image
বিজয় দিবস উপলক্ষে রাজধানীতে আলোকসজ্জা। ছবি: ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের কার্জন হল -সংবাদ

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১: বিজয় দিনের কথা যোদ্ধাদের মুখে

সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫
সংবাদ অনলাইন রিপোর্ট

বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ড এবং বাঙালি জাতি হাজার বছর ধরে পরাধীন জীবন-যাপন করার পর একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের স্বাদ পেয়েছিল। মঙ্গলবার সেই বিজয়ের দিন।

ইতিহাসের পথ বেয়ে নানা জাতি-গোষ্ঠীর নির্যাতন নিস্পেষণে হাজার বছর পেরিয়ে ১৭৫৭ সালে বাংলা নামের এ দেশ চলে যায় ব্র্রিটিশ শাসনের কবলে। তারপর দীর্ঘ প্রায় ২শ’ বছর কেটে যায় ব্রিটিশ শাসন-শোষণের যাতাকলে। ব্রিটিশ শাসনের পর পাকিস্তানি শাসন-নির্যাতনে কাটে আরও ২৪ বছর। এরপরই জেগে ওঠে নির্যাতিত বাঙালি জাতি, শোষিত বাংলার সাধারণ মানুষ।

বাঙালি জাতির অবিস্মরণীয় নেতা মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতাদের নেতৃত্বে দীর্ঘ সংগ্রামের পর বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানি বিজাতীয় শাসক-শোষকের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তি সংগ্রামে। একাত্তরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করে বাঙালি জাতির বীর সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের পরাজিত করে ছিনিয়ে আনে বিজয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। সূর্য প্রায় ডুবি-ডুবি। যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর ঢাকা তখন থমথমে। শহরের আশপাশে কোথাও থেমে-থেমে যুদ্ধও চলছিল, এমনকি শহরের প্রাণকেন্দ্রেও চলছিল বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ। এমন পরিবেশের মধ্যেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৫টা ২৫ মিনিটে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান) ‘ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের অধিনায়ক জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজি।

এরপরই মুক্তিযোদ্ধারা শহরের পথে-পথে আকাশে রাইফেলের ফাঁকা গুলিতে প্রকম্পিত করে স্লোগান তোলেন- ‘জয় বাংলা’। সন্ধ্যার পর থেকেই থমথমে ঢাকা তখন বিজয় উৎসবের নগরী। নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিবাদে বেরিয়ে আসে পথে। রাতভর বিজয়ের আনন্দের আলো জ্বলে নির্ঘুম ঢাকা নগরীর ঘরে-ঘরে।

কেমন ছিল ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার চিত্র? বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত প্রত্যক্ষদর্শী তিনজন মুক্তিযোদ্ধার কথায়, আর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক নানা গ্রন্থে পাওয়া যায় সেই ১৬ ডিসেম্বরের অনেক কথা, অনেক বিবরণ।

সেদিন বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই সড়কে তরুণ-যুবা আর উৎসুক মানুষের ভিড় লেগে ছিল। সকাল সাড়ে ১০টার পর সাভার-মিরপুর সড়ক দিয়ে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী বিপুল করতালি, আর জয়বাংলা জয়োচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করেন। পথে-পথে মুক্তিকামী মানুষ মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর বিজয় উদযাপনের প্রধান সঙ্গী। একদিকে পারস্পরিক জয়োচ্ছ্বাস, অন্যদিকে হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করানোর প্রস্তুতি।

যৌথ বাহিনীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আত্মসমর্পণের দায়িত্বে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের ইস্টার্ন আর্মির চিফ অব স্টাফ লে. জে. জে এফ আর জ্যাকব। ভারত থেকে যশোরে হেলিকপ্টার পরিবর্তন করে ঢাকা বিমানবন্দরে আসেন তিনি। সেখান থেকে তিনি, ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকী, কর্নেল এম এস খারা দুপুর একটা নাগাদ পাকিস্তানি আর্মির হেডকোয়ার্টারে পৌঁছান। এরপর আত্মসমর্পণের আনুষঙ্গিক কার্যক্রম গোছাতে শুরু করেন জেকব।

জে এফ আর জ্যাকব তার ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা’ গ্রন্থে বলেছেন এসব কথা। নিয়াজির অফিসে ফিরে এলে কর্নেল খারা আত্মসমপর্ণের শর্তাবলী পাঠ করে শোনান তিনি। নিয়াজির চোখ থেকে দরদর করে পানি পড়তে থাকে, সেই সঙ্গে ঘরে নেমে আসে পিনপতন নিস্তব্ধতা।

