image

হাদি হত্যা: ফয়সাল দেশে না বিদেশে, ‘নিশ্চিত নয়’ পুলিশ

রোববার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৫
সংবাদ অনলাইন রিপোর্ট

ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফ ওসমান হাদি হত্যার মূল সন্দেহভাজন ফয়সাল করিমের অবস্থান ৯ দিনেও নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ।

ফয়সালদের ব্যাংক হিসাবে ‘১২৭ কোটির অস্বাভাবিক লেনদেন’: সিআইডি

সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে, জানতে চায় ইনকিলাব মঞ্চ

হাদির ভাই বললেন, বিচার চাইলে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে

হত্যার বিচার ও গ্রেপ্তারের দাবিতে ঝালকাঠিতে

বিক্ষোভ-অবরোধ

রোববার, (২১ ডিসেম্বর ২০২৫) সন্ধ্যার পর সচিবালয়ে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এসে পুলিশ সদর দপ্তর, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির তরফে বলা হয়, ফয়সালকে ধরার ব্যাপারে তারা ‘সর্বোচ্চ চেষ্টা’ চালিয়ে যাচ্ছে। ডেভিল হান্ট অভিযানের ‘ফেইস-২’-এর সর্বশেষ তথ্য দিতে এ সংবাদ সম্মেলন ডাকা হলেও মূল বিষয় হয়ে উঠে হাদির হত্যাকা-।

এ বিষয়ে অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক খন্দকার রফিকুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) প্রধান শফিকুল ইসলাম, বিজিবি ময়মনসিংহ সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মোস্তাফিজুর রহমান, এআইজি (মিডিয়া) শাহাদাত হোসেন, র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক ইন্তেখাব চৌধুরী হাদি নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন। সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিক জানতে চান, মূল সন্দেহভাজন ফয়সাল দেশে আছেন, নাকি বিদেশে?

জবাবে অতিরিক্ত আইজি রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ফয়সাল দেশে নাকি দেশের বাইরে, এটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আমরা অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছি। সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত আছে।’ ফয়সালের বাবা-মা, স্ত্রীসহ এ পর্যন্ত মোট ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জানিয়ে ডিএমপির ডিবিপ্রধান শফিকুল বলেন, ‘র‌্যাব, ডিবি ও বিজিবি মিলে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের কাছে অনেক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।’ যে মোটরসাইকেল ব্যবহার করা হয়েছে, সেটির পাশাপাশি অস্ত্র উদ্ধারের কথা জানান তিনি।

‘যেসব অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে, তার মধ্যে একটি হাদি হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পরীক্ষার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে।’ এই হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিক না ব্যক্তিগত, গত কয়দিনের তদন্তে কোনো তথ্য পাওয়া গেছে কিনা, সেই প্রশ্ন করেন এক সাংবাদিক। জবাবে শফিকুল বলেন, ‘রাজনৈতিক কারণে এই হত্যাকাণ্ড বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তদন্ত চলছে।’

র‌্যাব কর্মকর্তা ইন্তেখাব বলেন, ‘আটক ব্যক্তিদের কাছ যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তা হচ্ছে- ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টার পর ফয়সাল ও আলমগীর (মটরসাইকেলচালক) আগারগাঁও যান এবং হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত পিস্তল ও গোলাবারুদ লুকানোর পরিকল্পনা করেন। ‘অস্ত্রের ব্যাগটি সে তার বাবাকে দিয়ে শ্যালক শিপুর কাছে হস্তান্তর করতে বলে এবং সে সিএনজি যোগে সাভারের উদ্দেশে রওনা দেয়।’

পরে ফয়সালের বাবা ব্যাগটি শিপুর কাছে দেয়। পরে শিপু নরসিংদীতে গিয়ে তার বোন অর্থাৎ ফয়সালের স্ত্রী সামিয়ার কাছে অস্ত্রের ব্যাগটি দেয়। পরে সামিয়া ব্যাগটি শিপুকে লুকানোর জন্য বললে শিপু তার বন্ধু ফয়সালের বাসায় সেটি রাখার জন্য দেয়।’ র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, ‘পরে বিভিন্নভাবে হাদিকে গুলি করার বিষয়টি প্রচারিত হলে ভয় পেয়ে পার্শ্ববর্তী তরুয়ার বিলে অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ ব্যাগটি ফেলে দেয়া হয়।’ সেখান থেকেই পরে র‌্যাব সেগুলো উদ্ধার করে বলেন তিনি। সেক্টর কমান্ডার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ঘটনার পর তারা সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করেন। মানবপাচারে সহায়তার অভিযোগে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ‘সীমান্ত এলাকায় অন্যতম মানব পাচারকারী ফিলিপকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’

