ভারতের একদল উগ্রপন্থি লোক দিল্লিস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনে হামলা করেছে। তারা হাইকমিশন ভবনের নিরাপত্তা বেষ্টনী অগ্রাহ্য করে বাংলাদেশ হাউজের গেইটে গিয়ে বিক্ষোভ করেছে। সেখান থেকে বাংলাদেশ দূতকে প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দিয়েছে উগ্রপন্থিরা। উগ্রপন্থিদের নিবৃত্ত করতে নিরাপত্তা বাহিনী কাজ করেনি। গতকাল শনিবার রাতে নজিরবিহীন এ ঘটনা ঘটেছে। রোববার,(২১ ডিসেম্বর ২০২৫) দিল্লি ও ঢাকার কূটনৈতিক ও সাংবাদিকদের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে দিল্লিতে হাইকমিশনের হামলার ঘটনায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় একটি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছে, সেখানে নিরাপত্তা বেষ্টনী ‘লঙ্ঘন’ কিংবা ‘নিরাপত্তা পরিস্থিতি তৈরির’ মতো ‘কোনো প্রচেষ্টা ছিল না’।
তবে ঢাকায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন দিল্লির এ ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, ‘আমরা শুনেছি, আমাদের হাইকমিশনারকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। আমরা মনে করি, এটা নরমালি, সিকিউরিটির যে নিয়মকানুন আছে, সেটা ঠিকমতো পালন হয়নি। আমরা আশা করবো, এ ধরনের পরিবেশ আর কখনো সৃষ্টি হবে না।’
দিল্লিতে হাইকমিশনে যা ঘটেছে
ঢাকায় পাওয়া খবরে জানা গেছে, গতকাল শনিবার স্থানীয় সময় রাত ৯টার দিকে অখ- হিন্দু রাষ্ট্রসেনার ব্যানারে ২০/২৫ জনের উগ্রবাদী একটি দল চার/পাঁচটি গাড়িতে দিল্লির চাণক্যপুরীর কূটনৈতিক এলাকার বাংলাদেশ হাইকমিশনের মূল ফটকের সামনে চলে যায়। প্রচলিত নিয়মানুযায়ী নিরাপত্তা বাহিনী এসব উগ্রবাদীদের হাইকমিশনের সামনে আসতে দেয়ার কথা নয়। কিন্তু তাদের হাইকমিশনের মূল ফটকে আসার সময় নিরাপত্তা বাহিনী কোনো রকম বাধা দেয়নি। ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী বিদেশি কূটনৈতিক মিশন এবং দেশগুলোর দূতদের নিরাপত্তা নিñিদ্র করার জন্য বাংলাদেশ এবং ভারত উভয় সরকারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
উগ্রবাদী অখ- হিন্দু রাষ্ট্রসেনার বিক্ষোভকারীরা বাংলাদেশ হাউজের সামনে প্রায় ৩০ মিনিট অবস্থান করে। বাংলাদেশ হাউজের গেইটের সামনে এসে বিক্ষোভকারীরা উত্তেজনাপূর্ণ স্লোগান দেয়। এ সময় তারা বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে কথা বলছিল। তারা ‘হিন্দুদের নিরাপত্তা দিতে হবে’, ‘হাইকমিশনারকে ধর’বলে স্লোগান দেয়। দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার রিয়াজ হামিদুল্লাহকে হত্যার হুমকিও দেয়।
# ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্য
গতকাল শনিবার রাতে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার পর রোববার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রাণধীর জয়সওয়াল এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি পাল্টা অভিযোগ করেন যে, দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে ‘বিভ্রান্তিকর প্রোপাগান্ডা’ চালানো হয়েছে।
রাণধীর জয়সওয়াল বলেন, ‘বাংলাদেশের কিছু গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর প্রোপাগান্ডা আমরা দেখেছি। সত্যটা হচ্ছে, ২০ ডিসেম্বর (গত) ২০/২৫ জন যুবক নয়া দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে জড়ো হয়ে ময়মনসিংহে দীপু চন্দ্র দাসের নৃশংস হত্যার প্রতিবাদে স্লোগান দিয়েছে এবং বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার আহ্বান জানিয়েছে। নিরাপত্তা বেষ্টনী লঙ্ঘন কিংবা নিরাপত্তা পরিস্থিতি তৈরির মতো কোনো প্রচেষ্টা সেখানে ছিল না।’
জয়সওয়াল সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে কিছু কথাবার্তা বলছে- হিন্দুদের নিরাপত্তা দিতে হবে; হাইকমিশনারকে ধরো। পরে তারা মেইন গেইটের সামনে এসে কিছুক্ষণ চিৎকার করে। ওরা চিৎকার করে চলে গেছে, এতটুকুই আমি জানি।’
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জয়সওয়াল বলেন, ‘কয়েক মিনিট পরই ওই দলটিকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে ঘটনাস্থলে থাকা পুলিশ সদস্যরা। এই ঘটনার ভিডিও প্রমাণ প্রকাশিত হয়েছে।’
