জুলাই অভ্যুত্থান: ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’
এক মাসের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে আত্মসমর্পণ করে আপিল করা যাবে
চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থান দমানোর চেষ্টায় ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ সংঘটনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। শেখ হাসিনার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালেরও একই সাজা হয়েছে। ওই অভ্যুত্থানের সময় পুলিশপ্রধানের দায়িত্বে থাকা চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী (অ্যাপ্রুভার) হওয়ায় তাকে দেয়া হয়েছে ৫ বছরের কারাদণ্ড।
শেখ হাসিনা এবং আসাদুজ্জামান খান কামালের বাংলাদেশে থাকা সব সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে জব্দের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। জুলাই আন্দোলনে নিহতদের পরিবার এবং আহতদের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে সরকারের প্রতি নির্দেশও এসেছে রায়ে।
বাংলাদেশের রেওয়াজ অনুযায়ী, বেসামরিক আদালতের রায়ে আসামিকে আমৃত্যু ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা আপিল করারও সুযোগ পাবেন। তবে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল পলাতক থাকায় আপিল করতে চাইলে তাদের ট্রাইব্যুনাল আত্মসমর্পণ করে এক মাসের মধ্যে আপিল করতে হবে।
টানা ৪৪ বছর ধরে দেশের প্রাচীন রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগের (বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ) সভাপতির দায়িত্বে আছেন আটাত্তর পেরোনো শেখ হাসিনা। টানা দেড় দশক দেশের সরকরারপ্রধানের দায়িত্ব সামলানোর এক পর্যায়ে শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছর ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হন তিনি। ওইদিনই তিনি দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান; এখন পর্যন্ত সেখানেই আছেন।
শেখ হাসিনাই দেশের প্রথম সরকারপ্রধান যিনি সাবেক (ক্ষমতাচ্যুত) হওয়ার পর আদালতের রায়ে সর্বোচ্চ (মৃত্যুদণ্ড) সাজাপ্রাপ্ত হলেন। তার মৃত্যুদণ্ডের এই রায় এলো তার বিয়ে বার্ষিকীর দিনে। ১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর পরমাণু বিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল।
শেখ হাসিনার শাসনামলেই এই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য। এ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডের রায়ের ভিত্তিতেই আওয়ামী লীগের আমলে জামায়াতে ইসলামীর পাঁচ শীর্ষ নেতা এবং বিএনপির একজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ শেখ হাসিনার মামলার রায় ঘোষণা করে। এ রায়ে মোট ছয়টি অংশ ছিল।
সোমবার,(১৭ নভেম্বর ২০২৫) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়; শেষ হয় বিকেল ৩টার কিছুক্ষণ আগে।
৪৫৩ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশ দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে একাধিক্রমে পড়েন তিন বিচারক। রায়ের সময় শেখ হাসিনাসহ আসামিদের অপরাধের প্রমাণ হিসেবে আমলে নেয়া ফোনালাপের রেকর্ড শোনানো হয়, জুলাই সহিংসতা নিয়ে জাতিসংঘ প্রতিবেদনও উপস্থাপন করা হয়।
ট্রাইব্যুনালের দ্বিতীয় সদস্য বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী এবং প্রথম সদস্য বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ রায়ের দুটি অংশ পড়ে শোনান। সর্বশেষে আসামিদের সাজার বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদার।
রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশনে আদালতের কার্যক্রম সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
রায় ঘোষণার সময় জনাকীর্ণ আদালতে আইনজীবীরা ছাড়াও ‘শহীদ’ মীর মুগ্ধর ভাই মীর স্নিগ্ধসহ চব্বিশের জুলাই-আগস্টে নিহতদের কয়েকজনের পরিবারের সদস্যরা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি সাদিক কায়েম ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ফরহাদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন। ট্রাইব্যুনাল কক্ষে এদের পাশেই বসেছেন ছাত্রদলসমর্থিত সাবেক ডাকসু ভিপি প্রার্থী আবিদ ও জিএস প্রার্থী শেখ তানভীর বারী হামীম। উপস্থিত ছিলেন ইনকিলাব মঞ্চের আহবায়ক শরীফ ওসমান হাদী।
সংবাদ সংগ্রহের জন্য ট্রাইব্যুনাল কক্ষে ছিলেন দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের সাংবাদিক।
মামলার আসামিদের মধ্যে শেখ হাসিনার মতো আসাদুজ্জামান খান কামালরও কামালও ভারতে পালিয়ে আছেন। গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন শুধু পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। রায়ের জন্য এদিন সকালে আবদুল্লাহ আল-মামুনকে আদালতে হাজির করা হয়। রায় শেষে তাকে আবার ফিরিয়ে নেয়া হয় কারাগারে।
আসামিদের বিরুদ্ধে ৫ অভিযোগ
শেখ হাসিনাসহ এ মামলার তিন আসামির বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। সেগুলো হলো- উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান; প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ; রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা; রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় আন্দোলনরত ছয়জনকে গুলি করে হত্যা এবং আশুলিয়ায় ছয়জনকে পুড়িয়ে হত্যা করা।
