শিল্পী, সংগীত এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিরাপদ ও সম্মানিত ‘না হওয়া পর্যন্ত’ আর বাংলাদেশে আসবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর প্রপৌত্র সিরাজ আলী খান।
শুক্রবার ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট ভবনে এক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার কথা ছিল সিরাজ আলী খানের। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ছায়ানট ভবনে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়। আর তারপরই তিনি ঢাকা ছেড়ে চলে যান।
ফিরে গিয়ে রোববার এক ফেইসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন, “আমাকে ভারী হৃদয়ে স্পষ্ট করে বলতে হচ্ছে – শিল্পী, সংগীত এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিরাপদ ও সম্মানিত না হওয়া না হওয়া পর্যন্ত আমি বাংলাদেশে আর আসবো না।
“এই সিদ্ধান্ত রাগ থেকে নেয়া নয়, বরং আমার পরিবারের উত্তরাধিকার, আমার শিল্প এবং আমার নিরাপত্তার দায়িত্ববোধ থেকে। আমি এখনও বিশ্বাস করি, সংগীতের শক্তি আছে সারিয়ে তোলার ও ঐক্যের। আমি শুধু আশা করি, একদিন শিল্প ও সংস্কৃতির প্রতি সম্মান এতটাই শক্তি নিয়ে ফিরে আসবে যে সেই সেতু আবারও গড়ে তোলা যাবে।”
বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং শিল্পকলা একাডেমিকে ট্যাগ করে সিরাজ আলী লিখেছেন, “আমার এই পোস্ট সরকারের বিরুদ্ধে নয়, কিংবা বাংলাদেশের সেই শিক্ষিত, সংস্কৃতিমনস্ক মানুষদের বিরুদ্ধেও নয়, যারা সবসময় আমাকে অসীম সম্মান ও উষ্ণ ভালোবাসা দিয়েছেন।
“আমার যন্ত্রণা একমাত্র সেই উন্মত্ত জনতার মানসিকতার বিরুদ্ধে, যারা সংস্কৃতি ও জ্ঞানের প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আক্রমণ চালায়। সংগীত ও শিল্প সবসময়ই রাজনীতি ও সহিংসতার ঊর্ধ্বে, তবে এটা গভীরভাবে কষ্ট দেয় সেগুলো যখন আঘাতের লক্ষ্যবস্তু হয়।”
বিশ্বখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ছেলে আলী আকবর খান; তার সন্তান ধ্যানেশ খান, আর তার ছেলে সিরাজ আলী খান। তিনি মাইহার ঘরানার সংগীতের একজন খ্যাতিমান শিল্পী, থাকেন ভারতে।
সিরাজ আলী খান ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় এসেছিলেন। এর আগে গত ৮ অক্টোবর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেছিলেন সিরাজ আলী খান। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বর্ণাঢ্য আয়োজনের লালবাগ কেল্লায় ধ্রুপদী সংগীতের আয়োজন করেছিল সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
সে প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, “ঢাকায় অতীতে যে উষ্ণতা ও ভালোবাসা পেয়েছি – বিশেষ করে একটি ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক পরিসরে আয়োজিত এক স্মরণীয় অনুষ্ঠানে, তা আমি কোনোদিন ভুলব না।”
তিনি বলেন, “আমি সবসময় আমার শিকড়ের সঙ্গে যুক্ত হতে বাংলাদেশে এসেছি – আমার পরিবারের সংগীত, বড় বাবা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের ঐতিহ্য এবং মাইহার ঘরানার জীবন্ত উত্তরাধিকার ভাগ করে নিতে। আমি শুধু সংগীত, বিনয় ও শ্রদ্ধা নিয়েই এসেছিলাম।
“জীবনে প্রথমবার, গভীর বেদনার সঙ্গে বলতে হচ্ছে – আমরা আমাদের জীবনের জন্য ভয় পেয়েছি। আগে কখনো কল্পনাও করিনি যে বাংলাদেশে একজন ভারতীয় শিল্পী হিসেবে নিজের পরিচয় দেওয়াই আমাকে বিপদের মুখে ফেলতে পারে। কোনোমতে নিরাপদে ভারতে ফিরতে পেরেছি – এর জন্য আমি কৃতজ্ঞ।”
সিরাজ আলী খান লিখেছেন, ১৯ ডিসেম্বর যা ঘটেছে, তা শুধু সংগীতযন্ত্র বা একটি সংগঠন ভাঙচুর নয়, এটা ‘সংস্কৃতি, শিল্পী এবং যৌথ ঐতিহ্যের ওপর’ আঘাত।
“সংগীত সবসময়ই আমাদের দেশ ও ইতিহাসের মধ্যে একটি সেতু ছিল। যখন সেই সেতু ভয় ও সহিংসতায় ভেঙে যায়, তখন আরও গভীর কিছু হারিয়ে যায়।”
বাংলাদেশকে ‘পূর্বপুরুষের ভূমি’ হিসেবে উল্লেখ করে সিরাজ আলী খান লিখেছেন, “যন্ত্রণা থেকে উৎসারিত সমালোচনা কখনোই প্রত্যাখ্যান নয় – বরং উদ্বেগের প্রকাশ। আমি এখনো আশাবাদী যে প্রজ্ঞা, সংলাপ এবং সংস্কৃতির প্রতি সম্মানই শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে – যেমনটা এই মাটির দীর্ঘ ইতিহাসে বারবার হয়েছে।”