বাগেরহাটের সংসদীয় আসন চারটি থেকে কমিয়ে তিনটি করে নির্বাচন কমিশনের গেজেট ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিল, তা বহাল রেখেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার ঠিক আগে সর্বোচ্চ আদালতের এই সিদ্ধান্ত এলো। এর ফলে বাগেরহাটে চারটি আসনেই ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের ভোট হবে। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা লিভ টু আপিলের (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) ওপর শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ বুধবার, (১০ ডিসেম্বর ২০২৫) এই রায় দেয়।
রায়ের পর নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী কামাল হোসেন মিয়াজী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘রায়ের বিষয়টা আমি লিখিতভাবে ইসিকে জানাবো, নির্বাচন কমিশনকে জানাবো। নির্বাচন কমিশনের পরবর্তী ইন্সট্রাকশন সাপেক্ষে তারা যেভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন, সে অনুযায়ী আমার রেসপন্সটা হবে।’
হাইকোর্ট রায়ে বলেছিল, বাগেরহাটের আসন আগের অবস্থায় ফিরিয়ে এনে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গেজেট প্রকাশ করতে হবে। এখন গেজেট প্রকাশ ছাড়া ইসির আর কোনো উপায় আছে কিনা, তা জানতে চান একজন সাংবাদিক। উত্তরে ইসির আইনজীবী বলেন, ‘যেহেতু হাইকোর্ট ডিভিশনের রায়টা আপিল বিভাগের আজকের সিদ্ধান্ত, আজকের আদেশ দিয়ে দ্বারা বহাল রয়েছে, সেহেতু হাইকোর্ট ডিভিশনের যে আদেশ ছিল, একটা নির্দেশনা ছিল ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গেজেট প্রকাশ করা। তো এই হাইকোর্ট ডিভিশনের এই আদেশটা যেহেতু বহাল আছে, সেহেতু আর কোনো গেজেট প্রকাশ হবে না।’
সীমানা নিয়ে অসঙ্গতির বিষয়ে আদালতে উপস্থাপন করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, পুরো দেশের জনসংখ্যার গড় করে আসন পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে। চার সংসদীয় আসনের জেলা আছে ১৪টি। এর মধ্যে বাগেরহাটে জনসংখ্যা সবচেয়ে কম। আবার পাঁচ সংসদীয় আসন বিশিষ্ট জেলার সংখ্যা নয়টি। এর মধ্যে গাজীপুরের জনসংখ্যা ও ভোটার সবচেয়ে বেশি।
‘এবার ৩৯টি আসনের সীমানা নির্ধারণ হয়েছে। এখানে এটি একমাত্র জেলা ছিল যেখান থেকে একটা সংসদীয় আসন কার্টেইল করা হয়েছে এবং গাজীপুর একমাত্র জেলা ছিল যেখানে একটা আসন যুক্ত করা হয়েছে। অন্যান্য আসনের ক্ষেত্রে সীমানা নির্ধারণটা হয়েছে একটা ইউনিয়ন বা দুইটা ইউনিয়নকে বা উপজেলাকে এক সংসদীয় এলাকা থেকে অন্য সংসদীয় এলাকায় প্লেস করা হয়েছে।’
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত ৩০ জুলাই নির্বাচন কমিশন বাগেরহাটের চারটি আসন থেকে একটি কমিয়ে তিনটি করার প্রস্তাব দেয়। আর গাজীপুরের আসন পাঁচটি থেকে বাড়িয়ে ছয়টি করা হয়।
ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বাগেরহাটে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল হরতাল-অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। চারটি আসন বহাল রাখার দাবিতে কমিশনের শুনানিও হয়। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্তে অটল থাকে। গত ৪ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত গেজেটে চারটি আসন থেকে একটি কমিয়ে বাগেরহাটে তিন আসন দেয়া হয়।
ওই গেজেট অনুযায়ী বাগেরহাট সদর, চিতলমারী ও মোল্লাহাট নিয়ে বাগেরহাট-১; ফকিরহাট, রামপাল ও মোংলা নিয়ে বাগেরহাট-২ এবং কচুয়া, মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা নিয়ে বাগেরহাট-৩ আসন গঠিত হয়েছে। এর আগে চিতলমারী-মোল্লাহাট-ফকিরহাট নিয়ে ছিল বাগেরহাট-১; বাগেরহাট সদর-কচুয়া নিয়ে ছিল বাগেরহাট-২; রামপাল-মোংলা নিয়ে ছিল বাগেরহাট-৩ এবং বাগেরহাট-৪ ছিল মোরেলগঞ্জ-শরণখোলা।
এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের গেজেট চ্যালেঞ্জ করে এর আগে বাগেরহাটে চারটি সংসদীয় আসন বহালের আবেদন জানিয়ে হাইকোর্টে দুটি রিট আবেদন করা হয়। বাগেরহাট প্রেসক্লাব, জেলা আইনজীবী সমিতি, জেলা বিএনপি, জেলা জামায়াতে ইসলামী, জেলা ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জেলা ট্রাক মালিক সমিতি এ রিট মামলা দুটি করে। বাংলাদেশ সরকার, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশন সচিব ও অ্যাটর্নি জেনারেলকে সেখানে বিবাদী করা হয়।
প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ১৬ সেপ্টেম্বর চারটি সংসদীয় আসন বহাল করতে কেন নির্দেশনা দেয়া হবে না এবং চারটি আসন থেকে একটি কমিয়ে তিনটি করে নির্বাচন কমিশনের গেজেট কেন অবৈধ হবে না, তা জানাতে রুল জারি করা হয়। নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্টদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়। সেই রুলের ওপর শুনানি শেষে গত ১০ নভেম্বর রায় দেয় বিচারপতি শশাঙ্ক শেখর সরকার ও বিচারপতি ফয়সাল হাসান আরিফের হাইকোর্ট বেঞ্চ। নির্বাচন কমিশনের গেজেট ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে বাগেরহাটের চারটি আসন বহাল রাখার আদেশ দেয়া হয় সেখানে।
হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় গত ৩ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হলে নির্বাচন কমিশন ও গাজীপুর-৬ আসন থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী টঙ্গী পূর্ব থানা বিএনপির সভাপতি সরকার জাবেদ আহমেদ পৃথকভাবে আপিলের আবেদন করেন। গাজীপুর-৬ আসন থেকে জামায়াতের সম্ভাব্য প্রার্থী হাফিজুর রহমান এর আগে আপিল বিভাগে একটি আবেদন করেন। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা লিভ টু আপিল ও আবেদনগুলো একসঙ্গে শুনানির জন্য উঠে।
নির্বাচন কমিশনের পক্ষে বুধবার, শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, সঙ্গে ছিলেন কমিশনের আইনজীবী কামাল হোসেন মিয়াজী। সরকার জাবেদ আহমেদের পক্ষে আইনজীবী এম বদরুদ্দোজা বাদল আর সালাহ উদ্দিন সরকারের পক্ষে আইনজীবী মুস্তাফিজুর রহমান খান শুনানি করেন। রিট আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানি করেন শেখ মোহাম্মদ জাকির হোসেন। হাফিজুর রহমানের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন। সেই শুনানি শেষে নির্বাচন কমিশনের আবেদন নাকচ করে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখলো সর্বোচ্চ আদালত।