alt

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি

সরকারের যুক্তির সঙ্গে একমত নন বিশেষজ্ঞরা

ফয়েজ আহমেদ তুষার : শনিবার, ০৬ আগস্ট ২০২২

আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি, পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার এবং বিপিসির লোকসানের কথা বলে দেশে জ্বালানি তেলের দাম হঠাৎ করে ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে সরকার। তবে সরকারের এসব যুক্তির সঙ্গে একমত হতে পারছেন না জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। সেবাধর্মী এই প্রতিষ্ঠানের লাভ-লোকসান আমদানি মূল্য ও বিক্রয় মূল্যের বিয়োগ ফল দিয়ে বের করে দেখালেই হবে না। বিপিসি বছর বছর সরকারকে যে ট্যাক্স (শুল্ক, কর ও মুসক) দিচ্ছে, সেটাও রাষ্ট্রের মুনাফা হিসেবে ধরতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে গিয়ে দেশে উৎপাদিত পেট্রল, অকটেনের দাম বৃদ্ধি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বলে মনে করেন তারা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম যখন অনেক কম ছিল, তখন সরকার দেশে সে অনুযায়ী তেলের দাম কমায়নি। কিছুদিন আগে আন্তর্জাতিক বাজার ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও এখন তা কমতে শুরু করেছে। তাই এই মুহূর্তে তেলের দাম এতটা বাড়ানোর কোন যুক্তি নেই।

পার্শ¦বর্তী দেশে জ্বালানি তেল পাচার হওয়ার কথা সরকার শুধু দাম বাড়ানোর আগেই বলে থাকে বলেও মন্তব্য করেছেন একজন বিশেষজ্ঞ।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের এক তথ্যে দেখা যায়, ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত বিপিসি বিভিন্ন শুল্ক, কর ও মুসক ইত্যাদি বাবদ রাষ্ট্রীয় কোষাগােের ৬৯ হাজার ২২০ কোটি টাকা প্রদান করেছে, যা ওই বছর ৭০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।

বিপিসির এক কর্মকর্তা বলেন, পরবর্তী বছরগুলোতে গড়ে সাত হাজার কোটি টাকা করে ট্যাক্স দিলে রাষ্ট্রীয় কোষগারে বিপিসির এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ট্যাক্স জমা পড়েছে।

বছরওয়ারি লাভ লোকসান

১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭৭ সালের ১ জানুয়ারি পেট্রোবাংলা থেকে আলাদা হয়ে কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে বিপিসি। বিপিসির এক কর্মকর্তা জানান, ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরে বিপিসি ২৫ লাখ টাকা মুনাফা জমা দেয় সরকারি কোষাগারে। এর তিন বছর পর ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে বিপিসি জমা দেয় তিন কোটি টাকা। এইচ এম এরশাদের শাসনামলে একটানা ছয় অর্থবছর বিপিসি থেকে মুনাফা পায় সরকার। এরপর ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে বিপিসি ৮০ কোটি টাকা মুনাফা দেয়। পরের টানা ১৬ অর্থবছর লোকসান ও ব্যাংকঋণে জর্জরিত বিপিসি সরকারকে মুনাফা দিতে পারেনি।

১৯৯৯-২০০০ থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বিপিসি প্রায় ৫২ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। তবে লোকসান দিলেও ওই ১৪টি অর্থবছরে সরকারকে শুল্ক-কর দিয়েছে ৪৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।

বিশ্ববাজারের জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ায় ২০১৪-১৫ এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিপিসি যথাক্রমে ৪১২৬ কোটি এবং ৯০৪০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। আর ২০১৪-১৫ এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আরও প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা শুল্ক-কর জমা দেয়।

বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কমতে থাকলে বিপিসির উচ্চ মুনাফার ওই সময়ে স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষ বিশেষ করে ভোক্তাদের পক্ষ থেকে দাম কমানোর দাবি জানানো হয়েছিল। ২০১৬ সালে সরকার একবার তেলের দাম অল্প কমিয়েছিল।