রায়ে আদালত বলেছে, আসামিদের বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগের প্রতিটি প্রমাণিত হয়েছে। পাঁচটি অভিযোগ তিনটি কাউন্টে ভাগ করে সাজা প্রদান করা হয়েছে আসামিদের।
অভিযোগ-১:
গণভবনে ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার ‘উসকানিমূলক’ বক্তব্য প্রদান এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ‘প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায়’ তাদের অধীনস্ত ও নিয়ন্ত্রণাধীন আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র ‘আওয়ামী সন্ত্রাসীদের’ মাধ্যমে ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণের অংশ হিসেবে হত্যা, হত্যার চেষ্টা, নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার অপরাধ সংঘটনের প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, অপরাধ সংঘটন প্রতিরোধে ব্যর্থতা, অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শান্তি প্রদান না করা এবং ষড়যন্ত্র করার অপরাধ; যা আসামিদের জ্ঞাতসারে সংঘটিত।
অভিযোগ-২
: আসামি শেখ হাসিনার ছাত্র-জনতার ওপর হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের ‘হত্যা করে নির্মূলের নির্দেশ’ এবং এ নির্দেশ বাস্তবায়নে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ও অধীনস্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ প্রদানের পাশাপাশি সহায়তা, সম্পৃক্ততা ও ষড়যন্ত্র করেন।
অভিযোগ-৩:
রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে স্বল্প দূরত্ব থেকে নিরস্ত্র আন্দোলনকারী ছাত্র আবু সাঈদের ‘বুক লক্ষ্য করে বিনা উসকানিতে একাধিক গুলি চালিয়ে’ তাকে নির্মমভাবে হত্যা করার মাধ্যমে উল্লিখিত আসামিদের জ্ঞাতসারে এবং তাদের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ, প্ররোচণা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্র করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন।
অভিযোগ-৪:
ঢাকা মহানগরীর চানখাঁরপুল এলাকায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর তৎকালীন সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে নিরীহ-নিরস্ত্র ৬ জন ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করার মাধ্যমে উল্লিখিত আসামিদের জ্ঞাতসারে এবং তাদের কর্তৃক হত্যার নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্র করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন।
অভিযোগ-৫:
ঢাকার আশুলিয়া থানার সামনে এবং আশপাশ এলাকায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর তৎকালীন সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নিরীহ-নিরস্ত্র ৬ ছাত্র-জনতাকে গুলি করে তাদের মধ্যে ৫ জনের মৃতদেহ এবং একজনকে জীবিত ও গুরুতর আহত অবস্থায় আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার অপরাধ, যা আসামিদের জ্ঞাতসারে সংঘটিত হয়েছে। ওই ঘটনায় হত্যা, নির্যাতন, মৃত ও জীবিত অবস্থায় আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে অমানবিক আচরণ করার অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে।
কোন অপরাধে কী সাজা
২০২৪ সালের ১৪ই জুলাই আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে অংশ নেয়া আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চা, রাজাকারের নাতি-পুতি বলে উল্লেখ করেন। ‘উসকানিমূলক’ বক্তব্য দিয়ে ছাত্র-জনতাকে হত্যার প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, অপরাধ সংঘটন প্রতিরোধে ব্যর্থতার জন্য শেখ হাসিনাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড (ইমপ্রিসনমেন্ট টিল ন্যাচারাল ডেথ) দেয় ট্রাইব্যুনাল।
দ্বিতীয় অভিযোগে হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের ‘হত্যা করে নির্মূলের নির্দেশ’, চতুর্থ অভিযোগে চানখাঁরপুলে ছয় হত্যা এবং পঞ্চম অভিযোগে আশুলিয়ায় ছয়জনকে হত্যা ও লাশ পোড়ানোর ঘটনাতেও শেখ হাসিনাকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত। এই তিন অভিযোগ মিলিয়ে তাকে দেয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড।
চতুর্থ অভিযোগে চানখাঁরপুলে ছয় হত্যা এবং পঞ্চম অভিযোগে আশুলিয়ায় ছয়জনকে হত্যা ও লাশ পোড়ানোর ঘটনায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল-মামুনকে দোষী সাব্যস্ত করে ট্রাইব্যুনাল। তাদের মধ্যে কামালকে দেয়া হয় সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড।
আর মামুন রাজসাক্ষী (অ্যাপ্রুভার) হিসেবে তথ্য দিয়ে অপরাধ প্রমাণে সহযোগিতা করায় তাকে লঘুদণ্ড দেয়া হয়।
ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলে, আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। অপরাধের ব্যাপকতা এবং যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, যেসব অপরাধ তিনি করেছেন সেগুলোর জন্য তিনি সর্বোচ্চ শাস্তির যোগ্য। কিন্তু যেহেতু তিনি এ মামলাকে অর্থবহ করে তোলার জন্য সাহায্য করেছেন সে বিষয় বিবেচনায় তিনি ন্যূনতম সাজা পাবেন। ট্রাইব্যুনাল রায়ে আরও বলেছে, তিনি সব এট্রোসিটিজের (নৃশংসতা) জন্য দায়ী। কিন্তু ঘটনার বিবরণ পূর্ণাঙ্গভাবে ডিসক্লোজ করেছেন তিনি। এসব বিষয় বিবেচনায় সাবেক এই আইজিপিকে ট্রাইব্যুনাল পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়।
