কাজেই আমরা এই জুলাই সনদ সই অনুষ্ঠানে সারা জাতি বড় রকমের উৎসবের মধ্যে আমরা শরিক হবে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যে কলম দিয়ে সই করা হবে সেগুলো জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হবে। মানুষ তাদের ভুলতে পারবে না। এটা এমন একটা ঘটনা যে ঘটনার ভেতরে থেকে এর বিশালত্ব বোঝা যাচ্ছে না। মাসের পর মাস বৈঠক করে হতাশা এসেছে, মনে হয়েছে এটা হয়তো অসমাপ্ত থেকে যাবে। তবে এটা অসমাপ্ত থেকে যায়নি। তিনি বলেন, ‘জুলাই সনদ জাতির জন্য একটা মস্ত বড় সম্পদ হয়ে রইলো।’
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, যে দলিলগুলো তৈরি করা হয়েছে সেগুলো হারিয়ে যাবে না। এগুলো জনসাধারণের মধ্যে সহজ ভাষায় প্রচার করা হবে। যাতে করে সবার মনের মধ্যে থাকে কেন একমত হয়েছি। সরকার হিসেবে জুলাই সনদ ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব তাদের।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, যে বিতর্কগুলো হয়েছে সেগুলোকে বিষয়ভিত্তিকভাবে ভিডিও করে ও বই করে রাখা হবে। যেন এগুলো সম্পদ হিসেবে থাকে, হারিয়ে না যায়। যাতে করে সবাই জানতে পারে কেমন জাতি গড়ার জন্য এগুলো করা হয়েছে।
সনদ এবং নির্বাচন বিচ্ছিন্ন কোনো জিনিস নয় উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, উত্তরণটা কীভাবে হবে এটা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। সেটার উত্তরও জুলাই সনদে দেয়া আছে। এ উত্তর নিয়ে যেন সন্তোষভাবে উত্তরণটা করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেভাবে রূপান্তরটি হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিপূর্ণ প্রচেষ্টা হবে আপনারা যত কষ্ট করে এগুলো রচনা করছেনৃ সেটা যেন আমরা বাস্তবে রূপান্তর করতে পারি। নির্বাচনের মাধ্যমে এবং আমাদের দৈনন্দিন রাজনৈতিক মাধ্যমে যেন আমরা সেটাকে রূপান্তর করতে পারি। এই হলো আমাদের আশা। আগামী শুক্রবারে (আগামীকাল) আমরা সেই আশাকে সারা জাতির সামনে নিয়ে আসবে।’
১৭ অক্টোবর (আগামীকাল) জুলাই সনদ সই অনুষ্ঠান নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা উৎসবমুখরভাবে সেখানে যাবে এবং এই দলিলে সই করবো এবং উৎসব করবো। সবাই, সারা জাতি এটায় শরিক হবে। আপনারা তাদের সামনের সারির মানুষ যারা প্রকৃত সই করছেন। সারাদেশের মানুষ চিন্তার মধ্যে, তাদের ভাবনার মধ্যে আপনাদের সঙ্গে সই করছে। জাতির জন্য এটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’
‘আনন্দঘন’ পরিবেশে সইয়ের আশা আলী রীয়াজের
বুধবার সন্ধ্যায় রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে ‘জরুরি’ বৈঠকের স্বাগত বক্তব্যে ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘একদিন পর শুক্রবার (আগামীকাল) জাতীয় সংসদের প্লাজায় দাঁড়িয়ে আমরা আশা করছি জাতীয় সনদ যে প্রক্রিয়ার মধ্যে আপনারা অংশগ্রহণ করেছেন এবং বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে আপনারা যে জায়গায় উপনীত হয়েছেন, তারই অংশ হিসেবে জাতীয় সনদে আমরা সই করতে পারবো। এটাই আমরা আশা করছি।
তিনি বলেন, ‘তারই প্রস্তুতির দিকগুলো সম্পূর্ণরূপে শেষ করার আমরা চেষ্টা করছি। এই সনদ সইয়ের ক্ষেত্রে অনুষ্ঠানের জন্য আরও একটু সময় নেয়ার থেকে দ্রুততার দিকে যাওয়ার আমরা চেষ্টা করেছি। এবং আমাদের দিক থেকে পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে আপনাদের প্রত্যেককে জানান হয়েছিল এবং প্রত্যেকটি দল থেকে জাতীয় সনদে স্বাক্ষরকারীদের নাম বেশ কিছুদিন আগেই দিয়েছেন।’