বিপিসির মুনাফা ও লোকসানের তুলনামূলক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে টানা মুনাফা করতে শুরু করে বিপিসি। গত বছর পর্যন্ত এই মুনাফার পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৮ হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিপিসি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৮৬৫৩ কোটি টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫৬৪৪ কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪৭৬৮ কোটি টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫০৬৬ কোটি টাকা এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯৫৫৯ কোটি টাকা লাভ করে। ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট লাভের অঙ্ক ৪৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।

টানা মুনাফাকালে বিপিসি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি শুল্ক-কর জমা দিয়েছে। এর মধ্যে ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে টানা তিন অর্থবছরে মোট ২৭ হাজার কোটি টাকার বেশি শুল্ক জামা পড়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৪ হাজার ১২২ কোটি টাকা শুল্ক-কর দিয়েছে সংস্থাটি।

বৈশ্বিক করোনা মহামারীর এক সময় তেলের দাম শূন্যে, পরবর্তীতে ঋণাত্মক কোটায় নেমে আসে। সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব কমে এলে তেলের বাজার আবার উঠতে শুরু করে। বিপিসির লাভের মধ্যেই আন্তর্জাতিক বাজার চড়তে থাকলে দাম সমন্বয়ে সবশেষ ২০২১ সালের নভেম্বরে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম প্রতি লিটারে ১৫ টাকা করে বাড়ানো হয়।

সরকারের দাবি, বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির ফলে বিপিসি গত ছয় মাসে (ফেব্রুয়ারি ২২ থেকে জুলাই ২০২২ পর্যন্ত) জ্বালানি তেল বিক্রয়ে ৮০১৪ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। তাই তেলের দাম সমন্বয় জরুরি হয়ে পড়েছে। আর ভারতের কলকাতায় তেলের দাম বেশি হওয়ায় দেশের তেল পাচার হয়ে যাচ্ছে বলেও মনে করেন সরকার-সংশ্লিষ্টরা।

লোকসানের এই সময় বিপিসি কতটাকা শুল্ক-কর দিয়েছে, সে তথ্য জানা যায়নি। তবে গত কয়েক বছরের হিসাবে গড়ে এই পাঁচ মাসে সংস্থাটির পক্ষ থেকে ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা শুল্ক-কর জমা পড়ার কথা।

প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে তেল পাচার প্রসঙ্গে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘এর কোন প্রমাণ আছে? দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী আছে, রাষ্ট্রকে সুরক্ষিত রাখতে তাদের বেতন-ভাতা দেয়া হয়। এখানে কারো ব্যর্থতা থাকলে তার দায় আছে, তার শাস্তি হওয়া উচিত।’ তিনি বলেন, ‘দেশ থেকে তেল পাচার হলে সেসব ঘটনা শোনা যেত। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে কোন মন্তব্য করলে সেটি দায়িত্বপূর্ণ হতে হয়। তেল পাচারের অভিযোগ তুললে, সেসবের প্রমাণ দিতে হয়, দলিলপত্র দেখাতে হয়, তদন্ত করতে হয়। সরকারের কাছে এসব ঘটনার কোন তথ্য-প্রমাণ আছে কি না, আমার জানা নেই।’

দাম বাড়ানোর এখতিয়ার জ্বালানি বিভাগের নেই দাবি করে শামসুল আলম বলেন, ‘আইন অনুযায়ী এই ক্ষমতা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি)। গণশুনানির মাধ্যমে কমিশন দাম সমন্বয় করতে পারে।’

সরকার অবৈধভাবে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করে বলে অভিযোগ করে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, ‘বিইআরসি থাকতে রাষ্ট্র কীভাবে আইন অমান্য করে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি করে।’ তিনি বলেন, ‘বিশ্ব বাজারে তেলের দাম ১৪০ ডলার থেকে কমে ৯০ ডলারে চলে এসেছে। দাম আবার হয়ত বাড়তে পারে। কিন্তু দাম আগামীতে যদি আরও কমে যায়, সরকার তো একবার দাম বাড়িয়ে দিলে বিশ্ব বাজারে দাম কমলেও আর দেশের বাজারে দাম কমান না।’ তিনি বলেন, ‘তেলের দামের কারণে পরিবহন খরচ অনেক বেড়ে যাবে। এর ফলে প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়বে। মানুষের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।’ জনগণের প্রতি অবজ্ঞা থেকেই সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্তব্য করে বদরুল ইমাম বলেন, ‘মানুষের প্রতি সংবেদনশীলতা থাকলে জ্বালানি তেলের মূল্য এতটা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব ছিল না।’

