ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের পর জুলাই সনদ প্রণয়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ‘সভ্যতা’ আনার যে দাবি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস করেছিলেন, গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে হামলার পর তার সেই বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
বুধবার, (২৪ ডিসেম্বর ২০২৫) ঢাকার শাহবাগে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির উদ্যোগে বিভিন্ন বাম সংগঠনের যৌথ সমাবেশে এ কথা বলেন গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য আনু মুহাম্মদ। তিনি এই সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন।
আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘মাসের পর মাস ধরে আমরা যে নৃশংসতা দেখছি, বিশেষ করে গত ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বর দেখলাম, এটাই কি মুহাম্মদ ইউনূসের সভ্যতার নমুনা? এই প্রশ্নটা আজকে আমাদের সবাইকে করতে হবে।’
প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানট ও উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কার্যালয়ে হামলা এবং সব হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে গত ১৭ অক্টোবর জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের ভাষণে মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘আমরা এক বর্বর জগতে ছিলাম। যেখানে আইন-কানুন ছিল না। মানুষের ইচ্ছায় যা ইচ্ছা তা করতে পারতো। এখন আমরা সভ্যতায় আসলাম।’
ইউনূসের সেই বক্তব্যের পর ‘সভ্যতা’র সংজ্ঞা নির্ধারণ নিয়ে তখনই শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী আক্রমণের পর আবার তা সামনে আনলেন তিনি। তিনি মনে করেন, এই হামলাগুলো উদ্দেশ্যহীন উচ্ছৃঙ্খল আচরণ নয়, বরং একটা মতাদর্শিক অবস্থান থেকে পরিকল্পিত সন্ত্রাস।
আনু মুহাম্মদ বলেন, বিভিন্ন ভবন ও প্রতিষ্ঠানে যে ভয়ঙ্কর আক্রমণ, হামলা ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে সেগুলো অবিশ্বাস্য ঘটনা। গত দেড় দশক ধরে স্বৈরাচারী হাসিনা আমলের অন্যায়, দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘন নির্বাচনকে নির্বাসনে পাঠানোসহ সবকিছুর বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার থেকেছেন, সেই নূরুল কবীরকে আওয়ামী লীগের দোসর বলে তার ওপর আক্রমণ করা হয়েছে। ছায়ানট, উদীচী, প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে আক্রমণগুলো দেখলে বোঝা যায়। এটা উদ্দেশ্যহীন কতিপয় যুবকের হঠাৎ করে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ নয়, এটা খুবই পরিকল্পিত একটা সন্ত্রাস আক্রমণ।
আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘এটা আরও অবিশ্বাস্য এ কারণে যে, প্রত্যেকটা ঘটনার সময় তাদের (আক্রমণকারী) সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। কিন্তু তারা যখন ধ্বংসযজ্ঞ করছে, মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে, সে সময় সামনে পুলিশ ও সেনাবাহিনী দাঁড়ানো ছিল নিষ্ক্রিয়ভাবে। সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থা কী কারণে নিষ্ক্রিয় থাকলো, কেন নীরব থাকলো? কী কারণে, কীভাবে তারা এমন ভূমিকা পালন করলো, যাতে মনে হলো যারা এই ধ্বংসযজ্ঞ বা পরিকল্পিত আক্রমণ চালাচ্ছে, তাদের পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা সহযোগিতার ভূমিকায় রাষ্ট্র নেমেছে, সরকার নেমেছে? এই ভূমিকার কারণ কী?’
আনু মুহাম্মদ বলেন, গত কয়েক মাসে ফেইসবুকে যে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে, তার মধ্যে এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে আক্রমণ করার উসকানি দেয়া হয়েছে। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার এগুলো অজানা থাকার কথা নয়। গোয়েন্দা সংস্থা জানে যে, দেশ থেকে এবং বিদেশ থেকে কিছু উসকানিদাতা উসকানি দিচ্ছে মানুষকে আক্রমণ করার জন্য, ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য।
গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির এই সদস্য বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির ওপর আক্রমণ করার জন্য উসকানি দেয়া হচ্ছে, তাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন; আরেকটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শুধু শেখ হাসিনার আমল নয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন সময় শোষণ, নিপীড়ন, আধিপত্য, বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাদের একটা স্পষ্ট অবস্থান আছে এবং সেই সঙ্গে তারা মুক্তিযুদ্ধ ও গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে। মুক্তিযুদ্ধ চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির ওপর আক্রমণ কারা, কেন করতে পারে?
সমাবেশ থেকে সাত দফা দাবি উপস্থাপন করেন গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ঐক্যের নির্বাহী সদস্য মফিজুর রহমান। এসব দাবির মধ্যে আছে শরিফ ওসমান বিন হাদি, দীপু চন্দ্র দাস, আয়েশা আক্তারের হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার; উদীচী, ছায়ানট, প্রথম আলো, ডেইলি স্টারসহ দেশজুড়ে সংঘটিত প্রতিটি মব ও সন্ত্রাসী হামলার তদন্ত ও বিচার এবং সব সহিংসতায় উসকানিদাতাদের অবিলম্বে চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা। অন্য দাবিগুলো হলো- মতপ্রকাশের অধিকার ও জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিপূরণ দেয়া; চরমভাবে ব্যর্থ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে অপসারণ এবং তফসিলে ঘোষিত নির্ধারিত সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন। গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ঐক্যের শিল্পীদের প্রতিবাদী গানে শুরু হয় এই সমাবেশ। বাউলগান পরিবেশন করেন শিল্পী দেলোয়ার হোসেন। সমাবেশে সংহতি জানিয়ে উপস্থিত ছিলেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রতিনিধিরা। সমাবেশ শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য, মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণ, কাঁটাবন ও শাহবাগ মোড় ঘুরে উদীচী কার্যালয়ের সামনে গিয়ে শেষ হয়।
অর্থ-বাণিজ্য: নির্বাচনের প্রার্থীদের জন্য শনিবার সব ব্যাংক খোলা থাকবে