সেজন্য ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এ অনুষ্ঠানে আমরা চাই জাতীয় নেতারা ছাড়াও যারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে যুক্ত সে সমস্ত অতিথিরা উপস্থিত থাকুন।’
সে বিবেচনা থেকে দলগুলোর কাছে অতিথিদের তালিকা চাওয়ার কথাও তুলে ধরেন কমিশনের সহ-সভাপতি। তিনি বলেন, এ অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র বৃহস্পতিবার (বুধবার) থেকে পাঠানো হবে। সই অনুষ্ঠানে স্বল্প সময়ে যেন সব দলের প্রতিনিধি সই করতে পারেন, সে ব্যবস্থাও রাখা হবে।
এখনও দ্বিমত রয়েছে
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের পূর্ণ ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় সংস্কারের ১৭টি বিষয়ে ৮৪ দফার জুলাই জাতীয় সনদ চূড়ান্ত করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বাকি ৬৭টি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কেউ কেউ বিরোধিতা করেছে, দিয়েছে নোট অব ডিসেন্ট।
জুলাই সনদে রাষ্ট্রীয় সংস্কারের যে ৮৪ দফা, তার মধ্যে ৪৭টি বিষয়কে ‘সংবিধান সংশোধন সাপেক্ষে সংস্কার’ এবং বাকি ৩৭টি বিষয়কে ‘আইন/অধ্যাদেশ, বিধি ও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে সংস্কার’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে ঐকমত্য কমিশন।
জুলাই সনদের পটভূমি ব্যাখ্যা করে সংস্কারযজ্ঞ নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম তুলে ধরার পর সংস্কারের ৮৪ দফা তুলে ধরা হয়েছে ৪০ পৃষ্ঠার সনদে। এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর কী অঙ্গীকার করছে, তা উল্লেখ করার পর রাখা হয়েছে সইয়ের জায়গা।
তবে সনদের কিছু বিষয় এবং বাস্তবায়নের বিষয় নিয়ে এখনো ঐকমত্য হয়নি।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী) বলেছে, জুলাই সনদে জাতি গঠনের ইতিহাস ‘ভুলভাবে’ উপস্থাপিত হয়েছে। দলটির সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেছেন, সংবিধানের চার মূলনীতি ঠিক না রাখলে সনদে সই করা ‘সম্ভব হবে না’।
এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রশ্ন সনদের অঙ্গীকারনামা নিয়ে। বিভিন্ন দল সনদের অনেক পয়েন্টে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে। কিন্তু এই অঙ্গীকারনামার প্রথম পয়েন্টে বলা হয়েছে, ‘...এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবো’। স্বাভাবিকভাবে বিভিন্ন বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেয়া বেশিরভাগ দলের পক্ষেই এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করা সম্ভব নয়।
‘একইভাবে দ্বিতীয় পয়েন্টে’...পূর্ণাঙ্গভাবে সংবিধানে তফসিল হিসেবে অথবা যথোপযুক্তভাবে সংযুক্ত করবো’ এই কথার উল্লেখ আছে। সনদকে সংবিধানে যুক্ত করার ক্ষেত্রে আমাদের কোনো আপত্তি নাই।
“তবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন দলের ভিন্ন ভিন্ন মতসহ লিখিত একটা দলিল কীভাবে সংবিধানে যুক্ত হতে পারে- সে ব্যাপারে আমরা স্পষ্ট হতে পারছি না।”
মাসুদ রানা বলেন, ‘সনদে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আমরা জুলাই সনদ ২০২৫-এর বৈধতা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করবো না...’ । কোনো দল যদি দেখে, যে বিষয়গুলোতে তারা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছিল, সেগুলোই অনুমোদিত ও কার্যকর হতে যাচ্ছে, তবে তার পক্ষে আদালতের শরণাপন্ন হওয়া স্বাভাবিক ও যৌক্তিক। জুলাই সনদের মতো একটা গণতান্ত্রিক সনদে এই ধরনের অঙ্গীকার থাকাটা অনভিপ্রেত।’
