এক ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন, এমন প্রস্তাবে জাময়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) বেশীরভাগ রাজনৈতিক দল একমত হলেও বিএনপিসহ ৩টি দল তাতে দ্বিমত পোষণ করেছে বলে জানিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ।

তিনি বলেন, সারাদিন আলোচনায় তারা দুটি বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। এর একটি হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, আরেকটি হচ্ছে সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি নিয়ে। দীর্ঘ আলোচনা করেও ঐক্যমতে পৌঁছানো যায়নি।

রবিবার(২২-৬-২০২৫) ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শেষে আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের এ কথা জানান।

তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ এবং কতবার থাকবেন- এসব বাদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সময় (মোট কার্যকাল) নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী পদে একই ব্যক্তি ১০ বছরের বেশি থাকতে পারবেন না- এই বিষয়ে এখন পর্যন্ত আলোচনা করে তিনটি দল বাদে সবাই এক জায়গায় পৌঁছেছে। আশা করি এ বিষয়ে সবাই একমত হতে পারবে। আশা করি সব দল এই বিষয়ে একমত পোষণ করতে পারবে। তিনটি দল হলো- বিএনপি, এনডিএম, ও বিএলডিপি; এই বিষয়ে তাদের ভিন্ন ভিন্ন কারণে মতপার্থক্য আছে।’

ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি বলেন, ‘আলোচনার পরে এ তিনটি দল ভিন্নমত পোষণ করে তারা বিষয়টি পুনর্বিবেচনার কথা বলেছে। তারা তাদের নির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা করে আবার আলোচনার কথা বলেছে। তারা মনে করে এই বিষয়ের সঙ্গে অন্যান্য বিষয় যুক্ত, বিশেষ করে এনসিসি (জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল) গঠন ও উচ্চকক্ষ কীভাবে গঠিত হবে। ওইসব সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনার সময় তারা বিষয়টি উপস্থাপন করবে।’

আলী রিয়াজ বলেন, ‘সংবিধান ও রাষ্ট্রের মূলনীতি সংবিধান সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। বিভিন্ন দলের সেন্টিমেন্ট ও অবস্থান বিবেচনা করে ঐকমত্য কমিশন থেকে একটি প্রস্তাব হাজির করা হবে। কি আলোচনা হয়েছে তার প্রতিফলন অনুযায়ী একটি প্রস্তাব হাজির করা হবে। যাতে করে সাম্য ও মানবিক মর্যাদা সামাজিক সুবিচার ও গণতন্ত্র সংবিধানে উল্লেখ করা বা অন্যভাবে যুক্ত করা তখন বিবেচনা করা। কমিশন থেকে একটা সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব লিখিত আকারে তুলে ধরা।’

প্রধানমন্ত্রী মেয়াদ, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) ও অন্যান্য বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বুধবার থেকে ফের সংলাপে বসবে রাজনৈতিক দলগুলো।

আলী রীয়াজ বলেন, ‘বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অনুরোধ করেছে আগামী দুই দিন বৈঠক মুলতবি করার জন্য। দলগুলো তাদের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা করতে চায়। আশা করছি এর মাধ্যমে অমীমাংসিত বিষয়গুলো মীমাংসিত করতে পারব।’

বাহাত্তরের সংবিধান

বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতি বাতিল চায় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। সংলাপ শেষে দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে আমরা স্পষ্টভাবে জানিয়েছি, বাহাত্তরের মুজিববাদী মূলনীতি আমরা রাখার পক্ষে না। এ মূলনীতি বাদ দিতে হবে।’

এনসিপির এই যুগ্ম আহ্বায়ক বলেন, ‘সংবিধান সংস্কার কমিশনের একটা প্রস্তাব ছিল। সংবিধানে সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচারের সঙ্গে গণতন্ত্রকে যুক্ত করে এই চারটি অন্তর্ভুক্ত থাকবে মূলনীতি হিসেবে। বৈঠকে আলোচনার সময় এটা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটা মতানৈক্য দেখা গেল। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা স্পষ্টভাবে জানিয়েছি, বাহাত্তরের মুজিববাদী মূলনীতি আমরা রাখার পক্ষে না। এ মূলনীতি বাদ দিতে হবে।’

কিছু রাজনৈতিক দল তাদের আদর্শিক জায়গা থেকে এই চার মূলনীতি বাদ দেওয়ার ব্যাপারে একমত হতে পারেনি বলে জানান জাবেদ রাসিন। তিনি বলেন, ‘আমরা সে ক্ষেত্রে বলেছি, আমাদের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার যে অভ্যুত্থানের যে স্পিরিট, সে স্পিরিটের বিপরীতে গিয়ে এখানে আলোচনার কোনো মানে হয় না। সুতরাং বাহাত্তরের চার মূলনীতি বাদ দিয়ে তার পরবর্তী বাকি মূলনীতিগুলো সংযোজন করতে হবে।’ তবে এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো ঐকমত্য হয়নি।