শেখ হাসিনা এবং আসাদুজ্জামান খান কামালকে সর্বোচ্চ সাজা দেয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশে তাদের সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে জব্দের নির্দেশ দেয় আদালত। পাশাপাশি জুলাই আন্দোলনে নিহতদের পরিবার এবং আহতদের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে সরকারকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
*মামলার ৩৯৭ দিনের মাথায় রায়*
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। ওই বছর ১৭ অক্টোবর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় প্রথম মামলা (মিসকেস বা বিবিধ মামলা) হয়। ওইদিনই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এ মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল।
এ মামলায় প্রথমে শেখ হাসিনাই ছিলেন একমাত্র আসামি। এ বছরের ১৬ মার্চ তার পাশাপাশি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকেও আসামি করা হয়। একাধিকবার সময় বাড়ানোর পর চলতি বছরের ১২ মে এই মামলায় চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। সেদিন আসামি হিসেবে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নাম প্রথমবারের মতো আসে। মামলায় আসামি হন তিনজন- শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
এরপর ১ জুন প্রসিকিউশন ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের দপ্তরে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ এবং যাবতীয় দলিল জমা দেয়। এর মধ্য দিয়ে ‘মিসকেস’ আনুষ্ঠানিকভাবে মামলায় রূপ নেয়।
চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাড়ে আট হাজার পৃষ্ঠার ওই অভিযোগপত্র বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেন। এরপর গত ১০ জুলাই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। সেদিনই আল-মামুন ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হওয়ার আবেদন করেন।
গত ৩ আগস্ট এ মামলায় সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এরমধ্য দিয়ে এ মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়।
মামলায় প্রথম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গুরুতর আহত হওয়া খোকন চন্দ্র বর্মণ। বিচারে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ মোট ৫৪ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয় গত ৮ অক্টোবর। এরপর যুক্তিতর্ক শুরু হয় গত ১২ অক্টোবর, যা শেষ হয় ২৩ অক্টোবর।
সর্বশেষ ১৩ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল জানান, ১৭ নভেম্বর (সোমবার) এ মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। সবমিলিয়ে ‘মিসকেস’ থেকে এ মামলার রায় ঘোষণা পর্যন্ত সময় লেগেছে ৩৯৭ দিন।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও তিনটি মামলা চলছে ট্রাইব্যুনালে। এছাড়া আদালত অবমাননার দায়ে তাকে এই ট্রাইব্যুনাল এর আগে ছয় মাসের কারাদণ্ড ও দিয়েছিল।
কোটা আন্দোলন
সরকারি চাকরির কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সরকারের পদত্যাগের এক দফার রূপ নেয়ার পর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে; হেলিকপ্টারে চড়ে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা।
এরপর তার বিরুদ্ধে কয়েকশ’ মামলা হয় দেশের বিভিন্ন আদালত ও থানায়। আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মীকে সেসব মামলায় আসামি করা হয়। এরমধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের উদ্যোগ নেয়।
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের ঘটনা সারা বিশ্বের নজর কেড়েছিল। ফলে তার রায়ের দিনে পুরো বাংলাদেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর নজর ছিল ট্রাইব্যুনালের দিকে। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এ মামলার রায় ঘোষণার কার্যক্রম আদালত থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
*আইনজীবী যারা*
প্রসিকিউশনের প্রধান কৌঁসুলি (চিফ প্রসিকিউটর) হিসেবে এ মামলা পরিচালনায় নেতৃত্ব দেন মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, যিনি এক সময় একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ মামলার আসামি জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের আইনজীবী ছিলেন।
রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনায় তাজুল ইসলামের সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম, গাজী এমএইচ তামিম, বিএম সুলতান মাহমুদ, ফারুক আহম্মদ, মো. আব্দুস সোবহান তরফদার, মো. সহিদুল ইসলাম সরদার, তানভীর হাসান জোহাসহ প্রসিকিউশনদল।
চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন যায়েদ বিন আমজাদ। আর শেখ হাসিনা ও কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন শুনানি করেন।
