বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কাছে থেকে দেখেছেন অনেকেই। শুধু কাছে থেকে দেখা না বঙ্গবন্ধুর সাথে কাজ করেছেন তাঁর সাহচর্য পেয়েছেন এমন কয়জন ব্যক্তি শোনালেন শেখ মুজিবুর রহমান থেকে বঙ্গবন্ধু এবং এরপর জাতির জনক হয়ে ওঠার ইতিহাস। যে মাসে এই আলোচনা হলো, সেই আগস্টের ১৫ তারিখে ১৯৭৫এ সপরিবার নিহত হয়েছিলেন ক্ষণজন্মা এই মহান পুরুষ।
বুধবার (১৭ আগস্ট) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) কনফারেন্স রুমে আয়োজিত ‘বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় স্মৃতি থেকে নানা বিষয়ে বলেন আলোচকবৃন্দ।
সভায় লে.কর্ণেল (অব:) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির, বীর প্রতিক তাঁর স্মৃতি কথায় বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স কুড়ি। আমার জীবনের প্রথম অপারেশন ছিলো বঙ্গবন্ধুকে চেনার অপারেশন। সেনাবাহিনীতে কাজ করার সুবাদে আমার প্রশিক্ষণ ছিলো, চাকরী ছেড়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেই। বঙ্গবন্ধুকে চেনা শুরু হয় যেভাবে-চারিদিকে যুদ্ধের দামামা চারিদিকে। সিলেটের চা বাগানের ভেতর দিয়ে রাতের অন্ধকারে আমরা কয়জন মুক্তিযোদ্ধা এগুচ্ছি এমন সময় একজন নারী দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে আর চিৎকার কওে আমাদেও থামতে বলছে। ভাবলাম হয়তো কোনো সংবাদ বা বিপদে পড়েছে ওই নারী। কাছে এসে হাপাতে হাপাতে বল্লো, বাজান, আমি তোমাদের কিছু দিতে চাই। আমরা ভাবলাম হয়তে খাবার-দাবার দেবে। কারণ ওই সময় এভাবেই আমাদের খাবার দিতো গ্রামের মানুষ। আমি বল্লাম, ‘কি দিবা মা’। তিনি তখন ১৪ কিংবা ১৫ বছরের লিকলিকে শরীরের এক ছেলেকে দেখিয়ে বল্লো ‘এই ছেলেকে দিতে এসেছি। এরে তোমরা সাথে করে নিয়ে যাও।’ ছেঁড়া লুঙ্গি, ফতুয়া পরা ছেলেটির চোখে মুখে দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট। বাচ্চা ছেলেটিকে দেখে বল্লাম ও ছোট ছেলে ও কি করবে। ওই নারী তখন বেশ জোর গলায় বলে ওঠেন, ‘আমার ছেলের অনেক সাহস’।
বল্লাম, ‘মা আপনার বাড়িতে কেউ আছে, ওই নারী বল্লেন, ‘আমরা ভীনদেশী। স্বামী মারা গেছে।’ একটাই ছেলে আছে আর কেউ নাই ভেবে ছেলেটিকে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলতেই ওই নারী চিৎকার করে বলেন ওঠেন, ‘তোমাকে কে মুক্তির নেতা বানাইছে, তুমি তো দেখি শ্যাখের বেটার হুকুম মানো না। তুমি কেমন করে যুদ্ধ করবা’। অল্প কিছু সময় পর কাঁদতে কাঁদতে ছেলের হাত আমার হাতে দিয়ে বলেন, বাজান শ্যাখের বেটার হুকুম মানো য্ুেদ্ধ তোমরা জয়লাভ করবে। এই বলে ছেলেকে হাতে তুলে দিয়ে চলে গেলেন। এই ঘটনার পর বদলে গেলো জীবন। বুঝলাম বঙ্গবন্ধুর কথার মূল্য সাধারণ মানুষের কাছে কতোটা ছিলো। চিনলাম বঙ্গবন্ধুকে।
বঙ্গবন্ধুকে চিনেছিলাম শাহেদ আলী কসাইএর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা দেখে। আমার দৃষ্টিতে প্রথম সফল গেরিলা যোদ্ধা শাহেদ আলী কসাই।পাকিস্তানকে পরাস্ত করেছিলো প্রথম। ৩১ বছরের শক্ত যুবক শাহেদ আলী, কসাইয়ের কাজ করে। ৭ মার্চের ভাষণ শুনেছিলেন বাজারে গিয়ে, রেডিওতে, পরদিন।
