১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বিকেলটি একটু শীতের। হালকা কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। দিনের তাপমাত্রা আবহাওয়া অফিসের গণনায় ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেও রমনার খোলা রেসকোর্স ময়দানের উত্তাপ অনেক বেশি। একটি বট গাছের নিচে অনাড়ম্বর আয়োজন। আত্মসমপর্ণের দলিলে সইয়ের জন্য দরকার পড়ে টেবিল-চেয়ারের। তাৎক্ষণিক একটি টেবিল এবং দুটি চেয়ার আনা হয় পাশের ঢাকা ক্লাব থেকে। এমনি করে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে যায় ৩৫ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য ও ২৯ সেন্টিমাটার উচ্চতার সাধারণ সেই টেবিলটি। বর্তমানে যা শোভা পাচ্ছে জাতীয় জাদুঘরে। ওই সময় ঢাকা ক্লাবে ব্যবহৃত টেবিলের সঙ্গে এই টেবিলটির মিলও খুঁজে পাওয়া যায়।
১৪ ডিসেম্বর। মিত্রবাহিনীর বোমা হামলায় বর্তমান বঙ্গভবন তৎকালীন গভর্নর হাউজ বিধ্বস্ত হয়। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে যায় পাকিস্তানের পোষ্য গভর্নর মালেকের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিপরিষদ। পদত্যাগ করে নিরাপদ জোন শাহবাগের ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে আশ্রয় নেয়।
ডিসেম্বরের শুরু থেকেই দৃশ্যপট দ্রুত পাল্টে যেতে থাকে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একে একে পতন ঘটতে থাকে পাকিস্তান বাহিনীর। মুক্তিযোদ্ধারা একে একে ঘোষণা করতে থাকেন মুক্তাঞ্চল।
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনী নিয়ে গঠিত যৌথবাহিনী তখন ঢাকার বিভিন্নস্থানে অনবরত বোমাবর্ষণ করে পাকিস্তান বাহিনীকে দুর্বল করে ফেলেছে। বিমান থেকে লিফলেট ফেলে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয় বারবার। ওই সময় যারা ঢাকায় ছিলেন তাদের আনন্দ আর আতঙ্কের মধ্য দিয়ে কাটে প্রতিটি মুহূর্ত, বর্ণনা দিচ্ছিলেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।
ডিসেম্বরের শুরুতেই ঢাকাকে ঘিরে ফেলে মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ব্রিগেড। মেজর খালেদ মোশারফের কে ফোর্স মানিকগঞ্জের পথ দিয়ে, কর্নেল তাহেরের ফোর্স গাজীপুর দিয়ে এবং কে এম সফিউল্ল্যাহর এস ফোর্স নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা দিয়ে ঢাকার দিকে এগোতে থাকে।
ক্যাপ্টেন এটিএম হায়দারের নেতৃত্বাধীন ক্র্যাক প্লাটুন মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কয়েকমাসের মধ্যেই ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আতঙ্কগ্রস্ত করে ফেলেছিল। অদম্য সাহসী এই গেরিলা যোদ্ধারা আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের দৃষ্টি কাড়ে।
অবরুদ্ধ ঢাকাবাসী বুঝে যায় যুদ্ধ শেষের দিকে। তবুও পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণে গড়িমসি করতে থাকে। ১৩ ডিসেম্বরও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আত্মসমর্পণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। শেষ মুহূর্তেও পাকিস্তানের আশা ছিল মার্কিন নৌ-বহর এসে তাদের সহায়তা করবে। কিন্তু তা বিফল হয়। পাকিস্তানকে আত্মসমর্পণের জন্য ভারত ১৬ ডিসেম্বর সকাল ১০টা পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। পরে অবশ্য আরও ৬ ঘণ্টা সময় বাড়ানো হয়।
১৬ ডিসেম্বর দুপুর ১টার দিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল জ্যাকব আত্মসমর্পণের খসড়া দলিল নিয়ে তেজগাঁও বিমানবন্দরে আসেন। সেখানে জাতিসংঘের প্রতিনিধিও ছিলেন। আলোচনা চলে পাকিস্তানের লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি, রাও ফরমান আলী, জামসেদ খানের সঙ্গে। পাকিস্তানের জেনারেলরা যৌথ বাহিনী কাছে নয়, ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করার কথা জানান।
