নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে গণভোট ও প্রতিনিধি প্রত্যাহারের প্রস্তাবসহ আরও সুপারিশ
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন জাতীয় সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধিকে প্রত্যাহার ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে জনগণের মত যাচাইয়ে গণভোট ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব করেছে। কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে অন্যান্য সুপারিশের সঙ্গে এই দুটি ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব করা হয়েছে।
সেখানে গণভোটের বিধানটি আগামী সংসদে উত্থাপন করে পাস করা এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিনিধি প্রত্যাহার বা রিকল ব্যবস্থা চালুর বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
শনিবার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনটি মন্ত্রি পরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
তার আগে ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন জমা দেয়। সেদিন প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপও সংবাদিকদের কাছে তুলে ধরা হয়।
সেখানে ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ব্যবহার বাতিল, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন বাতিল, জাতীয় নির্বাচনে ‘না-ভোট’ ফেরানো, ‘না-ভোট’ বেশি পড়লে নির্বাচন বাতিল, ৪০ শতাংশ ভোট না পড়লে পুনর্নির্বাচন, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সর্বোচ্চ দুই বারে সীমিত, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরানো, অনলাইন ভোটিং চালুর সুপারিশ করেছিল বদিউল আলম মজুমদার কমিশন।
এর সঙ্গে এবার গণভোট এবং প্রতিনিধি প্রত্যাহারের বিষয়টিও যুক্ত হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য জনগণের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে মতামত নেওয়ার পদ্ধতি গণভোট। এটি মূলত জনমত যাচাইয়ের একটি পদ্ধতি, যেটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চালু রয়েছে। বিভিন্ন দেশে আলাদা আলাদা বিষয়ে গণভোট হয়েছে। যেমন, সংবিধান সংশোধন, গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন, আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি ইত্যাদি।
বাংলাদেশেও ১৯৭৭, ১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে বাহাত্তরের সংবিধানে গণভোটের বিধান ছিল না। ১৯৭৯ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমান পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সেটি যুক্ত করেন।
পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৫৮, ৮০ ও ৯০ক অনুচ্ছেদ সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের বিধান বাতিল করা হয়। তবে ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পঞ্চদশ সংশোধনীতে ১৪২ অনুচ্ছেদ যুক্ত করে গণভোটের বিধান বাতিল করা হয়।
গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২০২৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর সংবিধানের ওই ধারাটি বাতিল ঘোষণা করে হাই কোর্ট গণভোটের বিধান ফিরিয়ে আনার রায় দেয়।
আদালতের রায়ে গণভোটের বিধানটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনর্বহাল নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
কারণ ‘জেনারেল ক্লজ অ্যাক্ট’ এর ৬ ধারা অনুযায়ী কোনো আইনকে পুনরুজ্জীবিত করতে হলে সংসদে আইনটি পাস করতে হবে।
জাতীয় সংসদের ক্ষেত্রে প্রতিনিধি প্রত্যাহার ব্যবস্থা চালুর সুপারিশ করেছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন।
তবে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এড়াতে নির্বাচিত প্রতিনিধির মেয়াদের প্রথম ও শেষ বছরে প্রত্যাহার কার্যকর না করার প্রস্তাবও করেছে কমিশন।
কীভাবে প্রতিনিধি প্রত্যাহার হবে, তার নমুনা হিসেবে বলা হয়েছে-
• কোনো ব্যক্তি বা দলকে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী আসনের মোট ভোটারের ন্যূনতম এক-তৃতীয়াংশের স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে হবে।
• প্রত্যাহারের কারণ উল্লেখ করে সইসহ একটি আবেদন নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দিতে হবে। কমিশন সেটি মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্ত নেবে।
• আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠ (৫১%) জনগণ প্রত্যাহারের পক্ষে ভোট দিলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে তার পদ থেকে অপসারণ করা হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে, শপথ ভাঙলে, প্রতিশ্রুতি না রাখলে কিংবা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লে জনগণের কাছে তার জবাবদিহিতার সুযোগ সীমিত।
