ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু হচ্ছেন দেশের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি একমাত্র প্রার্থী হওয়ায় ভোটের প্রয়োজন হচ্ছে না। আজ মনোনয়নপত্র পরীক্ষার আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত ঘোষণা করবেন ‘নির্বাচনী কর্তা’।
ছাত্ররাজনীতির শুরুতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নজরে পড়েন সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক স্মৃতি তার।
রোববার (১২ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় ফোনালাপে সংবাদকে ‘হবু’ রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘বাহাত্তরের কথা... আমি তখন পাবনা জেলা ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাবনা এসেছিলেন। ফিরে যাওয়ার সময় তার সঙ্গে হেলিকপ্টারে করে ঢাকা এসেছিলাম।’
ছাত্রজীবনেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে হেলিকপ্টার ভ্রমণ, আজও স্মৃতিতে অম্লান, জানালেন মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন।
পাবনা জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি, জেলা যুবলীগ সভাপতি, বাকশাল ও আওয়ামী লীগ জেলা নেতা থেকে এই রাজনীতিক বর্তমানে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা উপকমিটির চেয়ারম্যানও তিনি। একাত্তরে পাবনা জেলার স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়কের পদে থাকা সাহাবুদ্দিন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ডের পর সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকেও কারাগারে পাঠানো হয়।
আইন পেশা, বিচারকের দায়িত্ব, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কমিশনারসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব সামলানোর বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার তার।
স্মৃতিকথা
কলেজ জীবনে প্রবেশের আগেই ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পাবনায় তার সাক্ষাৎ হয়। নিজের এক লেখায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার কিছু স্মৃতি তুলে ধরেন এভাবে-
বঙ্গবন্ধুকে আমার প্রথম দেখা ১৯৬৬ সালের ৮ এপ্রিল। ছয় দফার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রচারণায় এদিন পাবনা টাউন হলে আয়োজিত একটি জনসভায় যোগ দিতে এসেছিলেন তিনি। সেদিন বঙ্গবন্ধু তার স্বভাবসুলভ আদরের ডাক ‘তুই’ সম্বোধন করে বেশকিছু দিক-নির্দেশনা দিয়েছিলেন।’
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুকে পেয়েছিলাম জাতীয় নেতা হিসেবে, আর ১৯৭২ সালে পেলাম স্বাধীনতার স্থপতি ও বাঙালি জাতির পিতা হিসেবে। বন্যাকবলিত মানুষকে বাঁচাতে পাবনায় ‘মুজিববাঁধ’ উদ্বোধন করতে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু। আমি তখন পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। স্বভাবতই জনসভার স্বাগত বক্তব্যের দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর।
বক্তৃতা শেষে মঞ্চ থেকে যখন মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়েছি, ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধু আমার হাত ধরে ফেললেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দাঁড়িয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কপালে চুমু দিয়ে বললেন- ‘তুই তো ভালো বলিস’। বঙ্গবন্ধুর বুকে লেপ্টে আছি কী বলব কী বলা উচিত, বুঝতে পারছিলাম না। মুহূর্তের জন্য হতবিহ্বল হয়ে পড়লাম।
বঙ্গবন্ধুকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদানের মধ্য দিয়ে যথারীতি অনুষ্ঠান শেষ হয়। বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টারে উঠতে যাচ্ছেন, এমন মুহূর্তে জানতে চাইলেন ঢাকা যাব কি না? আগে-পাছে চিন্তা না করে রাজি হয়ে গেলাম। প্রথমবারের মতো হেলিকপ্টার ভ্রমণের সুযোগ হলো, তা-ও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে। ঢাকায় হেলিকপ্টার থামল পুরাতন বিমানবন্দর তেজগাঁওয়ে।
আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে ডাকলেন বঙ্গবন্ধু। নির্দেশ দিলেন- ‘ওকে (আমাকে) বাসায় নিয়ে খেতে দাও, তারপর খরচ দিয়ে পাবনা পাঠিয়ে দিও’।