ফয়সালদের ব্যাংক হিসাবে

‘১২৭ কোটির অস্বাভাবিক লেনদেন’: সিআইডি

হাদি হত্যাকাণ্ডে প্রধান সন্দেহভাজন ফয়সাল করিম মাসুদ ও তার স্বার্থ সংশ্লিষ্টদের ব্যাংক হিসাবে ১২৭ কোটি টাকার ‘অস্বাভাবিক লেনদেনের’ তথ্য পাওয়ার কথা বলেছে সিআইডি। রোববার, সিআইডি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি জানিয়ে বলেছে, তারা ‘মানিলন্ডারিং’ নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য পর্যালোচনা করে এই ‘অস্বাভাবিক লেনদেনের’ তথ্য পাওয়া গেছে।

সিআইডি বলছে, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় প্রাপ্ত বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বইয়ের তথ্য সিআইডি গুরুত্ব নিয়ে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ শুরু করে। ‘এতে দেখা যায়, অভিযুক্ত ও তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু চেক বইয়ে বিভিন্ন পরিমাণ অর্থের কথা উল্লেখ রয়েছে। চূড়ান্ত লেনদেন সম্পন্ন না হওয়া এসব

রেকর্ডের সমষ্টিগত মূল্য প্রায় ২১৮ কোটি টাকা।’

প্রাথমিক বিশ্লেষণের বরাত দিয়ে সিআইডি বলেছে, অভিযুক্ত ফয়সাল ও তার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে ১২৭ কোটি টাকার বেশি অস্বাভাবিক লেনদেন সংঘটিত হয়েছে, যা মানিলন্ডারিং, সংঘবদ্ধ অপরাধ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমসংক্রান্ত অর্থায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারে।’ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘মূল অভিযুক্ত ও তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে থাকা প্রায় ৬৫ লাখ টাকা রাষ্ট্রের অনুকূলে দ্রুততম সময়ে যেন বাজেয়াপ্ত করা যায়, সেজন্যও যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করছে সিআইডি। ‘পাশাপাশি এই অর্থের মূল সরবরাহকারী ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করার জন্য সিআইডির অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পেছনে পরিকল্পনা, অর্থায়ন ও অস্ত্র সরবরাহে কোনো সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী নেটওয়ার্ক সক্রিয় ছিল কিনা, সে বিষয়েও সিআইডির একাধিক টিম কাজ করছে।’

# সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে, জানতে চায় ইনকিলাব মঞ্চ

হাদি নিহতের ঘটনায় এখন পর্যন্ত সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা জানতে চেয়েছে ইনকিলাব মঞ্চ। জুলাই গণঅভ্যুত্থান অনুপ্রাণিত সাংস্কৃতিক প্লাটফর্মটি রোববার, বিকেল ৪টায় ফেইসবুক পোস্টে বলেছে, ‘আজকের সংবাদ সম্মেলনে যথোপযুক্ত ব্যাখ্যা প্রদানে ব্যর্থ হলে ব্যর্থতার দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও সহকারী উপদেষ্টা উভয়কে পদত্যাগ করতে হবে।’ এ পোস্টে তারা দুই দফা দাবি জানিয়েছে।

খুনি, খুনের পরিকল্পনাকারী, খুনের সহায়তাকারী, পলায়নে সহযোগী, আশ্রয়দাতাসহ পুরো খুনি চক্রকে অতি দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। গত ১২ ডিসেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত বিচারের জন্য কী কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সরকারের তরফ থেকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও সহকারী উপদেষ্টা খোদা বকসকে জাতির সামনে ব্যাখ্যা দিতে হবে। গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা ‘ফ্যাসিস্টের দোসরদের’ চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। এদিনই বিকেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। সেখানে অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেইজ-২ ও দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়ে ব্রিফ করার কথা রয়েছে।