পরের নির্বাচনের আগে জনগণের অসন্তোষ প্রকাশের কোনো কার্যকর মাধ্যম থাকে না। প্রতিনিধি প্রত্যাহার ব্যবস্থা এই সমস্যার একটি অন্তর্বর্তী সমাধান হতে পারে।
তবে এ ধরনের ব্যবস্থা চালু হলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য এর অপব্যবহার এবং বেশি পরিমাণে প্রতিনিধি প্রত্যাহারের আয়োজন করার জন্য সরকারের নির্বাচনী ব্যয় বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
আওয়ামী লীগের আমলে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ব্যাপক ‘কারচুপি’, ‘জালিয়াতি’, ‘রাতে ভোট দিনে করা’, ভোটকেন্দ্র দখলসহ নানা অভিযোগ ওঠে।
এছাড়া দলটির শাসনামলে ব্যাপক ‘দুর্নীতি’, অর্থ ‘পাচারের’ অভিযোগ ছিল আলোচিত। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ‘কর্তৃত্ববাদী’ শাসন, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও ছিল।
এমন প্রেক্ষাপট ক্ষমতার পালাবদলের পর অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাত সংস্কারে লক্ষ্যে গত অক্টোবরে প্রথম ধাপে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এর মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন অন্যতম।
সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সর্বোচ্চ দুই বারে সীমিত এবং ১০০ আসন নিয়ে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের সুপারিশ করেছে বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচন সংস্কার কমিশন।
এছাড়া সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে দুইবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের অযোগ্য এবং এক সঙ্গে একজন দলীয় প্রধান, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা যাতে হতে না পারেন সে বিধান চালু করার প্রস্তাব দিয়েছে সংস্কার কমিশন।
সংসদে উচ্চকক্ষ গঠনের ও সে কক্ষের আসন বণ্টন সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের হারের ভিত্তিতে (সংখ্যানুপাতিক) করার সুপারিশ করেছে কমিশন।
উচ্চকক্ষের নির্বাচনের বিষয়ে কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে প্রত্যেক দলের প্রাপ্ত আসনের ৫০ শতাংশ দলের সদস্যদের থেকে এবং বাকি অর্ধেক আসন নির্দলীয় ভিত্তিতে নাগরিক সমাজ, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, মানবসেবা প্রদানকারী, শ্রমজীবী প্রতিনিধি, নারী উন্নয়নকর্মী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী থেকে সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচিত করার বিধান করার সুপারিশ এসেছে।
দলীয় ও নির্দলীয় সদস্যদের মধ্যে অন্তত ৩০ শতাংশ নারী রাখার শর্তও দেওয়া হয়েছে। এছাড়া উচ্চকক্ষের আসন পাওয়ার যোগ্যতা মোট প্রাপ্ত ভোটের ৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
সংসদের নিম্ন কক্ষের আসন ১০০ বাড়িয়ে ৪০০ করতে এবং এর মধ্যে নারীদের জন্য নির্ধারিত ১০০ আসনে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নির্বাচন করতে বলা হয়েছে। যাতে যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট আসন থেকে নারীদের সরাসরি নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
আর জাতীয় সংসদের দুই কক্ষের সদস্য এবং স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে তৈরি নির্বাচকমণ্ডলীর (ইলেকটোরাল কলেজ) ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করার বিধান করতে বলা হয়েছে সুপারিশে।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলোপ করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। পরে নির্বাচিত সরকারের অধীনে তিনটি জাতীয় নির্বাচন হয়।
প্রয়োজনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ চার মাস নির্ধারণ করে এ সময়ের মধ্যে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন সম্পন্ন করার সুপারিশ করা হয়েছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে।
এ সরকারের জন্য সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় আইন ও বিধিবিধানের সংস্কার এবং প্রশাসনিক রদবদলের বিধান রাখার কথাও বলা হয় প্রতিবেদনে।
এতে স্থায়ী ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল-এনসিসি’ কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের নাম চূড়ান্ত এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান এবং অন্য ২০ উপদেষ্টাকে নিয়োগ করতে বলা হয়।