ডিসেম্বরের শুরু থেকে ঢাকার ইস্কাটনে আত্মগোপনে ছিলেন ছাত্র রাজনীতিক ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। তিনি ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা। ১৬ ডিসেম্বর সকালেই আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে টুকু বলেন, ‘পাকিস্তানিরা গুটিয়ে যাচ্ছে, রাস্তা খালি হয়ে যাচ্ছে, আর আমাদের বাঙালি সাধারণ মানুষও রাস্তায় উঁকিঝুঁকি করছে। চারদিকে থমথমে ভাব, আমার যতদূর মনে পড়ে কারফিউ দিয়েছিল ওরা। তারপর যখন ঘোষণা হলো- রেসকোর্সে আত্মসমর্পণ হবে, তখন মানুষ একবারে স্রোতের মতো বের হয়ে আসছে।’

রণাঙ্গণের খবরাখবর নিয়ে ‘পূর্ববাংলা’ নামে একটি পত্রিকা বের করতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও মাহফুজ উল্লাহ (প্রয়াত সাংবাদিক)। তখনকার পরিবেশের কথা উল্লেখ করে ইকবাল হাসান প্রকাশিত এক লেখায় বলেন, ‘আত্মগোপন থেকে বের হয়ে দেখি মুক্তিযোদ্ধারা শহরে ঢুকতেছে যারা ফিল্ডে ছিল। যারা ঢুকছে- কৃষক, সাধারণ মানুষের সন্তানদেরই দেখলাম। যুদ্ধে কৃষক শ্রমিক এরাই ছিল বেশি।’

১৬ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় মেজর জেনারেল নাগরার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী সাভার-মিরপুর সড়ক দিয়ে বিপুল করতালি ও মুহুর্মুহু জয় বাংলা ধ্বনির মধ্য দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করে। জেনারেল নাগরার সঙ্গে ছিল মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন গ্রুপ-দল।

এর আগে সকাল ৮.৩০ মিনিটে জেনারেল নাগরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় নায়ক জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজির কাছে একটি চিঠি পাঠান। এতে দ্রুত পাকিস্তানি বাহিনীকে ঢাকায় আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দেয়া হয়। সেদিন ক্যান্টনমেন্টের দিকে ফেরার সময় পাকিস্তানি একাধিক আর্মি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে উপস্থিত জনতার ওপরে গুলি ছোঁড়ে।

ইকবাল হাসানের ভাষ্য, ‘পাকিস্তানি বাহিনীর একজন গুলি করা শুরু করে দিলো। ওর কাছে অস্ত্র লুকানো ছিল বোধহয়। তারপর ইন্ডিয়ান সৈনিকরা ৩-৪ জনকে গুলি করে মেরে ফেললো, আর আমাদের সিভিলিয়ান দুজন মারা গেল।’

‘আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার লোকজন ও বিশ্ব মিডিয়ার উপস্থিতির কারণে শাহবাগের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের দিকে মুক্তিবাহিনীর অনেকের আগ্রহ ছিল। ছবি উঠলে বিশ্ব মিডিয়ায় প্রকাশ হবে, এই আগ্রহে অনেকেই হোটেলে যাতায়াত করে।’ জানান ইকবাল হাসান মাহমুদ।

‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা’ গ্রন্থে জে এফ আর জ্যাকব আত্মসমর্পণ প্রসঙ্গে লিখছেন, ‘গার্ড অব অনার পরিদর্শনের পর অরোরা ও নিয়াজি টেবিলের দিকে এগিয়ে যান। অরোরার নিয়ে আসা আত্মসমর্পণের দলিল টেবিলের ওপরে রাখা হয়। নিয়াজি সেটার ওপরে কৌতূহলী চোখ বুলিয়ে নিয়ে সই করেন। অরোরাও সই করেন। ... ঘড়ির দিকে চোখ (ভারতীয় সময়) ফেলে দেখি, সময় বিকেল চারটা ৫৫ মিনিট। এরপর নিয়াজি তার কাঁধ থেকে অ্যাপলেট (সেনা অধিনায়কদের সম্মানসূচক ব্যাজ) খুলে ফেলেন এবং ল্যানিয়াড (ছোট দড়ি বিশেষ)’সহ পয়েন্ট ৩৮ রিভলভার অরোরার হাতে ন্যস্ত করেন। তার চোখে অশ্রু দেখা যাচ্ছে, সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত জনতা তখন নিয়াজিবিরোধী ও পাকিস্তানবিরোধী স্লোগান ও গালিগালাজ দিতে থাকে।’

