জুবাইয়া বিনতে কবীর
২৮ মে ছিল ‘মাসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা দিবস’। দিনটি নারীর মৌলিক অধিকার এবং স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, মাসিকÑএই প্রাকৃতিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াÑএখনো সমাজে ট্যাবু, কুসংস্কার আর নীরব যন্ত্রণার শিকার।
বাংলাদেশের বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে পরিচালিত এক গবেষণায় ৪৪৮ জন কিশোরীর ওপর জরিপে দেখা গেছে, ৬৯% কিশোরী মাসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে কিছু না কিছু জানে। কিন্তু মাত্র ২৮.৬% সঠিকভাবে মাসিক স্বাস্থ্য চর্চা করে। এই ফারাক শুধু পরিসংখ্যান নয়, এটি এক নীরব সংকটÑযেখানে জ্ঞান থাকলেও প্রয়োগের সুযোগ বা সাহসের অভাব রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রজননক্ষম নারীদের মধ্যে মাত্র ২৯% ডিসপোজেবল প্যাড ব্যবহার করেন। বাকি ৬৮% পুরনো কাপড়, কখনো কখনো ধোঁয়া দেয়া মাটি বা ছাই ব্যবহারে বাধ্য হন। পাহাড়ি বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো মাসিক চলাকালীন নারীদের ‘অশুচি’ আখ্যা দিয়ে একঘরে করা হয়Ñযা একুশ শতকের সভ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
কিশোরীরা যখন জীবনের নতুন পর্বে পা রাখে, তখন মাসিকের মতো একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার সম্মুখীন হয়। কিন্তু পরিবার, সমাজ বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের এই বাস্তবতার জন্য প্রস্তুত করে না। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৪৫% কিশোরী প্রথম মাসিকের সময় ভয়, উদ্বেগ বা আত্মগ্লানিতে ভোগে। কেউ কেউ এটিকে রোগ মনে করে মা বা শিক্ষিকার কাছে প্রকাশ করতে দ্বিধা করে। ফলে সংক্রমণ, অস্বস্তি, এমনকি স্কুলে অনুপস্থিতি বাড়ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী মাত্র ৩৯% স্কুলে মাসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা দেয়া হয়। বাংলাদেশে এই হার আরও কম। কিছু স্কুলে প্যাড নিয়ে যাওয়াকে এখনো ‘বেয়াদবি’ হিসেবে দেখা হয়। শিক্ষক-শিক্ষিকারা এই বিষয়ে মুখ খুলতে দ্বিধা করেন, ফলে কিশোরীরা প্রয়োজনীয় সহানুভূতি ও নির্দেশনা থেকে বঞ্চিত হয়।
২০২৪ সালের মাসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা দিবসে ১,১০০টির বেশি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি উদ্যোগে প্রচারণা চালিয়ে ৯৬৬ মিলিয়ন মানুষের কাছে সচেতনতা পৌঁছেছে। বাংলাদেশে ‘প্যাডম্যান বাংলাদেশ’, ‘রুম টু রিড’, ‘ব্র্যাক’, ‘স্নেহা’ ও ‘স্নিগ্ধা’র মতো সংগঠন মাসিক সচেতনতা এবং সাশ্রয়ী প্যাড বিতরণে কাজ করছে, যা প্রশংসনীয়।
চ্যালেঞ্জ ও সমাধানের পথ
চ্যালেঞ্জগুলো কম নয় :
অধিক মূল্যের প্যাড : অনেক পরিবারের জন্য প্যাড কেনা বিলাসিতা। দৈনিক ১০ টাকা খরচ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা : পুনঃব্যবহারযোগ্য বা পরিবেশবান্ধব মাসিক সামগ্রী এখনো সহজলভ্য নয়।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব : স্কুল ও কর্মস্থলে নিরাপদ ও গোপনীয় স্যানিটারি সুবিধার ঘাটতি রয়েছে।
