অন্তর্বর্তী সরকারের সময় বিচারবহির্ভূতভাবে অন্তত ৪০ জন নিহত হয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠন অধিকার আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। ওই অনুষ্ঠানের পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনরা বলছেন, তাদের স্বজনদের সঙ্গে কী হয়েছে, তারা বেঁচে আছে নাকি, তাদের মেরে ফেলা হয়েছে- এসব তথ্য অন্তর্বর্তী সরকার তাদের জানাতে পারেনি।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে অধিকার এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আলোচনা সভায় নির্ধারিত আলোচক এবং গুমের শিকার ব্যক্তির স্বজনরা কথা বলেন। বুধবার, (১০ ডিসেম্বর ২০২৫) সকালে রাজধানীর গুলশানে একটি হোটেলে এ সভার আয়োজন করে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অধিকার।
আলোচনা সভায় গুম কমিশনের সদস্য হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত বিচারপতি মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী বলেন, মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করা সংস্থাগুলো নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে এবং বঞ্চিতদের অধিকার পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। সত্য নথিভুক্ত হলে তা ন্যায় বিচারের প্রথম ধাপ হয়ে ওঠে- সত্য কখনো কখনো বেদনাদায়ক হলেও এটি আরোগ্যের পথ দেখায়। আর মিথ্যা তাৎক্ষণিক স্বস্তি দিলেও এর ক্ষতি দীর্ঘস্থায়ী।
তিনি আরও বলেন, গুমবিষয়ক তদন্ত কমিশন সতর্কতার সঙ্গে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রমাণ যাচাই করে সত্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করছে। সত্য উদ্ঘাটনের প্রতি অঙ্গীকার থেকেই আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কারণ সত্য ছাড়া ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
আলোচনায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন ঘটনার তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন অধিকারের পরিচালক তাসকিন ফাহমিনা। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সংঘটিত
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে?, তা এখনও পরিষ্কার নয়। তাদের তথ্যানুযায়ী, গত বছরের ৯ আগস্ট থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে অন্তত ৪০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। যেখানে রাষ্ট্রীয় বাহিনীও জড়িত ছিল। তবে দোষীদের ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার, সে বিষয়ে এখনও পরিষ্কারভাবে জানা যায়নি।
গুম ও বিচারবহির্ভূত আটক-নির্যাতন নিয়ে কথা বলা অনেক সময় কঠিন, কারণ ভুক্তভোগীরা ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বোঝা বহন করেন বলে জানিয়েছেন গুমের শিকার সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান। তিনি বলেন, গুমের ঘটনাগুলো সঠিকভাবে নথিভুক্ত ও আলোচিত না হওয়ায় অনেক সত্য আড়ালে থেকে গেছে। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার গুমের মতো এমন মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরিবেশ তৈরি করেছিল।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটর সাইমুম রেজা তালুকদার বলেন, দীর্ঘকাল ধরে মানুষকে নানা নিপীড়ন, হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। তখন অনেক মানবাধিকার সংস্থা চুপ ছিল। পরে ছাত্রদের আন্দোলন ও প্রতিবাদ থেকেই রাজনৈতিক সচেতনতা ও গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। বিচার ও ন্যায়বিচার ধৈর্য, স্বচ্ছতা ও সাক্ষীর যথাযথ প্রমাণের ওপর নির্ভরশীল বলেও জানান তিনি।
গুমের শিকার ইসমাইল হোসেনের স্ত্রী নাসরিন জাহান বলেন, ‘আমি আমার স্বামীকে হারিয়েছি। এই সরকারের কাছে প্রত্যাশা ছিল সরকার অন্ততপক্ষে আমাদের কিছু করবে। আমাদের যতটা প্রত্যাশা ছিল, সে জায়গায় আমরা যেতে পারিনি। বিচারও ওভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারিনি।’
আলোচনায় অন্যদের মধ্যে অংশগ্রহণ করেন জনযোগের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম লালা, অধিকারের পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন, গণঅভ্যুত্থানে চোখ হারানো খান জসিম, তরুণদের মানবাধিকার সংগঠন অনুকূলের প্রতিনিধি জাহিদুল ইসলাম প্রমুখ।