‘মব সন্ত্রাসে’ হত্যা ২০২৫ সালে আগের বছরের চেয়ে বেড়েছে

বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫
সংবাদ অনলাইন রিপোর্ট

ময়মনসিংহের ভালুকায় ২০২৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর গার্মেন্টস শ্রমিক দিপু চন্দ্র দাসকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে কারখানা থেকে ধরে এনে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর তার মৃতদেহে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটায় একটি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী।

আসকের মানবাধিকার প্রতিবেদন

কারা হেফাজতে মৃত্যু

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড

আদিবাসী নিপীড়ন, ধর্ষণ

সীমান্ত হত্যা ও নির্যাতন

ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন

সাংবাদিক নির্যাতন

গৃহকর্মী নির্যাতন

এটি বর্বরতার চূড়ান্ত সীমাকে অতিক্রম করেছে উল্লেখ করে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলছে,

‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুসন্ধানে দিপু চন্দ্র দাসের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগের কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি।’

এরআগে ২০২৫ সালের ৯ আগস্ট রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলায় গত ভ্যানচোর সন্দেহে পিটিয়ে দুই ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। নিহত ব্যক্তিরা হলেন উপজেলার ঘনিরামপুর এলাকার বাসিন্দা রুপলাল দাস (৪০) ও মিঠাপুকুর উপজেলার প্রদীপ দাস (৩৫)।

রুপলাল দাস জুতা সেলাইয়ের কাজ করতেন আর প্রদীপ দাস ভ্যান চালাতেন। রুপলাল দাসের মেয়ের বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করার জন্য নিজের ভ্যান চালিয়ে আত্মীয় রুপলাল দাসের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন প্রদীপ দাস। রাত ৯টার দিকে তারাগঞ্জ-কাজীরহাট সড়কের বটতলা এলাকায় পৌঁছালে ভ্যানচোর সন্দেহে তাদের দুজনকে পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।

আসক বলছে, ‘ঘটনাস্থলে পুলিশের উপস্থিতি থাকলেও পুলিশের কোনো ধরনের পদক্ষেপ না নিয়ে ঘটনাস্থলে অধিক লোকের জড়ো হওয়া দেখে ঘটনাস্থল ত্যাগ করার অভিযোগ রয়েছে।’

ভালুকা আর তারাগঞ্জের এ ঘটনাই নয়, আসকের হিসাব অনুযায়ী ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ‘মব সন্ত্রাসের’ শিকার হয়ে কমপক্ষে ১৯৭ জনের প্রাণ গেছে। ২০২৫ সালে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আসকের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এ চিত্র পাওয়া গেছে। বুধবার, (৩১ ডিসেম্বর ২০২৫) আসক এ প্রতিবেদন প্রকাশ করছে।

দেশের বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত মানবাধিকার সম্পর্কিত খবর এবং আসকের পর্যবেক্ষণসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার তথ্য সংগ্রহ ও সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরী করা হয়েছে বলে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে।

আসক বলছে, ২০২৪ সালে মব সন্ত্রাসের শিকার হয়ে নিহত হয়েছিলেন অন্তত ১২৮ জন। আর অন্তর্বর্তী সরকারের এই (২০২৪ এর ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে) সময়কালে কমপক্ষে ২৯৩ জন মব সন্ত্রাসের শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন।

আসকের প্রতিবেদনে মব সন্ত্রাস, ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, বিচারবহির্ভূত হত্যা, হেফাজতে মৃত্যু, সংখ্যালঘু নির্যাতন, রাজনৈতিক সহিংসতায় হত্যা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতাসহ নানা ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

আসক বলেছে, ‘দেশে নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি জনগণের মধ্যে আশা ও প্রত্যাশা সৃষ্টি হলেও বাস্তব পর্যায়ে বৈষম্য, নিপীড়ন ও দমন-পীড়নের চিত্রে আশানুরূপ ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যায়নি; বরং কিছু ক্ষেত্রে মানবাধিকারের সামগ্রিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে বলে লক্ষ করা যায়। এই সময়ে মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ভাস্কর্য ও স্থাপনায় ভাঙচুর ও অবমাননার ঘটনা ঘটেছে। বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরেও বারবার ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এসব কর্মকাণ্ড বাঙালি জাতিসত্তা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত জাতীয় স্মৃতিচিহ্নসমূহের প্রতি গুরুতর অবমাননার শামিল।’

