ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফ ওসমান বিন হাদির ওপর হামলাকে একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দেখছে দেশের তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দল। তাদের মতে, এই হামলার লক্ষ্য হচ্ছে জুলাই অভ্যুত্থানকে নস্যাৎ করা এবং আসন্ন নির্বাচন ভণ্ডুল করা। এ ধরনের সব প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছে দলগুলো।
শনিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর শীর্ষ নেতারা এসব মতামত তুলে ধরেন। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে জানানো হয়, বৈঠকে রাজনৈতিক ঐক্য অটুট রাখার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ওসমান হাদির ওপর হামলা ছিল ‘পূর্ব-পরিকল্পিত ও গভীর ষড়যন্ত্রের’ অংশ, যার পেছনে একটি ‘বিরাট শক্তি’ সক্রিয় রয়েছে। তাঁর ভাষায়, ষড়যন্ত্রকারীদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করা। তিনি বলেন, “এই আক্রমণটি খুবই সিম্বলিক। তারা তাদের শক্তি প্রদর্শন করতে চায় এবং নির্বাচনের সব আয়োজন ভেস্তে দিতে চায়। এসব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।”
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করেছে এবং প্রশিক্ষিত শ্যুটার মাঠে নামিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সবাইকে সতর্ক ও সংযত থাকার আহ্বান জানান তিনি।
বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যই সবচেয়ে জরুরি। তিনি বলেন, “কোনো অবস্থাতেই আমাদের পরস্পরের দোষারোপে জড়ানো উচিত নয়। ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে আওয়াজ তুলতে হবে এবং কোনো অপশক্তিকে বরদাস্ত করা হবে না।”
তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক বক্তব্যে ভিন্নতা থাকলেও জাতির স্বার্থে এবং জুলাই অভ্যুত্থানের স্বার্থে সবাইকে এক কাতারে থাকতে হবে। একই সঙ্গে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান জোরদার এবং ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
জামায়াতে ইসলামীর নেতা গোলাম পরওয়ার বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একে অপরকে দোষারোপ করার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় বিরোধীরা সুযোগ নিচ্ছে। তিনি বলেন, “আমাদের আগের মতোই ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থে আমরা একে অন্যকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলছি। এতে জাতি বিভক্ত হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, সব রাজনৈতিক দলকে তাদের অঙ্গীকার ও দায়িত্ববোধ নতুন করে পর্যালোচনা করতে হবে।
এনসিপির প্রধান নাহিদ ইসলাম বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকেই একটি গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে এই অভ্যুত্থানকে খাটো করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তাঁর মতে, সুসংগঠিতভাবে জুলাইয়ের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন চলছে, যা মিডিয়া ও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে বিস্তৃত। তিনি সতর্ক করে বলেন, নির্বাচনের পর যারা ক্ষমতায় আসবে, তারাও এর ভুক্তভোগী হবে এবং কেউ একা সরকার পরিচালনা করতে পারবে না।
গণঅভ্যুত্থানের সামনের সারির নেতা নাহিদ ইসলাম বলেন, মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন একটি ন্যারেটিভ তৈরি করা হচ্ছে যেন জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীরা অপরাধ করেছে। তিনি অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিকে ‘নরমালাইজ’ করার নানা চেষ্টা চলছে—টিভি টকশোতে অংশগ্রহণ, প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে বৈঠক, বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ এবং আদালত প্রাঙ্গণে স্লোগানের মাধ্যমে।
নিজেদের জন্য আলাদা কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রয়োজন নেই উল্লেখ করে এনসিপি আহ্বায়ক বলেন, “আমরা এটা নেব না। জুলাইকে সবাই মিলে ‘ওউন’ করতে হবে। জুলাইকে নিয়ে কে কী বলবে—এই টানাপোড়েনে আমরা নিজেরাই জুলাইকে শেষ করে দিচ্ছি।”
তিনি আরও বলেন, “ষড়যন্ত্রকারীরা আমাদের অনৈক্যকে আমাদের পরাজয় হিসেবে দেখছে। তারা ভারতে বসে যা ইচ্ছা তা করছে, আর আমরা বিভক্ত হয়ে পড়ছি।”
নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মীর ছদ্মবেশে যারা আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কাজ করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরা ঐক্যবদ্ধ না থাকলে কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থাই কার্যকর হবে না। তিনি বলেন, রাজনৈতিক স্বার্থে দলগুলো নানা সময়ে আওয়ামী লীগকে সুযোগ করে দিচ্ছে, যা ভবিষ্যতের জন্য বিপজ্জনক।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ভবিষ্যতের জন্য সবাইকে চিন্তা করতে হবে—কীভাবে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা যায়। তিনি জোর দিয়ে বলেন, নিজেদের মধ্যে যেন দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকবে, কিন্তু কাউকে শত্রু ভাবা বা আক্রমণ করার সংস্কৃতি থেকে সরে আসতে হবে।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের সময় উত্তেজনা সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক, তবে তা যেন একটি নির্দিষ্ট মাত্রার মধ্যে নিয়ন্ত্রণে থাকে।
আসিফ নজরুল বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে হানাহানি শুরু হওয়ার পর থেকেই আওয়ামী লীগ শক্তিশালী হয়েছে। তিনি দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান, শুধু দলীয় স্বার্থ নয়, জাতীয় স্বার্থের বিষয়েও সজাগ থাকতে।
বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ওসমান হাদির ওপর হামলার প্রতিবাদে ইনকিলাব মঞ্চের উদ্যোগে একটি সর্বদলীয় প্রতিবাদ সভা আয়োজন করা হবে। আগামী দু-একদিনের মধ্যেই এই সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক ঐক্যে যাতে কোনো ফাটল না ধরে, সে জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয় বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির নেতারা। একই সঙ্গে নির্বাচনের আগে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে কঠোর অভিযান পরিচালনার দাবিও উঠে আসে বৈঠকে।
বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের এবং ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যসচিব আবদুল্লাহ আল জাবের।
আন্তর্জাতিক: ট্রাম্পের সঙ্গে বিরোধে মাদুরোর পাশে নেই শি-পুতিন
অর্থ-বাণিজ্য: শেয়ারবাজারে মূলধন বাড়লো আড়াই হাজার কোটি টাকা