মিথুশিলাক মুরমু
গত ২৩ মে, খুলনার কয়রা উপজেলার নলপাড়া মুণ্ডা কমিউনিটিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় উঠে এসেছে মুণ্ডা ভাষার অস্তিত্ব সংকট ও সংরক্ষণের জোরালো আবেদন।
কয়রা উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে আদিবাসী মুণ্ডা সম্প্রদায়ের হাজারো নারী-পুরুষ শতাধিক বছর ধরে বসবাস করে আসছেন। সভার মূল উদ্দেশ্য ছিল মুণ্ডা ভাষা সংরক্ষণ, ভাষার গুরুত্ব বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি এবং তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করা।
সুন্দরবনঘেঁষা দক্ষিণাঞ্চলের সাতক্ষীরার দেবহাটা, তালা ও শ্যামনগরেও মুণ্ডাদের দীর্ঘকালের বসতির চিহ্ন রয়েছে। সুন্দরবন আদিবাসী মুণ্ডা সংস্থা (সামস)-এর তথ্যমতে, শুধু শ্যামনগরেই ৪২০টি পরিবারের প্রায় ২,৭৪০ জন মুণ্ডা বাস করেন, যাদের মধ্যে প্রায় ৯৫ শতাংশই ভূমিহীন। অশিক্ষা ও অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে ভূমিদস্যুরা এ সম্প্রদায়ের ভূমি দখল করে তাদের আরও প্রান্তিক করে তুলেছে।
বাংলাদেশে মুণ্ডা জনগোষ্ঠীর সঠিক পরিসংখ্যান নিয়েও রয়েছে বিভ্রান্তি। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী দেশে মুণ্ডাদের সংখ্যা ছিল মাত্র ২,১৩২ জন। তবে বিভিন্ন গবেষণা ও স্থানীয় তথ্য অনুযায়ী উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বসবাসকারী মুণ্ডা জনগোষ্ঠীর প্রকৃত সংখ্যা তিন লক্ষের কাছাকাছি। অথচ ২০১১ সালের সরকারি শুমারিতে এ সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র ৩৮,২১২ জন। তথ্য অনুযায়ী, শুধু বৃহত্তর সিলেট জেলার ১৪টি উপজেলাতেই ৪০ হাজার মুণ্ডা বসবাস করেন।
বরেন্দ্র অঞ্চলে মু-া জনগোষ্ঠী প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত- মুণ্ডা ও পাহান। নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর, ধামইরহাট, মান্দা, বদলগাছী, পত্নীতলা, নিয়ামতপুর ও পোরশা উপজেলায় তাদের ঘনবসতি রয়েছে।
ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন জাতিগোষ্ঠী মুণ্ডাদের রয়েছে সাতটি বংশগোষ্ঠী- কম্পাট, খাঙ্গার, খাড়িয়া, পাথর, দেরগে, সাঙ্কা ও মাঙ্কী মুণ্ডা। তাদের আদি নিবাস ভারতের রাঁচি। জীবিকার তাগিদে বহু আগে তারা সুন্দরবন অঞ্চলে বসতি গড়ে তোলে।
খুলনা অঞ্চলের মুণ্ডা সম্প্রদায়ের অভিভাবকরা বর্তমানে মাতৃভাষা হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় উদ্বিগ্ন। নতুন প্রজন্মের কাছে ভাষাটি গুরুত্ব হারাতে বসেছে। পারিবারিকভাবে বাংলা ভাষার চর্চা বেড়ে যাওয়ায় হাজার বছরের পুরোনো মুণ্ডা ভাষাটি আজ বিলুপ্তির পথে।
মুণ্ডা শিশুরা স্কুলে গিয়ে বাংলা ভাষা পুরোপুরি না বুঝতে পারায় এবং মাতৃভাষায়ও শিক্ষা না পাওয়ায় এক ধরনের দ্বৈত সংকটে পড়ে। ফলে বিদ্যালয়মুখী হওয়ার আগ্রহ কমে যাচ্ছে। সমাধান হিসেবে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা এবং নিজ জনগোষ্ঠী থেকে শিক্ষক নিয়োগ করা জরুরি। একইসঙ্গে প্রয়োজন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যবস্থা।