পুরান ঢাকার বাসিন্দা আনোয়ারুল আলীম, ওষুধের ব্যবসা করতেন এক সময়। তখন থাকতেন পুরান ঢাকার মিডফোর্ড এলাকায়।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের পর রাতভর পুরান ঢাকায় বিজয়োল্লাসের সাক্ষী হয়েছিলেন তখনকার বিএ পরীক্ষার্থী আনোয়ারুল আলীম। তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানান, ‘ওই রাতে বাঙালি পরিবার সবাই জানালা খুলে রেখেছিল। ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিয়েছিল। রাস্তায় আলো নেই। ঘরের আলোয় রাস্তা আলোকিত ছিল।’ বলেন, ‘যাদের জানালা বন্ধ, তারা বাংলাদেশের পক্ষে না, এমনটাই সবার ধারণা ছিল।’

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ শুরুর পর শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের প্রতিরোধ যুদ্ধ। ঢাকায় যারা ছিলেন, সেই যুদ্ধের প্রায় পুরোটা সময় তাদের এক ধরনের বন্দীদশায় থাকতে হয়েছিল।

আনোয়ারুল আলীম বলেন, ‘আগের তিন দিন ছিল কারফিউ, শহরে ব্ল্যাকআউট। ১৫ ডিসেম্বর সম্ভবত আকাশবাণীতে শুনেছিলাম যে, সারেন্ডার হতে পারে। রেডিও তখন আস্তে শুনতে হত, গোপনে। আকাশবাণী আর মাঝে মধ্যে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র।’

পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করছে- চাইলেও ঘরে থেকে এমন কথা বিশ্বাস করতে বিশ্বাস হতে চাইছিল না আলীমের।

‘সারেন্ডারের খবর প্রথমে বিশ্বাস করিনি। যতক্ষণ না হয়, মানুষের মধ্যে বিশ্বাস আসেনি। তবে পরদিন মানে ১৬ ডিসেম্বর, আমার পরিষ্কার মনে আছে, ছাদে বসে আছি, বেলা ১১-১২টার দিকে হবে হয়তো, দেখলাম আকাশে ৩-৪টা ভারতীয় হেলিকপ্টার। আমার বাসা তখন মিডফোর্ড হাসপাতালের উল্টোদিকে। ওই হেলিকপ্টার দেখে মনে হলো- সারেন্ডার হতে চলেছে। পরে বন্ধুদের খোঁজ নেয়া শুরু করলাম।’

বন্ধুদের নিয়ে তখন রেসকোর্সের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন আলীম, যেখানে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যের আত্মসমর্পণের মঞ্চ ততক্ষণে প্রস্তত।

‘হাঁটতে হাঁটতে বন্ধুদের সঙ্গে আমিও রেসকোর্সে গিয়েছিলাম। যখন পৌঁছেছিলাম তখন সারেন্ডারের আনুষ্ঠানিকতা শেষ। তবুও প্রচুর মানুষ তখন রেসকোর্সে। সবাই উল্লাস করছে, স্লোগান দিচ্ছে। সারারাত মহল্লায় মহল্লায় উল্লাস। এখনও চোখের সামনে ভাসে।’

রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আখাউড়া থেকে এসেছিলেন মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ। বাংলাদেশের বিজয়ের সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন- মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার এস ফোর্সের অধিনায়ক কে এস সফিউল্লাহ।

সেদিনে ঢাকার অবস্থা নিয়ে সফিউল্লাহ বলেন, ‘এয়ারপোর্ট থেকে রেসকোর্স পর্যন্ত খুব বেশি মানুষ ছিল না। যখন আমরা নিয়াজিকে নিয়ে যাই তখন রেসকোর্সেও খুব মানুষ ছিল না। আত্মসমর্পণের পরে প্রচুর মানুষ রাস্তায় নামে। মিছিল করে।’

তিনি বলেন, ‘আমার শেষ যুদ্ধ হয়েছিল আখাউড়াতে। ওখানে পাকিস্তানের একটি ব্রিগেডকে পরাজিত করার পর ভারতীয় একটি ব্রিগেড আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়। আমি সিলেট হাইওয়ে ধরে আশুগঞ্জ যাই। আর ইন্ডিয়ান ব্রিগেড রেললাইন ধরে এগোয়। ১০ ডিসেম্বর আমরা নরসিংদীর রায়পুরা থেকে ঢাকার দিকে রওনা দেই। ১১ তারিখ আমরা ডেমরা পৌঁছাই। নদীর এ পার থেকে আমরা গুলি চালিয়েছিলাম। ডেমরা ঘাটে যুদ্ধ হয়।’

পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সারেন্ডার ফাইনাল হওয়ার পরপর আমাকে বলা হয়, আমি যেন জেনারেল নিয়াজিকে এয়ারপোর্ট থেকে রেসকোর্স নিয়ে যাই। আমার কাছে গাড়ি নেই। এতদিন তো পায়ে হেঁটে চলছি। ডেমরায় পাকিস্তানের যে ব্যাটালিয়ন আমার কাছে সারেন্ডার করে, সেটার কমান্ডারকে তার গাড়ি নিয়ে আসতে বললাম। ওই গাড়ি নিয়ে আমি এয়ারপোর্ট যাই। নিয়াজিকে নিয়ে আমি ঢাকা ক্লাবের উল্টোদিকে রেসকোর্সে যাই। আত্মসমর্পণ যেখানে হলো, সেখানে আমি দাঁড়ানো ছিলাম। নিয়াজি সিগনেচার করলো। জেনারেল অরোরা সই করার সময় তার নামটা ঠিক লেখেননি। আমি তখন তাকে বললাম, তার নাম ঠিক নাই। তারপর তিনি আবার সাইন করেন।’

এক সাক্ষাৎকারে জ্যাকব নিয়াজির আত্মসমর্পণ সম্পর্কে বলেন, “এরপর দেখি তার চোখে জল। আমি সেদিকে করুণাভরে তাকিয়ে ভাবলাম, এই লোকটা বাংলাদেশের মানুষকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। আপনারা জানেন, তার সেনাবাহিনী কী করেছে, তাই নতুন করে তা বলার নেই। এজন্য আমি তাকে ঢাকাবাসীর সামনে আত্মসমর্পণ করানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। নিয়াজী আবারও বললেন, তিনি তার সদর দপ্তরে আত্মসমর্পণ করবেন। আমি বললাম, ‘না’ আপনাকে রেসকোর্স ময়দানে ঢাকাবাসীর সামনে আত্মসমর্পণ করতে হবে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি নিয়মিত বাহিনীর প্রকাশ্য আত্মসমর্পণই শুধু নয়, আমি তাদের গার্ড অব অনার দিতেও বাধ্য করলাম।”

আত্মসমর্পণে আর দুয়েকদিন দেরি হলেই জাতিসংঘ তাদের যুদ্ধবিরতি আদেশ কার্যকর করত বলে শঙ্কা ছিল জ্যাকবের।

তার ‘সারেন্ডোর অ্যাট ঢাকা: বার্থ অব অ্যা নেশন’ বইয়ের তথ্যানুযায়ী, নিয়াজির অফিসে যখন আত্মসমর্পণের দলিলের খসড়া পড়ে শোনানো হয়, তখন সেখানে পিনপতন নিঃস্তব্ধতা। নিয়াজি কাঁদছিলেন। রাও ফরমান আলি ‘ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ’ কথাটিতে আপত্তি জানান। নিয়াজি বলেন, খসড়ায় তো নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের কথা বলা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত নিয়াজি খসড়া মেনে নেন।

সেই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন উপ প্রধান সেনাপতি এ কে খন্দকার। ২০১৩ সালে এক স্মৃতিচারণমূলক নিবন্ধে এ কে খন্দকার লেখেন, ‘আমি তখন কোলকাতায়। ১৬ ডিসেম্বর সকালের দিকে কিছু কাজে বাইরে গেছিলাম। ফিরলাম সকাল দশটার দিকে। ফিরে দেখি আমার জন্য কিছু লোক অপেক্ষা করছেন। তাদের কাছেই জানলাম পাকিস্তানি বাহিনী সেদিন বিকেলে যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। সেজন্য ঢাকার রেসকোর্সে একটি ছোট্ট অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান হবে। আর আমাকে সে অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ও মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করতে হবে।’

রেসকোর্স ময়দানে আনন্দ-উল্লাস আর ভিড়ের মধ্যে সেই অনুষ্ঠান আয়োজন নিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘সামান্য একটু জায়গা ফাঁকা রাখা ছিল, সেখানে একটি টেবিল পাতা। সামনেই ঢাকা ক্লাব, সেখান থেকে দুটো চেয়ার এনে বসার ব্যবস্থা করা গেল। বসলেন ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে জেনারেল অরোরা এবং পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে জেনারেল নিয়াজী। তারপর আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করলেন দুজনে।’

এ কে খন্দকার লিখেছেন, “স্বাক্ষরের পরপরই পাকিস্তানি অফিসারদের ওখান থেকে সরিয়ে নেয়া হলো। কারণ আত্মসমর্পণ করেছে বলে পাক সেনা অফিসারদের নিরাপত্তার দায়িত্বভার আমাদের ওপরই বর্তে গেছে। ওদিকে আশপাশে ঘিরে থাকা হাজার মানুষ উল্লাসে মুখর হয়ে উঠলেন। অনেকেই এগিয়ে এসে আমাদের জড়িয়ে ধরলেন। কাঁদছিলেন প্রায় সবাই। কাঁদতে কাঁদতে তারা বললেন, ‘আজ থেকে আমরা শান্তিতে ঘুমাবো’।”

‘জাতীয়’ : আরও খবর

সম্প্রতি