সামাজিক ভুল ধ্যানধারণা : মাসিককে ‘অশুচি’ বা ‘গুনাহ’ মনে করার প্রবণতা এখনো প্রবল।
সমাধানের দিকনির্দেশনা :
শিক্ষা : স্কুলের পাঠ্যক্রমে মাসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ছেলেদেরও এ বিষয়ে সচেতন করা জরুরি।
সুবিধা : স্কুল, কলেজ ও কর্মক্ষেত্রে আলাদা ওয়াশরুম, ডাস্টবিন ও ন্যাপকিন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
সচেতনতা : মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মাসিক নিয়ে ইতিবাচক আলোচনা বাড়াতে হবে।
অর্থনৈতিক সহায়তা : সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দরিদ্র নারীদের জন্য বিনামূল্যে বা ভর্তুকিমূল্যে প্যাড সরবরাহ এবং ‘প্যাড ব্যাংক’ গঠন করা যেতে পারে।
মাসিক কোনো রোগ বা দুর্ভাগ্য নয়Ñএটি নারীর সক্ষমতা ও উর্বরতার প্রতীক। কিন্তু আমাদের সমাজ এটিকে লজ্জা, অবজ্ঞা ও লুকোচুরির বিষয় বানিয়েছে। একজন নারী মাসিকের সময়ও যন্ত্রণা সহ্য করে সন্তান, পরিবার ও সমাজের দায়িত্ব পালন করেন। এই অবদানের প্রতি সম্মান না দেখানো সভ্যতার প্রতি অবিচার।
২৮ মে মাসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা দিবস কেবল একটি উপলক্ষ নয়Ñএটি নারী মর্যাদার দাবি, মানবাধিকারের প্রশ্ন এবং স্বাস্থ্য সচেতনতার আন্দোলন। আমাদের সমাজ তখনই বদলাবে, যখন আমরা মাসিককে লজ্জা নয়, জীবনের স্বাভাবিক অংশ হিসেবে গ্রহণ করব। নারীর রক্তপাতে ভয় বা অবজ্ঞা নয়, ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও স্বাস্থ্যবোধ খুঁজে নিতে হবে।
[লেখক : নারী অধিকারকর্মী ]
জুবাইয়া বিনতে কবীর
বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫
২৮ মে ছিল ‘মাসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা দিবস’। দিনটি নারীর মৌলিক অধিকার এবং স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, মাসিকÑএই প্রাকৃতিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াÑএখনো সমাজে ট্যাবু, কুসংস্কার আর নীরব যন্ত্রণার শিকার।
বাংলাদেশের বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে পরিচালিত এক গবেষণায় ৪৪৮ জন কিশোরীর ওপর জরিপে দেখা গেছে, ৬৯% কিশোরী মাসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে কিছু না কিছু জানে। কিন্তু মাত্র ২৮.৬% সঠিকভাবে মাসিক স্বাস্থ্য চর্চা করে। এই ফারাক শুধু পরিসংখ্যান নয়, এটি এক নীরব সংকটÑযেখানে জ্ঞান থাকলেও প্রয়োগের সুযোগ বা সাহসের অভাব রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রজননক্ষম নারীদের মধ্যে মাত্র ২৯% ডিসপোজেবল প্যাড ব্যবহার করেন। বাকি ৬৮% পুরনো কাপড়, কখনো কখনো ধোঁয়া দেয়া মাটি বা ছাই ব্যবহারে বাধ্য হন। পাহাড়ি বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো মাসিক চলাকালীন নারীদের ‘অশুচি’ আখ্যা দিয়ে একঘরে করা হয়Ñযা একুশ শতকের সভ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
