alt

জাতীয়

হঠাৎ বেড়ে গেছে এলপি গ্যাসের দাম বিপাকে ভোক্তারা

ফয়েজ আহমেদ তুষার : সোমবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২৩

চুলায় দুপুরের ভাত চড়ানো। হঠাৎ আগুন নিভে গেল। গ্যাস শেষ বুঝতে পেরে স্বামীকে নাজমা বেগম বললেন, ‘তাড়াতাড়ি সিলিন্ডার আন, নয়ত ভাত নষ্ট হয়ে যাবে।’ স্বামী নজরুল ইসলাম পূর্বপরিচিতি এলজি গ্যাসের দোকানদারকে ফোন দিয়ে বললেন, ‘এখনই একটা সিলিন্ডার পাঠাও, পরিষ্কার দেখে বোতল দিও। তোমাদের বোতলে যা ময়লা থাকে!’

দোকানদারের উত্তর, ‘ভাই গ্যাস পাঠায় দিতাছি। তবে দাম কিন্তু বাড়তি, জানেন তো? সতরশ (১৭০০) বিক্রি করি, আপনার জন্য সাড়ে ষোলশ (১৬০০)।’

‘কী বল? সরকারি দাম তো অনেক কম!’ বললেন নজরুল।

দোকানদারের উত্তর, ‘হ-ভাই, সরকারি রেট বারশ’ বত্রিশ (১২৩২) টাকা। তয়, সাপ্লাই নাই। আমরাই সাড়ে পোনরশ (১৫৫০) কইরা আনি। অহন পাঠায় দিমু ভাই?’

নজরুল বললেন, ‘এত্তো বেশি দাম! না থাক এখন পাঠিও না, আমি একটু খবর নিয়ে দেখি।’

রাজধানীর মগবাজার নয়াটোলার বাসিন্দা নজরুল ইসলামের অভিযোগ সোমবার (৩০ জানুয়ারি) দুপুরে তার এলাকার বেশ কয়েকটি দোকানে এলপি গ্যাসের দাম জানতে ফোন দেন তিনি। সব দোকানদারই সাড়ে ষোল থেকে সতেরশ’ টাকা পর্যন্ত দাম হাঁকাচ্ছে। এরপর তিনি বাসার সামনের দোকান থেকে সাড়ে ষোলশ’ টাকায় ১২ কেজির একটি সিলিন্ডার এনেছেন।

গতকাল রোববার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা দোকানগুলোতে হঠাৎ করে এলপি গ্যাসের দাম অনেকটাই বেড়ে গেছে। বাসার রান্নার কাজে সর্বোচ্চ চাহিদা থাকা ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম স্থানভেদে বেড়েছে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) ঘোষণা অনুযায়ী, বেসরকারি ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম হওয়ার কথা ১২৩২ টাকা। বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ১৬০০ থেকে ১৬৫০ টাকা। যদিও কমিশন নির্ধারিত দামে বাজারে এলপিজি কখনই পাওয়া যায় না। এক থেকে দেড়শ টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হয় গ্রাহককে। তবে এতটা ব্যবধান এর আগে দেখা যায়নি। প্রায় একই হারে বেড়েছে ১২ কেজির ঊর্ধ্বে অন্যান্য সিলিন্ডারের দামও।

খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সব জায়গায়ই বেড়েছে এলপি গ্যাসের দাম।

এলপি গ্যাসের ব্যবহার বৃদ্ধি
এক দশক আগে সরকার আবাসিক খাতে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়ার পর এলপি গ্যাসের (তরলীকৃত পেট্রলিয়াম গ্যাস বা এলপিজি) ব্যবহার বাড়তে থাকে। বাসাবাড়ি, রেস্তোরাঁ, হোটেলগুলো গ্যাস সংযোগ না পেয়ে এলপিজি ব্যবহার শুরু করে।