শুক্রবার রাত ১২টা থেকে দেশে ডিজেল ১১৪ টাকা লিটারে বিক্রি হচ্ছে, যা এতদিন ৮০ টাকা ছিল। লিটারে দাম বেড়েছে ৩৪ টাকা বা প্রায় ৪২ শতাংশ। কেরোসিনের দামও একই হারে বাড়ানো হয়েছে।

পেট্রলের নতুন দাম ১৩০ টাকা, যা এতদিন ৮৬ টাকা ছিল। এক্ষেত্রে দাম বেড়েছে লিটারে ৪৪ টাকা, বা প্রায় ৫১ শতাংশ। অকটেনের দাম বাড়ানো হয়েছে লিটারে ৪৬ টাকা বা প্রায় ৫২ শতাংশ। আগে অকটেনের দাম ছিল প্রতি লিটার ৮৯ টাকা, তা এখন বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ টাকায়।

একাধিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞের মতে, ‘সরকার অর্থনৈতিক দিক দিয়ে চাপে পড়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নেয়ার চেষ্টা করছে। আইএমএফের ঋণের শর্তের মধ্যে অন্যতম হলো জ্বালানি খাতে ভর্তুকি প্রত্যাহার। জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে সেই শর্ত পূরণ করা হয়েছে।’

বাংলাদেশে একদিনে ডেঙ্গুতে একজনের মৃত্যু; চলতি বছর মৃতের সংখ্যা ২৪৫

শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন ২৭ ঘণ্টা পর নিভেছে

শাহজালাল বিমানবন্দরের আগুনে পোশাক খাতের বড় ক্ষতি: বিজিএমইএর উদ্বেগ

‘নাশকতা কিনা’ প্রশ্নে ক্ষোভ বিমান উপদেষ্টার

‘বাতাসের কারণে’ আগুন নেভাতে দেরি: ফায়ার সার্ভিসের ডিজি

অগ্নিকাণ্ডে নাশকতার প্রমাণ মিললে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ: প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর

বিমানবন্দরে অগ্নিকাণ্ড তদন্তে বিমানের সাত সদস্যের কমিটি

ছবি

দাবি আদায়ে অনড় এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা, বিক্ষোভ শেষে আবারও শহীদ মিনারে অবস্থান

ছবি

ভাষা সৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আহসান উল্লাহ চৌধুরী আর নেই

ছবি

এবার ‘মার্চ টু যমুনা’র ঘোষণা এমপিও শিক্ষকদের

ছবি

বিচার বিভাগে নারীর অংশগ্রহণ জনআস্থার ‘বিশেষ প্রতীক’: প্রধান বিচারপতি

ছবি

বাংলাদেশ ওআইসির উদ্যোগের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ: শ্রম উপদেষ্টা

ছবি

ইভিএম: মামলা ও বকেয়ার বিষয়ে মাঠের তথ্য চেয়েছে ইসি

ছবি

ডেঙ্গু: আরও ৫১০ জন হাসপাতালে, আক্রান্ত ছাড়ালো ৫৮ হাজার

ছবি

এনসিপিকে ছাড়াই ‘জুলাই সনদ’ সই: ‘নবজন্ম হলো’, বললেন ইউনূস

ছবি

ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের সভা স্থগিত: পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের উদ্বেগ

ছবি

পুলিশ-জুলাই যোদ্ধা সংঘর্ষ সংসদ এলাকা রণক্ষেত্র

জুলাই জাতীয় সনদে সই আজ, অংশগ্রহণ নিয়ে সংশয়ে কয়েক দল

ছবি

জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর হতে যাচ্ছে আজ, কী থাকছে এই সনদে

