শরিফ ওসমান হাদি হত্যা মামলার প্রধান আসামি ও তার সহযোগী ভারতে পালিয়েছেন বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। তাদের পালাতে সহযোগিতা করেছেন ভারতের দুই নাগরিক। মেঘালয় পুলিশ ওই দুই ভারতীয় নাগরিককে গ্রেপ্তার করেছে।
ফয়সাল ‘ভারতে নেই’, কেউ গ্রেপ্তারও হয়নি, বলছে মেঘালয় পুলিশ
আগামী ৭ জানুয়ারি চার্জশিটের আশা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার
ফয়সালের সহযোগী কবির রিমান্ড শেষে কারাগারে
ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শহীদ হাদি হত্যার দুই আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ ও তার সহযোগী আলমগীর শেখকে ভারতে পালাতে সহযোগিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার দুইজনের নাম জানিয়েছে ডিএমপি। তারা হলেন- পূর্তি ও সামী। তবে ফয়সাল ‘ভারতে নেই’, কেউ গ্রেপ্তারও হয়নি বলে জানিয়েছেন মেঘালয় পুলিশ।
রোববার, (২৮ ডিসেম্বর ২০২৫) ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত কমিশনার এস এন নজরুল ইসলাম বলেন, হাদির হত্যাকাণ্ডটি পূর্বপরিকল্পিত। ঘটনার পর ফয়সাল ও আলমগীর ঢাকা থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় আমিনবাজারে যান। সেখান থেকে গাড়িতে করে কালামপুরে যান। কালামপুর থেকে আরেকটি গাড়িতে করে ময়মনসিংহ সীমান্তে যান। সেখানে ফয়সাল ও আলমগীরকে নেন ফিলিপ পাল ও সঞ্জয়। তারা সীমান্তে অবৈধভাবে মানুষ পারাপার করেন। পরে ফিলিপ দুইজনকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে নিয়ে যান।
সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত কমিশনার আরও বলেন, ফয়সাল ও আলমগীরকে ভারতের তুরা নামক স্থানে নিয়ে যান ফিলিপ। সেখানে ভারতীয় নাগরিক পূর্তির কাছে তিনি দুইজনকে পৌঁছে দেন। পরে সামী নামের এক ব্যক্তির গাড়িতে করে সেখান থেকে পালিয়ে যান তারা। তিনি আরও বলেন, হাদি হত্যার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৬ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এছাড়া ৪ জন সাক্ষীও আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।
হাদি হত্যা মামলাটির তদন্ত একেবারে শেষপর্যায়ে রয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানায় ডিএমপি। আগামী ৭-১০ দিনের মধ্যে এ মামলার অভিযোগপত্র দেয়া হবে বলে ডিএমপি জানায়। সংবাদ সম্মেলনে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের অনেককেই শনাক্ত করা হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে সবার নাম বলা যাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে এটাকে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডই মনে হচ্ছে।’
ফয়সাল ‘ভারতে নেই’, কেউ গ্রেপ্তারও হয়নি, বলছে মেঘালয় পুলিশ
হাদি হত্যার প্রধান সন্দেহভাজনের পালিয়ে ভারতে যাওয়া এবং তাকে সহায়তার অভিযোগে মেঘালয়ে দুইজন গ্রেপ্তার হওয়ার যে তথ্য ঢাকার পুলিশ দিয়েছে, দিল্লি তা অস্বীকার করেছে। রোববার ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,মেঘালয় পুলিশ ও দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) ডিএমপির দুটি দাবিই প্রত্যাখ্যান করেছে।
রোববার হাদি হত্যা মামলার অগ্রগতি জানাতে সংবাদ সম্মেলনে আসেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) এস এন মো. নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, হাদি হত্যার প্রধান দুই সন্দেহভাজন ফয়সাল করিম এবং আলমগীর শেখ ভারতে পালিয়ে গেছেন। মেঘালয় পুলিশের সঙ্গে ‘ইনফরমাল চ্যানেলে’ যোগাযোগ করে তারা জানতে পেরেছেন, মেঘালয় পুলিশ ফয়সাল করিমকে সহায়তাকারী পুত্তি ও সামি নামে দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তিনি পালিয়ে যাওয়ার একটি বর্ণনাও দেন।