# হাদির ভাই বললেন, বিচার চাইলে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে

আন্দোলনের চাপ না থাকলে হাদি হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন এই জুলাই যোদ্ধার ভাই শরিফ ওমর বিন হাদি। তিনি বলেছেন, ওসমান হাদিকে ভালোবাসলে, তার হত্যার বিচার চাইলে, শাহবাগকে ফ্যাসিবাদ ও ভারতীয় আধিপত্যবাদমুক্ত হিসেবে কায়েম করতে চাইলে জনগণকে আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে। রোববার, সকালে রাজধানীর মগবাজারের আল-ফালাহ মিলনায়তনে হাদির শাহাদাত উপলক্ষে জামায়াতে ইসলামীর আয়োজিত দোয়া মাহফিলে এ কথা বলেন ওমর বিন হাদি।

ইনসাফের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় হাদির সংগ্রামের কথা তুলে ধরে তার ভাই ওমর বিন হাদি বলেন, ‘আমরা ওসমান হাদির পক্ষ থেকে কোনো আর্থিক সহযোগিতা চাই না। কোনো অনুদান চাই না। শুধু একটাই চাই, ওসমান হাদির অসমাপ্ত বিপ্লবকে আপনারা সমাপ্ত করবেন। আপনারা যদি রাজি থাকেন, আমার সঙ্গে ওয়াদা করেন, ইনসাফের বাংলাদেশ গঠিত না হওয়া পর্যন্ত আপনারা শান্ত হবেন না।’ ‘ওসমান হাদি যে বিপ্লবী আন্দোলন শুরু করেছিল, যেই আন্দোলনের কারণে শহীদ হয়েছে, তার অসমাপ্ত বিপ্লব দেশের মানুষকে সমাপ্ত করতে হবে,’ বলেন ওমর বিন হাদি। ওমর বিন হাদি বলেন, ওসমান হাদির মৃত্যুর পর তার পরিবার, ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যরা এখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি।

# হত্যার বিচার ও গ্রেপ্তারের দাবিতে ঝালকাঠিতে বিক্ষোভ-অবরোধ

হাদি হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচার দাবিতে তার নিজ জেলা ঝালকাঠিতে বরিশাল-খুলনা মহাসড়ক তৃতীয় দিনের মতো অবরোধ করে করেন ছাত্র-জনতা। রোববার, দুপুর ২টার দিকে শহরের কলেজ মোড় এলাকায় তারা জড়ো হন। পরে মহাসড়কে অবরোধ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। এতে মহাসড়কে যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়, ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা।

ঝালকাঠির সদর থানার ওসি ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘অবরোধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ঘটনাস্থলে এসেছি। আমরা আন্দোলনকারীদের বোঝানার চেষ্টা করে।’ অবরোধে অংশ নেয়া ঝালকাঠি গণঅধিকার পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান সাগর বলেন, ‘ভারতীয় আগ্রাসন ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণেই শরিফ ওসমান হাদিকে হত্যা করা হয়েছে। এতদিন পার হয়ে গেলেও মূল অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। ‘আমাদের ভাইয়ের হত্যার বিচার যতদিনে না পাবো ততদিন আমাদের সংগ্রাম চলতেই থাকবে। আমার ভাই হাদি শহীদ হয়েছেন প্রয়োজনেও আমরাও শহীদ হবো। আমরা দ্রুত অপরাধীকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।’

গত ১২ ডিসেম্বর দুপুর সোয়া ২টার দিকে রাজধানীর বিজয়নগর পানির ট্যাংকির সামনে রিকশায় করে যাওয়ার সময় ওসমান হাদির ওপর আক্রমণ হয়। ওই সময় মোটরসাইকেলে করে এসে দুইজন তাকে খুব কাছ থেকে গুলি করে পালিয়ে যায়। পরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় দ্রুত তাকে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে নেয়া হয়। একপর্যায়ে পরিবারের ইচ্ছায় তাকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। এরপর সেখানে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) তার চিকিৎসা চলে। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য গত সোমবার এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে হাদিকে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেখানেই বৃহস্পতিবার তার মৃত্যু হয়। গত শনিবার জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জানাজা শেষে তাকে কবি নজরুল ইসলামের সমাধি প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়েছে।

‘জাতীয়’ : আরও খবর

» হাদি হত্যা: সিবিউন ও সঞ্জয় আবারও ৫ দিনের রিমান্ডে

সম্প্রতি