ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফ ওসমান বিন হাদিকে গুলি করে হত্যা চেষ্টার মামলায় সন্দেহভাজন ফয়সাল করিম মাসুদের স্ত্রী সাহেদা পারভীন সামিয়া, শ্যালক ওয়াহিদ আহমেদ শিপু ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু মারিয়া আক্তার লিমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ দিনের রিমান্ড দিয়েছে আদালত।
দুই দিন পর পল্টন থানায় হত্যা চেষ্টার মামলা ডিবিতে
তদন্ত কর্মকর্তার ৭ দিনের রিমান্ড আবেদনের শুনানি নিয়ে সোমবার, (১৫ ডিসেম্বর ২০২৫) সন্ধ্যায় ঢাকার অ্যাডিশনাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জশিতা ইসলামের আদালত এ আদেশ দেন।
প্রসিকিউশন বিভাগের এসআই রুকনুজ্জামান তাদের ৫ দিন করে রিমান্ডে দেয়ার তথ্য দেন। র্যাব তাদের তিনজনকে আটক করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। পরে এই তিনজনকে হাদিকে হত্যা চেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। আদালতে রিমান্ডের আবেদনে গতকাল রোববার রাত আড়াইটার দিকে নরসিংদীর সদর থানা এলাকা থেকে সামিয়া ও সিপুকে এবং সোমবার, ভোর পৌনে ৫টার দিকে মারিয়াকে ঢাকার বাড্ডা এলাকা থেকে গ্রেপ্তারের কথা বলা হয়েছে।
সোমবার, সন্ধ্যায় তাদের আদালতে হাজির করে ৭ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের মতিঝিল জোনাল টিমের পরিদর্শক ফয়সাল আহমেদ। রাষ্ট্রপক্ষে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী রিমান্ডের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। তবে আসামিদের পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না।
দুই দিন পর পল্টন থানায়
হত্যা চেষ্টা মামলা
গত শুক্রবার হাদিকে গুলির ঘটনার দুই দিন পর গতকাল রোববার রাতে পরিবারের সম্মতি নিয়ে পল্টন থানায় হত্যা চেষ্টা মামলাটি করেন ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আল জাবের। পরে মামলাটির তদন্তের ভার গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সন্দেহভাজন ফয়সালের স্ত্রী, শ্যালক ও বন্ধুকে গ্রেপ্তারের পর র্যাব জানিয়েছিল, শুক্রবার (গত) হাদিকে গুলির আগে ও পরে এই তিনজনের সঙ্গে ফয়সালের ঘনঘন ফোনে কথা বলার তথ্য পেয়েছেন তারা। তাদের তিনজনসহ হাদিকে হত্যা চেষ্টার ঘটনায় ছয়জনকে গ্রেপ্তারের তথ্য দিয়েছে পুলিশ।
ফয়সালের স্ত্রী, শ্যালক ও বন্ধুকে গ্রেপ্তারের আগে হাদিকে গুলির সময় ব্যবহার করা মোটরসাইকেলের মালিক আব্দুল হান্নানকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরে হান্নানকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। অন্যদিকে হাদিকে গুলিবর্ষণকারীদের পালানো ঠেকাতে সীমান্তে কঠোর নজরদারির মধ্যে শেরপুরের নালিতাবাড়ী এলাকা থেকে দুইজনকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ।
হত্যা চেষ্টার মামলা ডিবির হাতে
পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বলেন, ‘রোববার (গত) রাতে দায়ের হওয়া মামলাটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সোমবার, ডিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এখন থেকে গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করবে। তাদের নথিপত্র বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।’ এ মামলায় আসামি হিসেবে শুধু ফয়সাল করিম মাসুদের নাম রয়েছে। তবে যে মোটরসাইকেল থেকে এই হত্যাচেষ্টা হয়, সেই মোটরসাইকেলের চালক আলমগীরকে গোয়েন্দা পুলিশ শনাক্তের দাবি করলেও আসামি করা হয়নি। এর আগে উপ-কমিশনার সকালে বলেছিলেন, হাদির পরিবারের সম্মতি নিয়ে পল্টন থানায় রোববার (গত) রাতে হত্যা চেষ্টা মামলাটি করেন ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আল জাবের। এরই মধ্যে ফয়সাল ও তার তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাপল সফট আইটি লিমিটেড’র সব ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)।
