মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরাতে অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যাওয়ার কথা ভাবছে। একই অপরাধের দায়ে শেখ হাসিনার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামন খাঁন কামালকেও মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তারা দুজইন এখন ভারতে রয়েছেন।

প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী তাদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনতে ভারতে চিঠি দেবে অন্তর্বর্তী সরকার। পাশপাশি তাদের দুজনকেই দেশে ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট বা আইসিসি) যাওয়ার বিষয়েও অচিরেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

বৃহস্পতিবার, (২০ নভেম্বর ২০২৫) তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। এরপর ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ব্রিফিংয়ে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের বিভিন্ন তথ্য জানান। ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন।

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন প্রশ্নে যে গণভোট হবে, সে বিষয়ে তিন-চার কার্যদিবসের মধ্যে আইন তৈরি করা হবে বলেও তথ্য দেন এই উপদেষ্টা।

শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমরা (অন্তর্বর্তী সরকার) মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল- ওনাদের প্রত্যর্পণের জন্য আমরা চিঠি দিচ্ছি। পাশাপাশি ওনাদের প্রত্যর্পণ করার জন্য, যেহেতু ওনারা এখন দোষী সাব্যস্ত, মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত, কাজেই আমরা মনে করি ভারতের এখন বাড়তি দায়িত্ব রয়েছে তাদের ফেরত দেয়ার।’

আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের বিচারের আকাক্সক্ষা, সেটা পূরণ করার জন্য এই দায়িত্ব পালনে ভারত যেন আমাদের সঙ্গে প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী তার বাধ্যবাধকতা পালন করে, সেজন্য সেটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ভারতকে আমরা চিঠি দিচ্ছি। একই সঙ্গে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের দেশে ফেরানোর জন্য আন্তর্জাতিক যে অপরাধ আদালত রয়েছে, সেখানে কোনোভাবে ‘অ্যাপ্রোচ’ করা যায় কিনা, সেটা বিচার-বিবেচনা করার জন্য আমরা অচিরেই বসে সিদ্ধান্ত নেব।’

জুলাই অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গত সোমবার আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে রায় দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। রায়ে শেখ হাসিনা ও তার সময়কার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামন খাঁন কামালকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। আর রাজসাক্ষী হওয়া পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে দেয়া হয় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড। রায়ের দিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খাঁন কামালকে ফেরত দিতে ভারতের প্রতি আবারও আহ্বান জানায়।

শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলনে গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান। তিনি এবং তার সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামন খাঁন কামাল এখন পর্যন্ত ভারতেই অবস্থান করছেন। এদিকে শেখ হাসিনার দেশে ত্যাগের তিন দিন পর ৮ আগস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।

শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে ব্রিফিংয়ে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, ‘আপনারা (অন্তর্বর্তী সরকার) কতটুকু আশাবাদী?’ জবাবে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘আপনার প্রশ্নের মধ্যে যতটুক আশাবাদ আছে, ততটুকুই আশাবাদী আমরা।’

গত সোমবারের রায়ের পর থেকে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। বৃহস্পতিবার, এ নিয়ে কথা বলেন তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া থেকে ভারতীয় বার্তা সংস্থা এএনআইকে দেয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের যে অনুরোধ ঢাকা করেছে, নয়াদিল্লি তা গ্রহণ করবে বলে তিনি মনে করেন না।

*গণভোটের আইন*

গণভোট আয়োজনে আইন প্রণয়নের বিষয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘গণভোট আইন আমরা খুব দ্রুত করতে যাচ্ছি। এই সপ্তাহে করে ফেলবো। ধরেন, আজ কী বার, বৃহস্পতিবার (গত) বার তো? ধরেন আগামী তিন-চার কার্য দিবসের মধ্যে হয়ে যাবে।’

আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে দেশে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন প্রশ্নে সংসদ নির্বাচনের দিনেই গণভোট আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।

কিন্তু সেই গণভোট নিয়ে এখনও অধ্যাদেশ জারি হয়নি। আর অধ্যাদেশ জারি না হওয়ায় গণভোট নিয়ে নিজেদের করণীয় নির্ধারণ করা যাচ্ছে না বলে নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে বলা হচ্ছে।

বৃহস্পতিবার, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে গণভোটের প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্নের জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন বলেন, ‘অধ্যাদেশটা হলে তখন আমার একটা দায়বদ্ধতা আসবে এ ব্যাপারে বক্তব্য দেয়ার। কিন্তু রাজনীতিকরা অনেকে জিজ্ঞাসা করছেন, কীভাবে করবেন, কীভাবে এগুলোর জবাব দেবেন, কতটা বাক্স করবেন। এগুলোর সব চিন্তা, এক্সারসাইজ শুরু করবো আমরা অধ্যাদেশটা হওয়ার পর।’

*তত্ত্বাবধায়ক সরকার*

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় অবৈধ ঘোষণা করে বৃহস্পতিবার রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এরমধ্য দিয়ে সংবিধানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে এসেছে। তবে এটি কার্যকর হবে চতুর্দশ সংসদ নির্বাচন থেকে। আসছে ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠ্যেয় ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে।

সর্বোচ্চ আদালতের এ রায়ের বিষয়ে ব্রিফিংয়ে আইন উপদেষ্টা আফিস নজরুল বলেন, ‘আজকে একটি ঐতিহাসিক রায় হয়েছে। দীর্ঘদিন সংগ্রাম করার পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পাওয়া গিয়েছিল। এটি ভোটের নিশ্চয়তা দিয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কয়েকটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেখা গিয়েছিল। ক্ষমতাসীন দল পরাজিত হতো। এটা স্বাভাবিক মনে হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সাবেক একজন বিচারপতির নেতৃত্বে রায় দিয়ে এটিকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল। তারপর এর সুযোগ নিয়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এটিকে বাতিল করে।’

আসিফ নজরুল বলেন, ‘প্রথমে পঞ্চদশ সংশোধনী অবৈধ ঘোষিত হয়েছে মাস দু-এক আগে এক রায়ে। আর আজকে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক অত্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবৈধ বলে যে রায় দিয়েছিলেন সেটা বাতিল হয়েছে।’

এ প্রসঙ্গে আইন উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘এই মুহূর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনরুজ্জীবিত হয়েছে বলতে পারি। কিন্তু এটা কার্যকর হবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে। কারণ সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার হয়। এখন সংসদের অস্তিত্ব নেই। উচ্চ আদালতের নির্দেশ মোতাবেক আগামীতে যে সংসদ গঠিত হবে, সেই সংসদ যখন ভেঙে যাবে, তারপর ১৫ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে।’