ভাষণ শুনে যখন গ্রামে আসলেন, তখন শাহেদ আলী অন্য মানুষ। বেছে বেছে গ্রামের ১০জন ছেলেকে একত্রিত করলেন। বল্লেন ‘শ্যাখের বেটা হুকুম দিয়েছে যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে। আমার কসাইয়ের ছুরিটা আছে এই নিয়ে আমি যুদ্ধ করবো। হাবু মাঝি তুমি কি করবা, হাবু বলে আমার লগি বৈঠা আছে, হাশেম মিয়া ? আমার হাপর আছে, আরেকজন বলে আমার কোদাল আছে।
এমন ১০ জনকে নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু কওে শাহেদ। ১৩ মার্চ শাহেদ আলীর গ্রামে পাকিস্তানি সৈন্য ঢুকে পড়লে শাহেদ আলী তার দলকে নিয়ে চার সৈন্য আর একজন অফিসারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঘটনাস্থলে চার সেনাকে মেরে ফেলে আর আহত অফিসার মারা যায় কয়দিন পর। শাহেদ আলীকে এর খেসারত দিতে হয়েছিলো। নির্মম অত্যাচার করে পাকিস্তানীরা মেরে ফেলে শাহেদকে। এ জন্য যেন শাহেদেও কিন্তু আফসোস ছিলো না। দেশের জন্য হুকুম দিয়েছিলো শেখের বেটা তা মানতে গিয়ে জীবন দেওয়াতে এতোটুকু কুণ্ঠিত ছিলো না শাহেদ আলীরা। বঙ্গবন্ধু এমনই ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কথা এমন ছিলো সাধারণ মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতেন।
বঙ্গবন্ধুর প্রতিবেশী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ড. নাসরিন আহমেদ ভার্চুয়ালি যুক্ত হন আলোচনা সভায়। তিনি তাঁর স্মৃতি থেকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বাইরে থেকে দেখতে যেমন সুপুরষ ছিলেন তাঁর ভেতরটা ছিলো আরো সুন্দর। পাশাপাশি বাসা হওয়ায় একটু বেশী কাছে থেকে দেখেছি। দেখেছি, তাঁর কাছে যতো মানুষ আসতেন কারো সাথে গোমড়া মুখে কথা বলতেন না। প্রতিটা মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করতেন। কারো মাথায় হাত দিয়ে, কাউকে বুকে জাড়িয়ে ধরে কথা বলতেন।
‘আবার বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছাকে কখনো উঁচু গলায় কথা বলতে শুনিনি। বিশেষ করে কাজের লোকদের সাথে অত্যন্ত নরম করে কথা বলতেন। বাড়ির হেন কাজ নাই তিনি করতেন না বা তদারকি করতেন না।’
বঙ্গবন্ধুর মাকে দাদি ডাকতাম। যখন দাদি আসতেন, তখন বঙ্গবন্ধুর রুটিনে একটা বিরাট পরিবর্তন দেখা যেতো। দাদি ঢাকায় এলে উনি (বঙ্গবন্ধু) সারাদিন বাইরে থাকতেন কিন্তু সন্ধ্যার সময় ঠিক বাসায় চলে আসতেন। বাসায় এসে সোজা চলে যেতেন মা’র ঘরে। অনেক সময় জামা কাপড়ও বদলাতেন না। ঘরে গিয়ে জড়িয়ে ধরতেন মাকে। গালে গাল লাগিয়ে মুখ ঘষতেন, চুমা খেতেন। দাদিও যেন তার ছোট্ট বেলার খোকাকে আদর করতেন। মার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অন্ধ।
বঙ্গবন্ধুর সময়ে ঢাকা জেলার এসপি ছিলেন মাহবুব উদ্দিন আহমেদ, বীর বিক্রম। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু কখনোই পুলিশ বাহিনীকে ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করেননি। তিনি আধুনিক পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে কাজ শুরু করেছিলেন। পুলিশদের প্রতি তার একটাই বার্তা ছিল সাধারণ মানুষের উপর যেন অত্যাচার, নির্যাতন না করা হয়। সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে সর্বদা চেষ্টা করেছেন বঙ্গবন্ধু।’
তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার পর সৃষ্টি হয় জাসদ। তারা মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অস্ত্র জমা না দিয়ে সেগুলো দিয়ে লুট, হত্যা, ডাকাতি করত। তারপরও জাসদ নেতাদের আটক বা গ্রেপ্তারের আদেশ দেননি। তিনি আইনানুগভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছিলেন।’
স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘আমি তখন পুলিশ প্রশাসনে। বাংলার মানুষ কেমন আছে তা দেখতে বঙ্গবন্ধু কয়েকবার ছদ্মবেশে ঢাকা শহর দেখতে বের হন। একবার আমি আর বঙ্গবন্ধু গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছি। এ রাস্তা সে রাস্তা ঘুরে বঙ্গবন্ধু গাড়ি থামিয়ে মুখের চাদর অল্প খুলে এক রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করছেন, তোরা কেমন আছিস। এ কথা শুনে ফেলে রাস্তার পাশে আলাউদ্দিন সুইট মিটের একজন। গলা শুনেই চিনে ফেলে বঙ্গবন্ধুকে। সে চিৎকার করে সকলকে বলতে থাকে বঙ্গবন্ধু আসছে। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘মাহবুব দ্রুত গাড়ি চালিয়ে যাও নইলে এখান থেকে বেরোনো যাবে না’। তাঁর গলার স্বরটাও সাধারণ মানুষ চিনতো। এই হলো আমাদের বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন একান্ত সচিব ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান বলেন, বঙ্গবন্ধুর বিচার শাস্তি ইত্যাদি বিষয়ে পরিমিতবোধ ছিলো বর্ণনাতীত। তিনি কারো কাছে কিছু চাপিয়ে দিতেন না। সিদ্ধান্ত নিতেন আলাপ আলোচনার মাধ্যমে। যুদ্ধ বিধ্বস্থ একটা দেশের মানুষকে কিভাবে শান্ত করতে হয় তার মতো করে কেউ বুঝতো না। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছার নিজস্ব কিছু প্রপার্টি ছিলো যা তার বড় মেয়ে প্রধানমন্ত্রী এখন দেখভাল করেন। এই প্রপর্টি নিয়ে বঙ্গবন্ধু কখনোই মাথা গলাতেন না।
‘খাদ্য সংকট কাটাতে টিসিবি গঠন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু’ উল্লেখ করে ড. মশিউর বলেন, ‘দেশের খাদ্য সংকট কাটাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টিসিবি গঠন করেছিলেন। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখন খাদ্যসহ অন্যান্য জিনিসের সংকট ছিল। বঙ্গবন্ধু সেই সংকট কাটানোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। একটি ছিল পরিবহন ব্যবস্থার পুনর্গঠন, পুনঃস্থাপন। আরেকটি ছিল খাদ্য বিতরণ এবং ব্যবস্থাপনায় কোনোরকম দুর্বলতা বা অন্যায় কিছু হচ্ছে কিনা তা দূর করা। তখন তিনি একজন কর্মকর্তাকে কাজে লাগালেন। তার নাম ছিল জলিল। তিনি অত্যন্ত সৎ লোক ছিলেন। তাকে ক্ষমতা দেওয়া ছিল, যে তিনি যে কোনো সময়, যে কোনো জায়গায় গিয়ে অবস্থা দেখতে পারতেন এবং কোনো অ্যাকশন নেওয়া লাগলে তিনি নিতে পারতেন। একই সঙ্গে তিনি ওই সময় টিসিবি প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবে তিনি খাদ্য সংকট দূর করার চেষ্টা করেছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘তখন বলা হচ্ছিল ভারতে খাদ্য পাচার হয়ে যাচ্ছে। তখন তিনি খাদ্য পাচার কার্যক্রম প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। এভাবে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে একটি কল্যাণকর সামাজিক-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করেছিলেন।’