ইতোমধ্যে জেড ফোর্স ডেমরা পর্যন্ত মুক্ত করেছে। এরপরও ঢাকা ঢোকার পথ নিরাপদ নয়। পরাজিত শত্রুবাহিনী প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ট্রিগারে আঙুল রেখে বসে আছে। তখন ডেমরা এলাকার পাকিস্তানি ১২এফ এম ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল খিলজিকে সঙ্গে নিয়ে তার গাড়ি করেই কেএম সফিউল্লাহ তেজগাঁওয়ে রওনা হন।
১৬ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক বাহিনীর কমান্ডার ও মিত্র বাহিনীর অধিনায়ক লে. জে. অরোরা বিমানে করে সস্ত্রীক তেজগাঁও বিমানবন্দরে পৌঁছান। একই বিমানে আসেন বাংলাদেশের উইং কমান্ডার এবং মিত্র বাহিনীর উপ-প্রধান একে খন্দকার।
আত্মসমপর্ণের জন্য স্থান নির্ধারণ হয় রমনার রেসকোর্স ময়দান। একই গাড়িতে করে অরোরা ও নিয়াজি রেসকোর্স ময়দানে আসেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এএকে নিয়াজির দম্ভ ধুলোয় লুটিয়ে পড়েছে তখন। প্রস্তুত আত্মসমর্পণের দলিলে সই করার জন্য। তার কাছে কলম ছিল না। মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিত সিং অরোরা নিজের কলমটি বাড়িয়ে দেন। কাপা হাতে গ্রহণ করেন নিয়াজি। বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে সই করলেন ১৯ লাইনে লেখা দলিলটিতে।
এরপর নিয়াজি দাঁড়িয়ে কোমর থেকে বেল্টসহ রিভলবার এবং কাঁধ থেকে ব্যাজ খুলে টেবিলের ওপর রাখেন। হ্যান্ডশেক করেন দুজন। জে. নিয়াজি চলে যান মিত্র বাহিনীর হেফাজতে। সমাপ্তি ঘটে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের। সূচিত হলো নতুন এক অধ্যায়ের। সৃষ্টি হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। অনুষ্ঠানে সংবাদ সংগ্রহ করতে আসা ভারতীয় সাংবাদিক বিকচ চৌধুরী এখনও সেই ঘটনাকে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ দৃশ্য বলে মনে করেন।
জেনারেল নিয়াজি যখন গাড়ি থেকে নামেন তখন মুক্তিযোদ্ধা আবু ইউসুফ খান বীর বিক্রম ফ্লাগ স্ট্যান্ড থেকে তার পতাকাটি খুলে নিয়েছিলেন। পরাজিত নিয়াজি তখন কিছুই বলতে পারেননি। কিছু বলার সাহসও ছিল না। সেটি এখনও তার স্ত্রীর কাছেই সংগৃহীত আছে।
সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান, যা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বিজয়ের ইতিহাসে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এখানেই দিয়েছিলেন।
পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের পরদিন ঢাকার চিত্র হয়ে যায় অন্য রকম। ঘৃণায়, ক্রোধে বাঙালিরা মুছে ফেলে ২৪ বছরের অপছন্দের পাকিস্তান নামটি। সরকারি অফিসের নথিগুলোতে বাংলাদেশ লেখা রাবার স্ট্যাম্প বানিয়ে সিল দেয়া হয় পাকিস্তান নামের ওপর। কলম দিয়ে পাকিস্তান কেটে লেখা হয় প্রিয় বাংলাদেশ নামটি। বদলে যেতে থাকে সাইনবোর্ডগুলো। ভালোবাসার লাল-সবুজ পতাকা বানানোর হিড়িক পড়ে পাড়ায়-মহল্লায়, অলিতে-গলিতে। শিশু, কিশোর, যুবক ও বৃদ্ধরা রক্ত দিয়ে কেনা এই পতাকা নিয়ে মিছিল করে, জয় বাংলা স্লোগান তোলে। ভবনে ভবনে উড়তে থাকা পতাকা বিশ্বকে জানান দেয় স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের কথা।
মুক্তিযোদ্ধারা ছুটে যান শহীদ মিনারে। পাকহানাদার বাহিনী এ শহীদ মিনার গুঁড়িয়ে দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়। ভাঙা মিনারের পাদদেশে দাঁড়িয়েই শপথ নেন নতুন রাষ্ট্র গড়ার। সেই স্মৃতি আজও জ্বলজ্বল করছে ডা. সারওয়ার আলীর চোখে। অস্ত্র হাতে তিনিও শপথ করেছিলেন তখন।
এরই মধ্যে দেশের বিভিন্নস্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকায় এসে জড়ো হন। অবরুদ্ধ ঢাকা মুক্তি পায়। বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয় বাঙালি জাতি। ২৬৭ দিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাঙালি জাতি যে পতাকা পেয়েছে সেই পতাকা আজ অহংকার, গৌরবের। উড়ছে বাংলার আকাশজুড়ে।