অনুষ্ঠিত সভায় জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নেতৃত্ব উপস্থিত থেকে মুণ্ডা ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছেন। তবে শুধু আলোচনা আর প্রতিশ্রুতিতে থেমে থাকলে চলবে না, এখন দরকার বাস্তবমুখী পদক্ষেপ।
একটি ভাষার মৃত্যু শুধু একটি জনগোষ্ঠীর জন্য নয়, পুরো জাতির জন্যই অপূরণীয় ক্ষতি। ভাষা শহীদদের দেশে আরেকটি ভাষার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার দায় রাষ্ট্র এড়াতে পারে না।
মুণ্ডা জনগোষ্ঠী পরিশ্রমী ও সৃজনশীল। ব্রিটিশ আমলে এই জনগোষ্ঠীকে সমতলের বন জঙ্গল কেটে কৃষিযোগ্য ভূমি ও হাট-বাজার গড়ে তুলতে আনা হয়েছিল। সুন্দরবনের জঙ্গল পরিষ্কার করে বসতি স্থাপন এবং জনপদ গড়ার কাজেও তাদের ব্যবহার করা হয়েছে।
বর্তমানে তারা নানা পেশায় যুক্ত হলেও তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ভূমির অধিকার আজও সুরক্ষিত নয়। ভাষা রক্ষার এ সময়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সব মহলের কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন। নয়তো ইতিহাস একদিন জবাবদিহি চাইবেÑ কেন আমরা একটি জাতিগোষ্ঠীর ভাষা বিলুপ্ত হতে দিলাম?
[লেখক : কলামিস্ট ]
মিথুশিলাক মুরমু
বুধবার, ০৪ জুন ২০২৫
গত ২৩ মে, খুলনার কয়রা উপজেলার নলপাড়া মুণ্ডা কমিউনিটিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় উঠে এসেছে মুণ্ডা ভাষার অস্তিত্ব সংকট ও সংরক্ষণের জোরালো আবেদন।
কয়রা উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে আদিবাসী মুণ্ডা সম্প্রদায়ের হাজারো নারী-পুরুষ শতাধিক বছর ধরে বসবাস করে আসছেন। সভার মূল উদ্দেশ্য ছিল মুণ্ডা ভাষা সংরক্ষণ, ভাষার গুরুত্ব বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি এবং তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করা।
সুন্দরবনঘেঁষা দক্ষিণাঞ্চলের সাতক্ষীরার দেবহাটা, তালা ও শ্যামনগরেও মুণ্ডাদের দীর্ঘকালের বসতির চিহ্ন রয়েছে। সুন্দরবন আদিবাসী মুণ্ডা সংস্থা (সামস)-এর তথ্যমতে, শুধু শ্যামনগরেই ৪২০টি পরিবারের প্রায় ২,৭৪০ জন মুণ্ডা বাস করেন, যাদের মধ্যে প্রায় ৯৫ শতাংশই ভূমিহীন। অশিক্ষা ও অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে ভূমিদস্যুরা এ সম্প্রদায়ের ভূমি দখল করে তাদের আরও প্রান্তিক করে তুলেছে।
বাংলাদেশে মুণ্ডা জনগোষ্ঠীর সঠিক পরিসংখ্যান নিয়েও রয়েছে বিভ্রান্তি। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী দেশে মুণ্ডাদের সংখ্যা ছিল মাত্র ২,১৩২ জন। তবে বিভিন্ন গবেষণা ও স্থানীয় তথ্য অনুযায়ী উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বসবাসকারী মুণ্ডা জনগোষ্ঠীর প্রকৃত সংখ্যা তিন লক্ষের কাছাকাছি। অথচ ২০১১ সালের সরকারি শুমারিতে এ সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র ৩৮,২১২ জন। তথ্য অনুযায়ী, শুধু বৃহত্তর সিলেট জেলার ১৪টি উপজেলাতেই ৪০ হাজার মুণ্ডা বসবাস করেন।