বুধবার, ১৭ আগস্ট ২০২২
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কাছে থেকে দেখেছেন অনেকেই। শুধু কাছে থেকে দেখা না বঙ্গবন্ধুর সাথে কাজ করেছেন তাঁর সাহচর্য পেয়েছেন এমন কয়জন ব্যক্তি শোনালেন শেখ মুজিবুর রহমান থেকে বঙ্গবন্ধু এবং এরপর জাতির জনক হয়ে ওঠার ইতিহাস। যে মাসে এই আলোচনা হলো, সেই আগস্টের ১৫ তারিখে ১৯৭৫এ সপরিবার নিহত হয়েছিলেন ক্ষণজন্মা এই মহান পুরুষ।
বুধবার (১৭ আগস্ট) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) কনফারেন্স রুমে আয়োজিত ‘বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় স্মৃতি থেকে নানা বিষয়ে বলেন আলোচকবৃন্দ।
সভায় লে.কর্ণেল (অব:) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির, বীর প্রতিক তাঁর স্মৃতি কথায় বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স কুড়ি। আমার জীবনের প্রথম অপারেশন ছিলো বঙ্গবন্ধুকে চেনার অপারেশন। সেনাবাহিনীতে কাজ করার সুবাদে আমার প্রশিক্ষণ ছিলো, চাকরী ছেড়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেই। বঙ্গবন্ধুকে চেনা শুরু হয় যেভাবে-চারিদিকে যুদ্ধের দামামা চারিদিকে। সিলেটের চা বাগানের ভেতর দিয়ে রাতের অন্ধকারে আমরা কয়জন মুক্তিযোদ্ধা এগুচ্ছি এমন সময় একজন নারী দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে আর চিৎকার কওে আমাদেও থামতে বলছে। ভাবলাম হয়তো কোনো সংবাদ বা বিপদে পড়েছে ওই নারী। কাছে এসে হাপাতে হাপাতে বল্লো, বাজান, আমি তোমাদের কিছু দিতে চাই। আমরা ভাবলাম হয়তে খাবার-দাবার দেবে। কারণ ওই সময় এভাবেই আমাদের খাবার দিতো গ্রামের মানুষ। আমি বল্লাম, ‘কি দিবা মা’। তিনি তখন ১৪ কিংবা ১৫ বছরের লিকলিকে শরীরের এক ছেলেকে দেখিয়ে বল্লো ‘এই ছেলেকে দিতে এসেছি। এরে তোমরা সাথে করে নিয়ে যাও।’ ছেঁড়া লুঙ্গি, ফতুয়া পরা ছেলেটির চোখে মুখে দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট। বাচ্চা ছেলেটিকে দেখে বল্লাম ও ছোট ছেলে ও কি করবে। ওই নারী তখন বেশ জোর গলায় বলে ওঠেন, ‘আমার ছেলের অনেক সাহস’।
বল্লাম, ‘মা আপনার বাড়িতে কেউ আছে, ওই নারী বল্লেন, ‘আমরা ভীনদেশী। স্বামী মারা গেছে।’ একটাই ছেলে আছে আর কেউ নাই ভেবে ছেলেটিকে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলতেই ওই নারী চিৎকার করে বলেন ওঠেন, ‘তোমাকে কে মুক্তির নেতা বানাইছে, তুমি তো দেখি শ্যাখের বেটার হুকুম মানো না। তুমি কেমন করে যুদ্ধ করবা’। অল্প কিছু সময় পর কাঁদতে কাঁদতে ছেলের হাত আমার হাতে দিয়ে বলেন, বাজান শ্যাখের বেটার হুকুম মানো য্ুেদ্ধ তোমরা জয়লাভ করবে। এই বলে ছেলেকে হাতে তুলে দিয়ে চলে গেলেন। এই ঘটনার পর বদলে গেলো জীবন। বুঝলাম বঙ্গবন্ধুর কথার মূল্য সাধারণ মানুষের কাছে কতোটা ছিলো। চিনলাম বঙ্গবন্ধুকে।
বঙ্গবন্ধুকে চিনেছিলাম শাহেদ আলী কসাইএর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা দেখে। আমার দৃষ্টিতে প্রথম সফল গেরিলা যোদ্ধা শাহেদ আলী কসাই।পাকিস্তানকে পরাস্ত করেছিলো প্রথম। ৩১ বছরের শক্ত যুবক শাহেদ আলী, কসাইয়ের কাজ করে। ৭ মার্চের ভাষণ শুনেছিলেন বাজারে গিয়ে, রেডিওতে, পরদিন।
