রুমীকে ক্রমাগত হুমকি দেয়া হয়েছে, সুরাহা পাননি: সামান্তা শারমিন
রাজধানীর হাজারীবাগে একটি বেসরকারি ছাত্রী হোস্টেল থেকে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনপিপি) কর্মী জান্নাতারা রুমীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধারের খবর দিয়েছে পুলিশ। হাজারীবাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শাহাদাত হোসেন জানান, বৃহস্পতিবার, (১৮ ডিসেম্বর ২০২৫) সকালে জিগাতলা পুরাতন কাঁচাবাজার রোড এলাকায় ওই হোস্টেল থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে মর্গে পাঠান। ৩০ বছর বয়সী রুমী নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলার মো. জাকির হোসেনের মেয়ে।
তিনি এনসিপির ধানমন্ডি থানা শাখার যুগ্ম সমন্বয়কারী ছিলেন বলে দলের যুগ্ম সদস্যসচিব (দপ্তর) সালেহ উদ্দিন সিফাত জানান। পুলিশ কর্মকর্তা শাহাদাত বলেন, ‘৯৯৯ এ খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে আমরা তাকে সিলিং ফ্যানের এর সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় পাই।’ তিনি জানান, হোস্টেলের ঘরগুলো হার্ডবোর্ড দিয়ে পার্টিশন করা, ফলে পাশের রুম থেকে কিছুটা দেখা যায়।
‘সকালে গৃহকর্মী পাশের রুমের পার্টিশন বোর্ডের ফাঁক দিয়ে দেখেন রুমি সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছেন। পরে চেঁচামেচি করলে আশপাশে লোকজন ছুটে আসে এবং পুলিশকে খবর দেয়া হয়।’ রুমির ঘরে ডিপ্রেশনের ওষুধ পাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পারিবারিক কারণে তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন বলে আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।’ রুমীর মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। পরিদর্শক শাহাদাত বলেন, ‘ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আসার পর তার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।’
এনসিপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্যসচিব তারেক রেজা ফেইসবুক পোস্টে জানান, কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের হুমকি ও সাইবার বুলিংয়ের কারণে জান্নাত আরা রুমি আত্মহত্যা করেছেন। ওই পোস্টে তিনি লেখেন, এটি আত্মহত্যা নয় খুন। হাজারীবাগ থানার ওসি মো. হাফিজুর রহমান বলেন, এনসিপির নেত্রী জান্নাত আরা বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। তিনি জিগাতলার ওই ছাত্রী হোস্টেলের একটি কক্ষে একা থাকতেন। তিনি বলেন, পরিচারিকা ডাকাডাকির পর দরজায় ধাক্কাধাক্কি করেন। এ সময় হার্ডবোর্ডের দরজার ছিটকানি খুলে যায়। পরে পুলিশ সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ওড়না প্যাঁচানো অবস্থায় জান্নাত আরার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে।