প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ

এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা বলেন, বর্তমান যে ব্যবস্থা আছে, সে ব্যবস্থা থেকে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদটা সীমিত করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল। এ ছাড়া একজন ব্যক্তি কত সময় ধরে প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন, সে বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘একজন ব্যক্তির সর্বোচ্চ দুবার শপথ নিতে পারবেন, এই জায়গায় আমরা সীমা নির্ধারণ করার কথা বলেছিলাম। কিন্তু ঐকমত্যের স্বার্থে সবাই সর্বোচ্চ ১০ বছর বলে। সময় নির্ধারণের সবার সঙ্গে আমাদের মতামত ফেক্সিবল (নমনীয়) থাকবে।’

বিএনপির অবস্থান

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সংলাপ শেষে সাংবাদিকদেরবিলেন, ‘আজকের আলোচনায় কোনো শেষ সিদ্ধান্ত হয়নি। তাহলে আপনার প্রশ্ন করতে পারেন আমরা এতক্ষণ আলোচনার মাধ্যমে কোথায় গিয়ে দাঁড়ালাম। এই যে আমরা জনগণের অর্থ ব্যয় করে আলোচনা করছি সেটার যদি কোন ফলাফল না থাকে তবে বিষয়টি অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক হবে।’

তবে এখনই হতাশা ব্যক্ত করতে চান না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের মতামত কমিশনকে জানিয়েছি কিন্তু ফলাফল কি হবে সেটা আমরা এখনো বলতে পারছি না। তবে সকল রাজনৈতিক দল যেন দেশ ও জাতির মঙ্গলে একটি ন্যূনতম জায়গায় এসে ঐকমত্য সৃষ্টি করে সেজন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রচ- চেষ্টা করছে। আমি সবাইকে আহ্বান করব, আমরা যেন মিনিমাম ইস্যুগুলোতে একমত হয়ে ঐকমত্য সৃষ্টি করতে পারি।’

আজকের আলোচ্য সূচিতে থাকা তিনটি বিষয় ছিল প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি এবং নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণের জন্য একটি স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ গঠন।

তিনি বলেন, ‘একজন ব্যক্তি কতবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন সেটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কেউ কেউ পরপর দুই বা তিন মেয়াদের পক্ষে। কেউ বলেছেন একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে দেওয়া যে এই নির্দিষ্ট সংখ্যক বছরের পর কেউ আর প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। তবে, আমরা বিলেছি এই বিষয়গুলোর সঙ্গে এনসিসি (জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল) ও রাষ্ট্রপতির মেয়াদ, সংসদসহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ জটিল বিষয় জড়িত।’

এ সময় তিনি জানান, জটিল এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করার জন্য কমিশন প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলকে দুদিন করে সময় দিয়েছে, এ সময়ের মধ্যে দলের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কমিশনকে জানানো হবে।

রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সম্পর্কে আলোচনার ব্যাপারে তিনি জানান, ‘সংবিধানের মূলনীতির প্রশ্নে পঞ্চম সংশোধনীতে ফিরে যেতে চায় বিএনপি। পঞ্চম সংশোধনী ফেরত এলে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, গণতন্ত্র ও সামাজিক সুবিচার এই বিষয়গুলো সংবিধানে উল্লেখ্য রাখতে আমাদের আপত্তি নেই।’

তিনটি বিষয়ের মধ্যে প্রথম দুটি বিষয় নিয়ে গভীর আলোচনা হওয়ার কারণে তৃতীয় বিষয়টি অর্থাৎ নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণের জন্য স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ গঠনের বিষয়টি আজ আলোচনা হয়নি বলে তিনি জানান।

*জামায়াতের বক্তব্য*

একজন ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন, এর বেশি নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে এই মত দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী।

রবিবার সংলাপের বিরতিতে জামায়াতের এই অবস্থানের কথা সাংবাদিকদের জানান দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।

তিনি বলেন, ‘আমাদের পাঁচ বছরের টার্ম। সে হিসাবে দুবার কেউ যদি পরিপূর্ণ টার্ম পূর্ণ করেন, তিনি আর প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। দুনিয়ার বহু দেশে এমন নজির আছে। বাংলাদেশের জন্য এটা আমরা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করি এবং এটির ব্যাপারে প্রায় আমরা ঐকমত্যে পৌঁছেছি।’

বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান, মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া।