গৃহবধূকে শ্বাসরোধে হত্যার দায়ে স্বামীর আমৃত্যু কারাদণ্ড

ছবি

এখন থেকে সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে ডেঙ্গু টেস্ট

চীনে নারী পাচার: দূতাবাস ও ইমিগ্রেশনের ‘যোগসাজশ’ দেখছে র‌্যাব

ছবি

এশিয়া-প্যাসিফিক আঞ্চলিক স্কাউট’র নতুন কমিটির সদস্য নির্বাচিত হলেন স্নিধ

ছবি

সিইপিজেডে কারখানায় ভয়াবহ আগুন, শ্রমিকদের সরিয়ে নেয়া হয়েছে

শেখ হাসিনার ১৪০০ বার ফাঁসি হওয়া দরকার: চিফ প্রসিকিউটর

ছবি

এইচএসসি ও সমমানের ফল প্রকাশ দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন

ছবি

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ এ মাসেই, স্বাক্ষরের সুযোগ পরেও থাকবে: আলী রীয়াজ

ছবি

দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম পাসের হার ‘যথাযথই’ মনে করছেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান

ছবি

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শিক্ষার্থী আনাসসহ ৬ জনকে হত্যার মামলায় সাক্ষ্য দিলেন আসিফ মাহমুদ সজীব

ছবি

এইচএসসিতে ২০২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শতভাগ ফেল

ছবি

এইচএসসি ফল: জিপিএ-৫ কমেছে ৭৬ হাজার ৮১৪ জন

ছবি

এইচএসসি ফল: পাসের হারে এগিয়ে ঢাকা, পিছিয়ে কুমিল্লা

ছবি

এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাসের হার ৫৮.৮৩ শতাংশ

ছবি

ডেঙ্গুতে আরও ৭৫৮ জন হাসপাতালে, মৃত্যু ৪

ছবি

জুলাই সনদ: দ্বিমত থাকলেও সইয়ের প্রস্তুতি সম্পন্ন

ছবি

অস্ত্র মামলায় সুব্রত বাইনসহ চারজনের বিচার শুরুর আদেশ

tab

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি

সরকারের যুক্তির সঙ্গে একমত নন বিশেষজ্ঞরা

ফয়েজ আহমেদ তুষার

শনিবার, ০৬ আগস্ট ২০২২

আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি, পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার এবং বিপিসির লোকসানের কথা বলে দেশে জ্বালানি তেলের দাম হঠাৎ করে ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে সরকার। তবে সরকারের এসব যুক্তির সঙ্গে একমত হতে পারছেন না জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। সেবাধর্মী এই প্রতিষ্ঠানের লাভ-লোকসান আমদানি মূল্য ও বিক্রয় মূল্যের বিয়োগ ফল দিয়ে বের করে দেখালেই হবে না। বিপিসি বছর বছর সরকারকে যে ট্যাক্স (শুল্ক, কর ও মুসক) দিচ্ছে, সেটাও রাষ্ট্রের মুনাফা হিসেবে ধরতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে গিয়ে দেশে উৎপাদিত পেট্রল, অকটেনের দাম বৃদ্ধি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বলে মনে করেন তারা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম যখন অনেক কম ছিল, তখন সরকার দেশে সে অনুযায়ী তেলের দাম কমায়নি। কিছুদিন আগে আন্তর্জাতিক বাজার ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও এখন তা কমতে শুরু করেছে। তাই এই মুহূর্তে তেলের দাম এতটা বাড়ানোর কোন যুক্তি নেই।

পার্শ¦বর্তী দেশে জ্বালানি তেল পাচার হওয়ার কথা সরকার শুধু দাম বাড়ানোর আগেই বলে থাকে বলেও মন্তব্য করেছেন একজন বিশেষজ্ঞ।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের এক তথ্যে দেখা যায়, ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত বিপিসি বিভিন্ন শুল্ক, কর ও মুসক ইত্যাদি বাবদ রাষ্ট্রীয় কোষাগােের ৬৯ হাজার ২২০ কোটি টাকা প্রদান করেছে, যা ওই বছর ৭০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।