*সাক্ষীরা কে কী বলেছিলেন*
এ মামলায় মোট ৫৪ জন সাক্ষ্য দেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম প্রতীক আবু সাঈদের বাবা, নিহতদের পরিবারের সদস্য, জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক ও জুলাই আন্দোলনের নেতা নাহিদ ইসলাম, জুলাই আন্দোলনের আরেক নেতা উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান।
বদরুদ্দিন উমরের লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনানো হয় ট্রাইব্যুনালে, যা তিনি মৃত্যুর আগে লিখে পাঠিয়েছিলেন। এছাড়া রাজসাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেনসাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
তিনি বলেন, ‘১৮ জুলাই ২০২৪?এ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে ফোন করে জানায় যে, শেখ হাসিনা আন্দোলন বন্ধ করার জন্য প্রত্যক্ষভাবে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন।’ হেলিকপ্টারে করে হামলার বিষয়ে মামুন বলেন, ‘প্রতিবাদকারীদের এলাকা ভাগ করা হয়েছিল। তারপর হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে ছাত্র ও সাধারণ বেসামরিক অনেককে হত্যা ও জখম করা হয়।’
এ মামলার ৪ নম্বর অভিযোগ হলো রাজধানীর চানখাঁরপুলে ৬ হত্যা। এ মামলায় গত ১৬ অক্টোবর সাক্ষ্য দেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, যিনি আন্দোলনের সামনের সারির ছাত্রনেতা ছিলেন।
১৪০০ জনকে হত্যার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এখন আমরা বিভিন্নভাবে তালিকা পাচ্ছি। এরআগে আমরা আরও দুটি হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছি, যেটা বিডিআর বিডিআর হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তীতে শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ড। শত শত মানুষকে গুম করে হত্যা করা হয়েছে। অনেককে আর ফিরে পাওয়া যায় নাই। আমরা আয়নাঘর প্রত্যক্ষ করেছি। সুতরাং প্রত্যেকটা ঘটনায় প্রত্যেকটা ভিক্টিমের জন্য যদি আপনি একবার করে বিচার করতে যান, তাহলে এই বিচার হয়ত কেয়ামত পর্যন্ত শেষ হবে না। আমরা এ সকল ভিক্টিমদের পক্ষ থেকে এই ‘মিসডিডগুলো’ যে শেখ হাসিনা এবং এর সঙ্গে আর যারা জড়িত ছিলেন, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়েছি এবং আশা করি এই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হবে।’
মাহমুদুর রহমান সাক্ষ্যে বলেন, ‘বিডিআর হত্যাকাণ্ডে শেখ তাপসের জড়িত থাকার সব রকম প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তাকে কখনো বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। বিডিআর হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক ৫৭ জন অফিসারকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। তাদের পরিবারের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল। তৎকালীন সরকারপ্রধান, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা, স্বরাষ্টমন্ত্রী এবং সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদ সেনাসদস্য এবং তাদের পরিবারকে রক্ষা করবার কোনো রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি, বরং দুই দিন ধরে এই হত্যাযজ্ঞ ঘটতে দিয়েছিল।’
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা নাহিদ ইসলাম সাক্ষ্যে বলেন, ‘ছাত্রদের রাজাকারের বাচ্চা এবং রাজাকারের নাতিপুতি আখ্যায়িত করায় সমগ্র দেশের ছাত্রছাত্রীরা অপমানিত বোধ করে।’
ট্রাইব্যুনালে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালে প্রধান কৌঁসুলি মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘রোম স্ট্যাটিউট অব দ্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট’-এর ৭ অনুচ্ছেদে মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, যেখানে ‘ওয়াইডস্প্রেড অ্যাটাক’ এবং ‘সিস্টেম্যাটিক অ্যাটাকের’ কথা বলা আছে। এ দুই ধরনের অপরাধ শেখ হাসিনা করেছেন।
অন্যদিকে শেখ হাসিনার জন্য রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন যুক্তিতর্ক শুনানিতে বলেন, “আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে মূল এভিডেন্স অ্যাক্ট প্রয়োগের কোনো সুযোগ নেই। সিআরপিসিও এ আইনে গ্রহণ করা যায় না। এ আইনে বিচার মানে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে দিয়ে আসামিকে বলা হবে, ‘এখন সাঁতার কাটো’।”
শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের ‘কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’র অভিযোগের বিষয়ে আমির হোসেন বলেন, ‘যদি ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনকে বৈধও ধরে নেয়া হয়, সেই আন্দোলনকেও নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের রয়েছে।’
এ আইনজীবীর ভাষ্য, ‘রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ভুলত্রুটি থাকতে পারে। সেগুলো মেনে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। পৃথিবীর শুরু থেকে এগুলো হয়ে আসছে। ইরানের খোমেনি, মালয়েশিয়ার মাহথির মোহাম্মদ করেছেন। শুধু বেঠিকটাকে প্রাধান্য দেবেন, সঠিকটাকে দেবেন না-তা তো হবে না।’