১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সাংগঠনিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আরেকবার পাবনায় আসেন বঙ্গবন্ধু। জনসভার আয়োজন তখন স্টেডিয়ামে। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে সেবারও বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ হলো। বক্তৃতা শেষে বঙ্গবন্ধু ঠিক আগের মতো আমাকে জড়িয়ে ধরেন। মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেন, যেন ভবিষ্যতে আরও উন্নতি করি।
শিক্ষাজীবন
১৯৪৯ সালে পাবনা শহরের জুবিলি ট্যাঙ্কপাড়ায় (শিবরামপুর) মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর জন্ম। ছোটবেলা কেটেছে পাবনা শহরেই।
শহরের পূর্বতন গান্ধী বালিকা বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে রাধানগর মজুমদার অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হন চতুর্থ শ্রেণীতে। সেখান থেকে ১৯৬৬ সালে এসএসসি পাসের পর পাবনার এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হয়ে জড়িয়ে পড়েন ছাত্র রাজনীতিতে।
এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে এইচএসসি ও ১৯৭১ সালে (অনুষ্ঠিত ১৯৭২ সালে) বিএসসি পাস করেন করেন মো. সাহাবুদ্দিন। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এবং পাবনা শহীদ অ্যাডভোকেট আমিনুদ্দিন আইন কলেজ থেকে ১৯৭৫ সালে এলএলবি ডিগ্রি পান।
পেশাগত জীবন
শুরুর দিকে পাবনা জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য ছিলেন সাহাবুদ্দিন। ১৯৮২ সালে বিসিএস (বিচার) পরীক্ষা দিয়ে বিচারক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯৫ ও ১৯৯৬ সালে পরপর দুইবার বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব নির্বাচিত হন তিনি।
বিচারালয়ে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন শেষে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে ২০০৬ সালে অবসরে যান মো. সাহাবুদ্দিন। এর মধ্যে শ্রম আদালতের চেয়ারম্যান পদেও তিনি ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আইন মন্ত্রণালয় নিযুক্ত সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তখনকার বিচারক সাহাবুদ্দিন। বিচারক জীবনের ইতি টানার পর আবারও তিনি আইন পেশায় ফেরেন।
২০০৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী থাকার মধ্যে সরকার তাকে দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব দেয়। ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি সেই দায়িত্ব পালন করেন।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পরপরই আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা হয়। সে সময়ের ‘হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের’ মতো ঘটনার পরবর্তীতে ক্ষমতায় গিয়ে তদন্ত কমিশন গঠন করে আওয়ামী লীগ। ওই কমিশনের প্রধান ছিলেন সাহাবুদ্দিন।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর আওয়ামী লীগের সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিলে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে সাংবাদিকতা পেশাতেও যুক্ত ছিলেন তিনি। বিচার বিভাগে যোগ দেয়ার আগে ১৯৮০ থেকে দুই বছর দৈনিক বাংলার বাণীতে সাংবাদিকতা করেন তিনি। পাবনা প্রেসক্লাব ও অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরিতেও তিনি সদস্য ছিলেন।
রাজনীতি, বঙ্গবন্ধু এবং নীতি-নির্ধারণী বিভিন্ন বিষয়ে তিনি নিয়মিত কলামও লিখতেন।
সাহাবুদ্দিন চুপ্পু জেএমসি বিল্ডার্স লিমিটেডের প্রতিনিধি হিসেবে ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। এ ব্যাংকের অডিট কমিটিরও সদস্য তিনি।
পারিবারিক জীবন
১৯৭২ সালের ১৬ নভেম্বর পাবনা শহরের দিলালপুরের আলী আকতারের জ্যেষ্ঠ কন্যা ড. রেবেকা সুলতানার সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। ড. রেবেকা সুলতানা বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দিয়ে যুগ্ম-সচিব হিসেবে ২০০৯ সালে অবসরে যান। তিনি বর্তমানে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান রিসোর্চ প্রোগ্রাম বিভাগের অধ্যাপক এবং ফ্রেন্ডস ফর চিলড্রেন অর্গানাইজেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান।
সাহাবুদ্দিন-রেবেকা দম্পতির একমাত্র সন্তান মো. আরশাদ আদনান (রনি) দেশে ও বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে বর্তমানে একটি বেসরকারি ব্যাংকে উচ্চপদে কর্মরত।