এদিকে জান্নাত আরার মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভেরিফায়েড পেইজে পোস্ট দেন এনসিপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্যসচিব তারেক রেজা। সেখানে তিনি জানান, গত মাসে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রায়ের দিন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে জিয়ার কবর খুঁড়তে চাওয়া রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের একজনকে পিটিয়ে পুলিশের কাছে দিয়েছিলেন জান্নাত আরা। এরপর থেকে আওয়ামী লীগ জান্নাত আরাকে সাইবার বুলিং, হত্যা ও ধর্ষণের হুমকি দিচ্ছিলেন বলে তারেক রেজা তার পোস্টে জানান। ওই পোস্টে তারেক রেজা আরও লেখেন, এ কারণে জান্নাত আরা রাতে আত্মহত্যা করেছে। ফেইসবুকে দেয়া ওই পোস্টে তারেক রেজা আরও লিখেছেন, ‘এটাকে আমরা আত্মহত্যা হিসেবে দেখতে রাজি নই। এটা খুন। যারা আমার বোনের জীবনকে তছনছ করে দিয়েছে, তাদের জীবন আমরা শান্তিতে কাটাতে দেব না।’
রুমীকে ক্রমাগত হুমকি দেয়া হয়েছে, সুরাহা পাননি: সামান্তা শারমিন
‘ক্রমাগত হুমকি ও বুলিংয়ের শিকার’ হয়ে এনসিপি নেত্রী জান্নাতারা রুমী পুলিশের কাছে অভিযোগ দিয়েও কোনো সুরাহা পাননি বলে অভিযোগ করেছেন তার দলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন। তিনি বলেছেন, তথ্য প্রমাণসহ অভিযুক্তদের ফেইসবুক আইডি, ফোন নম্বর পুলিশের কাছে দেয়া হলেও তারা একজনের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়নি।’
সহযোদ্ধা রুমীর মরদেহ দেখতে বৃহস্পতিবার, সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে এসে সাংবাদিকদের সামনে এ বিষয়ে কথা বলেন সামান্তা। বাংলাদেশে সব জুলাই যোদ্ধার জীবন ‘হুমকির মুখে’ মন্তব্য করে এমন পরিস্থিতিতে কী করে নির্বাচন হবে সেই প্রশ্ন তোলেন। সামান্তা বলেন, ‘ওসমান হাদির মস্তিষ্ক ভেদ করে যাওয়া বুলেট যেমন আমাদেরকে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলেছে, রুমির ঝুলন্ত মরদেহ আমাদেরকে এই বাংলাদেশের সব মানুষকে এবং আমরা যারা এনসিপিসহ জুলাইয়ের সম্মুখসারীর যোদ্ধা তাদের সবাইকে এই ঝুলন্ত অবস্থায় আমরা দেখতে পাচ্ছি।
‘আমরা দেখেছি জুলাই ঘোষণাপত্রে জুলাইয়ের যারা সম্মুখসারীর যোদ্ধা, শহীদ পরিবার এবং যারা আহত হয়েছেন, যারা এই পুরো অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা করা হয় নাই।’ ৩০ বছর বয়সী জান্নাতারা রুমী ছিলেন এনসিপির ধানমন্ডি থানা শাখার যুগ্ম সমন্বয়কারী। তিনি নওগাঁ জেলার পতœীতলা উপজেলার মো. জাকির হোসেনের মেয়ে।
গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা রুমী মেডিকেল অ্যাসিসট্যান্ট হিসেবে কাজ করতেন। ঢাকার জিগাতলা পুরাতন কাঁচাবাজার রোড এলাকায় একটি ছাত্রী হোস্টেলে তিনি থাকতেন। রুমীর চাচাতো ভাই মেহেদী হাসান সাংবাদিকদের বলেছেন, দু’বার বিয়ে হয়েছিল তার বোনের। দুই সংসারই ভেঙে গেছে। দুই সংসারে দুটি সন্তানও রয়েছে রুমীর। তারা বাবার কাছে থাকে। এসব নিয়েও তার মধ্যে হতাশা ছিল।
আবার গত ১৪ নভেম্বর আওয়ামী লীগের ‘ঢাকা লকডাউন’ চলাকালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে মধ্য বয়সী এক নারী মারধরের ঘটনায় আলোচনায় আসেন রুমী। লাঠি হাতে রুমির পেটানোর দৃশ্য ফেইসবুকে ভাইরাল হওয়ার পর তার ঠিকানা, পারিবারিক পরিচয় ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়া হয়। তাকে ‘হত্যা ও ধর্ষণের’ হুমকি দেয়ার পাশাপাশি তার পরিবারকেও হুমকি-ধামকি দেয়া হচ্ছিল বলে এনসিপি নেতাদের অভিযোগ। তারা বলছেন, এসব কারণে গত কিছুদিন ধরে ‘ট্রমার মধ্যে’ ছিলেন রুমী। দলের কর্মসূচিতেও তাকে বিমর্ষ দেখা যেত।