তবে সংবিধান সংশোধন কমিশন স্থায়ী এনসিসি গঠন করার সুপারিশ না করলে, সব রাজনৈতিক দল, বিশেষজ্ঞ, নাগরিক সমাজ ও সমাজের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটি রূপরেখা তৈরি করে সেটি ক্ষমতাসীন দলের মাধ্যমে সংসদে পাস ও বাস্তবায়ন করার সুপারিশ এসেছে।
জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন এবং স্থানীয় নির্বাচনকে নির্দলীয় করতে আইন সংশোধনের সুপারিশ করা হয়।
আর নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য ১০% জেলা এবং ৫% উপজেলা/থানায় দলের অফিস এবং ন্যূনতম ৫ হাজার সদস্য রাখার বিধান করতে বলা হয়েছে।
পরপর দুটো নির্বাচনে অংশ না নিলে দলের নিবন্ধন বাতিল হবে, এমন বিধানও বাতিল করতে বলা হয়েছে।
নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে তথ্য অধিকার আইনের আওতায়ও আনতে বলেছে বদিউল আলম কমিশন।
নির্বাচনে ভোট দিতে প্রবাসী ভোটারদের জন্য পোস্টাল ভোটিংয়ের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।
চলতি বছরের ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাবনা রেখে অক্টোবরের মধ্যে যেসব প্রবাসীর ভোটার তালিকায় এবং এনআইডি সার্ভারে নিবন্ধন করা সম্ভব তাদেরকে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে প্রস্তাবিত পোস্টাল ভোটিং পদ্ধতিতে ভোট দেওয়ার সুযোগ দিতে সুপারিশ করা হয়েছে।
এছাড়া অনলাইন ভোটিং পদ্ধতি চালু করার সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদন তৈরি করতে কমিশন ৬৪টি সভা ও ২২ বার অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ করার কথা জানিয়েছে। আর ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯ হাজার ৭৫২ জনের মতামত নিয়েছে কমিশন।
রাষ্ট্রের অন্যান্য খাতের মতো নির্বাচন ব্যবস্থায়ও সংস্কার আনতে গত ৩ অক্টোবর সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন এর সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারকে প্রধান করে আট সদস্যের সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার।
কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল সে হিসাবে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে। পরে দুই সপ্তাহ সময় বাড়িয়ে ১৫ জানুয়ারি করা হয়। শনিবার প্রতিবেদনগুলো বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করেছে সংস্কার কমিশন।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে গণভোট ও প্রতিনিধি প্রত্যাহারের প্রস্তাবসহ আরও সুপারিশ
রোববার, ০৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন জাতীয় সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধিকে প্রত্যাহার ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে জনগণের মত যাচাইয়ে গণভোট ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব করেছে। কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে অন্যান্য সুপারিশের সঙ্গে এই দুটি ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব করা হয়েছে।
সেখানে গণভোটের বিধানটি আগামী সংসদে উত্থাপন করে পাস করা এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিনিধি প্রত্যাহার বা রিকল ব্যবস্থা চালুর বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
শনিবার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনটি মন্ত্রি পরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
তার আগে ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন জমা দেয়। সেদিন প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপও সংবাদিকদের কাছে তুলে ধরা হয়।
সেখানে ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ব্যবহার বাতিল, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন বাতিল, জাতীয় নির্বাচনে ‘না-ভোট’ ফেরানো, ‘না-ভোট’ বেশি পড়লে নির্বাচন বাতিল, ৪০ শতাংশ ভোট না পড়লে পুনর্নির্বাচন, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সর্বোচ্চ দুই বারে সীমিত, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরানো, অনলাইন ভোটিং চালুর সুপারিশ করেছিল বদিউল আলম মজুমদার কমিশন।
এর সঙ্গে এবার গণভোট এবং প্রতিনিধি প্রত্যাহারের বিষয়টিও যুক্ত হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য জনগণের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে মতামত নেওয়ার পদ্ধতি গণভোট। এটি মূলত জনমত যাচাইয়ের একটি পদ্ধতি, যেটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চালু রয়েছে। বিভিন্ন দেশে আলাদা আলাদা বিষয়ে গণভোট হয়েছে। যেমন, সংবিধান সংশোধন, গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন, আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি ইত্যাদি।