সরকারি খাত থেকে মাত্র ২ শতাংশ এলপিজি সরবরাহ আসায় তখন থেকেই বাজার ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে ভোক্তা স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে চলছিল এলপিজির বেসরকারি খাত।

ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করতে উচ্চ আদালতের নির্দেশে গত বছরের ১২ এপ্রিল দেশে প্রথমবারের মতো এলপিজির দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এরপর থেকে প্রতি মাসে একবার দাম সমন্বয় করা হচ্ছে।

এখনও ৯৮ শতাংশ এলপিজি সরবরাহ হয় বেসরকারি খাতের মাধ্যমে। অভিযোগ রয়েছে, বেশিরভাগ এলাকায় বিইআরসি ঘোষিত দামে বাজারে এলপিজি পাওয়া যায় না। বেশি দামে এলপিজি কিনতে হয় ভোক্তাদের।

অভিযোগ ভুরিভুরি
বাজারে সরকার নির্ধারিত দামে এলপি গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না- এমন অভিযোগ ভুরিভুরি। এ সংক্রান্ত অভিযোগের প্রমাণও পেয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন।

এলপি গ্যাস উৎপাদনকারী, বাজারজাতকারী এবং ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে কয়েক মাস আগে এক মতবিনিময় সভায় এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান।

সিলিন্ডার গ্যাসের বাজার ‘অস্থির’ হয়ে উঠেছে উল্লেখ করে ওই সভায় মহাপরিচালক বলেন, ‘কেন এমন হচ্ছে, এ বিষয়ে আমি গোয়েন্দা সংস্থাকে অনুরোধ করব অনুসন্ধান করতে। নির্দিষ্ট একটি চক্রের জন্য সরকার বিব্রত হবে, এটা কোনভাবেই মেনে নেয়া যাবে না। আমদানিকারক, উৎপাদক, বিক্রেতা পর্যায়ে আলোচনা করতে হবে, ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে দাম নিয়ে আসতে হবে।’

মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহার এবং অবৈধভাবে বড় থেকে ছোট সিলিন্ডারে গ্যাস ভরে বিক্রি করার অভিযোগ আছে বলেও জানান সভায় মহাপরিচালক সফিকুজ্জামান।

গ্রাহকদের অভিযোগ পেয়ে বিইআরসিও চেষ্টা করেছে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার। কমিশন চেয়ারম্যান মো. আবদুল জলিল বিভিন্ন সময় বলেছেন, ভোক্তাদের লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত করে কমিশন। সংশ্লিষ্ট আইন অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেয়া হয়।

ভোক্তা অধিকার, বিইআরসিসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায় থেকে নজরদারির পরও বাজারে বেশি দামে এলপিজি বিক্রি অব্যাহত আছে। বিপাকে পড়ে বেশি দামে গ্যাস কিনতে বাধ্য হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

ব্যবসায়ীরা যা বলছেন
এলপি গ্যাস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, বিশ্ববাজারে এলপিজির দাম বৃদ্ধি, ডলারের দাম বৃদ্ধি, আমদানি খরচ বৃদ্ধি এবং জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে পরিবহন খরচ বৃদ্ধি- এ বিষয়গুলো আমলে না নিয়ে বিইআরসি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে। যা প্রকৃত দামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিইআরসি নির্ধারিত দামে এলপিজি বিক্রি করলে তাদের লোকসান হয়।

দাম বেশি নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বেশ কয়েজন ডিলার বলেন, অপারেটর কোম্পানিগুলো তাদের মুনাফা কমিয়ে দিচ্ছে। এমনও হয়েছে, কোম্পানি এক মাসে তিন দফা মুনাফা কমিয়েছে। সেজন্য তাদের লাভ থাকছে না।

এলপিজির খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা চাহিদা অনুযায়ী কোন কোম্পানি থেকেই সিলিন্ডার পাচ্ছেন না। অনেক কোম্পানি সরবরাহ একদম বন্ধ করে দিয়েছে। কিছু কোম্পানি সরবরাহ দিলেও দাম বেশি দিয়ে কিনে আনতে হচ্ছে। এ কারণে তারাও দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন।