সেই প্রসঙ্গ ধরে সামান্তা শারমিন বলেন, ‘রুমির প্রত্যেকটা অ্যাকাউন্টে, প্রত্যেকটা কমেন্টে এবং তার যে লাস্ট পোস্ট ছিল হাদির সুস্থতা কামনায় সেখানে পর্যন্ত তাকে বুলিং করা হয়েছে। গত ১৩ নভেম্বর রুমি ধানমন্ডি থানায় একটি জিডি দায়ের করে। সেখানে অ্যাকাউন্ট এবং ফোন নাম্বারসহ হুমকিদাতাদের লিস্ট সে উপস্থিত করে। ‘আমরা আমাদের পক্ষ থেকে তদন্ত করে যে তথ্য-উপাত্ত তাদের কাছে দায়ের করেছি, প্রমাণ যেগুলো হাজির করেছি, সেই মোতাবেক আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখছি না।’
এনসিপির এই নেত্রী বলেন, ‘সবগুলো রাজনৈতিক দল নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা দেখছি আমাদের জুলাইযোদ্ধা যারা ছিলেন, যারা শহীদ পরিবার, তাদের ওপর ক্রমাগত হুমকি আসছে। এনসিপির একাধিক নেতাকর্মীর ওপর হামলা এবং হুমকি উভয়ই চলমান।
‘এটা শুধু এনসিপির ব্যাপার নয়। স্পষ্ট করে বলতে চাই, এটা বাংলাদেশের নিরাপত্তার বিষয়। এখানে দিল্লি, পিন্ডি এবং নিউইয়র্কের আধিপত্যবাদবিরোধী যত সংগ্রামী যোদ্ধা আছে, সবার প্রতি, সবার জীবনের প্রতি হুমকি আছে।’
সামান্ত বলেন, ‘রুমির মৃত্যু আমাদেরকে ভয় দেয় না। আমরা বরং সাহসে বলিয়ান হচ্ছি। রুমি এবং হাদি আমাদের হিরো। আমরা মনে করি যে, আমরা শাহাদাতকে ভয় পাই না। কিন্তু তার মানে এই নয় রাষ্ট্রের যে দুর্বলতা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে দুর্বলতা একই সঙ্গে এই ময়নাতদন্ত এবং পুলিশি তদন্ত কীভাবে হবে সেটার প্রতি আমরা কিন্তু সজাগ দৃষ্টি রাখব। এখানে কোনোভাবেই যাতে তথ্য গোপন করা না হয়।’
এআই ব্যবহার করে নারীদের ক্রমাগত বুলিং করা হচ্ছে এবং দেশের কিছু মানুষ সেগুলো বিশ্বাস করছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমি নিজে আমার নির্বাচন নিয়ে শঙ্কিত। এখানে নারীরা যে পরিমাণ সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার স্পষ্ট তথ্য প্রমাণাদি থাকা সত্ত্বেও একটি আইডি, একটি অ্যাকাউন্টের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
‘নারী নেতৃত্বকে এখানে প্রত্যেকটা দল থেকেই সেইফটি দিতে হবে। আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছি এই মুহূর্তে এখানে এআই এর ব্যবহার। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন কি চরম মাত্রায় এটা অবনতি ঘটেছে। আপনারা এটাও জানেন যে, বাংলাদেশের যে অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত কিছু মানুষ আছে, যারা শিক্ষার আওতায় এখনও আসেনি কিন্তু তারা এই বিষয়গুলো বিশ্বাস করছেন। ‘রাষ্ট্রীয়ভাবে এগুলোর যদি ব্যবস্থা নেয়া না হয়, শুধুমাত্র আমরা নির্বাচনের ডামাডোলে এগিয়ে গেলাম, কিন্তু আমরা কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সংস্কারের কথা বললাম না, এগুলোর ব্যাপারে কোনো আলাপ তুললাম না, এটা কোনো সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে আমাদেরকে নিয়ে যাবে না।’