নতুন শিক্ষাবর্ষের আর বাকি দু’দিন। পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন ও একাধিকবার দরপত্র আহ্বানের কারণে এখনও সারাদেশে পৌঁছেনি ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের সব পাঠ্যবই। মোট ৩০ কোটি বইয়ের মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রায় ২২ কোটি বই উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে গেছে বলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। বাকি সব বই আগামী ২৪ জানুয়ারির মধ্যে সরবরাহের সময় পাচ্ছেন ছাপাখানা মালিকরা।
জানা গেছে, পাঠ্যবই থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি বাদ পড়ছে। পাশাপাশি শেখ হাসিনার নামের পাশে স্বৈরাচারসহ একাধিক বিশেষণ যুক্ত করা হয়েছে।
এনসিটিবি সূত্র ও ছাপাখানা মালিকদের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রাথমিকের শতভাগ এবং মাধ্যমিকের প্রায় ৫৮ শতাংশ বই উপজেলা পর্যায়ে বিতরণ করা হয়েছে। মাধ্যমিকের আরও প্রায় তিন কোটি বই উপজেলা পর্যায়ে সরবরাহের অপেক্ষায় রয়েছে। এসব বই আগামী দুই-তিনদিনের মধ্যে উপজেলায় সরবরাহ সম্পন্ন হবে বলে কর্মকর্তারা আশা করছেন। এতে মাধ্যমিকের প্রায় ৭০ শতাংশ বই উপজেলায় পৌঁছে যাবে বলে তাদের ধারণা।
মাধ্যমিকের পাঠ্যবই ছাপার কাজ পাওয়া একজন মুদ্রাকর সংবাদকে জানিয়েছেন, পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তু পরিবর্তনের কারণে এবার একাধিকবার পুনরায় দরপত্র আহ্বান করেছে এনসিটিবি। এ কারণে কার্যাদেশ পেতেও দেরি হয়েছে। দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী সব বইয়ের ছাপা শেষ করতে তাদের আগামী ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দেয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যেই তারা বই ছাপার কাজ শেষ করার চেষ্টা করছেন।
সরকার ২০১০ সাল থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ করে আসছে। ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে বিতরণ করা হয়েছে প্রায় ৪০ কোটি বই। এবার বইয়ের সংখ্যা প্রায় ১০ কোটি কমলেও ছাপায় পিছিয়ে রয়েছে এনসিটিবি।
আগামী বছরের জন্য প্রাক-প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর মিলিয়ে প্রায় ৩০ কোটি পাঠ্যবই ছাপানো হচ্ছে। এর মধ্যে মাধ্যমিক স্তরের জন্য ২১ কোটি ৪৩ লাখ ৩০ হাজার ৩০০টি এবং প্রাথমিক স্তরের (ইবতেদায়ি ছাড়া) জন্য ৮ কোটি ৫৯ লাখ ২৪ হাজার ৮৫৪টি।
ছাপায় পিছিয়ে মাধ্যমিকের বই:
নতুন শিক্ষাবর্ষের আর দু’দিন বাকি। এখনও মাধ্যমিকের প্রায় ৪০ শতাংশের বেশি বই ছাপার কাজ শেষ হলেও সরবরাহ হয়নি। অবশ্য প্রাথমিকের শতভাগ পাঠ্যবই মাঠপর্যায়ে সরবরাহ করা হয়েছে।
শিক্ষা উপদেষ্টা চৌধুরী রফিকুল আবরার (সিআর আবরার) জানিয়েছেন, আগামী জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ের আগেই শতভাগ নতুন বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে যাবে।
তিনি গতকাল রোববার এনসিটিবি কার্যালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ তথ্য জানিয়ে বলেন, শিক্ষা কার্যক্রম আগামী বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে শুরু হবে। তার আগেই ‘অলমোস্ট হান্ড্রেড পার্সেন্ট’ বই পৌঁছে যাবে।
এনসিটিবির হিসেবে, গত ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত মাধ্যমিকের প্রায় ৭৮ শতাংশ বই ছাপা শেষে বাঁধাই হয়েছে। কিন্তু সরবরাহ-পূর্ব পরিদর্শনসহ (পিডিআই) আনুষাঙ্গিক কাজ শেষে মাধ্যমিকের মোট বইয়ের ৫৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ বই গত ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মাঠপর্যায়ে সরবরাহ করা হয়েছে। সে হিসেবে প্রায় ৪২ শতাংশ পাঠ্যবই এখনও সরবরাহ করা হয়নি।
গত ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ষষ্ঠ শ্রেণীর ৮৭ দশমিক ০১ শতাংশ পাঠ্যবই ছাপা শেষ হলেও সরবরাহ হয়েছে ৬৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ। সপ্তম শ্রেণীর ৬৬ দশমিক ২৪ শতাংশ পাঠ্যবই ছাপা শেষ হলেও সরবরাহ হয়েছে ৩৭ দশমিক ২৫ শতাংশ।
