সংবাদমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে হামলা: আদি ও অকৃত্রিম ফ্যাসিবাদের জঘন্য রূপ

ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফ ওসমান বিন হাদী সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। তিনি ঢাকায় আততায়ীর গুলিতে বিদ্ধ হয়েছিলেন। আমরা তার মৃত্যুতে গভীর শোক জানাই। শোকাহত পরিবারের প্রতি জানাই আন্তরিক সমবেদনা।

যে কোনো মৃত্যু বেদনাদায়ক। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন ঢাকা–৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ওসমান হাদীকে নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনা শুধু শোকের নয়, চরম উদ্বেগেরও। এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানাই। অবিলম্বে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করতে হবে।

কেন এই হত্যাকাণ্ড, এর পেছনের উদ্দেশ্য কী, কারা জড়িত-সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ব্যবহৃত অস্ত্র ও অর্থের উৎস জানতে হবে। এই ঘটনায় মূল অভিযুক্ত এর আগে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়ার পর কীভাবে জামিন পেল, কোন প্রক্রিয়ায় জামিনের মেয়াদ বাড়ল, হত্যাকাণ্ডের পর কীভাবে নিরাপদে পালিয়ে যেতে পারল-এসব বিষয় স্বচ্ছভাবে তদন্তের আওতায় আনতে হবে। এজন্য প্রয়োজন সত্যিকারের নিরপেক্ষ ও পেশাদার তদন্ত। তদন্তকারীদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে।

ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়কের মৃত্যু মানুষকে শোকাহত করেছে, ক্ষুব্ধও করেছে। এই শোক ও ক্ষোভ অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশে যা ঘটেছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সংবাদমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে একের পর এক হামলা হয়েছে। দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের কার্যালয়ে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। অনেক গণমাধ্যমকর্মী তখন কার্যালয়ে আটকা পড়ে প্রাণসংকটে পড়েন। উদ্ধারকাজে নিয়োজিত বাহিনীকেও বাধা দেওয়া হয়। নিউ এইজ পত্রিকার সম্পাদক এবং সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নূরুল কবীর ঘটনাস্থলে গেলে হামলাকারীদের হেনস্তার শিকার হন। এসব ঘটনার আমরা তীব্র নিন্দা জানাই।

হামলা হয়েছে ছায়ানটে। সেখানে নজরুল, লালনের ছবি ভাঙচুর করা হয়েছে। ধ্বংস করা হয়েছে বইপত্র আর বাদ্যযন্ত্র। হয়েছে লুটপাট।

সংবাদমাধ্যম, সাংবাদিক এ সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কারা হামলা চালিয়েছে? তারা কী বার্তা দিতে চায়? এটা কিসের লক্ষণ?

হামলার ধরন দেখে বোঝা যায় এসবই পূর্বপরিকল্পিত। হামলাকারীরা মুক্ত বুদ্ধি, মুক্ত চিন্তা ও মুক্ত কন্ঠের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়েছে। তারা জঘন্যতম ফ্যাসিবাদের চাষ করতে চায় এই বাংলায়।

আর এই জঘন্য আক্রমণের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী সরকার কী করেছে?

ইতিহাসের সেরা নির্বাচন করতে চাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা সরকারের দায়িত্ব ছিল। সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতা। সেই দায়িত্ব পালনে সরকার ব্যর্থ হয়েছে।

হাদীর হত্যাকারীকে গ্রেপ্তারের দায়িত্ব সরকারের। সরকার সেই দায়িত্ব পালন করেনি? মববাজরা মিডিয়া, সাংস্কৃতিক সংগঠনের দপ্তরে তাণ্ডব চালাল? সরকার তাদের প্রতিরোধ করল না? তাণ্ডব ঘটতে পারল। তাণ্ডবের পর এই দানবিক অন্ধকারের শক্তির বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিল সরকার?

বাংলাদেশে যে হিংস্র, বর্বর, বীভৎস তাণ্ডব হল, তা সভ্যতার লজ্জা। এই হিংস্র মবতন্ত্রই আদি ও অকৃত্রিম ফ্যাসিবাদ। মিডিয়া, সাংস্কৃতিক সংগঠনের দপ্তর আক্রমণ তারই উদগ্র রূপ। এই চূড়ান্ত বর্বরতার কোনও ক্ষমা নেই?

আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি, মবতন্ত্রকে কঠোর হাতে দমন করতে হবে। মবতন্ত্র বন্ধ না করলে পরিণতি ভালো হবে না। সরকার কখনোই শক্ত হাতে ব্যবস্থা নেয়নি। যার খেসারত দিয়ে যেতে হচ্ছে দেশকে, দেশের মানুষকে। এই অবস্থা আর চলতে দেওয়া যায় না। হিংস্র মবতন্ত্র আদি-অকৃত্রিম ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে এখনই দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে। নইলে সহিংসতার পর সহিংসতা দেখতে হতে পারে, তখন শোকের পর শোক বয়ে যেতে হবে জাতিকে। এই অন্ধকার থেকে দেশকে বের করা হয়তো তখন দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে।

সম্প্রতি