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫
জুলাই অভ্যুত্থান: ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’
এক মাসের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে আত্মসমর্পণ করে আপিল করা যাবে
চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থান দমানোর চেষ্টায় ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ সংঘটনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। শেখ হাসিনার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালেরও একই সাজা হয়েছে। ওই অভ্যুত্থানের সময় পুলিশপ্রধানের দায়িত্বে থাকা চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী (অ্যাপ্রুভার) হওয়ায় তাকে দেয়া হয়েছে ৫ বছরের কারাদণ্ড।
শেখ হাসিনা এবং আসাদুজ্জামান খান কামালের বাংলাদেশে থাকা সব সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে জব্দের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। জুলাই আন্দোলনে নিহতদের পরিবার এবং আহতদের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে সরকারের প্রতি নির্দেশও এসেছে রায়ে।
বাংলাদেশের রেওয়াজ অনুযায়ী, বেসামরিক আদালতের রায়ে আসামিকে আমৃত্যু ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা আপিল করারও সুযোগ পাবেন। তবে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল পলাতক থাকায় আপিল করতে চাইলে তাদের ট্রাইব্যুনাল আত্মসমর্পণ করে এক মাসের মধ্যে আপিল করতে হবে।
টানা ৪৪ বছর ধরে দেশের প্রাচীন রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগের (বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ) সভাপতির দায়িত্বে আছেন আটাত্তর পেরোনো শেখ হাসিনা। টানা দেড় দশক দেশের সরকরারপ্রধানের দায়িত্ব সামলানোর এক পর্যায়ে শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছর ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হন তিনি। ওইদিনই তিনি দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান; এখন পর্যন্ত সেখানেই আছেন।
শেখ হাসিনাই দেশের প্রথম সরকারপ্রধান যিনি সাবেক (ক্ষমতাচ্যুত) হওয়ার পর আদালতের রায়ে সর্বোচ্চ (মৃত্যুদণ্ড) সাজাপ্রাপ্ত হলেন। তার মৃত্যুদণ্ডের এই রায় এলো তার বিয়ে বার্ষিকীর দিনে। ১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর পরমাণু বিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল।
শেখ হাসিনার শাসনামলেই এই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য। এ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডের রায়ের ভিত্তিতেই আওয়ামী লীগের আমলে জামায়াতে ইসলামীর পাঁচ শীর্ষ নেতা এবং বিএনপির একজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ শেখ হাসিনার মামলার রায় ঘোষণা করে। এ রায়ে মোট ছয়টি অংশ ছিল।
সোমবার,(১৭ নভেম্বর ২০২৫) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়; শেষ হয় বিকেল ৩টার কিছুক্ষণ আগে।
৪৫৩ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশ দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে একাধিক্রমে পড়েন তিন বিচারক। রায়ের সময় শেখ হাসিনাসহ আসামিদের অপরাধের প্রমাণ হিসেবে আমলে নেয়া ফোনালাপের রেকর্ড শোনানো হয়, জুলাই সহিংসতা নিয়ে জাতিসংঘ প্রতিবেদনও উপস্থাপন করা হয়।
ট্রাইব্যুনালের দ্বিতীয় সদস্য বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী এবং প্রথম সদস্য বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ রায়ের দুটি অংশ পড়ে শোনান। সর্বশেষে আসামিদের সাজার বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদার।
রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশনে আদালতের কার্যক্রম সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
রায় ঘোষণার সময় জনাকীর্ণ আদালতে আইনজীবীরা ছাড়াও ‘শহীদ’ মীর মুগ্ধর ভাই মীর স্নিগ্ধসহ চব্বিশের জুলাই-আগস্টে নিহতদের কয়েকজনের পরিবারের সদস্যরা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি সাদিক কায়েম ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ফরহাদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন। ট্রাইব্যুনাল কক্ষে এদের পাশেই বসেছেন ছাত্রদলসমর্থিত সাবেক ডাকসু ভিপি প্রার্থী আবিদ ও জিএস প্রার্থী শেখ তানভীর বারী হামীম। উপস্থিত ছিলেন ইনকিলাব মঞ্চের আহবায়ক শরীফ ওসমান হাদী।
সংবাদ সংগ্রহের জন্য ট্রাইব্যুনাল কক্ষে ছিলেন দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের সাংবাদিক।
মামলার আসামিদের মধ্যে শেখ হাসিনার মতো আসাদুজ্জামান খান কামালরও কামালও ভারতে পালিয়ে আছেন। গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন শুধু পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। রায়ের জন্য এদিন সকালে আবদুল্লাহ আল-মামুনকে আদালতে হাজির করা হয়। রায় শেষে তাকে আবার ফিরিয়ে নেয়া হয় কারাগারে।
আসামিদের বিরুদ্ধে ৫ অভিযোগ