এছাড়া অষ্টম শ্রেণীর ৫৪ দশমিক ০৩ পাঠ্যবই ছাপা হলেও সরবরাহ করা হয়েছে ২১ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং নবম-দশম শ্রেণীর ৮৮ দশমিক ৬২ শতাংশ বই ছাপা হলেও সরবরাহ করা হয়েছে ৭২ দশমিক ৪১ শতাংশ।
মাধ্যমিকের পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন-বাদ বঙ্গবন্ধু উপাধি:
মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ে পুনরায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। অষ্টম শ্রেণীর সাহিত্য কণিকা বই থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ নিবন্ধটি বাদ দেয়া হয়েছে। এছাড়া উচ্চ মাধ্যমিকের ইংরেজি বই থেকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাদ পড়ছে বলে এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে।
পাঠ্যপুস্তকে কিছু বিষয়ে পরিবর্তনের কথা জানিয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মাহবুবুল হক পাটওয়ারী সাংবাদিকদের বলেন, পাঠ্যবইয়ে কিছু বিষয় সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে।
গণঅভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরই পাঠ্যবইয়ে বেশকিছু পরিবর্তন আনা হয়। মাধ্যমিকের প্রতি শ্রেণীর বাংলা বইয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে লেখা, কবিতা ও কার্টুন যুক্ত করা হয়। ইতিহাসনির্ভর বিভিন্ন বিষয়েও পরিবর্তন আনা হয়েছিল। একই সঙ্গে প্রতিটি বইয়ের পেছনের কভারে ‘গ্রাফিতি’ দেয়া হয়।
পাঠ্যবইয়ে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে মেজর জিয়াউর রহমানের নাম যুক্ত করা হয়েছে। আর বিভিন্ন শ্রেণীর বইয়ের শেষ কভারে লেখা শেখ হাসিনার ছবি সম্বলিত বাণী বাদ যাচ্ছে।
এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, এবার পাঠ্যবইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বঙ্গবন্ধু উপাধি বাদ দিয়ে সেখানে লেখা হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমান। আর উচ্চ মাধ্যমিকের বাংলা বইয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতির ওপর একটি লেখা যুক্ত করা হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে লেখাও বাদ যাচ্ছে।
এছাড়া বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামের পাশে স্বৈরাচারসহ একাধিক বিশেষণ ব্যবহার এবং ইতিহাসনির্ভর কিছু বিষয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে।
প্রাথমিকে উৎসবমুখর পরিবেশে বই বিতরণের আহ্বান:
উৎসবমুখর পরিবেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতে ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই বিতরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও ১ জানুয়ারি এই বই বিতরণ উৎসব উদযাপন করা হবে। এ উৎসবের মাধ্যমে প্রাথমিক স্তরের ৮ কোটি ৫৯ লাখ বই হাতে পাবে শিক্ষার্থীরা।
গত ২৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) এক চিঠিতে এ তথ্য জানানো হয়। চিঠিটি সব বিভাগীয় উপ-পরিচালক, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, উপজেলা ও থানা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারদের পাঠানো হয়েছে।
ডিপিই’র এক কর্মকর্তা জানান, ‘গণভোটের বিষয়টি আলাদা, সেটি ভিন্ন চিঠি। মা সমাবেশ বা অভিভাবক সমাবেশ করে আলাদাভাবে গণভোটের বিষয়টি জানানো ও সবাইকে সচেতন করতে এ উদ্যোগে নেয়া হয়েছে। এটিও বই বিতরণের দিনে করা হবে।’
এবার নতুন বই বিতরণের দিনে মা সমাবেশের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ ধরনের সমাবেশে সাধারণত বিভিন্ন সচেতনতামূলক আলোচনা হয় কীভাবে বাচ্চারা পড়াশোনা করবে, স্বাস্থ্যের বিষয়ে খেয়াল রাখা, কীভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবে ইত্যাদি। তারই ধারাবাহিকতায় গণভোটের বিষয়টি আলোচনা করা হবে। ওই একইদিনই করা হবে।
চিঠিতে বলা হয়, প্রতি বছরের ন্যায় ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি উৎসবমুখর পরিবেশে শিক্ষার্থীদের হাতে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হবে। সেদিন মা বা অভিভাবক সমাবেশ আয়োজন করে স্থানীয় প্রশাসন বা গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে উৎসবমুখর পরিবেশে শিক্ষার্থীদের হাতে বই বিতরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ করা হয়েছে।