বিপিসির এক কর্মকর্তা বলেন, পরবর্তী বছরগুলোতে গড়ে সাত হাজার কোটি টাকা করে ট্যাক্স দিলে রাষ্ট্রীয় কোষগারে বিপিসির এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ট্যাক্স জমা পড়েছে।

বছরওয়ারি লাভ লোকসান

১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭৭ সালের ১ জানুয়ারি পেট্রোবাংলা থেকে আলাদা হয়ে কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে বিপিসি। বিপিসির এক কর্মকর্তা জানান, ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরে বিপিসি ২৫ লাখ টাকা মুনাফা জমা দেয় সরকারি কোষাগারে। এর তিন বছর পর ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে বিপিসি জমা দেয় তিন কোটি টাকা। এইচ এম এরশাদের শাসনামলে একটানা ছয় অর্থবছর বিপিসি থেকে মুনাফা পায় সরকার। এরপর ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে বিপিসি ৮০ কোটি টাকা মুনাফা দেয়। পরের টানা ১৬ অর্থবছর লোকসান ও ব্যাংকঋণে জর্জরিত বিপিসি সরকারকে মুনাফা দিতে পারেনি।

১৯৯৯-২০০০ থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বিপিসি প্রায় ৫২ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। তবে লোকসান দিলেও ওই ১৪টি অর্থবছরে সরকারকে শুল্ক-কর দিয়েছে ৪৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।

বিশ্ববাজারের জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ায় ২০১৪-১৫ এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিপিসি যথাক্রমে ৪১২৬ কোটি এবং ৯০৪০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। আর ২০১৪-১৫ এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আরও প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা শুল্ক-কর জমা দেয়।

বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কমতে থাকলে বিপিসির উচ্চ মুনাফার ওই সময়ে স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষ বিশেষ করে ভোক্তাদের পক্ষ থেকে দাম কমানোর দাবি জানানো হয়েছিল। ২০১৬ সালে সরকার একবার তেলের দাম অল্প কমিয়েছিল।

বিপিসির মুনাফা ও লোকসানের তুলনামূলক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে টানা মুনাফা করতে শুরু করে বিপিসি। গত বছর পর্যন্ত এই মুনাফার পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৮ হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিপিসি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৮৬৫৩ কোটি টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫৬৪৪ কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪৭৬৮ কোটি টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫০৬৬ কোটি টাকা এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯৫৫৯ কোটি টাকা লাভ করে। ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট লাভের অঙ্ক ৪৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।

টানা মুনাফাকালে বিপিসি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি শুল্ক-কর জমা দিয়েছে। এর মধ্যে ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে টানা তিন অর্থবছরে মোট ২৭ হাজার কোটি টাকার বেশি শুল্ক জামা পড়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৪ হাজার ১২২ কোটি টাকা শুল্ক-কর দিয়েছে সংস্থাটি।

বৈশ্বিক করোনা মহামারীর এক সময় তেলের দাম শূন্যে, পরবর্তীতে ঋণাত্মক কোটায় নেমে আসে। সংক্রমণের প্রাদুর্ভাব কমে এলে তেলের বাজার আবার উঠতে শুরু করে। বিপিসির লাভের মধ্যেই আন্তর্জাতিক বাজার চড়তে থাকলে দাম সমন্বয়ে সবশেষ ২০২১ সালের নভেম্বরে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম প্রতি লিটারে ১৫ টাকা করে বাড়ানো হয়।

সরকারের দাবি, বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির ফলে বিপিসি গত ছয় মাসে (ফেব্রুয়ারি ২২ থেকে জুলাই ২০২২ পর্যন্ত) জ্বালানি তেল বিক্রয়ে ৮০১৪ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। তাই তেলের দাম সমন্বয় জরুরি হয়ে পড়েছে। আর ভারতের কলকাতায় তেলের দাম বেশি হওয়ায় দেশের তেল পাচার হয়ে যাচ্ছে বলেও মনে করেন সরকার-সংশ্লিষ্টরা।