আদালতে যা বললেন ফয়সালের স্ত্রী, শ্যালক ও বন্ধু
হাদির ওপর হামলার বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন মূল সন্দেহভাজন ফয়সাল করিম মাসুদের স্ত্রী, শ্যালক ও ‘বন্ধু’। ঢাকার অ্যাডিশনাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জশিতা ইসলামের আদালতে তারা হত্যা চেষ্টায় নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেন। এদিন তাদের প্রত্যেকের ৭ দিন করে রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের মতিঝিল জোনাল টিমের পরিদর্শক ফয়সাল আহমেদ। সেখানে রাষ্ট্রপক্ষে রিমান্ডের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী।
তিনি বলেন ‘হাদি জুলাই আন্দোলনের বীর সৈনিক। ঢাকার একটি আসনের সংসদ সদস্য প্রার্থী ছিলেন। ছাত্রলীগের কাছে থেকে দীর্ঘদিন পরিকল্পনার পর ফয়সাল করিম মাসুদ এ ঘটনা ঘটিয়েছে। সরকার তাকে ধরতে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে।’ রাষ্ট্রপক্ষের এ আইনজীবী বলেন, ‘এ তিনজন তদন্তপ্রাপ্ত আসামি। তারা একইসঙ্গে, একই ঘরে ছিল। এরপর বের হয়ে যায়। এত বড় ঘটনা। হাদি বাঁচবে কিনা জানি না। স্বাধীন, সার্বভৌম দেশকে ধ্বংসের প্রক্রিয়া চলছে। তাদের ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুরের প্রার্থনা করছি।’
এরপর বিচারক জানতে চান, আসামিপক্ষের কোনো আইনজীবী আছেন কিনা। তবে আসামিপক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না। এরপর বিচারক জানতে চান, তাদের কিছু বলার আছে কিনা। তখন ফয়সালের স্ত্রী সাহেদা পারভীন বলেন, ‘ঘটনার বিষয়ে কিছু জানি না। ঘটনার ২-৩ দিন আগে আমার সঙ্গে দেখা হয়। এরপর আর দেখা হয়নি। ঘটনার দিন কথা হয়। এরপর থেকে আমাদের সঙ্গে কথা বলেনি। আমাদের সঙ্গে সে থাকে না। অনেক রাতে যেত, আবার ভোরে চলে আসত। একথা বারবার বলে আসছি।’ ফয়সালের শ্যালক শিপু বলেন, ‘আমি ঘটনার বিষয়ে কিছু জানি না।’ ফয়সাল করিম মাসুদের বন্ধু মারিয়া আক্তারের পরিচয় জানতে চান আদালত। তখন মারিয়া বলেন, ‘সে আমার বন্ধু। ফেইসবুকে পরিচয়। এসব বিষয়ে কোনো কথা হয়নি। আর্থিক সমস্যার কারণে কিছু টাকা দিবে বলে জানায়।’ এরপর স্ত্রী সাহেদা পারভীন আদালতকে বলেন, ‘আমার দুই বছরের একটা বাচ্চা আছে। এর বাইরে যা যা তথ্য দেয়ার, দিয়েছি। আর আমাদের হয়ে কেউ কথা বলবে, বাবার বাড়িতে এমন কেউ নাই।’ পরে আদালত থেকে তাদের ৫ দিনের রিমান্ডের আদেশ আসে। এদিকে হাদিকে গুলি সময় ব্যবহার করা মোটরসাইকেলের মালিক আব্দুল হান্নানকে গতকাল রোববার ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
গত শুক্রবার রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন জুলাই গণঅভ্যুত্থান এবং আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পরিচিতি পাওয়া হাদি। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। গত শুক্রবার গণসংযোগের জন্য বিজয়নগর এলাকায় গিয়ে তিনি আক্রান্ত হন। চলন্ত রিকশায় থাকা তাকে গুলি করেন চলন্ত মোটরসাইকেলের পেছনে বসে থাকা আততায়ী। গুলিটি লাগে হাদির মাথায়। গুরুতর আহত হাদিকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে অস্ত্রোপচার করার পর রাতেই তাকে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে নেয়া হয়। তার অবস্থা ‘অত্যন্ত আশঙ্কাজনক’ বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। সোমবার, তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুর নেয়া হয়েছে।