দেড় যুগের নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে অবশেষে যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তার এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে ঘিরে বৃহস্পতিবার, (২৫ ডিসেম্বর ২০২৫)ঢাকার বিমানবন্দর এলাকা এবং ৩০০ ফিট সড়কের সংবর্ধনাস্থল জনসমুদ্রে পরিণত হয়।
নিরাপত্তা ও বিভিন্ন ধরনের সহায়তার জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে ফোনে কৃতজ্ঞতা জানালেন
সংবর্ধনা মঞ্চে বিশেষ চেয়ার সরিয়ে বসলেন সাধারণ চেয়ারে
দেশবাসীর উদ্দেশে বললেন, ‘আই হ্যাভ এ প্ল্যান’
সন্ধ্যায় হাসপাতালে মাকে দেখে ফিরলেন বাসায়
আজ বাদ জুমা বাবার কবর জিয়ারত, স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা
তাকে বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিজি-২০২ ফ্লাইটটি বৃহস্পতিবার, সিলেটে যাত্রাবিরতির পর বেলা ১১টা ৪৩ মিনিটে ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে তারেক রহমানকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানিয়ে এবং আলিঙ্গনে-করমর্দনে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা।
তারেক রহমান বিমানবন্দর থেকে ফোনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে কথা বলেন। নিরাপত্তা ও বিভিন্ন ধরনের সহায়তার জন্য এসময় তিনি সরকারপ্রধানের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার সময় লাগোয়া বাগানে জুতা খুলে খালি পায়ে ঘাসের উপরে দাঁড়িয়ে দেশের মাটির স্পর্শ নেন তারেক রহমান। এসময় এক টুকরো মাটি হাতে নিয়ে স্পর্শ নেন মাতৃভূমির।
ঢাকায় পৌঁছানোর আগে সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটে ফ্লাইটটি সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরে পৌঁছায়। সেখানে সোয়া ঘণ্টার যাত্রাবিরতি শেষে বেলা ১১টা ১১ মিনিটে বিমানটি ঢাকার পথে রওনা হয়। যাত্রাবিরতির সময় তারেক রহমান বিমানেই অবস্থান করেন। সকাল ১০টা ১৮ মিনিটে ফেইসবুকে সস্ত্রীক হাস্যোজ্জ্বল ছবি পোস্ট করে বিএনপি নেতা লেখেন, ‘অবশেষে সিলেটে, বাংলাদেশের মাটিতে!’
এর আগে সকাল ৯টা ৩৪ মিনিটে আরেক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘দীর্ঘ ৬ হাজার ৩শ’ ১৪ দিন পর বাংলাদেশের আকাশে!’
সবার প্রতি কৃতজ্ঞ
ঢাকায় শাহজালাল বিমানবন্দরে উষ্ণ অভ্যর্থনার পর দুপুর ১২টা ৩৫ মিনিটে বিএনপির পতাকা রঙে সাজানো বাসে চড়ে নেতাকর্মীদের সঙ্গে ৩০০ ফিট সড়কের পথে রওনা হন তিনি। সেখানে প্রস্তুত ছিল সংর্বধনা মঞ্চ। যাত্রাপথে বুলেট প্রুফ বাসের সামনের দিকে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে সবাইকে শুভেচ্ছা জানান তিনি।
মানুষের এমন উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বসিত হয়ে তারেক রহমান তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ফেইসবুকে ছোট্ট একটি পোস্টে তিনি লেখেন, ‘সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা’।
সংর্বধনাস্থলের পথে তারেকের গাড়ি বহর ধীর গতিতে চলতে শুরু করে। বিমানবন্দর থেকে ৩০০ ফিটের সংবর্ধনা মঞ্চ পর্যন্ত সড়কের দুইপাশে সারি বেধে দাঁড়ান নেতাকর্মীরা। কোথাও কোথাও ছিল ভিড় উপচে পড়েছে। এ সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা চারপাশে নজর রাখার পাশাপাশি সড়কের দুইপাশে থাকা কর্মী সমর্থকদের গাড়ি বহর থেকে দূরে রাখেন। রাস্তার দুই ধারে অবস্থান করা নেতাকর্মীরা একের পর এক স্লোগান দেন। তাদের স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে উঠে পুরো এলাকা। কুড়িল থেকে ৩০০ ফিটের পুরো সড়ক মুখরিত ছিল নানান স্লোগানে।
সমাবেশস্থল জনসমুদ্র