মগবাজারের এক দোকানদারা বলেন, সম্প্রতি চাহিদা অনুয়ায়ী সিলিন্ডার পাচ্ছেন না তিনি। তার মতে, যার মাসে ৩০০ সিলিন্ডার বিক্রি হয় সে পাচ্ছে ১৫০ সিলিন্ডার। দোকান ভাড়া, কর্মচারীর বেতনসহ অন্যান্য খরচ আগের মতোই থাকায় সিলিন্ডার প্রতি খরচ বেড়ে গেছে।

হঠাৎ দাম বাড়ার কারণ হিসেবে এই খাতের কোম্পানিগুলোর সংগঠন এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লোয়াব) সূত্রে জানা যায়, ডলার সংকটে অনেক দিন ধরে ব্যবসায়ীরা এলপিজি আমদানিতে চাহিদা অনুযায়ী ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না। এলপিজি আমদানিতে ঋণপত্র খোলা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর চিঠিও দিয়েছে লোয়াব।

সূত্র বলছে, এলসির জটিলতায় বর্তমানে এলপিজি সরবরাহকারী ২৪টি কোম্পানির মধ্যে ১২টি কোম্পানির সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি ১২টি কোম্পানিকেও রেশনিং করে এলপিজি সরবরাহ করতে হচ্ছে। এতে বাজারে এলপিজির সংকট দেখা দেয়ায় খুচরা বিক্রিতারা দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।

পরিসংখ্যান
২০০৮ সালে দেশে এলপি গ্যাসের মোট ব্যবহার ছিল যেখানে ৫০ হাজার মেট্রিক টন। ২০২০ সালে তা বেড়ে ১০২০ হাজার মেট্রিক টনে দাঁড়ায়। বর্তমানে মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১১ শতাংশ বা ৩৮ লাখ পরিবার এলপিজি ব্যবহারকারী।

অন্যদিকে মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৩ শতাংশ রান্নায় পাইপ লাইনের প্রাকৃতিক গ্যাস বা এনজি ব্যবহারকারী। তবে অনেক সময় চাপ কম থাকায় চুলা না জ্বলায় তাদের একটা অংশ ভিন্ন ব্যবস্থায় রান্না করতে বাধ্য হন।

বসুন্ধরা, যমুনা, বেক্সিমকো, ওরিয়নসহ বর্তমানে ২৯টি সরকারি-বেসরকারি কোম্পানি এলপিজি আমদানি, মজুদকরণ, বিতরণ, সরবরাহের কাজে নিয়োজিত। এলপিজির ডিলার প্রায় ৩ হাজার, আমদানিকারী অপারেটর ২০টি এবং এলপিজি আমদানি টার্মিনাল রয়েছে ১৪টি।

জ্বালানি বিশ্লেষজ্ঞ ও খাত সংশ্লিষ্ট অনেকের মতে, বাসায় রান্নার কাজে রাষ্ট্রীয় প্রাকৃতিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ রাখা এবং একমাত্র রাষ্ট্রীয় এলপিজি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস লিমিটেডের সরবরাহ ক্ষমতা দীর্ঘদিন ধরে ২ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা প্রকৃতপক্ষে এ খাতের বেসরকারি ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেয়ার সামিল।

তারা বলছেন, সরকার বলে রান্নায় এলপি গ্যাস ‘জনপ্রিয়’ হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এ খাতের গ্রাহকরা বাধ্য হয়ে এই গ্যাস ব্যবহার করছে। কারণ যারা পাইপলাইনে আসা সরকারি গ্যাস দিয়ে রান্না করেন, তারা রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী। যারা পাইপলাইনের আওতায় থেকেও বাধ্য হয়ে বেশিদামে এলপিজি ব্যবহার করেন তারা ভুক্তভোগী।