লোকসানের এই সময় বিপিসি কতটাকা শুল্ক-কর দিয়েছে, সে তথ্য জানা যায়নি। তবে গত কয়েক বছরের হিসাবে গড়ে এই পাঁচ মাসে সংস্থাটির পক্ষ থেকে ৪ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা শুল্ক-কর জমা পড়ার কথা।

প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে তেল পাচার প্রসঙ্গে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘এর কোন প্রমাণ আছে? দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী আছে, রাষ্ট্রকে সুরক্ষিত রাখতে তাদের বেতন-ভাতা দেয়া হয়। এখানে কারো ব্যর্থতা থাকলে তার দায় আছে, তার শাস্তি হওয়া উচিত।’ তিনি বলেন, ‘দেশ থেকে তেল পাচার হলে সেসব ঘটনা শোনা যেত। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে কোন মন্তব্য করলে সেটি দায়িত্বপূর্ণ হতে হয়। তেল পাচারের অভিযোগ তুললে, সেসবের প্রমাণ দিতে হয়, দলিলপত্র দেখাতে হয়, তদন্ত করতে হয়। সরকারের কাছে এসব ঘটনার কোন তথ্য-প্রমাণ আছে কি না, আমার জানা নেই।’

দাম বাড়ানোর এখতিয়ার জ্বালানি বিভাগের নেই দাবি করে শামসুল আলম বলেন, ‘আইন অনুযায়ী এই ক্ষমতা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি)। গণশুনানির মাধ্যমে কমিশন দাম সমন্বয় করতে পারে।’

সরকার অবৈধভাবে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করে বলে অভিযোগ করে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, ‘বিইআরসি থাকতে রাষ্ট্র কীভাবে আইন অমান্য করে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি করে।’ তিনি বলেন, ‘বিশ্ব বাজারে তেলের দাম ১৪০ ডলার থেকে কমে ৯০ ডলারে চলে এসেছে। দাম আবার হয়ত বাড়তে পারে। কিন্তু দাম আগামীতে যদি আরও কমে যায়, সরকার তো একবার দাম বাড়িয়ে দিলে বিশ্ব বাজারে দাম কমলেও আর দেশের বাজারে দাম কমান না।’ তিনি বলেন, ‘তেলের দামের কারণে পরিবহন খরচ অনেক বেড়ে যাবে। এর ফলে প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়বে। মানুষের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।’ জনগণের প্রতি অবজ্ঞা থেকেই সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্তব্য করে বদরুল ইমাম বলেন, ‘মানুষের প্রতি সংবেদনশীলতা থাকলে জ্বালানি তেলের মূল্য এতটা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব ছিল না।’

শুক্রবার রাত ১২টা থেকে দেশে ডিজেল ১১৪ টাকা লিটারে বিক্রি হচ্ছে, যা এতদিন ৮০ টাকা ছিল। লিটারে দাম বেড়েছে ৩৪ টাকা বা প্রায় ৪২ শতাংশ। কেরোসিনের দামও একই হারে বাড়ানো হয়েছে।

পেট্রলের নতুন দাম ১৩০ টাকা, যা এতদিন ৮৬ টাকা ছিল। এক্ষেত্রে দাম বেড়েছে লিটারে ৪৪ টাকা, বা প্রায় ৫১ শতাংশ। অকটেনের দাম বাড়ানো হয়েছে লিটারে ৪৬ টাকা বা প্রায় ৫২ শতাংশ। আগে অকটেনের দাম ছিল প্রতি লিটার ৮৯ টাকা, তা এখন বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ টাকায়।

একাধিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞের মতে, ‘সরকার অর্থনৈতিক দিক দিয়ে চাপে পড়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নেয়ার চেষ্টা করছে। আইএমএফের ঋণের শর্তের মধ্যে অন্যতম হলো জ্বালানি খাতে ভর্তুকি প্রত্যাহার। জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে সেই শর্ত পূরণ করা হয়েছে।’

back to top