রোববার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু হচ্ছেন দেশের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি একমাত্র প্রার্থী হওয়ায় ভোটের প্রয়োজন হচ্ছে না। আজ মনোনয়নপত্র পরীক্ষার আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত ঘোষণা করবেন ‘নির্বাচনী কর্তা’।
ছাত্ররাজনীতির শুরুতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নজরে পড়েন সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক স্মৃতি তার।
রোববার (১২ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় ফোনালাপে সংবাদকে ‘হবু’ রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘বাহাত্তরের কথা... আমি তখন পাবনা জেলা ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাবনা এসেছিলেন। ফিরে যাওয়ার সময় তার সঙ্গে হেলিকপ্টারে করে ঢাকা এসেছিলাম।’
ছাত্রজীবনেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে হেলিকপ্টার ভ্রমণ, আজও স্মৃতিতে অম্লান, জানালেন মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন।
পাবনা জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি, জেলা যুবলীগ সভাপতি, বাকশাল ও আওয়ামী লীগ জেলা নেতা থেকে এই রাজনীতিক বর্তমানে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা উপকমিটির চেয়ারম্যানও তিনি। একাত্তরে পাবনা জেলার স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়কের পদে থাকা সাহাবুদ্দিন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ডের পর সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকেও কারাগারে পাঠানো হয়।
আইন পেশা, বিচারকের দায়িত্ব, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কমিশনারসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব সামলানোর বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার তার।
স্মৃতিকথা
কলেজ জীবনে প্রবেশের আগেই ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পাবনায় তার সাক্ষাৎ হয়। নিজের এক লেখায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার কিছু স্মৃতি তুলে ধরেন এভাবে-
বঙ্গবন্ধুকে আমার প্রথম দেখা ১৯৬৬ সালের ৮ এপ্রিল। ছয় দফার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রচারণায় এদিন পাবনা টাউন হলে আয়োজিত একটি জনসভায় যোগ দিতে এসেছিলেন তিনি। সেদিন বঙ্গবন্ধু তার স্বভাবসুলভ আদরের ডাক ‘তুই’ সম্বোধন করে বেশকিছু দিক-নির্দেশনা দিয়েছিলেন।’
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুকে পেয়েছিলাম জাতীয় নেতা হিসেবে, আর ১৯৭২ সালে পেলাম স্বাধীনতার স্থপতি ও বাঙালি জাতির পিতা হিসেবে। বন্যাকবলিত মানুষকে বাঁচাতে পাবনায় ‘মুজিববাঁধ’ উদ্বোধন করতে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু। আমি তখন পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। স্বভাবতই জনসভার স্বাগত বক্তব্যের দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর।
বক্তৃতা শেষে মঞ্চ থেকে যখন মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়েছি, ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধু আমার হাত ধরে ফেললেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দাঁড়িয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কপালে চুমু দিয়ে বললেন- ‘তুই তো ভালো বলিস’। বঙ্গবন্ধুর বুকে লেপ্টে আছি কী বলব কী বলা উচিত, বুঝতে পারছিলাম না। মুহূর্তের জন্য হতবিহ্বল হয়ে পড়লাম।
বঙ্গবন্ধুকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদানের মধ্য দিয়ে যথারীতি অনুষ্ঠান শেষ হয়। বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টারে উঠতে যাচ্ছেন, এমন মুহূর্তে জানতে চাইলেন ঢাকা যাব কি না? আগে-পাছে চিন্তা না করে রাজি হয়ে গেলাম। প্রথমবারের মতো হেলিকপ্টার ভ্রমণের সুযোগ হলো, তা-ও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে। ঢাকায় হেলিকপ্টার থামল পুরাতন বিমানবন্দর তেজগাঁওয়ে।
আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে ডাকলেন বঙ্গবন্ধু। নির্দেশ দিলেন- ‘ওকে (আমাকে) বাসায় নিয়ে খেতে দাও, তারপর খরচ দিয়ে পাবনা পাঠিয়ে দিও’।