ছবি

সাবেক এমপি ও সংগীতশিল্পী মমতাজ ধানমন্ডিতে গ্রেপ্তার

পারভেজ হত্যা: জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কারাগারে টিনা

লম্বা ছুটির কবলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

ছবি

জিআই সনদপ্রাপ্ত হাজরাপুরী লিচুমেলা বসেছে মাগুরায়

ছবি

বেরোবিতে ইউজিসির নিয়ম উপেক্ষা করে শিক্ষক নিয়োগ

ছবি

‘কোরবানির পশু পরিবহনে নৌপথে থাকবে কঠোর নিরাপত্তা’

দেশে যেসব কারণে বাড়ে প্লেনের সিটের দাম

ছবি

জাতীয় সংগীত অবমাননার প্রতিবাদে ঢাবি শিক্ষার্থীদের সমবেত কণ্ঠ

ছবি

পরিবর্তনের মানসিকতা নিয়ে চিকিৎসাসেবায় আত্মনিয়োগের আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

ছবি

এবার গুজরাট থেকে ৭৮ বাংলাদেশিকে পুশব্যাক, নির্যাতনের অভিযোগ

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আড়ালে সাজানো নাটক চলছে: মির্জা আব্বাস

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ: জয় দেখাতে ক্ষয় আড়াল

একাত্তরে যারা জনযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল তারা অবস্থান ব্যাখ্যা করবে, আশা এনসিপির

ছবি

বাইসাইকেল কিনতে টাকা চুরি দেখে ফেলায় দুই খালাকে হত্যা

প্রজ্ঞাপন দেখে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত নেবে ইসি

আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সব সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ, প্রজ্ঞাপন

হাসিনাই জুলাই হত্যার ‘নির্দেশদাতা’: ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদন

ছবি

চলতি অর্থবছরে প্রবাসী আয়ে ২৭.৭০% প্রবৃদ্ধি, হুন্ডি কমায় ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স বৃদ্ধি

ছবি

চিকিৎসা ব্যয়ের চাপ, বিদেশে ডলার নেওয়ার অনুমোদিত সীমা বাড়লো

ছবি

র‍্যাব পুনর্গঠনে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন

ছবি

আওয়ামী লীগের নিবন্ধন: নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন দেখে সিদ্ধান্ত নেবে ইসি

ছবি

জুলাইয়ের দমন-পীড়নের ‘মাস্টারমাইন্ড ও হুকুমদাতা’ শেখ হাসিনা: ট্রাইব্যুনালের তদন্ত প্রতিবেদন

ছবি

শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে গণহত্যা মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা

ছবি

দাবদাহ: ৭ পরামর্শ দিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

বনশ্রীতে শিশু গৃহকর্মীকে ধর্ষণ, গৃহকর্তা গ্রেপ্তার

এক যুগ পর ভাইয়ের বাসায় খালেদা জিয়া

নিষিদ্ধ সংগঠনের কার্যক্রম শক্ত হাতে দমন করা হবে -ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি

ছবি

পাথারিয়ায় বনভূমি দখল, জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে

ছবি

ঝিকরগাছা ও গুরুদাসপুরে বিএনপির দু’গ্রুপে সংঘর্ষ, এক কর্মীর মৃত্যু

ছবি

২৫ মে পেট্রোল পাম্প মালিকদের কর্মবিরতির ঘোষণা

ছবি

প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম তথ্য জানাতে রাডার স্টেশন চালু