মব সন্ত্রাস

২০২৫ সালজুড়ে মব সন্ত্রাস আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে বলে আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। আসক বলেছে, ‘কোনো ধরনের প্রমাণ, তদন্ত বা আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে, সন্দেহ, গুজব সৃষ্টি করে মানুষকে মারধর ও হত্যা করা হয়েছে। তৌহিদি জনতার নামে বেআইনিভাবে মব তৈরি করে শিল্প-সংস্কৃতি কেন্দ্র ভাঙচুর, বাউল সম্প্রদায়ের ওপর হামলা- এমনকি কবর থেকে তুলে লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। মুক্তিযোদ্ধাসহ বিরুদ্ধ মতের মানুষকে নানাভাবে হেনস্তা করার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নিষ্ক্রিয়তা এবং অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার ক্ষেত্রে উদাসীনতার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে।’

আসকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, মব সন্ত্রাসের শিকার হয়ে ২০২৫ সালে ঢাকা জেলায় সর্বাধিক ২৭, গাজীপুরে ১৭, নারায়ণগঞ্জে ১১, চট্টগ্রামে ৯, কুমিল্লায় ৮, ময়মনসিংহে ৬, বরিশালে ৬, নোয়াখালীতে ৬, গাইবান্ধায় ৬, শরীয়তপুরে ৬, লক্ষ্মীপুরে ৫, সিরাজগঞ্জে ৫, টাঙ্গাইলে ৫, নরসিংদীতে ৪, যশোরে ৪ জনসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মব সন্ত্রাসে কমপক্ষে ১৯৭ জন নিহত হয়েছেন।

আদিবাসী নিপীড়ন, ধর্ষণ ও হত্যা

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের বরাত দিয়ে আসক জানায়, ২০২৫ সালের মে মাসে খাগড়াছড়ির থানচিতে একজন ২৯ বছর বয়সী খিয়াং নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। তার দেহে মারাত্মক আঘাতের চিহ্ন ছিল, চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছিল। স্থানীয় ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা এই ঘটনার বিচার দাবি করে বিক্ষোভ করলে পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে।

২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে খাগড়াছড়ির গুইমারায় স্থানীয় কিশোরীর ধর্ষণের কথা ছড়িয়ে পড়ায় ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর তরুণরা প্রতিবাদে রাস্তায় নামেন। এ ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে। এতে তিন ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর সদস্য নিহত ও চারজন আহত হন।

আসক বলছে, ২০২৫ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা সহিংসতা, নিপীড়ন, যৌন নির্যতান, হত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন।

আসক বলছে, ২০২৫ সালে নারীর প্রতি সহিংসতা গুরুতর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, অনলাইন সহিংসতা এবং নারীদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক বক্তব্য ছড়ানো, তাদের পোষাক ও আচরণ নিয়ে নৈতিকতা নির্ধারণের চেস্টা তথা ‘মোরাল পুলিশিং’- এর মতো নিপীড়নমূলক প্রবণতা গুরুতর আকার ধারণ করেছে।

আসকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ধর্ষণের মোট ৭৪৯টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৫৬৯টি ছিল একক ধর্ষণ এবং ১৮০টি দলবদ্ধ ধর্ষণ। ভুক্তভোগীদের একটি বড় অংশই শিশু ও কিশোরী। ধর্ষণের পর অন্তত ৩৬ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে, সাত জন নারী আত্মহত্যা করেছেন এবং ধর্ষণের চেষ্টার পর প্রাণ হারিয়েছেন আরও ছয় জন নারী। পাশাপাশি ধর্ষণের চেষ্টার ঘটনা ঘটেছে অন্তত ২৩০টি।

আসকের তথ্যমতে, ধর্ষণের ঘটনা দেশের প্রতিটি জেলাতেই সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ঘটনার শিকার হয়েছে ঢাকা জেলায় ৮৪, এরপর নারায়ণগঞ্জে ৪২, গাজীপুরে ৩৫, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লায় ২৮ জন সহ অন্যান্য জেলায় বাকি ৫৩২টি ধর্ষণের মত সহিংসতা ঘটেছে।