চার মূলনীতি নিয়ে বিবৃতিতে দলটি বলছে, ‘সংবিধানের মূলনীতির আলোচনাটি এই উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত নয়। আদর্শিক-রাজনৈতিক বিষয়গুলোকে আলোচনার বাইরে রাখা উচিত। কারণ এ ব্যাপারে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য সম্ভব নয়। তাই এই অংশে আলোচনার সময়ে আমরাসহ চারটি দল ওয়াক আউট করেছিলাম। এর বাইরেও দুটি দল ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে। আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম এই বিষয়টি বাদ দিয়ে সনদ রচিত হবে। কিন্তু চূড়ান্ত খসড়ায় সেটার প্রতিফলন আমরা দেখলাম না। আমাদের জাতি গঠনের ইতিহাসটাও সনদে ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
‘আমরা দীর্ঘদিন আলোচনা করেছি এই বিষয়গুলো নিয়ে। এর একটা সুন্দর পরিণতি আমরা সবাই চাই। আমরা আবারও কমিশনকে অনুরোধ করবো সার্বিক দিক বিবেচনা করে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য। সেটা না হলে এই সনদে স্বাক্ষর করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।’
সনদের চূড়ান্ত খসড়া নিয়ে আপত্তি রয়েছে বাম ঘারানার অন্য দলগুলোরও। সিপিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেছেন, ‘এখানে যা দেখলাম, তাতে ভূমিকায় এর আগেও আমরা বলেছিলাম, এটাতে ইতিহাস যথাযতভাবে তুলে ধরা হয়নি।’
‘এই সনদে সংবিধানের চার মূল নীতিকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যার বিরোধিতা আমরা শুরু থেকে করে আসছি। আমরা তখনও বলেছি, চার মূলনীতির প্রশ্নে আমরা কোনো ছাড় দেব না। কিন্তু এই সনদে আমরা দেখলাম, তারা চার মূলনীতি ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছে, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।’
পাশাপাশি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে যে অঙ্গীকার সনদে রাখা হয়েছে, তাতে ভিন্নমত রয়েছে সিপিবির।
প্রিন্স বলেন, ‘বাস্তবায়ন পদ্ধতিতে আমরা যা দিয়েছিলাম, তা চোখে পড়ে নাই। সুতরাং এই ধরনের স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যাওয়া যাবে কিনা সেটা দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনা করে দেখবো। তবে এই ধারা অব্যাহত থাকলে আমাদের পক্ষে এই সনদের পক্ষে কথা বলার মত পরিবেশ নেই।’
সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে কমিশনের আলাদা সুপারিশ দেয়ার কথা। তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
সনদ বাস্তবায়নে গণভোট করার বিষয়ে দলগুলো একমত হলেও পদ্ধতি আর ভোটের সময় নিয়ে মতভিন্নতা আছে।
জামায়াতে ইসলামী ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের আগে আগামী নভেম্বরেই গণভোট চায়। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে তারা আন্দোলনও করছে।
অন্যদিকে পিআর পদ্ধতি নিয়ে বিএনপির আপত্তি প্রবল। দলটি বলছে, জাতীয় নির্বাচন আর গণভোট এক দিনে হলে তবেই তারা রাজি।
সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ‘সংবিধান আদেশ’ জারির মাধ্যমে সংস্কার বাস্তবায়নের পক্ষে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। তা না হলে তারা সনদে সই করবে না বলে জানিয়েছে।
বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫
শুক্রবার জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই সনদ সইয়ের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কমিশনের পক্ষ থেকে ৩২টি রাজনৈতিক দল ও একটি জোটের কাছে চূড়ান্ত জুলাই জাতীয় সনদের কপি পাঠানো হয়েছে।
এদিকে জুলাই সনদ সইয়ের বিষয় নিয়ে বুধবার,(১৫ অক্টোবর ২০২৫) দিনভর প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের বৈঠক করেছে ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা।
গত কিছুদিনের একাধিক বৈঠকে জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একাধিক বৈঠক হলেও জুলাই সনদ সম্পর্কে একমত হতে পারেনি দলগুলো।
প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক
বুধবার দুপুরে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস জুলাই সনদ সইয়ের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
মতভিন্নতা মিটিয়ে জুলাই জাতীয় সনদ সই নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটাতে রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেছেন ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার পর রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এ বৈঠক শুরু হয়। কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, সফর রাজ হোসেন, ইফতেখারুজ্জামান, বদিউল আলম মজুমদার, মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারও বৈঠকে উপস্থিত আছেন।
রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক সচিব ইসমাইল জবিউল্লাহ, জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মতিউর রহমান আকন্দ, জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন, বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ, বাসদ মার্কসবাদীর সমন্বয়ক মাসুদ রানা, ১২ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জুসহ ৩১টি দল ও জোটের নেতারা বৈঠকে উপস্থিত আছেন।
বৈঠকে বক্তৃতায় আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন হবেই বলে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন হবেই। এটা এই যে ঐকমত্য কমিশনের যে সনদ, এটা সনদেরই অংশ এখন। এটার সঙ্গে এটা জড়িত। এই যে ঘোষণা আমরা করলাম এটা আমাদের রক্ষা করতে হবে। এটা এমন না যে কথার কথা বলে ফেলেছি। ওই রকম না। এটা ফেব্রুয়ারিতে হবে এবং ওই যে বারবার বলেছি, এটা উৎসবমুখর নির্বাচন হবে।’
রাজনৈতিক দলের নেতাদের উদ্দেশে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আপনারা যেমন সবাই মিলে সনদ তৈরি করেছেন। আমাদের সরকারের দায়িত্ব হলো সবাই মিলে উৎসবমুখর নির্বাচনটা করে দেয়া। তাহলেই আমাদের কাজ পরিণত হলো।’
রাজনৈতিক দল ও ঐকমত্য কমিশনকে একান্তভাবে ধন্যবাদ দেয়ার জন্য তিনি এই বৈঠকে যোগ দিয়েছেন বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে, কঠিন কঠিন বিষয়ে আলোচনা করা এবং সন্তোষজনকভাবে রাজনৈতিক দল ও ঐকমত্য কমিশন মিলে এর সমাপ্তি আনায় তিনি ব্যক্তিগতভাবে তাদের ধন্যবাদ জানান। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘যে অসম্ভবকে আপনারা সম্ভব করেছেন এটা শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, পৃথিবীর পলিটিক্যাল সিস্টেমের (রাজনৈতিক ব্যবস্থার) ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে।’