এর ঘণ্টা দুয়েক পরেই হিন্দুস্তান টাইমসের অনলাইনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিএসএফ ও মেঘালয় পুলিশের বরাত দিয়ে ডিএমপির দাবি অস্বীকার করা হয়। হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, হাদি হত্যার প্রধান দুই সন্দেহভাজন হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে মেঘালয়ে পালিয়ে গেছেন এবং এখন সেই রাজ্যে অবস্থান করছেন বাংলাদেশ পুলিশের এমন বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করেছেন মেঘালয় পুলিশের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা।
মেঘালয় পুলিশ সদর দপ্তরের ওই কর্মকর্তার বরাত দিয়ে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। প্রতিবেদনে উল্লিখিত অভিযুক্তদের কাউকেই গারো পাহাড়ে খুঁজে পাওয়া যায়নি এবং কোনো গ্রেপ্তারও করা হয়নি।’ হাদি হত্যায় অভিযুক্ত ফয়সাল ও আলমগীরের সীমান্ত পার হওয়া বা এই ঘটনায় পুত্তি ও সামি নামে দুইজনের ভূমিকার পক্ষে কোনো গোয়েন্দা তথ্য, সরেজমিন যাচাই বা অভিযানগত কোনো প্রমাণ নেই বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।
মেঘালয় পুলিশের ওই শীর্ষ কর্মকর্তার বরাতে বলা হয়েছে, ‘পুত্তি বা সামী নামে কাউকেই মেঘালয়ের কোথাও শনাক্ত করা যায়নি, খুঁজে পাওয়া বা গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। ধারণা করা যায়, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনো প্রকার ভেরিফিকেশন বা সমন্বয় ছাড়াই এই বিবরণ তৈরি করা হয়েছে।’ মেঘালয় পুলিশের এই দাবির পক্ষে ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীও সমর্থন জানিয়েছে বলে হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়।
বিএসএফের মেঘালয় ফ্রন্টিয়ারের মহাপরিদর্শক ওপি উপাধ্যায় বাংলাদেশ পুলিশের দাবিগুলো প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘হালুয়াঘাট সেক্টর দিয়ে এই ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক সীমান্ত পার হয়ে মেঘালয়ে প্রবেশের প্রকার প্রমাণই নেই। বিএসএফের পক্ষ থেকে এমন কোনো ঘটনা শনাক্ত বা রিপোর্ট করা হয়নি। এই দাবিগুলো ভিত্তিহীন এবং বিভ্রান্তিকর।’ বিএসএফ ও মেঘালয় পুলিশের এমন অবস্থানের বিষয়ে জানতে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার এসএন নজরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। এর আগে রোববার বেলা সাড়ে ১১টার সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ কর্মকর্তা নজরুল বলেন, ঘটনাটি ‘পূর্বপরিকল্পিত’ হওয়ায় আসামিদের শনাক্ত করার আগেই তারা ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে দেশ ছেড়ে যান।
# ৭ জানুয়ারি চার্জশিটের আশা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার
হাদি হত্যা মামলার তদন্ত কাজ ‘শেষ পর্যায়ে’ জানিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, আসছে বছরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে এই মামলার চার্জশিট দেয়া হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদেই হাদি হত্যার বিচার সম্পন্ন হবে বলেও প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। রোববার সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির সভা শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে কারা জড়িত রয়েছে তা উদ্ঘাটনে জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। গ্রেপ্তাকৃতদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য সাক্ষীদের জবানবন্দি এবং উদ্ধারকৃত আলামত পর্যালোচনা করে সার্বিক বিবেচনায় মামলাটির তদন্তের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ‘আগামী ১০ দিনের মধ্যে অর্থাৎ আগামী বছর ৭ জানুয়ারি এই মামলার চার্জশিট দেয়া সম্ভব হবে বলে আশা করছি।’ সবাইকে এ বিষয়ে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমরা অতি দ্রুত এই হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য এবং এর পিছনে যারা জড়িত রয়েছে তাদের নাম ঠিকানা পূর্ণাঙ্গ তালিকা সবার সামনে উন্মোচন করবো।’ ইতোমধ্যে এই মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্তের কথাও তুলে ধরেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দ্রুততার সঙ্গে ন্যায় বিচার নিশ্চিতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এই কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে ফ্যাসিস্ট দোসর, দুষ্কৃতকারী ও সন্ত্রাসীরা অনবরত তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। সেজন্য অনুরোধ করবো আমরা এমন কেন কাজ না করি যা আমাদের শত্রু পক্ষকে শক্তিশালী করবে এবং হাদি হত্যার বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে।’ তিনি আশ্বস্ত করে বলেন, ‘বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার, এই অন্তবর্তী সরকারের মেয়াদেই হাদি ভাইয়ের হত্যার বিচার সম্পণ্ণ করা হবে ইনশাআল্লাহ।’ তদন্তে নেমে দুটি বিদেশি পিস্তল, ৫২ রাউন্ড গুলি, মোটরসাইকেল ও ভুয়া নম্বর প্লেট এবং ৫৩টি অ্যাকাউন্টের বিপরীতে ২১৮ কোটি টাকার চেক উদ্ধারের কথা জানান তিনি।
# ফয়সালের সহযোগী কবির রিমান্ড শেষে কারাগারে
হাদি হত্যা মামলায় প্রধান আসামি ফয়সাল করিম মাসুদের সহযোগী কবিরকে রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। দুই দফায় ১২ দিনের রিমান্ড শেষে রোববার তাকে আদালতে হাজির করে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের মতিঝিল জোনাল টিমের ইন্সপেক্টর ফয়সাল আহমেদ। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার অ্যাডিশনাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জশিতা ইসলাম এ আদেশ দেন। প্রসিকিউশনের এসআই রুকনুজ্জামান এ তথ্য জানান।
গত ১৫ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা এলাকা থেকে কবিরকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এরপর গত ১৬ ডিসেম্বর সাত দিন এবং ২৩ ডিসেম্বর পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয় তার। গত ১৪ ডিসেম্বর ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আল জাবের বাদী হয়ে হত্যাচেষ্টা মামলা করেন, যা হাদির মৃত্যুর পর হত্যা মামলায় রূপান্তর হয়। পরবর্তীতে মামলাটিতে ৩০২ ধারা যুক্ত হয়। এই মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া আসামিরা হলেন, ফয়সালের বাবা মো. হুমায়ুন কবির ও মা মোসা. হাসি বেগম, ফয়সালের স্ত্রী সাহেদা পারভীন সামিয়া, বন্ধু মারিয়া আক্তার লিমা ও শ্যালক ওয়াহিদ আহমেদ সিপু, রেন্ট-এ কার ব্যবসায়ী মুফতি মো. নুরুজ্জামান নোমানী ওরফে উজ্জ্বল, ফয়সালের সহযোগী মো. কবির, ভারতে পালাতে সহযোগিতাকারী সিবিউন দিউ ও সঞ্জয় চিসিম এবং আমিনুল ইসলাম রাজু।
ওসমান হাদি ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ছিলেন। গত ১২ ডিসেম্বর জুমার নামাজের কিছু পর রাজধানীর বিজয়নগর কালভার্ট রোডে রিকশায় থাকা হাদিকে গুলি করা হয়। তাকে মাথায় গুলি করার পর আততায়ীরা মোটরসাইকেল নিয়ে পালিয়ে যায়। পরে হাদিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে নেয়া হয়। সেখানে ১৮ ডিসেম্বর মারা যান তিনি। রোববার মানিক মিয়া এভিনিউতে লাখ লাখ মানুষের অংশগ্রহণে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদসংলগ্ন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধিস্থলের পাশে দাফন করা হয়।