তারেক রহমানকে স্বাগত জানাতে পূর্বাচলের ৩৬ জুলাই এক্সপ্রেসওয়ে (তিনশ ফিট সড়ক) জনসমুদ্রে পরিণত হয় সকাল থেকেই। বিমানবন্দর থেকে কুড়িল বিশ্বরোড পর্যন্ত সড়কে তীব্র যানজট ছিল। ভোর থেকেই বিমানবন্দর সড়কে গাড়ি চলছিল থেমে থেমে। আলো ফোটার পর তিনশ ফিট সড়ক ঘুরে দেখা যায়, কুড়িল বিশ্বরোড থেকে শুরু করে সংবর্ধনা মঞ্চ পর্যন্ত পুরো সড়ক নেতাকর্মীদের পদচারণায় মুখর। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা হাজার হাজার নেতাকর্মী রাতেই সমাবেশস্থলে অবস্থান নেন। অনেককেই রাত কাটান খোলা আকাশের নিচে। মঞ্চ আর আশপাশের এলাকায় তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না, পুরো এলাকায় ছিল উৎসবের আমেজ।
সবার মুখে মুখে দুটি স্লোগান বেশি শোনা যায়- ‘তারেক - রহমান, তারেক - রহমান’, ‘লিডার - আসছেন, লিডার - আসছেন’। স্লোগান, প্ল্যাকার্ড আর উচ্ছ্বাসে পুরো সমাবেশস্থল উৎসব কেন্দ্রে পরিণত হয়।
মঞ্চের ব্যানারে লেখা ছিল ‘জনাব তারেক রহমান এর ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’। মঞ্চে ছিল ১৯টি চেয়ার। মঞ্চের চারপাশে সতর্ক অবস্থানে ছিলেন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা।
সাধারণ চেয়ার
সড়কে জনস্রোতের কারণে খুব ধীরে চলা গাড়িবহরটি বিকেল পৌনে ৪টায় সমাবেশস্থলে পৌঁছায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই মঞ্চে উঠেন তারেক রহমান। বিশেষ চেয়ার সরিয়ে সাধারণ চেয়ারে বসে পড়েন তিনি।
অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, এরপর স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। এরপরই বক্তব্য রাখেন তারেক রহমান।
প্রায় ১৮ বছর পর দেশে ফিরে পূর্বাচলে লাখো মানুষের সমাবেশ মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিএনপি নেতা তারেক রহমান স্মরণ করলেন মার্টিন লুথার কিংয়ের অমর বাণী; সেই সুরে সুর মিলিয়ে বললেন, ‘আই হ্যাভ এ প্ল্যান’।
সংবর্ধনা মঞ্চে বিএনপির জেষ্ঠ্য নেতাদের ছাড়াও দীর্ঘদিনের যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গীদের মধ্যে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান পার্থ, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি তানিয়া রব, গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক, এনডিএমের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, এনপিপির চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, গণফোরামের সুব্রত চৌধুরী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক নুরুল আমিন ব্যাপারীসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
এভারকেয়ার থেকে বাসায়
এদিকে শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে তারেক রহমানের স্ত্রী জুবাইদা রহমান ও মেয়ে জাইমা রহমান সরাসরি যান গুলশানের ১৯৬ নম্বর বাসায়। তাদের দেশে ফেরার যাত্রায় সঙ্গী হিসেবে পোষা বিড়াল জেবুও ছিল। দুপুর আড়াইটায় বিএনপির ফেইসবুক পেইজে জানানো হয়, তাদের বহনকারী গাড়ি বাসায় পৌঁছে। ভিডিওতে জুবাইদা ও জাইমার পাশাপাশি তারেক রহমানের শাশুড়ি সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুকেও দেখা যায়।
তারেক রহমান ৩০০ ফিট সড়কে সংবর্ধন অনুষ্ঠান সেরে মাকে দেখতে বসুন্ধরার এভারকেয়ার হাসপাতালে যান। গত ২৩ নভেম্বর থেকে সেখানে ভর্তি আছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ২৭ নভেম্বর তার অবস্থা সংকটাপন্ন হলে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে নেয়া হয়।
বিমানবন্দর থেকে সমাবেশস্থল পর্যন্ত যেমন উপচেপড়া ভিড় ছিল, হাসপাতাল যাত্রার পুরো পথেই নেতাকর্মীদের ভিড় ছিল। ফলে তারেক রহমানের এই যাত্রায়ও ছিল ধীরগতি। তারেক রহমানকে একনজর দেখতে হাসপাতাল ও আশপাশের এলাকায়ও উপস্থিত ছিলেন বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী।