ছবি

সারাদেশে গরম চরমে, অতিষ্ঠ মানুষ ও প্রাণিকুল

‘ট্রেড বাস্কেটে’ সর্বোচ্চ গুরুত্ব যুক্তরাষ্ট্রের

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি

শেয়ারবাজারের জন্য প্রধান উপদেষ্টার পাঁচ নির্দেশনা

আ’লীগের নিবন্ধন বিষয়ে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত: সিইসি

tab

জাতীয়

হঠাৎ বেড়ে গেছে এলপি গ্যাসের দাম বিপাকে ভোক্তারা

ফয়েজ আহমেদ তুষার

সোমবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২৩

চুলায় দুপুরের ভাত চড়ানো। হঠাৎ আগুন নিভে গেল। গ্যাস শেষ বুঝতে পেরে স্বামীকে নাজমা বেগম বললেন, ‘তাড়াতাড়ি সিলিন্ডার আন, নয়ত ভাত নষ্ট হয়ে যাবে।’ স্বামী নজরুল ইসলাম পূর্বপরিচিতি এলজি গ্যাসের দোকানদারকে ফোন দিয়ে বললেন, ‘এখনই একটা সিলিন্ডার পাঠাও, পরিষ্কার দেখে বোতল দিও। তোমাদের বোতলে যা ময়লা থাকে!’

দোকানদারের উত্তর, ‘ভাই গ্যাস পাঠায় দিতাছি। তবে দাম কিন্তু বাড়তি, জানেন তো? সতরশ (১৭০০) বিক্রি করি, আপনার জন্য সাড়ে ষোলশ (১৬০০)।’

‘কী বল? সরকারি দাম তো অনেক কম!’ বললেন নজরুল।

দোকানদারের উত্তর, ‘হ-ভাই, সরকারি রেট বারশ’ বত্রিশ (১২৩২) টাকা। তয়, সাপ্লাই নাই। আমরাই সাড়ে পোনরশ (১৫৫০) কইরা আনি। অহন পাঠায় দিমু ভাই?’

নজরুল বললেন, ‘এত্তো বেশি দাম! না থাক এখন পাঠিও না, আমি একটু খবর নিয়ে দেখি।’

রাজধানীর মগবাজার নয়াটোলার বাসিন্দা নজরুল ইসলামের অভিযোগ সোমবার (৩০ জানুয়ারি) দুপুরে তার এলাকার বেশ কয়েকটি দোকানে এলপি গ্যাসের দাম জানতে ফোন দেন তিনি। সব দোকানদারই সাড়ে ষোল থেকে সতেরশ’ টাকা পর্যন্ত দাম হাঁকাচ্ছে। এরপর তিনি বাসার সামনের দোকান থেকে সাড়ে ষোলশ’ টাকায় ১২ কেজির একটি সিলিন্ডার এনেছেন।

গতকাল রোববার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা দোকানগুলোতে হঠাৎ করে এলপি গ্যাসের দাম অনেকটাই বেড়ে গেছে। বাসার রান্নার কাজে সর্বোচ্চ চাহিদা থাকা ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম স্থানভেদে বেড়েছে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) ঘোষণা অনুযায়ী, বেসরকারি ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম হওয়ার কথা ১২৩২ টাকা। বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ১৬০০ থেকে ১৬৫০ টাকা। যদিও কমিশন নির্ধারিত দামে বাজারে এলপিজি কখনই পাওয়া যায় না। এক থেকে দেড়শ টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হয় গ্রাহককে। তবে এতটা ব্যবধান এর আগে দেখা যায়নি। প্রায় একই হারে বেড়েছে ১২ কেজির ঊর্ধ্বে অন্যান্য সিলিন্ডারের দামও।

খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সব জায়গায়ই বেড়েছে এলপি গ্যাসের দাম।

এলপি গ্যাসের ব্যবহার বৃদ্ধি
এক দশক আগে সরকার আবাসিক খাতে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়ার পর এলপি গ্যাসের (তরলীকৃত পেট্রলিয়াম গ্যাস বা এলপিজি) ব্যবহার বাড়তে থাকে। বাসাবাড়ি, রেস্তোরাঁ, হোটেলগুলো গ্যাস সংযোগ না পেয়ে এলপিজি ব্যবহার শুরু করে।