ভাষণ শুনে যখন গ্রামে আসলেন, তখন শাহেদ আলী অন্য মানুষ। বেছে বেছে গ্রামের ১০জন ছেলেকে একত্রিত করলেন। বল্লেন ‘শ্যাখের বেটা হুকুম দিয়েছে যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে। আমার কসাইয়ের ছুরিটা আছে এই নিয়ে আমি যুদ্ধ করবো। হাবু মাঝি তুমি কি করবা, হাবু বলে আমার লগি বৈঠা আছে, হাশেম মিয়া ? আমার হাপর আছে, আরেকজন বলে আমার কোদাল আছে।
এমন ১০ জনকে নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু কওে শাহেদ। ১৩ মার্চ শাহেদ আলীর গ্রামে পাকিস্তানি সৈন্য ঢুকে পড়লে শাহেদ আলী তার দলকে নিয়ে চার সৈন্য আর একজন অফিসারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঘটনাস্থলে চার সেনাকে মেরে ফেলে আর আহত অফিসার মারা যায় কয়দিন পর। শাহেদ আলীকে এর খেসারত দিতে হয়েছিলো। নির্মম অত্যাচার করে পাকিস্তানীরা মেরে ফেলে শাহেদকে। এ জন্য যেন শাহেদেও কিন্তু আফসোস ছিলো না। দেশের জন্য হুকুম দিয়েছিলো শেখের বেটা তা মানতে গিয়ে জীবন দেওয়াতে এতোটুকু কুণ্ঠিত ছিলো না শাহেদ আলীরা। বঙ্গবন্ধু এমনই ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কথা এমন ছিলো সাধারণ মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতেন।
বঙ্গবন্ধুর প্রতিবেশী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ড. নাসরিন আহমেদ ভার্চুয়ালি যুক্ত হন আলোচনা সভায়। তিনি তাঁর স্মৃতি থেকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বাইরে থেকে দেখতে যেমন সুপুরষ ছিলেন তাঁর ভেতরটা ছিলো আরো সুন্দর। পাশাপাশি বাসা হওয়ায় একটু বেশী কাছে থেকে দেখেছি। দেখেছি, তাঁর কাছে যতো মানুষ আসতেন কারো সাথে গোমড়া মুখে কথা বলতেন না। প্রতিটা মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করতেন। কারো মাথায় হাত দিয়ে, কাউকে বুকে জাড়িয়ে ধরে কথা বলতেন।
‘আবার বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছাকে কখনো উঁচু গলায় কথা বলতে শুনিনি। বিশেষ করে কাজের লোকদের সাথে অত্যন্ত নরম করে কথা বলতেন। বাড়ির হেন কাজ নাই তিনি করতেন না বা তদারকি করতেন না।’
বঙ্গবন্ধুর মাকে দাদি ডাকতাম। যখন দাদি আসতেন, তখন বঙ্গবন্ধুর রুটিনে একটা বিরাট পরিবর্তন দেখা যেতো। দাদি ঢাকায় এলে উনি (বঙ্গবন্ধু) সারাদিন বাইরে থাকতেন কিন্তু সন্ধ্যার সময় ঠিক বাসায় চলে আসতেন। বাসায় এসে সোজা চলে যেতেন মা’র ঘরে। অনেক সময় জামা কাপড়ও বদলাতেন না। ঘরে গিয়ে জড়িয়ে ধরতেন মাকে। গালে গাল লাগিয়ে মুখ ঘষতেন, চুমা খেতেন। দাদিও যেন তার ছোট্ট বেলার খোকাকে আদর করতেন। মার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অন্ধ।
বঙ্গবন্ধুর সময়ে ঢাকা জেলার এসপি ছিলেন মাহবুব উদ্দিন আহমেদ, বীর বিক্রম। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু কখনোই পুলিশ বাহিনীকে ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করেননি। তিনি আধুনিক পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে কাজ শুরু করেছিলেন। পুলিশদের প্রতি তার একটাই বার্তা ছিল সাধারণ মানুষের উপর যেন অত্যাচার, নির্যাতন না করা হয়। সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে সর্বদা চেষ্টা করেছেন বঙ্গবন্ধু।’
তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার পর সৃষ্টি হয় জাসদ। তারা মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অস্ত্র জমা না দিয়ে সেগুলো দিয়ে লুট, হত্যা, ডাকাতি করত। তারপরও জাসদ নেতাদের আটক বা গ্রেপ্তারের আদেশ দেননি। তিনি আইনানুগভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছিলেন।’
স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘আমি তখন পুলিশ প্রশাসনে। বাংলার মানুষ কেমন আছে তা দেখতে বঙ্গবন্ধু কয়েকবার ছদ্মবেশে ঢাকা শহর দেখতে বের হন। একবার আমি আর বঙ্গবন্ধু গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছি। এ রাস্তা সে রাস্তা ঘুরে বঙ্গবন্ধু গাড়ি থামিয়ে মুখের চাদর অল্প খুলে এক রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করছেন, তোরা কেমন আছিস। এ কথা শুনে ফেলে রাস্তার পাশে আলাউদ্দিন সুইট মিটের একজন। গলা শুনেই চিনে ফেলে বঙ্গবন্ধুকে। সে চিৎকার করে সকলকে বলতে থাকে বঙ্গবন্ধু আসছে। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘মাহবুব দ্রুত গাড়ি চালিয়ে যাও নইলে এখান থেকে বেরোনো যাবে না’। তাঁর গলার স্বরটাও সাধারণ মানুষ চিনতো। এই হলো আমাদের বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন একান্ত সচিব ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান বলেন, বঙ্গবন্ধুর বিচার শাস্তি ইত্যাদি বিষয়ে পরিমিতবোধ ছিলো বর্ণনাতীত। তিনি কারো কাছে কিছু চাপিয়ে দিতেন না। সিদ্ধান্ত নিতেন আলাপ আলোচনার মাধ্যমে। যুদ্ধ বিধ্বস্থ একটা দেশের মানুষকে কিভাবে শান্ত করতে হয় তার মতো করে কেউ বুঝতো না। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছার নিজস্ব কিছু প্রপার্টি ছিলো যা তার বড় মেয়ে প্রধানমন্ত্রী এখন দেখভাল করেন। এই প্রপর্টি নিয়ে বঙ্গবন্ধু কখনোই মাথা গলাতেন না।
‘খাদ্য সংকট কাটাতে টিসিবি গঠন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু’ উল্লেখ করে ড. মশিউর বলেন, ‘দেশের খাদ্য সংকট কাটাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টিসিবি গঠন করেছিলেন। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখন খাদ্যসহ অন্যান্য জিনিসের সংকট ছিল। বঙ্গবন্ধু সেই সংকট কাটানোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। একটি ছিল পরিবহন ব্যবস্থার পুনর্গঠন, পুনঃস্থাপন। আরেকটি ছিল খাদ্য বিতরণ এবং ব্যবস্থাপনায় কোনোরকম দুর্বলতা বা অন্যায় কিছু হচ্ছে কিনা তা দূর করা। তখন তিনি একজন কর্মকর্তাকে কাজে লাগালেন। তার নাম ছিল জলিল। তিনি অত্যন্ত সৎ লোক ছিলেন। তাকে ক্ষমতা দেওয়া ছিল, যে তিনি যে কোনো সময়, যে কোনো জায়গায় গিয়ে অবস্থা দেখতে পারতেন এবং কোনো অ্যাকশন নেওয়া লাগলে তিনি নিতে পারতেন। একই সঙ্গে তিনি ওই সময় টিসিবি প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবে তিনি খাদ্য সংকট দূর করার চেষ্টা করেছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘তখন বলা হচ্ছিল ভারতে খাদ্য পাচার হয়ে যাচ্ছে। তখন তিনি খাদ্য পাচার কার্যক্রম প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। এভাবে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে একটি কল্যাণকর সামাজিক-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করেছিলেন।’