১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সাংগঠনিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আরেকবার পাবনায় আসেন বঙ্গবন্ধু। জনসভার আয়োজন তখন স্টেডিয়ামে। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে সেবারও বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ হলো। বক্তৃতা শেষে বঙ্গবন্ধু ঠিক আগের মতো আমাকে জড়িয়ে ধরেন। মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেন, যেন ভবিষ্যতে আরও উন্নতি করি।
শিক্ষাজীবন
১৯৪৯ সালে পাবনা শহরের জুবিলি ট্যাঙ্কপাড়ায় (শিবরামপুর) মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর জন্ম। ছোটবেলা কেটেছে পাবনা শহরেই।
শহরের পূর্বতন গান্ধী বালিকা বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে রাধানগর মজুমদার অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হন চতুর্থ শ্রেণীতে। সেখান থেকে ১৯৬৬ সালে এসএসসি পাসের পর পাবনার এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হয়ে জড়িয়ে পড়েন ছাত্র রাজনীতিতে।
এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে এইচএসসি ও ১৯৭১ সালে (অনুষ্ঠিত ১৯৭২ সালে) বিএসসি পাস করেন করেন মো. সাহাবুদ্দিন। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এবং পাবনা শহীদ অ্যাডভোকেট আমিনুদ্দিন আইন কলেজ থেকে ১৯৭৫ সালে এলএলবি ডিগ্রি পান।
পেশাগত জীবন
শুরুর দিকে পাবনা জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য ছিলেন সাহাবুদ্দিন। ১৯৮২ সালে বিসিএস (বিচার) পরীক্ষা দিয়ে বিচারক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯৫ ও ১৯৯৬ সালে পরপর দুইবার বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব নির্বাচিত হন তিনি।
বিচারালয়ে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন শেষে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে ২০০৬ সালে অবসরে যান মো. সাহাবুদ্দিন। এর মধ্যে শ্রম আদালতের চেয়ারম্যান পদেও তিনি ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আইন মন্ত্রণালয় নিযুক্ত সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তখনকার বিচারক সাহাবুদ্দিন। বিচারক জীবনের ইতি টানার পর আবারও তিনি আইন পেশায় ফেরেন।
২০০৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী থাকার মধ্যে সরকার তাকে দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব দেয়। ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি সেই দায়িত্ব পালন করেন।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পরপরই আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা হয়। সে সময়ের ‘হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের’ মতো ঘটনার পরবর্তীতে ক্ষমতায় গিয়ে তদন্ত কমিশন গঠন করে আওয়ামী লীগ। ওই কমিশনের প্রধান ছিলেন সাহাবুদ্দিন।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর আওয়ামী লীগের সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিলে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে সাংবাদিকতা পেশাতেও যুক্ত ছিলেন তিনি। বিচার বিভাগে যোগ দেয়ার আগে ১৯৮০ থেকে দুই বছর দৈনিক বাংলার বাণীতে সাংবাদিকতা করেন তিনি। পাবনা প্রেসক্লাব ও অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরিতেও তিনি সদস্য ছিলেন।
রাজনীতি, বঙ্গবন্ধু এবং নীতি-নির্ধারণী বিভিন্ন বিষয়ে তিনি নিয়মিত কলামও লিখতেন।
সাহাবুদ্দিন চুপ্পু জেএমসি বিল্ডার্স লিমিটেডের প্রতিনিধি হিসেবে ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। এ ব্যাংকের অডিট কমিটিরও সদস্য তিনি।
পারিবারিক জীবন
১৯৭২ সালের ১৬ নভেম্বর পাবনা শহরের দিলালপুরের আলী আকতারের জ্যেষ্ঠ কন্যা ড. রেবেকা সুলতানার সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। ড. রেবেকা সুলতানা বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দিয়ে যুগ্ম-সচিব হিসেবে ২০০৯ সালে অবসরে যান। তিনি বর্তমানে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান রিসোর্চ প্রোগ্রাম বিভাগের অধ্যাপক এবং ফ্রেন্ডস ফর চিলড্রেন অর্গানাইজেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান।
সাহাবুদ্দিন-রেবেকা দম্পতির একমাত্র সন্তান মো. আরশাদ আদনান (রনি) দেশে ও বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে বর্তমানে একটি বেসরকারি ব্যাংকে উচ্চপদে কর্মরত।