বাংলাদেশেও ১৯৭৭, ১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে বাহাত্তরের সংবিধানে গণভোটের বিধান ছিল না। ১৯৭৯ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমান পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সেটি যুক্ত করেন।
পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৫৮, ৮০ ও ৯০ক অনুচ্ছেদ সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের বিধান বাতিল করা হয়। তবে ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পঞ্চদশ সংশোধনীতে ১৪২ অনুচ্ছেদ যুক্ত করে গণভোটের বিধান বাতিল করা হয়।
গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২০২৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর সংবিধানের ওই ধারাটি বাতিল ঘোষণা করে হাই কোর্ট গণভোটের বিধান ফিরিয়ে আনার রায় দেয়।
আদালতের রায়ে গণভোটের বিধানটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনর্বহাল নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
কারণ ‘জেনারেল ক্লজ অ্যাক্ট’ এর ৬ ধারা অনুযায়ী কোনো আইনকে পুনরুজ্জীবিত করতে হলে সংসদে আইনটি পাস করতে হবে।
জাতীয় সংসদের ক্ষেত্রে প্রতিনিধি প্রত্যাহার ব্যবস্থা চালুর সুপারিশ করেছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন।
তবে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এড়াতে নির্বাচিত প্রতিনিধির মেয়াদের প্রথম ও শেষ বছরে প্রত্যাহার কার্যকর না করার প্রস্তাবও করেছে কমিশন।
কীভাবে প্রতিনিধি প্রত্যাহার হবে, তার নমুনা হিসেবে বলা হয়েছে-
• কোনো ব্যক্তি বা দলকে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী আসনের মোট ভোটারের ন্যূনতম এক-তৃতীয়াংশের স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে হবে।
• প্রত্যাহারের কারণ উল্লেখ করে সইসহ একটি আবেদন নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দিতে হবে। কমিশন সেটি মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্ত নেবে।
• আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠ (৫১%) জনগণ প্রত্যাহারের পক্ষে ভোট দিলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে তার পদ থেকে অপসারণ করা হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে, শপথ ভাঙলে, প্রতিশ্রুতি না রাখলে কিংবা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লে জনগণের কাছে তার জবাবদিহিতার সুযোগ সীমিত।
পরের নির্বাচনের আগে জনগণের অসন্তোষ প্রকাশের কোনো কার্যকর মাধ্যম থাকে না। প্রতিনিধি প্রত্যাহার ব্যবস্থা এই সমস্যার একটি অন্তর্বর্তী সমাধান হতে পারে।
তবে এ ধরনের ব্যবস্থা চালু হলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য এর অপব্যবহার এবং বেশি পরিমাণে প্রতিনিধি প্রত্যাহারের আয়োজন করার জন্য সরকারের নির্বাচনী ব্যয় বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
আওয়ামী লীগের আমলে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ব্যাপক ‘কারচুপি’, ‘জালিয়াতি’, ‘রাতে ভোট দিনে করা’, ভোটকেন্দ্র দখলসহ নানা অভিযোগ ওঠে।
এছাড়া দলটির শাসনামলে ব্যাপক ‘দুর্নীতি’, অর্থ ‘পাচারের’ অভিযোগ ছিল আলোচিত। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ‘কর্তৃত্ববাদী’ শাসন, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও ছিল।
এমন প্রেক্ষাপট ক্ষমতার পালাবদলের পর অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাত সংস্কারে লক্ষ্যে গত অক্টোবরে প্রথম ধাপে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এর মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন অন্যতম।
সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সর্বোচ্চ দুই বারে সীমিত এবং ১০০ আসন নিয়ে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের সুপারিশ করেছে বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচন সংস্কার কমিশন।
এছাড়া সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে দুইবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের অযোগ্য এবং এক সঙ্গে একজন দলীয় প্রধান, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা যাতে হতে না পারেন সে বিধান চালু করার প্রস্তাব দিয়েছে সংস্কার কমিশন।
সংসদে উচ্চকক্ষ গঠনের ও সে কক্ষের আসন বণ্টন সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের হারের ভিত্তিতে (সংখ্যানুপাতিক) করার সুপারিশ করেছে কমিশন।
