দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসনের অবসান ঘটিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আগামী ২৫ ডিসেম্বর দেশে আসবেন বলে জানিয়েছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
শুক্রবার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠক শেষে এ তথ্য জানন তিনি। ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন তারেক রহমান।
রাতে বৈঠক শেষে এক ব্রিফিংয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, “আমাদের সংগ্রামী নেতা, এই দেশের গণমানুষের অত্যন্ত প্রিয় মানুষ, জনাব তারেক রহমান, আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, তিনি আগামী ২৫শে ডিসেম্বর, আমি আবার রিপিট করছি যে আগামী ২৫শে ডিসেম্বর তিনি ঢাকার মাটিতে আমাদের মাঝে এসে পৌঁছবেন।
“আমরা দলের পক্ষ থেকে সকলের পক্ষ থেকে আমরা তার আগমনকে শুধু স্বাগত নয়, আমরা আনন্দের সঙ্গে সমগ্র জাতিকে জানাতে চাইছি।”
২০০৭-০৮ সালের সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খালেদা জিয়ার মত তার বড় ছেলে তারেক রহমানকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি পরিবার নিয়ে লন্ডনে চলে যান, দেশে আর ফেরেননি।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে যেদিন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হল, সেদিনই বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে তারেককে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এরপর গত সাত বছর ধরে লন্ডন থেকে ভিডিও কলেই তিনি দল চালাচ্ছেন। আর দেশে ঝড়-ঝাপটা সামলে বিএনপিকে টিকিয়ে রেখেছেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল আলমগীরসহ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা।
২০২০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার খালেদা জিয়াকে নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তি দেয়। কিন্তু দুই শর্তের কারণে তিনি কার্যত বন্দি ছিলেন বাসা আর হাসপাতালের জীবনে। রাজনৈতিক কোনো কর্মকাণ্ডে তাকে আর দেখা যায়নি।
৫ অগাস্ট ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর রাষ্ট্রপতি সাজা মওকুফ করে খালেদা জিয়াকে পুরোপুরি মুক্তি দেন। পরে উচ্চ আদালতও তাকে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে খালাস দেয়।
আওয়ামী লীগের আমলে দেওয়া বিভিন্ন রায়ে তারেকেরও সাজা হয়েছিল। সেসব মামলায় তারেকও খালাস পান। তাতে তার দেশে ফেরার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।
এ বছর জানুয়ারিতে লন্ডনে গিয়ে চিকিৎসা নেন খালেদা জিয়া। সেখানে দীর্ঘদিন পর ছেলের সঙ্গে তার দেখা হয়। চিকিৎসা শেষে খালেদা জিয়া দেশে ফিরলেও তারেক ফেরেননি।
বিএনপি নেতারা বলে আসছিলেন, তাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ‘শিগগিরই’ ফিরবেন। তবে কোনো নির্দিষ্ট তারিখ তারা বলতে পারছিলেন না।
এর মধ্যে বিএনপি ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য আংশিক প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে। সেখানে জানানো হয়, বগুড়া-৬ আসনে প্রথমবারের মত ভোট করবেন তিনি। ওই ঘোষণার পর তারেকের দেশে ফেরার সম্ভাবনা জোরালো হয়।
২৩ নভেম্বর ফের অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন খালেদা জিয়া। এ অবস্থায় তারেক কেন ফিরছেন না, সেই প্রশ্ন আবার সামনে আসে।
২৯ নভেম্বর তারেক রহমানের এক বক্তব্যের পর পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়। এক ফেইসবুক পোস্টে তিনি বলেন, “এমন সঙ্কটকালে মায়ের স্নেহ স্পর্শ পাবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা যে কোনো সন্তানের মত আমারও রয়েছে। কিন্তু অন্য আর সকলের মত এটা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমার একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ অবারিত ও একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়।”
তারেক রহমানের দেশে ফিরতে বাধা কোথায়, সেই প্রশ্ন তখন জোরেশোরে উঠতে থাকে। তিনি লন্ডনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন কি না, সেখানে তার ‘স্ট্যাটাস’ কী, সেসব প্রশ্নও তোলেন কেউ কেউ।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারেক রহমানের পাসপোর্ট নেই, তবে তিনি চাইলেই ট্র্যাভেল পাসের ব্যবস্থা করা হবে।