মুখপাত্র বলেন, ‘ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী বিদেশ মিশন বা কার্যালয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভারত অঙ্গীকারাবদ্ধ।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশের পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির ওপর ভারত ‘নজর রাখছে’ মন্তব্য করে আরও তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগে রাখছেন আমাদের কর্মকর্তারা। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিষয়ে আমাদের জোরালো উদ্বেগ জানানো হয়েছে। আমরাও দীপু দাসের বর্বর হত্যার ঘটনায় দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানাচ্ছি।’
# দিল্লির বক্তব্য গ্রহণযোগ্য না: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
এদিকে গতকাল শনিবারের হাইকমিশনের হামলা এবং রোববার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জয়সওয়ালের ব্যাখ্যা দেয়ার পর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে রোববার বিকেলে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘দিল্লি যেভাবে উপস্থাপন করছে সেটা গ্রহণযোগ্য না।’
প্রতিক্রিয়ায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘২৫ বা ৩০ জনের একটা হিন্দু চরমপন্থি সংগঠনের একটা দল এতদূর পর্যন্ত আসতে পারবে কেন একটা স্যান্সিটাইজড এলাকার মধ্যে, তার মানে তাদের আসতে দেয়া হয়েছে। তাইলে যেভাবে তারা আসছে, আসতে পারার কথা না কিন্তু নরমালি এবং তারপরে সেখানে তারা দাঁড়িয়ে শুধু ওই হিন্দু নাগরিকের হত্যার প্রতিবাদ স্লোগান দিয়ে চলে গেছে তা না, তারা অনেক কিছু বলেছে সেটা আমরা জানি এবং আমাদের পত্রপত্রিকায় যে রিপোর্টটা আসছে সেটাকে তারা বলছে মিসলিডিং এটাও সত্য না। আমাদের পত্রপত্রিকায় মোটামুটি সঠিক রিপোর্টই এসেছে। আমরা যেটুকু তথ্য পেয়েছি আমার কাছে প্রমাণ নেই যে হাইকমিশনারকে হত্যার হুমকি দিয়েছে। কিন্তু আমরা এটাও শুনেছি, তাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। ’
এ ঘটনার পর থেকে দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনারের পরিবার ঝুঁকি অনুভব করছে বলে জানান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, ‘সেটা কেউ একজন কথা বললো, সেটার মধ্যে হতে পারে। কিন্তু আমার কথা হলো যে এ পর্যন্ত আসতে পারবে কেন? এসে এখানে হুমকি দিতে পারবে কেন? সাধারণত আমরা যখন কোনো প্রটেস্ট গ্রুপ যখন যায় সেটা আগে থেকে ইনফর্ম করা হয় এবং পুলিশ তাদের একটু দূরে এক জায়গাতে আটকে দেয়। কখনো যদি কোনো কাগজপত্র দেয়ার থাকে দুইজন এসে দিয়ে যায়। এটা হলো নর্ম। সবখানেই এটা হয় আমাদের দেশেও হয়। এটা আমরা গ্রহণ করি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘দ্বিতীয়ত বিষয় হচ্ছে যে একজন বাংলাদেশি নাগরিক নিঃশংসভাবে খুন হয়েছে। এটার সঙ্গে মাইনরিটিজের নিরাপত্তাকে একসঙ্গে করে ফেলার কোনো মানে হয়নি। তিনি বাংলাদেশের নাগরিক যাকে হত্যা করা হয়েছে এবং অবিলম্বে বাংলাদেশের সরকার এই ব্যাপারে একশন নিয়েছে। ইতোমধ্যে আপনারা জানেন যে বেশ কিছু অ্যারেস্ট করা হয়েছে। তো এ ধরনের ঘটনা যে শুধু বাংলাদেশে ঘটে তা নয়। এই অঞ্চলের সব দেশেই ঘটে এবং প্রত্যেক দেশের দায়িত্ব হচ্ছে সেক্ষেত্রে যথাপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া। বাংলাদেশ নিচ্ছে অন্যদেরও উচিত সেরকম ব্যবস্থা নেয়া।’
ঢাকা প্রতিবাদে কীভাবে জানাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দেখুন ফরমেট নিয়ে বরং আমরা আলাপ না করাই ভালো, কারণ তারাও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, আমরাও যোগাযোগ রাখি, যোগাযোগ আছে এবং আমরা যেটাকে বলার সেটা বলি, তার পরিপ্রেক্ষিতেই এই যে প্রেস নোট এসেছে, যে কারণে আমাদেরও এখন এটা একইভাবে ওপেনলি যেতে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ভরসা রাখছি যে ভারত যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেবে।’
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘এখানে ব্যাপারটা শুধু কিন্তু যে তারা এখানে এসছে দুটো স্লোগান দিয়েছে তা না। এর ভেতরে কিন্তু একটা পরিবার বাস করে, হাইকমিশনার এবং তার পরিবার ওখানে বাস করে তারা থ্রেটেন ফিল করেছে এবং তারা কিন্তু আতঙ্কিত হয়েছে যে কারণ এডিকুয়েট সিকিউরিটি অফ ছিল, দুইজন গার্ড ছিল তারা চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। কাজেই এটাকে আমরা মনে করি যে আরেকটু পৃথক করাটা সত্যিকারই ওই দেশের দায়িত্ব।’