হাদি হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে একদল মানুষ জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো ও ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার পত্রিকা অফিসে হামলা ও ভাঙচুর করেছে। একইভাবে কিছু মানুষ হামলা করেছে ধানমন্ডিতে ছায়ানট ভবনে। এভাবে সংবাদপত্র ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের ওপর এমন হামলার প্রতিবাদ জানিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন।
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাকে পরিকল্পিত উল্লেখ করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলেছে, এই ঘটনা মতপ্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি গুরুতর আঘাত। এটি স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য ভয়ংকর বার্তা। এক বিবৃতিতে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে সহিংসতার সময় প্রতিবাদ জানাতে ডেইলি স্টারের সামনে গেলে নিউ এইজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবীর হেনস্তার শিকার হন। এ ঘটনারও প্রতিবাদ জানায় আসক। তারা মনে করে, এ ঘটনা স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য ভয়ংকর বার্তা বহন করে।
দেশে পরিকল্পিতভাবে মব সন্ত্রাস ও সহিংসতার ধারাবাহিকতা দেখা গেছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, এই ঘটনা গভীরভাবে উদ্বেগজনক ও ভয়াবহ। প্রতিষ্ঠানটি এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে।
বিবৃতিতে ঢাকায় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট ভবনে হামলা, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে ভাঙচুর, রাজশাহী ও খুলনায় ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ এবং চট্টগ্রামে ভারতীয় উপ-হাইকমিশনের সামনে রাতের অবস্থানকে সুপরিকল্পিত অস্থিরতা সৃষ্টির অপচেষ্টা বলে উল্লেখ করা হয়। আসক মনে করে, ‘সংবাদমাধ্যম, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, ঐতিহাসিক স্থাপনার ওপর এই ধরনের সমন্বিত হামলা দেশে উগ্র ও সহিংস চিন্তার বিপজ্জনক বিস্তারের ইঙ্গিত দেয়’।
এ হামলার প্রতিবাদ জানিয়েছে ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটি, কূটনৈতিক সংবাদ দাতাদের সংগঠন ডিকাবসহ বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন।
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয় এবং ছায়ানটে হামলার ঘটনা পরিকল্পিত বলে মনে করছে নাগরিক সমাজ। এ হামলার জড়িতদের খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনার দাবিও জানিয়েছে তারা। শুক্রবার,(১৯ ডিসেম্বর ২০২৫) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে সমাবেশ করে নাগরিক সমাজ। এর আগে তারা ডেইলি স্টার ও ছায়ানট ভবনের সামনেও প্রতিবাদ সমাবেশ করে। প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা বলেন, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে যে হামলা দেখা গেছে, সেই হামলা পরিকল্পিত। এটি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার একটি জঘন্য প্রচেষ্টামাত্র। এই অপরাধীদেরও খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
‘সাংবাদিক, সম্পাদক ও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর হামলা চালানোর ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে মিডিয়া ফ্রিডম কোয়ালিশন ইন বাংলাদেশ। শুক্রবার, এক বিবৃতিতে এ নিন্দা জানিয়েছে তারা। মিডিয়া ফ্রিডম কোয়ালিশন (এমএফসি) একটি বৈশ্বিক জোট, যারা অনলাইন ও অফলাইনে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সমর্থনে একসঙ্গে কাজ করে। এই জোট সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তাকে সমর্থন করে এবং যারা সাংবাদিকদের ক্ষতি করে তথা গণমাধ্যমের কাজকে কঠোরভাবে সংকুচিত করার অপচেষ্টা চালান, তাদের জবাবদিহি নিশ্চিতে কাজ করে। ঢাকায় নিয়োজিত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ডেনমার্ক, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, সুইডেন ও সুইজারল্যান্ডের কূটনীতিকেরা মিডিয়া ফ্রিডম কোয়ালিশনের হয়ে কাজ করছেন। মিডিয়া ফ্রিডম কোয়ালিশনের বিবৃতিতে বলা হয়, এ ধরনের সহিংসতা ও ভীতি প্রদর্শন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এসব হামলা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও জনগণের জানার অধিকারকে সরাসরি আঘাত করে।
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা এবং সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও নিউ এইজ পত্রিকার সম্পাদক প্রবীণ সাংবাদিক নূরুল কবীরকে প্রকাশ্যে হেনস্তার ঘটনায় ডিপ্লোমেটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ (ডিক্যাব) গভীর উদ্বেগ ও তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। শুক্রবার, ডিক্যাব সভাপতি এ কে এম মঈনুদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক আরিফুজ্জামান মামুন স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এই নিন্দা জানানো হয়। বিবৃতিতে সাংবাদিক আনিস আলমগীরের গ্রেপ্তারের ঘটনাতেও নিন্দা প্রকাশ করা হয়। গুলিবিদ্ধ হয়ে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর ঘটনায় রাষ্ট্রীয় শোকের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করা হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, ডিক্যাব মনে করে, স্বাধীন ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান ভিত্তি। গণমাধ্যমের কণ্ঠ রুদ্ধ করতে সহিংসতা, ভয়ভীতি প্রদর্শন, হামলা কিংবা হেনস্তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ ধরনের কর্মকাণ্ড গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার এবং আইনের শাসনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
বিবৃতিতে বলা হয়, প্রবীণ সাংবাদিক ও সম্পাদক নূরুল কবীরকে প্রকাশ্যে হেনস্তার ঘটনা সাংবাদিক সমাজের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এটি শুধু পেশাগত মর্যাদার ওপর আঘাত নয়, বরং সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন তোলে।
ডিক্যাব অবিলম্বে এসব ঘটনার সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও দ্রুত তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার জোর দাবি জানিয়েছে। একই সঙ্গে গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর ও দৃশ্যমান পদক্ষেপও প্রত্যাশা করেছে।
পরিকল্পিতভাবে একটি স্বার্থান্বেষী মহল প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা চালিয়েছে বলে মনে করছেন প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ। গতকাল প্রথম আলোর কর্মীদের মানববন্ধন কর্মসূচিতে তিনি এমন পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের প্রতিবাদে এ কর্মসূচি ডাকা হয়। ঢাকার কারওয়ানবাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে বিকেল ৪টায় এ মানববন্ধন হয়।