বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী চরিত্র, ‘আপসহীন নেত্রী’ খ্যাত বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া আর নেই। মঙ্গলবার, (৩০ ডিসেম্বর ২০২৫) ভোর ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন।
তাকে সংসদ ভবন এলাকায় স্বামী জিয়াউর রহমানের কবরের পাশেই সমাহিত করা হবে
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও গুরুত্বের সঙ্গে মৃত্যুর সংবাদ প্রচার
রাষ্ট্রীয় ও দলীয় শোক প্রকাশ
শেষ পর্যন্ত চিকিৎসার জন্য আর বিদেশে
নেয়া গেল না
মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। তার এই প্রয়াণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির দীর্ঘ চার দশকের লড়াই-সংগ্রাম, উত্থান-পতন এবং ক্ষমতার পালাবদলের এক ঘটনাবহুল অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটলো।
তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরেই লিভার সিরোসিস, কিডনি জটিলতা, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস ও হৃদরোগসহ নানাবিধ শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন। শ্বাসকষ্ট বৃদ্ধি পেলে গত ২৩ নভেম্বর তাকে দ্রুত এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং দেশি-বিদেশি চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের অধীনে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হলেও শারীরিক অবস্থার কারণে তা সম্ভব হয়নি। মঙ্গলবার, ভোর ৬টায় চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
সরেজমিন রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের সামনে গিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের ব্যাপক ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। প্রিয় নেত্রীর মৃত্যুর খবর শুনে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে নানান পর্যায়ের নেতাকর্মীরা ছুটে এসেছেন এক পলক দেখতে। কেউ কেউ তাদের নেত্রীকে একপলক দেখার জন্য এসেছেন, কেউ কেউ ভালোবাসার টানে ছুটে এসেছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হাসপাতালের সামনে ব্যারিকেড দিয়ে বেষ্টনী দিয়ে রেখেছে পুলিশ। এছাড়া র্যাব ও বিজিবিসহ আরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিয়েছেন। ঢাকায় থাকা দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রায় সবাই তখন হাসপাতালের ভেতরে অবস্থান করছিলেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
গত ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার পরদিন থেকেই খালেদা জিয়ার শ্বাসকষ্টের জটিলতা বাড়ে। পরে ২৩ নভেম্বর এভারকেয়ার হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। পরিক্ষা-নিরিক্ষার পর তার ফুসফুসে সংক্রমণ ধরা পড়লে ২৬ নভেম্বর সিসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। ফুসফুসে সংক্রমণের কারণে যে জটিলতা তৈরি হয়েছিল, সেটার কিছুটা উন্নতি হলেও হৃদ?যন্ত্রে জটিলতা রয়ে গিয়েছিল।
এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু শারীরিক অবস্থা বিমান ভ্রমণের অনুকূলে না থাকায় বিদেশ যাত্রা পিছিয়ে যায়। তাকে বহন করতে কাতার সরকারের ব্যবস্থাপনায় এয়ার অ্যাম্বুলেন্সও ঢাকায় আসার কথা ছিল, যা শেষ মুহূর্তে বাতিল করা হয়। জার্মানভিত্তিক অপারেটর ‘এফএআই এভিয়েশন গ্রুপ’-এর এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটি গত ৯ ডিসেম্বর সকাল ৮টায় ঢাকায় অবতরণ এবং রাত ৯টায় লন্ডনের উদ্দেশে উড্ডয়নের কথা ছিল। সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ অপারেটরের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই অনুমতি বা ‘স্লট’ বরাদ্দও দিয়েছিল। তবে পরদিন অপারেটর সংস্থাটি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কাছে স্লট বাতিলের আবেদন করে। এর আগে কাতার আমিরের বিশেষ বিমানে তাকে নেয়ার কথা থাকলেও কারিগরি ত্রুটির কারণে তা বাতিল করে জার্মানি থেকে এই বিমানটি ভাড়া করা হয়েছিল।
চিকিৎসকদের সূত্রে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার পাকস্থলীর রক্তক্ষরণ বন্ধে ছোট একটি অপারেশন করা হয় এভায়কেয়ার হাসপাতালে। এরপর তিনি ওষুধ গ্রহণ করতে পারছিলেন, যা চিকিৎসকরা পরোক্ষ উন্নতি হিসেবে দেখেছেন। চিকিৎসকরা বলেছেন, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা স্থীতিশীল।
তখন খালেদা জিয়ার বিদেশ যাত্রার বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন জানিয়েছিলেন, ‘এয়ার অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত থাকলেও বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টি নির্ভর করছে ওনার শারীরিক অবস্থার ওপর। যখনই মেডিকেল বোর্ড মনে করবে তাকে নিরাপদে স্থানান্তর করা সম্ভব, তখনই তিনি বিদেশে যাবেন।’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সহধর্মিণী ডা. জুবাইদা রহমান দেশে ফিরে স্বশরীরে হাসপাতালে উপস্থিত থেকে মেডিকেল বোর্ডের সঙ্গে সমন্বয় করে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার তদারকি করছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেয়ার আর সুযোগ তৈরি করা সম্ভব হয়নি।