জুলাই সনদ রচনাকে ছাত্র জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী অধ্যায় হিসেবে উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘ছাত্র-জনতার যে অভ্যুত্থান, এই অভ্যুত্থানের এটাই আমার মনে হয় পরবর্তী অধ্যায় সঠিকভাবে রচিত হলো। যে সংস্কারের কথা আমরা মুখে বলে যাচ্ছিলাম, আপনারা সেই সংস্কার, প্রকৃতপক্ষে যে সংস্কার হবে তা করে দেখিয়ে দিয়েছেন। কাজেই আমরা এই জুলাই সনদ সই অনুষ্ঠানে সারা জাতি বড় রকমের উৎসবের মধ্যে আমরা শরিক হবে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যে কলম দিয়ে সই করা হবে সেগুলো জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হবে। মানুষ তাদের ভুলতে পারবে না। এটা এমন একটা ঘটনা যে ঘটনার ভেতরে থেকে এর বিশালত্ব বোঝা যাচ্ছে না। মাসের পর মাস বৈঠক করে হতাশা এসেছে, মনে হয়েছে এটা হয়তো অসমাপ্ত থেকে যাবে। তবে এটা অসমাপ্ত থেকে যায়নি। তিনি বলেন, ‘জুলাই সনদ জাতির জন্য একটা মস্ত বড় সম্পদ হয়ে রইলো।’
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, যে দলিলগুলো তৈরি করা হয়েছে সেগুলো হারিয়ে যাবে না। এগুলো জনসাধারণের মধ্যে সহজ ভাষায় প্রচার করা হবে। যাতে করে সবার মনের মধ্যে থাকে কেন একমত হয়েছি। সরকার হিসেবে জুলাই সনদ ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব তাদের।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, যে বিতর্কগুলো হয়েছে সেগুলোকে বিষয়ভিত্তিকভাবে ভিডিও করে ও বই করে রাখা হবে। যেন এগুলো সম্পদ হিসেবে থাকে, হারিয়ে না যায়। যাতে করে সবাই জানতে পারে কেমন জাতি গড়ার জন্য এগুলো করা হয়েছে।
সনদ এবং নির্বাচন বিচ্ছিন্ন কোনো জিনিস নয় উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, উত্তরণটা কীভাবে হবে এটা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। সেটার উত্তরও জুলাই সনদে দেয়া আছে। এ উত্তর নিয়ে যেন সন্তোষভাবে উত্তরণটা করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেভাবে রূপান্তরটি হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিপূর্ণ প্রচেষ্টা হবে আপনারা যত কষ্ট করে এগুলো রচনা করছেনৃ সেটা যেন আমরা বাস্তবে রূপান্তর করতে পারি। নির্বাচনের মাধ্যমে এবং আমাদের দৈনন্দিন রাজনৈতিক মাধ্যমে যেন আমরা সেটাকে রূপান্তর করতে পারি। এই হলো আমাদের আশা। আগামী শুক্রবারে (আগামীকাল) আমরা সেই আশাকে সারা জাতির সামনে নিয়ে আসবে।’
১৭ অক্টোবর (আগামীকাল) জুলাই সনদ সই অনুষ্ঠান নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা উৎসবমুখরভাবে সেখানে যাবে এবং এই দলিলে সই করবো এবং উৎসব করবো। সবাই, সারা জাতি এটায় শরিক হবে। আপনারা তাদের সামনের সারির মানুষ যারা প্রকৃত সই করছেন। সারাদেশের মানুষ চিন্তার মধ্যে, তাদের ভাবনার মধ্যে আপনাদের সঙ্গে সই করছে। জাতির জন্য এটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’
‘আনন্দঘন’ পরিবেশে সইয়ের আশা আলী রীয়াজের
বুধবার সন্ধ্যায় রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে ‘জরুরি’ বৈঠকের স্বাগত বক্তব্যে ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘একদিন পর শুক্রবার (আগামীকাল) জাতীয় সংসদের প্লাজায় দাঁড়িয়ে আমরা আশা করছি জাতীয় সনদ যে প্রক্রিয়ার মধ্যে আপনারা অংশগ্রহণ করেছেন এবং বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে আপনারা যে জায়গায় উপনীত হয়েছেন, তারই অংশ হিসেবে জাতীয় সনদে আমরা সই করতে পারবো। এটাই আমরা আশা করছি।
তিনি বলেন, ‘তারই প্রস্তুতির দিকগুলো সম্পূর্ণরূপে শেষ করার আমরা চেষ্টা করছি। এই সনদ সইয়ের ক্ষেত্রে অনুষ্ঠানের জন্য আরও একটু সময় নেয়ার থেকে দ্রুততার দিকে যাওয়ার আমরা চেষ্টা করেছি। এবং আমাদের দিক থেকে পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে আপনাদের প্রত্যেককে জানান হয়েছিল এবং প্রত্যেকটি দল থেকে জাতীয় সনদে স্বাক্ষরকারীদের নাম বেশ কিছুদিন আগেই দিয়েছেন।’