*কারা হেফাজতে ১০৭ জনের মৃত্যু*

২০২৫ সালে কমপক্ষে ১০৭ জন দেশের বিভিন্ন কারাগারে মারা গেছেন। এর মধ্যে ৬৯ জন হাজতি এবং কয়েদি ৩৮ জন। সারা দেশের কারাগারগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মারা গেছেন ৩৮ জন এবং এরপর রয়েছে গাজীপুর, যেখানে ৭ জন মারা গেছেন। এ ছাড়া বাকি মৃত্যুগুলো হয়েছে দেশের অন্যান্য কারাগারে। উল্লেখ্য, ২০২৪ সালে দেশের কারাগারসমূহে ৬৫ জনের মৃত্যু ঘটেছিল। যার মধ্যে হাজতি ৪২ এবং কয়েদি ছিলেন ২৩ জন।

১৪ জুন ২০২৫ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢাকা জেলার সাভার এলাকার বিরুলিয়া ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান সুজনের (৪৫) ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। কারা কর্তৃপক্ষ এটিকে আত্মহত্যা বললেও আসকের কাছে পরিবারের দাবি অনুযায়ী তিনি হৃদ্?রোগে ভুগছিলেন এবং কারাগারে যথাযথ চিকিৎসা পাননি। পাশাপাশি তিনি আত্মহত্যা করতে পারেন বলে পরিবার মনে করে না।

২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে সাবেক শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন জেল হেফাজতে থাকাকালীন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ আউটপোস্টের ইন্সপেক্টর মো. ফারুকের ভাষ্য অনুযায়ী, তাকে আগের দিন হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং ২৯ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টা ২০ মিনিটে তিনি মারা যান।

তবে মৃত্যুর পর একটি বিষয় জনপরিসরে তীব্র বিতর্কের জন্ম দেয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কিছু ছবিতে দেখা যায়, মৃত্যুর পরও তার হাতে হাতকড়া পরানো অবস্থায় তাকে বহন করা হয়েছে।

*বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড*

২০২৫ সালে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ার’-এর নামে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনাও অব্যাহত ছিল। আসকের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ২০২৫ সালে কমপক্ষে ৩৮ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। এসব ঘটনা সংঘটিত হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে, নির্যাতনে, কথিত ‘গুলিতে’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে। বছরের বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত এসব ঘটনা আবারও প্রমাণ করে যে বিচারিক প্রক্রিয়া এড়িয়ে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী বলপ্রয়োগ একটি চলমান মানবাধিকার সংকট হিসেবে বিদ্যমান রয়েছে।

২০২৫ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত বিচারবহির্ভূত হত্যার ৩৮টি ঘটনার মধ্যে শারীরিক নির্যাতন, যৌথ বাহিনীর হেফাজতসহ তথাকথিত ‘গুলিতে’ বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ২৬ জন। এ ছাড়া কমপক্ষে ১২ জন দেশের বিভিন্ন থানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুবরণ করেছেন। উল্লেখ্য, ২০২৪ সালে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন ২১ জন।

*রাজনৈতিক সহিংসতা*

আসক বলছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা একটি চরম ও ধারাবাহিক রূপ ধারণ করেছে, যা ২০২৫ সালে আরও বিস্তৃত ও সহিংসতর হয়ে উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে দেশে অন্তত ৪০১টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় প্রায় ৪ হাজার ৭৪৪ জন আহত এবং ১০২ জন নিহত হয়েছেন।

আসকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই সময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে অন্তত ৩৫টি সংঘর্ষের ঘটনায় ৪৫৪ জন আহত এবং নিহত হয়েছেন ১০ জন; বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে ৩৩টি সংঘর্ষের ঘটনায় ৫২০ জন আহত এবং ৩ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া বিএনপি ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মধ্যে ৪টি সহিংস সংঘর্ষের ঘটনায় শতাধিক আহত হয়েছেন। সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, দলীয় অভ্যন্তরীণ সহিংসতার মাত্রা বিশেষত বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলে ১৯২টি সংঘর্ষে অন্তত ৩৯ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২ হাজার ৩৮০ জন।