এর আগে গত জানুয়ারির প্রথম দিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেয়া হয়েছিল। কাতারের আমিরের পাঠানো বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে লন্ডনে নেয়া হয়েছিল। এরপর যুক্তরাজ্যের লন্ডনে বিশেষায়িত হাসপাতাল ‘লন্ডন ক্লিনিকে’ ভর্তি করা হয়েছিল। সে সময় নিজে গাড়ি চালিয়ে তারেক রহমান খালেদা জিয়াকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছান। সঙ্গে ছিলেন তারেক রহমানের সহধর্মিণী জুবাইদা রহমান।
লন্ডনের ‘লন্ডন ক্লিনিকে’ কিছুদিন চিকিৎসা নেয়ার পর খালেদা জিয়া তার বড় ছেলে তারেক রহমানের বাসায় থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করেন।
তারও আগে ২০২৩ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঢাকায় আসা জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের তিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে খালেদা জিয়ার শরীরে রক্তনালিতে সফল অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল।
তখন চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, তার (খালেদা জিয়ার) লিভার প্রতিস্থাপন খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, লিভার প্রতিস্থাপনের পর পুরো চিকিৎসায় দুই মাসের মতো লেগে যেতে পারে। চোখ ও পায়ের ফলোআপ চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়া ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই আরেকবার লন্ডনে গিয়েছিলেন।
বিএনপি সূত্র নিশ্চিত করে জানিয়েছে, খালেদা জিয়াকে সংসদ ভবন এলাকায় জিয়া উদ্যানে স্বামী জিয়াউর রহমানের কবরের পাশেই সমাহিত করা হবে। এজন্য সব রকম প্রস্তুতি চলছে। ইতোমধ্যে তাকে সমাহিত করতে কবরের মাপ নেয়া হয়েছে। মঙ্গলবার, সকাল পৌনে ১২টার দিকে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, দাফনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার লক্ষ্যে কবরের মাপ নেয়া হচ্ছে। খালেদা জিয়ায় মৃত্যতে জিয়া উদ্যান এলাকায় তার কবর খননকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জেরদার করা হয়েছে। একে একে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা জিয়া উদ্যানে ছুটে আসছেন।
খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছেন এবং আজ তার জানাজা ও দাফনের জন্য সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা তাকে ‘জাতির জন্য অনুপ্রেরণার এক অনন্য উৎস’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদানের বিষয়ে বিশেষ ক্যাবিনেট বৈঠকেরও ডাক দেয়া হয়।
বিএনপিও দলের পক্ষ থেকে ৭ দিনের শোক কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে রয়েছে দলীয় কার্যালয়গুলোতে কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাজ ধারণ, কোরআন খতম এবং শোক বই খোলা।
খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বিএনপিতে এবং জাতীয় রাজনীতিতে বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। মায়ের মৃত্যুতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে অত্যন্ত বিমর্ষ ও নির্বাক দেখা গেছে, যিনি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দলীয় বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন। বিশ্লেষকদের মতে, খালেদা জিয়া ছিলেন দলটির ঐক্যের প্রতীক। গত ১৫ বছরে জেল-জুলুম ও মামলা-হামলার মুখেও নেতাকর্মীরা তাকে ছেড়ে যাননি, যা দলে তার গভীর গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ দেয়।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও গুরুত্বের সঙ্গে মৃত্যুর সংবাদ প্রচার
খালেদা জিয়ার মৃত্যু সংবাদ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হয়েছে। রয়টার্স, বিবিসি, এএফপি, সিএনএন, আল জাজিরা এবং নিউইয়র্ক টাইমসসহ প্রধান প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলো তাকে বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী এবং গণতন্ত্রের জন্য আপসহীন লড়াকু হিসেবে চিত্রিত করেছে। গার্ডিয়ান ও ওয়াশিংটন পোস্ট তাদের প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার সঙ্গে তার দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং সাম্প্রতিক সময়ে কারাবাসের বিষয়টিও তুলে ধরেছে।
খালেদা জিয়া কেবল একজন রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি সময়ের প্রতিনিধি। তিনি সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে কখনো পরাজিত হননি, যা তার অসামান্য জনপ্রিয়তার প্রমাণ। জীবনের শেষ ভাগে তিনি দীর্ঘ কারাভোগ ও অসুস্থতার সঙ্গে লড়াই করেছেন, কিন্তু দেশ ছেড়ে যাননি। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারালো এমন একজন নেত্রীকে, যিনি সংকটকালে বার বার সাহসের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ইতিহাস তাকে মনে রাখবে গণতন্ত্রের প্রতি তার অবিচল আস্থা এবং আপসহীন সংগ্রামের জন্য।