সরকারি খাত থেকে মাত্র ২ শতাংশ এলপিজি সরবরাহ আসায় তখন থেকেই বাজার ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে ভোক্তা স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে চলছিল এলপিজির বেসরকারি খাত।

ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করতে উচ্চ আদালতের নির্দেশে গত বছরের ১২ এপ্রিল দেশে প্রথমবারের মতো এলপিজির দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এরপর থেকে প্রতি মাসে একবার দাম সমন্বয় করা হচ্ছে।

এখনও ৯৮ শতাংশ এলপিজি সরবরাহ হয় বেসরকারি খাতের মাধ্যমে। অভিযোগ রয়েছে, বেশিরভাগ এলাকায় বিইআরসি ঘোষিত দামে বাজারে এলপিজি পাওয়া যায় না। বেশি দামে এলপিজি কিনতে হয় ভোক্তাদের।

অভিযোগ ভুরিভুরি
বাজারে সরকার নির্ধারিত দামে এলপি গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না- এমন অভিযোগ ভুরিভুরি। এ সংক্রান্ত অভিযোগের প্রমাণও পেয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন।

এলপি গ্যাস উৎপাদনকারী, বাজারজাতকারী এবং ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে কয়েক মাস আগে এক মতবিনিময় সভায় এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান।

সিলিন্ডার গ্যাসের বাজার ‘অস্থির’ হয়ে উঠেছে উল্লেখ করে ওই সভায় মহাপরিচালক বলেন, ‘কেন এমন হচ্ছে, এ বিষয়ে আমি গোয়েন্দা সংস্থাকে অনুরোধ করব অনুসন্ধান করতে। নির্দিষ্ট একটি চক্রের জন্য সরকার বিব্রত হবে, এটা কোনভাবেই মেনে নেয়া যাবে না। আমদানিকারক, উৎপাদক, বিক্রেতা পর্যায়ে আলোচনা করতে হবে, ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে দাম নিয়ে আসতে হবে।’

মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহার এবং অবৈধভাবে বড় থেকে ছোট সিলিন্ডারে গ্যাস ভরে বিক্রি করার অভিযোগ আছে বলেও জানান সভায় মহাপরিচালক সফিকুজ্জামান।

গ্রাহকদের অভিযোগ পেয়ে বিইআরসিও চেষ্টা করেছে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার। কমিশন চেয়ারম্যান মো. আবদুল জলিল বিভিন্ন সময় বলেছেন, ভোক্তাদের লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত করে কমিশন। সংশ্লিষ্ট আইন অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেয়া হয়।

ভোক্তা অধিকার, বিইআরসিসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায় থেকে নজরদারির পরও বাজারে বেশি দামে এলপিজি বিক্রি অব্যাহত আছে। বিপাকে পড়ে বেশি দামে গ্যাস কিনতে বাধ্য হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

ব্যবসায়ীরা যা বলছেন
এলপি গ্যাস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, বিশ্ববাজারে এলপিজির দাম বৃদ্ধি, ডলারের দাম বৃদ্ধি, আমদানি খরচ বৃদ্ধি এবং জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে পরিবহন খরচ বৃদ্ধি- এ বিষয়গুলো আমলে না নিয়ে বিইআরসি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে। যা প্রকৃত দামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিইআরসি নির্ধারিত দামে এলপিজি বিক্রি করলে তাদের লোকসান হয়।

দাম বেশি নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বেশ কয়েজন ডিলার বলেন, অপারেটর কোম্পানিগুলো তাদের মুনাফা কমিয়ে দিচ্ছে। এমনও হয়েছে, কোম্পানি এক মাসে তিন দফা মুনাফা কমিয়েছে। সেজন্য তাদের লাভ থাকছে না।

এলপিজির খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা চাহিদা অনুযায়ী কোন কোম্পানি থেকেই সিলিন্ডার পাচ্ছেন না। অনেক কোম্পানি সরবরাহ একদম বন্ধ করে দিয়েছে। কিছু কোম্পানি সরবরাহ দিলেও দাম বেশি দিয়ে কিনে আনতে হচ্ছে। এ কারণে তারাও দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন।