সেজন্য ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এ অনুষ্ঠানে আমরা চাই জাতীয় নেতারা ছাড়াও যারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে যুক্ত সে সমস্ত অতিথিরা উপস্থিত থাকুন।’
সে বিবেচনা থেকে দলগুলোর কাছে অতিথিদের তালিকা চাওয়ার কথাও তুলে ধরেন কমিশনের সহ-সভাপতি। তিনি বলেন, এ অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র বৃহস্পতিবার (বুধবার) থেকে পাঠানো হবে। সই অনুষ্ঠানে স্বল্প সময়ে যেন সব দলের প্রতিনিধি সই করতে পারেন, সে ব্যবস্থাও রাখা হবে।
এখনও দ্বিমত রয়েছে
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের পূর্ণ ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় সংস্কারের ১৭টি বিষয়ে ৮৪ দফার জুলাই জাতীয় সনদ চূড়ান্ত করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বাকি ৬৭টি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কেউ কেউ বিরোধিতা করেছে, দিয়েছে নোট অব ডিসেন্ট।
জুলাই সনদে রাষ্ট্রীয় সংস্কারের যে ৮৪ দফা, তার মধ্যে ৪৭টি বিষয়কে ‘সংবিধান সংশোধন সাপেক্ষে সংস্কার’ এবং বাকি ৩৭টি বিষয়কে ‘আইন/অধ্যাদেশ, বিধি ও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে সংস্কার’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে ঐকমত্য কমিশন।
জুলাই সনদের পটভূমি ব্যাখ্যা করে সংস্কারযজ্ঞ নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম তুলে ধরার পর সংস্কারের ৮৪ দফা তুলে ধরা হয়েছে ৪০ পৃষ্ঠার সনদে। এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর কী অঙ্গীকার করছে, তা উল্লেখ করার পর রাখা হয়েছে সইয়ের জায়গা।
তবে সনদের কিছু বিষয় এবং বাস্তবায়নের বিষয় নিয়ে এখনো ঐকমত্য হয়নি।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী) বলেছে, জুলাই সনদে জাতি গঠনের ইতিহাস ‘ভুলভাবে’ উপস্থাপিত হয়েছে। দলটির সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেছেন, সংবিধানের চার মূলনীতি ঠিক না রাখলে সনদে সই করা ‘সম্ভব হবে না’।
এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রশ্ন সনদের অঙ্গীকারনামা নিয়ে। বিভিন্ন দল সনদের অনেক পয়েন্টে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে। কিন্তু এই অঙ্গীকারনামার প্রথম পয়েন্টে বলা হয়েছে, ‘...এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবো’। স্বাভাবিকভাবে বিভিন্ন বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেয়া বেশিরভাগ দলের পক্ষেই এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করা সম্ভব নয়।
‘একইভাবে দ্বিতীয় পয়েন্টে’...পূর্ণাঙ্গভাবে সংবিধানে তফসিল হিসেবে অথবা যথোপযুক্তভাবে সংযুক্ত করবো’ এই কথার উল্লেখ আছে। সনদকে সংবিধানে যুক্ত করার ক্ষেত্রে আমাদের কোনো আপত্তি নাই।
“তবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন দলের ভিন্ন ভিন্ন মতসহ লিখিত একটা দলিল কীভাবে সংবিধানে যুক্ত হতে পারে- সে ব্যাপারে আমরা স্পষ্ট হতে পারছি না।”