শেখ হাসিনাসহ এ মামলার তিন আসামির বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। সেগুলো হলো- উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান; প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ; রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা; রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় আন্দোলনরত ছয়জনকে গুলি করে হত্যা এবং আশুলিয়ায় ছয়জনকে পুড়িয়ে হত্যা করা।
রায়ে আদালত বলেছে, আসামিদের বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগের প্রতিটি প্রমাণিত হয়েছে। পাঁচটি অভিযোগ তিনটি কাউন্টে ভাগ করে সাজা প্রদান করা হয়েছে আসামিদের।
অভিযোগ-১:
গণভবনে ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার ‘উসকানিমূলক’ বক্তব্য প্রদান এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ‘প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায়’ তাদের অধীনস্ত ও নিয়ন্ত্রণাধীন আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র ‘আওয়ামী সন্ত্রাসীদের’ মাধ্যমে ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণের অংশ হিসেবে হত্যা, হত্যার চেষ্টা, নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার অপরাধ সংঘটনের প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, অপরাধ সংঘটন প্রতিরোধে ব্যর্থতা, অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শান্তি প্রদান না করা এবং ষড়যন্ত্র করার অপরাধ; যা আসামিদের জ্ঞাতসারে সংঘটিত।
অভিযোগ-২
: আসামি শেখ হাসিনার ছাত্র-জনতার ওপর হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের ‘হত্যা করে নির্মূলের নির্দেশ’ এবং এ নির্দেশ বাস্তবায়নে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ও অধীনস্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ প্রদানের পাশাপাশি সহায়তা, সম্পৃক্ততা ও ষড়যন্ত্র করেন।
অভিযোগ-৩:
রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে স্বল্প দূরত্ব থেকে নিরস্ত্র আন্দোলনকারী ছাত্র আবু সাঈদের ‘বুক লক্ষ্য করে বিনা উসকানিতে একাধিক গুলি চালিয়ে’ তাকে নির্মমভাবে হত্যা করার মাধ্যমে উল্লিখিত আসামিদের জ্ঞাতসারে এবং তাদের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ, প্ররোচণা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্র করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন।
অভিযোগ-৪:
ঢাকা মহানগরীর চানখাঁরপুল এলাকায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর তৎকালীন সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে নিরীহ-নিরস্ত্র ৬ জন ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করার মাধ্যমে উল্লিখিত আসামিদের জ্ঞাতসারে এবং তাদের কর্তৃক হত্যার নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্র করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন।
অভিযোগ-৫:
ঢাকার আশুলিয়া থানার সামনে এবং আশপাশ এলাকায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর তৎকালীন সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নিরীহ-নিরস্ত্র ৬ ছাত্র-জনতাকে গুলি করে তাদের মধ্যে ৫ জনের মৃতদেহ এবং একজনকে জীবিত ও গুরুতর আহত অবস্থায় আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার অপরাধ, যা আসামিদের জ্ঞাতসারে সংঘটিত হয়েছে। ওই ঘটনায় হত্যা, নির্যাতন, মৃত ও জীবিত অবস্থায় আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে অমানবিক আচরণ করার অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে।
কোন অপরাধে কী সাজা
২০২৪ সালের ১৪ই জুলাই আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে অংশ নেয়া আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চা, রাজাকারের নাতি-পুতি বলে উল্লেখ করেন। ‘উসকানিমূলক’ বক্তব্য দিয়ে ছাত্র-জনতাকে হত্যার প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, অপরাধ সংঘটন প্রতিরোধে ব্যর্থতার জন্য শেখ হাসিনাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড (ইমপ্রিসনমেন্ট টিল ন্যাচারাল ডেথ) দেয় ট্রাইব্যুনাল।
দ্বিতীয় অভিযোগে হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের ‘হত্যা করে নির্মূলের নির্দেশ’, চতুর্থ অভিযোগে চানখাঁরপুলে ছয় হত্যা এবং পঞ্চম অভিযোগে আশুলিয়ায় ছয়জনকে হত্যা ও লাশ পোড়ানোর ঘটনাতেও শেখ হাসিনাকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত। এই তিন অভিযোগ মিলিয়ে তাকে দেয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড।
চতুর্থ অভিযোগে চানখাঁরপুলে ছয় হত্যা এবং পঞ্চম অভিযোগে আশুলিয়ায় ছয়জনকে হত্যা ও লাশ পোড়ানোর ঘটনায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল-মামুনকে দোষী সাব্যস্ত করে ট্রাইব্যুনাল। তাদের মধ্যে কামালকে দেয়া হয় সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড।
আর মামুন রাজসাক্ষী (অ্যাপ্রুভার) হিসেবে তথ্য দিয়ে অপরাধ প্রমাণে সহযোগিতা করায় তাকে লঘুদণ্ড দেয়া হয়।
ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলে, আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। অপরাধের ব্যাপকতা এবং যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, যেসব অপরাধ তিনি করেছেন সেগুলোর জন্য তিনি সর্বোচ্চ শাস্তির যোগ্য। কিন্তু যেহেতু তিনি এ মামলাকে অর্থবহ করে তোলার জন্য সাহায্য করেছেন সে বিষয় বিবেচনায় তিনি ন্যূনতম সাজা পাবেন। ট্রাইব্যুনাল রায়ে আরও বলেছে, তিনি সব এট্রোসিটিজের (নৃশংসতা) জন্য দায়ী। কিন্তু ঘটনার বিবরণ পূর্ণাঙ্গভাবে ডিসক্লোজ করেছেন তিনি। এসব বিষয় বিবেচনায় সাবেক এই আইজিপিকে ট্রাইব্যুনাল পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়।
শেখ হাসিনা এবং আসাদুজ্জামান খান কামালকে সর্বোচ্চ সাজা দেয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশে তাদের সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে জব্দের নির্দেশ দেয় আদালত। পাশাপাশি জুলাই আন্দোলনে নিহতদের পরিবার এবং আহতদের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে সরকারকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
*মামলার ৩৯৭ দিনের মাথায় রায়*
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। ওই বছর ১৭ অক্টোবর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় প্রথম মামলা (মিসকেস বা বিবিধ মামলা) হয়। ওইদিনই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এ মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল।
এ মামলায় প্রথমে শেখ হাসিনাই ছিলেন একমাত্র আসামি। এ বছরের ১৬ মার্চ তার পাশাপাশি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকেও আসামি করা হয়। একাধিকবার সময় বাড়ানোর পর চলতি বছরের ১২ মে এই মামলায় চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। সেদিন আসামি হিসেবে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নাম প্রথমবারের মতো আসে। মামলায় আসামি হন তিনজন- শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
এরপর ১ জুন প্রসিকিউশন ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের দপ্তরে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ এবং যাবতীয় দলিল জমা দেয়। এর মধ্য দিয়ে ‘মিসকেস’ আনুষ্ঠানিকভাবে মামলায় রূপ নেয়।
চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাড়ে আট হাজার পৃষ্ঠার ওই অভিযোগপত্র বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেন। এরপর গত ১০ জুলাই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। সেদিনই আল-মামুন ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হওয়ার আবেদন করেন।
গত ৩ আগস্ট এ মামলায় সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এরমধ্য দিয়ে এ মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়।
মামলায় প্রথম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গুরুতর আহত হওয়া খোকন চন্দ্র বর্মণ। বিচারে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ মোট ৫৪ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয় গত ৮ অক্টোবর। এরপর যুক্তিতর্ক শুরু হয় গত ১২ অক্টোবর, যা শেষ হয় ২৩ অক্টোবর।
সর্বশেষ ১৩ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল জানান, ১৭ নভেম্বর (সোমবার) এ মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। সবমিলিয়ে ‘মিসকেস’ থেকে এ মামলার রায় ঘোষণা পর্যন্ত সময় লেগেছে ৩৯৭ দিন।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও তিনটি মামলা চলছে ট্রাইব্যুনালে। এছাড়া আদালত অবমাননার দায়ে তাকে এই ট্রাইব্যুনাল এর আগে ছয় মাসের কারাদণ্ড ও দিয়েছিল।
কোটা আন্দোলন
সরকারি চাকরির কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সরকারের পদত্যাগের এক দফার রূপ নেয়ার পর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে; হেলিকপ্টারে চড়ে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা।
এরপর তার বিরুদ্ধে কয়েকশ’ মামলা হয় দেশের বিভিন্ন আদালত ও থানায়। আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মীকে সেসব মামলায় আসামি করা হয়। এরমধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের উদ্যোগ নেয়।
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের ঘটনা সারা বিশ্বের নজর কেড়েছিল। ফলে তার রায়ের দিনে পুরো বাংলাদেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর নজর ছিল ট্রাইব্যুনালের দিকে। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এ মামলার রায় ঘোষণার কার্যক্রম আদালত থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
*আইনজীবী যারা*
প্রসিকিউশনের প্রধান কৌঁসুলি (চিফ প্রসিকিউটর) হিসেবে এ মামলা পরিচালনায় নেতৃত্ব দেন মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, যিনি এক সময় একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ মামলার আসামি জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের আইনজীবী ছিলেন।
রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনায় তাজুল ইসলামের সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম, গাজী এমএইচ তামিম, বিএম সুলতান মাহমুদ, ফারুক আহম্মদ, মো. আব্দুস সোবহান তরফদার, মো. সহিদুল ইসলাম সরদার, তানভীর হাসান জোহাসহ প্রসিকিউশনদল।
চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন যায়েদ বিন আমজাদ। আর শেখ হাসিনা ও কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন শুনানি করেন।