বরেন্দ্র অঞ্চলে মু-া জনগোষ্ঠী প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত- মুণ্ডা ও পাহান। নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর, ধামইরহাট, মান্দা, বদলগাছী, পত্নীতলা, নিয়ামতপুর ও পোরশা উপজেলায় তাদের ঘনবসতি রয়েছে।
ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন জাতিগোষ্ঠী মুণ্ডাদের রয়েছে সাতটি বংশগোষ্ঠী- কম্পাট, খাঙ্গার, খাড়িয়া, পাথর, দেরগে, সাঙ্কা ও মাঙ্কী মুণ্ডা। তাদের আদি নিবাস ভারতের রাঁচি। জীবিকার তাগিদে বহু আগে তারা সুন্দরবন অঞ্চলে বসতি গড়ে তোলে।
খুলনা অঞ্চলের মুণ্ডা সম্প্রদায়ের অভিভাবকরা বর্তমানে মাতৃভাষা হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় উদ্বিগ্ন। নতুন প্রজন্মের কাছে ভাষাটি গুরুত্ব হারাতে বসেছে। পারিবারিকভাবে বাংলা ভাষার চর্চা বেড়ে যাওয়ায় হাজার বছরের পুরোনো মুণ্ডা ভাষাটি আজ বিলুপ্তির পথে।
মুণ্ডা শিশুরা স্কুলে গিয়ে বাংলা ভাষা পুরোপুরি না বুঝতে পারায় এবং মাতৃভাষায়ও শিক্ষা না পাওয়ায় এক ধরনের দ্বৈত সংকটে পড়ে। ফলে বিদ্যালয়মুখী হওয়ার আগ্রহ কমে যাচ্ছে। সমাধান হিসেবে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা এবং নিজ জনগোষ্ঠী থেকে শিক্ষক নিয়োগ করা জরুরি। একইসঙ্গে প্রয়োজন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যবস্থা।
অনুষ্ঠিত সভায় জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নেতৃত্ব উপস্থিত থেকে মুণ্ডা ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছেন। তবে শুধু আলোচনা আর প্রতিশ্রুতিতে থেমে থাকলে চলবে না, এখন দরকার বাস্তবমুখী পদক্ষেপ।
একটি ভাষার মৃত্যু শুধু একটি জনগোষ্ঠীর জন্য নয়, পুরো জাতির জন্যই অপূরণীয় ক্ষতি। ভাষা শহীদদের দেশে আরেকটি ভাষার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার দায় রাষ্ট্র এড়াতে পারে না।
মুণ্ডা জনগোষ্ঠী পরিশ্রমী ও সৃজনশীল। ব্রিটিশ আমলে এই জনগোষ্ঠীকে সমতলের বন জঙ্গল কেটে কৃষিযোগ্য ভূমি ও হাট-বাজার গড়ে তুলতে আনা হয়েছিল। সুন্দরবনের জঙ্গল পরিষ্কার করে বসতি স্থাপন এবং জনপদ গড়ার কাজেও তাদের ব্যবহার করা হয়েছে।
বর্তমানে তারা নানা পেশায় যুক্ত হলেও তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ভূমির অধিকার আজও সুরক্ষিত নয়। ভাষা রক্ষার এ সময়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সব মহলের কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন। নয়তো ইতিহাস একদিন জবাবদিহি চাইবেÑ কেন আমরা একটি জাতিগোষ্ঠীর ভাষা বিলুপ্ত হতে দিলাম?
[লেখক : কলামিস্ট ]