সেরকম কোনো আবেদন তিনি তখন করেননি। তার বদলে অসুস্থ মাকে তিনি লন্ডনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে চিকিৎসকরাও অনুমতি দেন। কিন্তু গোল বাধে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে। তারপর খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে তার লন্ডনযাত্রা অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে যায়।
খালেদা জিয়া এখনো হাসপাতালেই আছেন। এর মধ্যে দেশে এসেছেন তারেকের স্ত্রী জুবায়দা রহমান। এবার তারেক রহমানের ফেরার তারিখ জানালেন মির্জা ফখরুল।
শুক্রবার রাতের প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, “আজকে গণতন্ত্রের পথে যে বাধাগুলো সৃষ্টি হয়েছে, আমরা মনে করি তারেক রহমান সাহেবে দেশে এসে পৌঁছালে সমস্ত বাধা দূর হয়ে যাবে।”
গত মে মাসে লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকের প্রসঙ্গ ধরে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “সেই সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ফলে আমাদের নির্বাচন সম্পর্কে যতটুকু শঙ্কা ছিল, সেটা চলে গিয়েছিল।
“গতকাল নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে নির্বাচনের যে রেল চলতে শুরু করেছে, সারা দেশের মানুষের মধ্যে আশা-প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছে সেটা বাস্তবায়িত হতে চলেছে।”
‘হাদি হত্যাচেষ্টা প্রসঙ্গে’
শুক্রবার দুপুরে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফ ওসমান বিন হাদিকে গুলির ঘটনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটি নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে জানিয়ে ফখরুল বলেন, “এই ঘটনায় এটাই প্রমাণিত হয় যে, সব অপশক্তি নির্বাচনকে বানচাল করার জন্য যারা কাজ করছে, তাদেরই একটা চক্রান্ত।”
হাদির ওপর হামলাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করার দাবি জানান বিএনপি মহাসচিব।
‘এমসিতে ‘একটি দলের আচরণ’ নিয়ে ক্ষোভ
গুলিবিদ্ধ হাদিকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার পর তাকে দেখতে সেখানে গিয়ে তোপের মুখে পড়েন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। ঢাকার একই আসন থেকে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার কথা রয়েছে তাদের। আব্বাসকে দেখে ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দেন ইনকিলাব মঞ্চের কর্মীরা।
সে প্রসঙ্গ ধরে ফখরুল ব্রিফিংয়ে বলেন, “এটা না বলে পারছি না, আমাদের স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য বিএনপির দীর্ঘকালের নেতা মির্জা আব্বাস সাহেব ঢাকা-৮ আসনের একজন প্রার্থী। শরীফ ওসমান বিন হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শুনে তিনি স্বাভাবিকভাবে একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে সহানুভূতি জানাতে সাথে সাথে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটি গিয়েছিলেন।”
“কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেই দলের কিছু ব্যক্তি ও সমর্থক ও আরো কিছু চক্রান্তকারী তারা সেখানে সমবেত হয়ে উত্তেজনামূলক স্লোগান দেয় এবং এক পর্যায়ে তারা মব সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। সেটার আমরা তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং হুঁশিয়ার করে দিতে চাই সকল পক্ষকে, এই ধরনের আচরণ করতে গেলে বিএনপি বসে থাকবে না, বিএনপি তার জবাব সাথে সাথে দেবে।”
ফখরুল বলেন, “আমরা খুব স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমরা কোনো রকমের গোলযোগ ও কোনো সন্ত্রাস চাই না। কিন্তু বিএনপির ওপরে আঘাত এলে আমরা সেটা সহজভাবে নেব না। কীভাবে জবাব দিতে হয় সেটা বিএনপি জানে।
“আমি তাই বলব, সেই সমস্ত মব সৃষ্টি না করে উত্তেজনা সৃষ্টি না করে, নির্বাচনের পরিবেশ বিনষ্ট না করে সবার যেন সংবিত ফিরে আসে, কীভাবে নির্বাচনটা সুষ্ঠু হবে, সেই কাজটা চেষ্টা করে। নইলে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ ব্যাহত হবে, গণতন্ত্রের যাত্রাপথ ব্যাহত হবে। আমি সকল মহলকে বলব, এ বিষয়টা গুরুত্ব সহকারে দেখেন।”