image

ভোট রক্ষা মানেই দেশ রক্ষা: নির্বাচন ও গণভোটে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টা

মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫
সংবাদ অনলাইন রিপোর্ট

আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন ও গণভোটকে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পথরেখা নির্ধারণের এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত হিসেবে উল্লেখ করে ভোট রক্ষা করার মাধ্যমে দেশ রক্ষা করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। মঙ্গলবার বিজয় দিবসের সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, ভোটের ওপর নির্ভর করছে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভাগ্য।

জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “ভোটের ওপর নির্ভর করছে আপনার আমার সবার ভবিষ্যৎ, আপনার আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ। যোগ্য লোককে ভোট দিন। জাতির ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করুন।” তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, এই নির্বাচনকে সত্যিকার অর্থে উৎসবমুখর, অংশগ্রহণমূলক, শান্তিপূর্ণ এবং সর্বোপরি সুষ্ঠু করতে সরকার প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

নির্বাচনের জন্য সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা কামনা করে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “আপনারা একে অপরকে প্রতিযোগী হিসেবে দেখবেন, কখনো শত্রু হিসেবে দেখবেন না।”

নির্বাচন কমিশন আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তারিখ ঘোষণা করার পর এই প্রথম জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধান উপদেষ্টা। ভাষণে তিনি জানান, দায়িত্ব গ্রহণের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তিনটি বিষয়কে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। সেগুলো হলো—জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার, একটি জবাবদিহিমূলক ও কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের জন্য রাষ্ট্রকাঠামোর মৌলিক সংস্কার এবং একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন।

তিনি বলেন, “জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালে তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকারের নির্দেশে সংগঠিত হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় এগিয়ে চলছে। ইতোমধ্যে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক একটি মামলার রায় ঘোষিত হয়েছে।”

তিনি আরও জানান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল স্বাধীন, স্বচ্ছ ও প্রমাণভিত্তিক বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশের ছাত্র, শ্রমিক ও সাধারণ জনগণের ওপর নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের প্রধান নির্দেশদাতা হিসেবে পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধান শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছেন।

ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে।

রাষ্ট্র সংস্কারের অগ্রগতি তুলে ধরে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ইতোমধ্যে বেশ কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত সংস্কার সম্পন্ন হয়েছে। কয়েক ডজন পুরোনো আইন সংশোধন করা হয়েছে এবং একাধিক নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, “সংস্কারের সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ হচ্ছে জুলাই জাতীয় সনদ। মৌলিক সাংবিধানিক সংস্কার নিশ্চিত করার জন্য এটি আদেশ আকারে জারি হয়েছে।”

এখন জনগণের সিদ্ধান্তই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—এ কথা উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে এখন নাগরিকদের অনুমোদন নেওয়ার পালা। তাই আগামী নির্বাচনে আপনাদের সিদ্ধান্ত অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ। গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের পথরেখা এখান থেকেই সূচিত হবে।”

তিনি জানান, আগামী সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একইসঙ্গে জুলাই জাতীয় সনদের ওপর গণভোট অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে জনগণ হ্যাঁ বা না ভোটের মাধ্যমে সংস্কারের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে মতামত জানাবেন।

এই নির্বাচন ও গণভোটই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে—এ কথা জোর দিয়ে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা কোন ধরনের রাষ্ট্র প্রত্যাশা করি, তা নির্ভর করবে গণভোটের ফলাফলের ওপর। এই ভোটের মাধ্যমে ঠিক হবে নতুন বাংলাদেশের চরিত্র, কাঠামো ও অগ্রযাত্রার গতিপথ।”

জনগণকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “ভোটকে শুধুই কাগজে একটি সিল মারার আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে দেখবেন না; বরং এটি হবে নতুন রাষ্ট্র বিনির্মাণে আপনার সক্রিয় অংশগ্রহণ, গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা এবং দেশকে এগিয়ে নিতে সরাসরি অবদান। দেশের মালিকানা আপনাদের হাতে, আর সেই মালিকানারই স্বাক্ষর আপনার ভোট।”

রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশে তিনি বলেন, “এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা ও পবিত্রতা রক্ষার জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা অপরিসীম। নির্বাচনের মাঠে এমন একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করুন, যাতে দেশের মানুষ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন।”

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কার নির্বাচনের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “যারা ভোট বাক্স ডাকাতি করবে তারা দেশের মানুষের স্বাধীনতা হরণকারী। তারা নাগরিকদের দুশমন। তাদের থেকে নাগরিকদের রক্ষা করা আমাদের সবার অবশ্য কর্তব্য।”

তিনি আরও বলেন, “ভোট বাক্সে ভোট জমা দিতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যৎ আর রচনা করা যাবে না। আপনার ভোট আপনি সযত্নে ভোট বাক্সে দিয়ে আসুন। কেউ বাধা সৃষ্টি করলে তাকে সুশৃঙ্খলভাবে প্রতিহত করুন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা নিন।”

জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, “মনে রাখবেন, ভোট রক্ষা করা দেশ রক্ষা করার সমান দায়িত্ব। ভোট রক্ষা করুন, দেশকে রক্ষা করুন। ভোট দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবার গাড়ির চাকা—এই চাকা কাউকে চুরি করতে দেবেন না।”

নির্বাচন সামনে রেখে মাঠ প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনে রদবদলের বিষয়টি তুলে ধরে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এই পরিবর্তনগুলো কারও প্রতি অনুরাগ বা বিরাগ থেকে নয়; বরং দক্ষতা, যোগ্যতা ও পেশাগত সক্ষমতার ভিত্তিতে করা হয়েছে।

তিনি বলেন, “আমাদের লক্ষ্য একটাই—দেশের প্রতিটি ভোটার যেন নিরাপদ পরিবেশে, ভয়মুক্ত মনে এবং সর্বোচ্চ স্বাধীনতায় ভোট দিতে পারেন।”

জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট আয়োজনের কারণ ব্যাখ্যা করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জনগণ যেন সরাসরি দেশের ভবিষ্যৎ সংস্কারদিশা নির্ধারণে সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। তিনি জানান, এই গণভোট বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নতুন মাইলফলক হবে এবং প্রতিটি ভোট আগামী দিনের রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করবে।

গণভোটের প্রভাব শতবর্ষব্যাপী হবে উল্লেখ করে তিনি সবাইকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “আপনাদের ভোটই নির্ধারণ করবে রাষ্ট্র কোন পথে অগ্রসর হবে, প্রশাসন কোন কাঠামোয় পুনর্গঠিত হবে এবং নতুন বাংলাদেশ কেমন রূপ পাবে।”

ভাষণের শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা দেশের সকল শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, ছাত্র-ছাত্রী, নারী-পুরুষ এবং নবীন-প্রবীণ সবাইকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানান। তিনি মুক্তিযুদ্ধসহ স্বাধীনতার জন্য যুগে যুগে আত্মত্যাগকারী বীর যোদ্ধা ও শহীদদের গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।

ভাষণের শেষভাগে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “আমরা আজ এক নতুন ইতিহাসের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছি। এই দেশ আমাদের, এই রাষ্ট্র আমাদের, এর ভবিষ্যৎও আমাদের হাতেই।”

তিনি আরও বলেন, “মহান মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক অনুপ্রেরণা ধারণ করে জনগণের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে যে নবযাত্রা সূচিত হয়েছে, তা এগিয়ে নেওয়াই আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব।”

শেষে জাতির উদ্দেশে তিনি আহ্বান জানান, শতবর্ষের সংগ্রাম ও ত্যাগে অর্জিত স্বাধীনতাকে পূর্ণতা দিতে নতুন প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ, সুখী ও সুন্দর বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সবাই যেন ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী ও লিঙ্গ পরিচয় নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে শান্তি, সমৃদ্ধি ও গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যায়।

‘জাতীয়’ : আরও খবর

সম্প্রতি