মাসুদ রানা বলেন, ‘সনদে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আমরা জুলাই সনদ ২০২৫-এর বৈধতা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করবো না...’ । কোনো দল যদি দেখে, যে বিষয়গুলোতে তারা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছিল, সেগুলোই অনুমোদিত ও কার্যকর হতে যাচ্ছে, তবে তার পক্ষে আদালতের শরণাপন্ন হওয়া স্বাভাবিক ও যৌক্তিক। জুলাই সনদের মতো একটা গণতান্ত্রিক সনদে এই ধরনের অঙ্গীকার থাকাটা অনভিপ্রেত।’
চার মূলনীতি নিয়ে বিবৃতিতে দলটি বলছে, ‘সংবিধানের মূলনীতির আলোচনাটি এই উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত নয়। আদর্শিক-রাজনৈতিক বিষয়গুলোকে আলোচনার বাইরে রাখা উচিত। কারণ এ ব্যাপারে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য সম্ভব নয়। তাই এই অংশে আলোচনার সময়ে আমরাসহ চারটি দল ওয়াক আউট করেছিলাম। এর বাইরেও দুটি দল ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে। আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম এই বিষয়টি বাদ দিয়ে সনদ রচিত হবে। কিন্তু চূড়ান্ত খসড়ায় সেটার প্রতিফলন আমরা দেখলাম না। আমাদের জাতি গঠনের ইতিহাসটাও সনদে ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
‘আমরা দীর্ঘদিন আলোচনা করেছি এই বিষয়গুলো নিয়ে। এর একটা সুন্দর পরিণতি আমরা সবাই চাই। আমরা আবারও কমিশনকে অনুরোধ করবো সার্বিক দিক বিবেচনা করে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য। সেটা না হলে এই সনদে স্বাক্ষর করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।’
সনদের চূড়ান্ত খসড়া নিয়ে আপত্তি রয়েছে বাম ঘারানার অন্য দলগুলোরও। সিপিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেছেন, ‘এখানে যা দেখলাম, তাতে ভূমিকায় এর আগেও আমরা বলেছিলাম, এটাতে ইতিহাস যথাযতভাবে তুলে ধরা হয়নি।’
‘এই সনদে সংবিধানের চার মূল নীতিকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যার বিরোধিতা আমরা শুরু থেকে করে আসছি। আমরা তখনও বলেছি, চার মূলনীতির প্রশ্নে আমরা কোনো ছাড় দেব না। কিন্তু এই সনদে আমরা দেখলাম, তারা চার মূলনীতি ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছে, যা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।’
পাশাপাশি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে যে অঙ্গীকার সনদে রাখা হয়েছে, তাতে ভিন্নমত রয়েছে সিপিবির।
প্রিন্স বলেন, ‘বাস্তবায়ন পদ্ধতিতে আমরা যা দিয়েছিলাম, তা চোখে পড়ে নাই। সুতরাং এই ধরনের স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যাওয়া যাবে কিনা সেটা দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনা করে দেখবো। তবে এই ধারা অব্যাহত থাকলে আমাদের পক্ষে এই সনদের পক্ষে কথা বলার মত পরিবেশ নেই।’
সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে কমিশনের আলাদা সুপারিশ দেয়ার কথা। তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
সনদ বাস্তবায়নে গণভোট করার বিষয়ে দলগুলো একমত হলেও পদ্ধতি আর ভোটের সময় নিয়ে মতভিন্নতা আছে।
জামায়াতে ইসলামী ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের আগে আগামী নভেম্বরেই গণভোট চায়। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে তারা আন্দোলনও করছে।
অন্যদিকে পিআর পদ্ধতি নিয়ে বিএনপির আপত্তি প্রবল। দলটি বলছে, জাতীয় নির্বাচন আর গণভোট এক দিনে হলে তবেই তারা রাজি।
সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ‘সংবিধান আদেশ’ জারির মাধ্যমে সংস্কার বাস্তবায়নের পক্ষে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। তা না হলে তারা সনদে সই করবে না বলে জানিয়েছে।