মগবাজারের এক দোকানদারা বলেন, সম্প্রতি চাহিদা অনুয়ায়ী সিলিন্ডার পাচ্ছেন না তিনি। তার মতে, যার মাসে ৩০০ সিলিন্ডার বিক্রি হয় সে পাচ্ছে ১৫০ সিলিন্ডার। দোকান ভাড়া, কর্মচারীর বেতনসহ অন্যান্য খরচ আগের মতোই থাকায় সিলিন্ডার প্রতি খরচ বেড়ে গেছে।

হঠাৎ দাম বাড়ার কারণ হিসেবে এই খাতের কোম্পানিগুলোর সংগঠন এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লোয়াব) সূত্রে জানা যায়, ডলার সংকটে অনেক দিন ধরে ব্যবসায়ীরা এলপিজি আমদানিতে চাহিদা অনুযায়ী ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না। এলপিজি আমদানিতে ঋণপত্র খোলা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর চিঠিও দিয়েছে লোয়াব।

সূত্র বলছে, এলসির জটিলতায় বর্তমানে এলপিজি সরবরাহকারী ২৪টি কোম্পানির মধ্যে ১২টি কোম্পানির সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি ১২টি কোম্পানিকেও রেশনিং করে এলপিজি সরবরাহ করতে হচ্ছে। এতে বাজারে এলপিজির সংকট দেখা দেয়ায় খুচরা বিক্রিতারা দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।

পরিসংখ্যান
২০০৮ সালে দেশে এলপি গ্যাসের মোট ব্যবহার ছিল যেখানে ৫০ হাজার মেট্রিক টন। ২০২০ সালে তা বেড়ে ১০২০ হাজার মেট্রিক টনে দাঁড়ায়। বর্তমানে মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১১ শতাংশ বা ৩৮ লাখ পরিবার এলপিজি ব্যবহারকারী।

অন্যদিকে মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৩ শতাংশ রান্নায় পাইপ লাইনের প্রাকৃতিক গ্যাস বা এনজি ব্যবহারকারী। তবে অনেক সময় চাপ কম থাকায় চুলা না জ্বলায় তাদের একটা অংশ ভিন্ন ব্যবস্থায় রান্না করতে বাধ্য হন।

বসুন্ধরা, যমুনা, বেক্সিমকো, ওরিয়নসহ বর্তমানে ২৯টি সরকারি-বেসরকারি কোম্পানি এলপিজি আমদানি, মজুদকরণ, বিতরণ, সরবরাহের কাজে নিয়োজিত। এলপিজির ডিলার প্রায় ৩ হাজার, আমদানিকারী অপারেটর ২০টি এবং এলপিজি আমদানি টার্মিনাল রয়েছে ১৪টি।

জ্বালানি বিশ্লেষজ্ঞ ও খাত সংশ্লিষ্ট অনেকের মতে, বাসায় রান্নার কাজে রাষ্ট্রীয় প্রাকৃতিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ রাখা এবং একমাত্র রাষ্ট্রীয় এলপিজি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস লিমিটেডের সরবরাহ ক্ষমতা দীর্ঘদিন ধরে ২ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা প্রকৃতপক্ষে এ খাতের বেসরকারি ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেয়ার সামিল।

তারা বলছেন, সরকার বলে রান্নায় এলপি গ্যাস ‘জনপ্রিয়’ হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এ খাতের গ্রাহকরা বাধ্য হয়ে এই গ্যাস ব্যবহার করছে। কারণ যারা পাইপলাইনে আসা সরকারি গ্যাস দিয়ে রান্না করেন, তারা রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী। যারা পাইপলাইনের আওতায় থেকেও বাধ্য হয়ে বেশিদামে এলপিজি ব্যবহার করেন তারা ভুক্তভোগী।

back to top