কিশোরীরা যখন জীবনের নতুন পর্বে পা রাখে, তখন মাসিকের মতো একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার সম্মুখীন হয়। কিন্তু পরিবার, সমাজ বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের এই বাস্তবতার জন্য প্রস্তুত করে না। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৪৫% কিশোরী প্রথম মাসিকের সময় ভয়, উদ্বেগ বা আত্মগ্লানিতে ভোগে। কেউ কেউ এটিকে রোগ মনে করে মা বা শিক্ষিকার কাছে প্রকাশ করতে দ্বিধা করে। ফলে সংক্রমণ, অস্বস্তি, এমনকি স্কুলে অনুপস্থিতি বাড়ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী মাত্র ৩৯% স্কুলে মাসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা দেয়া হয়। বাংলাদেশে এই হার আরও কম। কিছু স্কুলে প্যাড নিয়ে যাওয়াকে এখনো ‘বেয়াদবি’ হিসেবে দেখা হয়। শিক্ষক-শিক্ষিকারা এই বিষয়ে মুখ খুলতে দ্বিধা করেন, ফলে কিশোরীরা প্রয়োজনীয় সহানুভূতি ও নির্দেশনা থেকে বঞ্চিত হয়।
২০২৪ সালের মাসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা দিবসে ১,১০০টির বেশি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি উদ্যোগে প্রচারণা চালিয়ে ৯৬৬ মিলিয়ন মানুষের কাছে সচেতনতা পৌঁছেছে। বাংলাদেশে ‘প্যাডম্যান বাংলাদেশ’, ‘রুম টু রিড’, ‘ব্র্যাক’, ‘স্নেহা’ ও ‘স্নিগ্ধা’র মতো সংগঠন মাসিক সচেতনতা এবং সাশ্রয়ী প্যাড বিতরণে কাজ করছে, যা প্রশংসনীয়।
চ্যালেঞ্জ ও সমাধানের পথ
চ্যালেঞ্জগুলো কম নয় :
অধিক মূল্যের প্যাড : অনেক পরিবারের জন্য প্যাড কেনা বিলাসিতা। দৈনিক ১০ টাকা খরচ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা : পুনঃব্যবহারযোগ্য বা পরিবেশবান্ধব মাসিক সামগ্রী এখনো সহজলভ্য নয়।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব : স্কুল ও কর্মস্থলে নিরাপদ ও গোপনীয় স্যানিটারি সুবিধার ঘাটতি রয়েছে।
সামাজিক ভুল ধ্যানধারণা : মাসিককে ‘অশুচি’ বা ‘গুনাহ’ মনে করার প্রবণতা এখনো প্রবল।
সমাধানের দিকনির্দেশনা :
শিক্ষা : স্কুলের পাঠ্যক্রমে মাসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ছেলেদেরও এ বিষয়ে সচেতন করা জরুরি।
সুবিধা : স্কুল, কলেজ ও কর্মক্ষেত্রে আলাদা ওয়াশরুম, ডাস্টবিন ও ন্যাপকিন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
সচেতনতা : মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মাসিক নিয়ে ইতিবাচক আলোচনা বাড়াতে হবে।
অর্থনৈতিক সহায়তা : সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দরিদ্র নারীদের জন্য বিনামূল্যে বা ভর্তুকিমূল্যে প্যাড সরবরাহ এবং ‘প্যাড ব্যাংক’ গঠন করা যেতে পারে।
মাসিক কোনো রোগ বা দুর্ভাগ্য নয়Ñএটি নারীর সক্ষমতা ও উর্বরতার প্রতীক। কিন্তু আমাদের সমাজ এটিকে লজ্জা, অবজ্ঞা ও লুকোচুরির বিষয় বানিয়েছে। একজন নারী মাসিকের সময়ও যন্ত্রণা সহ্য করে সন্তান, পরিবার ও সমাজের দায়িত্ব পালন করেন। এই অবদানের প্রতি সম্মান না দেখানো সভ্যতার প্রতি অবিচার।
২৮ মে মাসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা দিবস কেবল একটি উপলক্ষ নয়Ñএটি নারী মর্যাদার দাবি, মানবাধিকারের প্রশ্ন এবং স্বাস্থ্য সচেতনতার আন্দোলন। আমাদের সমাজ তখনই বদলাবে, যখন আমরা মাসিককে লজ্জা নয়, জীবনের স্বাভাবিক অংশ হিসেবে গ্রহণ করব। নারীর রক্তপাতে ভয় বা অবজ্ঞা নয়, ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও স্বাস্থ্যবোধ খুঁজে নিতে হবে।
[লেখক : নারী অধিকারকর্মী ]