এদিকে গুলশানের বাসায় ঘণ্টা দুয়েক বিশ্রাম নেয়ার পর শাশুড়ি খালেদা জিয়াকে দেখতে এভারকেয়ার হাসপাতালে যান জুবাইদা রহমান, সঙ্গে ছিলেন মেয়ে জাইমা রহমান। বিকেল ৪টার পর তারা এভারকেয়ারে যান বলে বিএনপির ফেইসবুক পেইজের লাইভে বলা হয়। ৫টা ৫০ মিনিটের দিকে তাদের সঙ্গে যুক্ত হন তারেক রহমান।
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে হাসপাতাল থেকে বের হন তারেক রহমান। এ সময় তার সঙ্গে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা ছিলেন।
রাত সাড়ে আটটার দিকে তিনি গুলশান অ্যাভিনিউয়ের ১৯৬ নম্বর বাড়িতে পৌঁছান। বাড়িটি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর তার সহধর্মিণী খালেদা জিয়াকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের মন্ত্রিসভা। মাস কয়েক আগে এ বাড়ির দলিলপত্র বিএনপি চেয়ারপারসনের কাছে হস্তান্তর করেন গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান ও রাজউক চেয়ারম্যান রিয়াজুল ইসলাম রিজু।
তারেক রহমান এখন থেকে ১৯৬ নম্বর বাড়িতেই পরিবার নিয়ে থাকবেন। এর পাশেই ‘ফিরোজা’ নামের বাড়িটি খালেদা জিয়ার আবাসস্থল। হাসপাতালে ভর্তির আগে তিনি এ বাড়িতেই ছিলেন।
এক-এগারোর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ সালের ৭ মার্চ মইনুল রোডের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বিএনপির তৎকালীন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানকে। ওই বছরের ২৮ নভেম্বর আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অমানবিক নিপীড়নের বর্ণনা তুলে ধরেছিলেন তিনি। রিমান্ড, নির্যাতন, ১৮ মাস কারাভোগের পর ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জামিন নিয়ে চিকিৎসার জন্য সপরিবারে লন্ডনে যান তারেক রহমান।
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ১৩টি এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তার বিরুদ্ধে ৭২টি মামলা হয়। এর মধ্যে অন্তত ৫টি মামলায় যাবজ্জীবন কারাদ-সহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয় তাকে। গণমাধ্যমেও তার বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দেয় আদালত। শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। একে একে সব মামলা থেকে খালাস পান তারেক রহমান।
সতেরো বছরের বেশি সময় পর বৃহস্পতিবার, তিনি দেশে ফিরে এলেন। এ সময় ঢাকায় শাহজালাল বিমানবন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানাতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, সালাহউদ্দিন আহমদ, আব্দুল মঈন খান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ (টুকু) ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র শাহাদাত হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
আজ ও আগামীকালের কর্মসূচি
আজ শুক্রবার জুমার নামাজের পর তারেক রহমান যাবেন শেরেবাংলা নগরে। সেখানে তার বাবা, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবর জিয়ারত করবেন। জিয়ার সমাধি থেকে তারেক যাবেন সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে। মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন।
আগামীকাল নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য ভোটার তালিকায় নাম লেখাবেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। জাতীয় পরিচয়পত্রের কাজ সেরে তিনি যাবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, সেখানে ইনকিলাব মঞ্চের শরীফ ওসমান হাদির কবর জিয়ারত করবেন। পরে তিনি শ্যামলীতে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের দেখতে যাবেন।