আসক বলছে, এসব ঘটনা রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের সংকট ও সহিংসতার সংস্কৃতিকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। এ ছাড়া সারা দেশে দুর্বৃত্তদের হামলা, নির্যাতন ও গুলিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কমপক্ষে ১১১ জন নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন।

*সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানি*

২০২৫ সালে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও আইনি নিপীড়নের ঘটনা একটি উদ্বেগজনক ধারায় পৌঁছেছে বলে মনে করে আসক।

আসকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে অন্তত ৩৮১ জন সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা নির্যাতন, হয়রানি বা হুমকির শিকার হয়েছেন অন্তত ২৩ জন সাংবাদিক। প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছেন ২০ জন। প্রকাশিত সংবাদ বা মতামতকে কেন্দ্র করে মামলার সম্মুখীন হয়েছেন কমপক্ষে ১২৩ জন সাংবাদিক। পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় সরাসরি হামলার শিকার হয়েছেন ১১৮ জন সাংবাদিক। এ সময়কালে দুর্বৃত্ত কর্তৃক হত্যার শিকার হয়েছেন ৩ জন সাংবাদিক এবং দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে রহস্যজনকভাবে ৪ জন সাংবাদিকের লাশ উদ্ধারের ঘটনা ঘটে।

আসক বলেছে, ‘এ সময়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হুমকির মধ্যে পড়েছে। গণমাধ্যমের ওপর বাংলাদেশের ইতিহাসের জঘন্যতম হামলা হয়েছে ১৮ ডিসেম্বর। এ দিন রাতে একদল প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার ভবনে নজিরবিহীনভাবে ভাঙচুর, লুটতরাজ ও আগুন–সন্ত্রাস চালায়। এই হামলার ফলে সেখানে কর্মরত সংবাদকর্মীরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় পড়েন। এমনকি হামলার সময় ফায়ার সার্ভিসের কাজে বাধা দেওয়ার ঘটনাও ঘটে, যা পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তোলে। এর ফলে পত্রিকা দুটির ইতিহাসে মুদ্রিত ও অনলাইন সংস্করণ এক দিনের জন্য বন্ধ রাখতে হয়।’

*ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন*

২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, ভয়ভীতি, লুটপাট, আগুন ও প্রতিমা ভাঙচুরের মতো একাধিক সহিংস ঘটনা ঘটেছে। এই বছর হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর কমপক্ষে ৪২টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এই হামলাসমূহে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৩টি বাড়িঘর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে ৩৬টি বসতঘরে। এ ছাড়া ৪টি মন্দিরে হামলা, ৬৪টি প্রতিমা ভাঙচুর, ৯টি জমি দখলের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১ জন, আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১৫ জন।

একই সময়ে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মন্দিরে ১টি হামলার ঘটনা ঘটে। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, রাজনৈতিক বিদ্বেষ ও ভূমি দখলের প্রবণতা এ ধরনের সহিংসতার পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে, যা সংবিধানপ্রদত্ত ধর্মীয় স্বাধীনতার লঙ্ঘন। ২০২৫ সালে মব তৈরি করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে। কখনো এক বা একাধিক ব্যক্তির ওপর হামলা, পুরো সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের মতো ঘটনা ঘটে।

*নারীর অধিকার*

পর্যবেক্ষণে আসক বলছে, নারীরা বর্তমানে এক বিস্তৃত নিরাপত্তাহীনতার আবহে জীবনযাপন করছেন। বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশ্যে নারীদের মারধর, অপমান, এবং শারীরিক নিপীড়নের ঘটনা বেড়েছে। ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, এবং পারিবারিক ও সামাজিক সহিংসতা এখন প্রায় নিয়মিত সংবাদে উঠে আসছে। নারীদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক বক্তব্য ছড়ানো, তাদের পোশাক বা আচরণ নিয়ে নৈতিকতা নির্ধারণের চেষ্টা তথা ‘মোরাল পুলিশিং’এর নামে যা দিনদিন তীব্রতর হচ্ছে। নারীদের এই নিপীড়ন কেবল ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি কাঠামোগত সহিংসতার রূপ নিয়েছে, যেখানে নারীদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পথ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে।