উচ্চকক্ষের নির্বাচনের বিষয়ে কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে প্রত্যেক দলের প্রাপ্ত আসনের ৫০ শতাংশ দলের সদস্যদের থেকে এবং বাকি অর্ধেক আসন নির্দলীয় ভিত্তিতে নাগরিক সমাজ, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, মানবসেবা প্রদানকারী, শ্রমজীবী প্রতিনিধি, নারী উন্নয়নকর্মী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী থেকে সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচিত করার বিধান করার সুপারিশ এসেছে।
দলীয় ও নির্দলীয় সদস্যদের মধ্যে অন্তত ৩০ শতাংশ নারী রাখার শর্তও দেওয়া হয়েছে। এছাড়া উচ্চকক্ষের আসন পাওয়ার যোগ্যতা মোট প্রাপ্ত ভোটের ৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
সংসদের নিম্ন কক্ষের আসন ১০০ বাড়িয়ে ৪০০ করতে এবং এর মধ্যে নারীদের জন্য নির্ধারিত ১০০ আসনে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নির্বাচন করতে বলা হয়েছে। যাতে যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট আসন থেকে নারীদের সরাসরি নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
আর জাতীয় সংসদের দুই কক্ষের সদস্য এবং স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে তৈরি নির্বাচকমণ্ডলীর (ইলেকটোরাল কলেজ) ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করার বিধান করতে বলা হয়েছে সুপারিশে।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলোপ করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। পরে নির্বাচিত সরকারের অধীনে তিনটি জাতীয় নির্বাচন হয়।
প্রয়োজনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ চার মাস নির্ধারণ করে এ সময়ের মধ্যে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন সম্পন্ন করার সুপারিশ করা হয়েছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে।
এ সরকারের জন্য সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় আইন ও বিধিবিধানের সংস্কার এবং প্রশাসনিক রদবদলের বিধান রাখার কথাও বলা হয় প্রতিবেদনে।
এতে স্থায়ী ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল-এনসিসি’ কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের নাম চূড়ান্ত এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান এবং অন্য ২০ উপদেষ্টাকে নিয়োগ করতে বলা হয়।
তবে সংবিধান সংশোধন কমিশন স্থায়ী এনসিসি গঠন করার সুপারিশ না করলে, সব রাজনৈতিক দল, বিশেষজ্ঞ, নাগরিক সমাজ ও সমাজের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটি রূপরেখা তৈরি করে সেটি ক্ষমতাসীন দলের মাধ্যমে সংসদে পাস ও বাস্তবায়ন করার সুপারিশ এসেছে।
জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন এবং স্থানীয় নির্বাচনকে নির্দলীয় করতে আইন সংশোধনের সুপারিশ করা হয়।
আর নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য ১০% জেলা এবং ৫% উপজেলা/থানায় দলের অফিস এবং ন্যূনতম ৫ হাজার সদস্য রাখার বিধান করতে বলা হয়েছে।
পরপর দুটো নির্বাচনে অংশ না নিলে দলের নিবন্ধন বাতিল হবে, এমন বিধানও বাতিল করতে বলা হয়েছে।
নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে তথ্য অধিকার আইনের আওতায়ও আনতে বলেছে বদিউল আলম কমিশন।
নির্বাচনে ভোট দিতে প্রবাসী ভোটারদের জন্য পোস্টাল ভোটিংয়ের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।
চলতি বছরের ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাবনা রেখে অক্টোবরের মধ্যে যেসব প্রবাসীর ভোটার তালিকায় এবং এনআইডি সার্ভারে নিবন্ধন করা সম্ভব তাদেরকে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে প্রস্তাবিত পোস্টাল ভোটিং পদ্ধতিতে ভোট দেওয়ার সুযোগ দিতে সুপারিশ করা হয়েছে।
এছাড়া অনলাইন ভোটিং পদ্ধতি চালু করার সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদন তৈরি করতে কমিশন ৬৪টি সভা ও ২২ বার অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ করার কথা জানিয়েছে। আর ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯ হাজার ৭৫২ জনের মতামত নিয়েছে কমিশন।
রাষ্ট্রের অন্যান্য খাতের মতো নির্বাচন ব্যবস্থায়ও সংস্কার আনতে গত ৩ অক্টোবর সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন এর সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারকে প্রধান করে আট সদস্যের সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার।
কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল সে হিসাবে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে। পরে দুই সপ্তাহ সময় বাড়িয়ে ১৫ জানুয়ারি করা হয়। শনিবার প্রতিবেদনগুলো বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করেছে সংস্কার কমিশন।