*সাক্ষীরা কে কী বলেছিলেন*
এ মামলায় মোট ৫৪ জন সাক্ষ্য দেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম প্রতীক আবু সাঈদের বাবা, নিহতদের পরিবারের সদস্য, জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক ও জুলাই আন্দোলনের নেতা নাহিদ ইসলাম, জুলাই আন্দোলনের আরেক নেতা উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান।
বদরুদ্দিন উমরের লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনানো হয় ট্রাইব্যুনালে, যা তিনি মৃত্যুর আগে লিখে পাঠিয়েছিলেন। এছাড়া রাজসাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেনসাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
তিনি বলেন, ‘১৮ জুলাই ২০২৪?এ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে ফোন করে জানায় যে, শেখ হাসিনা আন্দোলন বন্ধ করার জন্য প্রত্যক্ষভাবে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন।’ হেলিকপ্টারে করে হামলার বিষয়ে মামুন বলেন, ‘প্রতিবাদকারীদের এলাকা ভাগ করা হয়েছিল। তারপর হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে ছাত্র ও সাধারণ বেসামরিক অনেককে হত্যা ও জখম করা হয়।’
এ মামলার ৪ নম্বর অভিযোগ হলো রাজধানীর চানখাঁরপুলে ৬ হত্যা। এ মামলায় গত ১৬ অক্টোবর সাক্ষ্য দেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, যিনি আন্দোলনের সামনের সারির ছাত্রনেতা ছিলেন।
১৪০০ জনকে হত্যার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এখন আমরা বিভিন্নভাবে তালিকা পাচ্ছি। এরআগে আমরা আরও দুটি হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছি, যেটা বিডিআর বিডিআর হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তীতে শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ড। শত শত মানুষকে গুম করে হত্যা করা হয়েছে। অনেককে আর ফিরে পাওয়া যায় নাই। আমরা আয়নাঘর প্রত্যক্ষ করেছি। সুতরাং প্রত্যেকটা ঘটনায় প্রত্যেকটা ভিক্টিমের জন্য যদি আপনি একবার করে বিচার করতে যান, তাহলে এই বিচার হয়ত কেয়ামত পর্যন্ত শেষ হবে না। আমরা এ সকল ভিক্টিমদের পক্ষ থেকে এই ‘মিসডিডগুলো’ যে শেখ হাসিনা এবং এর সঙ্গে আর যারা জড়িত ছিলেন, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়েছি এবং আশা করি এই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হবে।’
মাহমুদুর রহমান সাক্ষ্যে বলেন, ‘বিডিআর হত্যাকাণ্ডে শেখ তাপসের জড়িত থাকার সব রকম প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তাকে কখনো বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। বিডিআর হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক ৫৭ জন অফিসারকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। তাদের পরিবারের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল। তৎকালীন সরকারপ্রধান, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা, স্বরাষ্টমন্ত্রী এবং সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদ সেনাসদস্য এবং তাদের পরিবারকে রক্ষা করবার কোনো রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি, বরং দুই দিন ধরে এই হত্যাযজ্ঞ ঘটতে দিয়েছিল।’
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা নাহিদ ইসলাম সাক্ষ্যে বলেন, ‘ছাত্রদের রাজাকারের বাচ্চা এবং রাজাকারের নাতিপুতি আখ্যায়িত করায় সমগ্র দেশের ছাত্রছাত্রীরা অপমানিত বোধ করে।’
ট্রাইব্যুনালে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালে প্রধান কৌঁসুলি মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘রোম স্ট্যাটিউট অব দ্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট’-এর ৭ অনুচ্ছেদে মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, যেখানে ‘ওয়াইডস্প্রেড অ্যাটাক’ এবং ‘সিস্টেম্যাটিক অ্যাটাকের’ কথা বলা আছে। এ দুই ধরনের অপরাধ শেখ হাসিনা করেছেন।
অন্যদিকে শেখ হাসিনার জন্য রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন যুক্তিতর্ক শুনানিতে বলেন, “আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে মূল এভিডেন্স অ্যাক্ট প্রয়োগের কোনো সুযোগ নেই। সিআরপিসিও এ আইনে গ্রহণ করা যায় না। এ আইনে বিচার মানে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে দিয়ে আসামিকে বলা হবে, ‘এখন সাঁতার কাটো’।”
শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের ‘কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’র অভিযোগের বিষয়ে আমির হোসেন বলেন, ‘যদি ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনকে বৈধও ধরে নেয়া হয়, সেই আন্দোলনকেও নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের রয়েছে।’
এ আইনজীবীর ভাষ্য, ‘রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ভুলত্রুটি থাকতে পারে। সেগুলো মেনে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। পৃথিবীর শুরু থেকে এগুলো হয়ে আসছে। ইরানের খোমেনি, মালয়েশিয়ার মাহথির মোহাম্মদ করেছেন। শুধু বেঠিকটাকে প্রাধান্য দেবেন, সঠিকটাকে দেবেন না-তা তো হবে না।’