*পারিবারিক সহিংসতা*

২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে দেশে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে কমপক্ষে ৫৬০টি। এর মধ্যে একাধিক নারী স্বামী ও তার পরিবারের সদস্যদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ২৮ জন নারী স্বামীর দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন এবং ১০ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন স্বামীর পরিবারের হাতে। এ ছাড়া ২১৭ জন নারী স্বামী কর্তৃক হত্যার শিকার হয়েছেন এবং ৬৩ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে স্বামীর পরিবারের সদস্যদের দ্বারা। নিজের পরিবারের সদস্যদের হাতেও ৫১ জন নারী প্রাণ হারিয়েছেন এবং ২৩ জন নারী পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এসব সহিংসতা থেকে মুক্তির পথ খুঁজে না পেয়ে অন্তত ১৬৮ জন নারী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন, যা সামাজিক কাঠামোর সহানুভূতির অভাব ও নিরাপত্তাহীন বাস্তবতাকে নগ্নভাবে প্রকাশ করে বলে মনে করে আসক।

*যৌন হয়রানি*

আসকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত অন্তত ১৯৩ নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। উত্যক্তকারীরা অন্তত ১৭৩জন ভুক্তভোগীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছেন। এর মধ্যে প্রতিবাদ করায় খুন হয়েছে ৩ জন নারী ও ৮ জন পুরুষ। এ ছাড়া চার জন নারী আত্বহত্যা করেছে।

আসকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে যৌতুকসংক্রান্ত সহিংসতার অন্তত ৭৯টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৩৫জন নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন, ৪১ জনকে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়।

২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে নারীর ওপর এসিড নিক্ষেপের অন্তত আটটি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে তিন জন নারী প্রাণ হারিয়েছেন।

*গৃহকর্মীদের ওপর সহিংসতা*

২০২৫ সালে গৃহকর্মীদের ওপর সহিংসতার ১৬টি ঘটনা ঘটেছে। এই সময়ে অন্তত পাঁচ জন গৃহকর্মী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তিন জন এবং ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে এক জনের ওপর। একই সঙ্গে তিন জন আত্মহত্যা করেছেন এবং চির জনের মৃত্যু হয়েছে নির্যাতনের পর।

*শিশু অধিকার*

২০২৫ সালে ১০২৩ জন শিশু বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। একই সময়ে অন্তত ৪১০ জন শিশু বিভিন্ন ধরনের সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছে। এসব ঘটনার মধ্যে রয়েছে ধর্ষণের পর হত্যা, শারীরিক নির্যাতন, অপহরণ, আত্মহত্যা এবং বিস্ফোরণে মৃত্যু।

*সীমান্ত হত্যা ও নির্যাতন*

আসকের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় কমপক্ষে ৩৪ জন বাংলাদেশি নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২৪ জন বিএসএফের গুলিতে এবং ১০ জন বিএসএফ এর শারীরিক নির্যাতনের পর মারা যান। এ ছাড়াও একই সময়ে ৩৮ জন গুলিবিদ্ধ বা শারীরিকভাবে আহত হন এবং ১৪ জন অপহরণের শিকার হন, যাদের মধ্যে চার জনকে পরে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়।

২০২৫ সালে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সার্বিক পর্যবেক্ষণে আসক বলছে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পরিবর্তন মানবাধিকারের বাস্তব পরিস্থিতিতে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আনতে পারেনি। বরং পুরনো নিপীড়ন-পদ্ধতির ধারাবাহিকতা নতুন রূপে বহমান রযেছে। দমনমূলক শাসনব্যবস্থা, জবাবদিহিতাহীন এবং বৈষম্যমূলক আচরণকে নিষ্কণ্টকভাবে টিকিয়ে রেখেছে। যা মানবাধিখার পরিস্থতিকে সার্বিকভাবে অস্থির ও উদ্বেগজনক বলে বিবেচিত হয়েছে।

আসক বলছে, জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্য মর্যাদাপূর্ণ ও সম-অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশে মানবাধিকার সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য সরকার ও নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রয়াস জরুরি বলে প্রতিষ্ঠানটি মনে করে। সর্বোপরি মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে সরকারের আরো কার্যকর ভূমিকা প্রত্যাশা করে আসক।

‘জাতীয়’ : আরও খবর

» খ্রিস্টীয় নববর্ষ উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানালেন প্রধান উপদেষ্টা

সম্প্রতি