alt

উপ-সম্পাদকীয়

আসন্ন ব্রিকস সম্মেলন ও বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি

আজিজ পাটোয়ারি

: রোববার, ১৩ আগস্ট ২০২৩

আগামী ২২ থেকে ২৪ আগস্ট দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে এ বছরের ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ব্রিকস নেতারা এবং সম্ভাব্য সদস্যপদ আবেদনকারীরা আগামী দিনে বিদ্যমান বৈশ্বিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে- এমন অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে তিন দিনের জন্য বসবে এ সম্মেলনে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর জোহানেসবার্গের সম্মেলনে যোগ দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ এবং অন্যান্য আবেদনকারী রাষ্ট্র যারা ব্রিকসে সদস্যপদ চায় তাদের জন্য শীর্ষ সম্মেলনটি তাৎপর্যপূর্ণ হবে। শীর্ষ সম্মেলনটি ব্রিকসের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ কারণ সম্মেলনের সময় নতুন মুদ্রা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা নিয়ে আলোচনা হবে সদস্যদের মধ্যে। এই প্রেক্ষাপটে, ব্রিকসের বর্তমান চ্যালেঞ্জ এবং ব্রিকসে বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জগুলো মূল্যায়ন করা জরুরি।

এক নজরে ব্রিকস

ব্রিকস হলো গ্লোবাল সাউথ বা বৈশ্বিক দক্ষিণের পাঁচটি উন্নয়নশীল দেশের একটি জোট; যারা ভবিষ্যতে বিশ্ব অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জোটের মূল সদস্য হলো ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা। একসঙ্গে এই পাঁচটি দেশ বিশ্বের জনসংখ্যার ৪৫% প্রতিনিধিত্ব করে, পৃথিবীর ভূখন্ডের ৩০% জুড়ে অবস্থান করে এবং বৈশ্বিক জিডিপির ৩১.৫% তাদের দখলে। ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের জিডিপির ৫০ শতাংশ ব্রিকসের এই পাচটি দেশের দখলে থাকার সম্ভাবনাও রয়েছে।

ব্রিকস একটি অনন্য সংস্থা, কারণ এটি পুরোপুরি গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো নিয়ে গঠিত এবং গ্লোবাল নর্থ বা পশ্চিমা বিশ্বের আধিপত্য হ্রাসের জন্য সাউথ-সাউথ বা দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতার প্রচার করে। ব্রিকসের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আকাক্সক্ষা রয়েছে। জোটের লক্ষ্য মূলত বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণে বৈশ্বিক পর্যায়ে অংশীদারিত্ব এবং ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। এরই লক্ষ্যে, ব্রিকস ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং বিদ্যমান বহুপাক্ষিক উন্নয়ন ব্যাংকগুলোতে পশ্চিমা আধিপত্যকে টক্কর দেয়ার জন্য নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি) প্রতিষ্ঠা করেছে। এছাড়াও ব্রিকসের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগের সুযোগ চিহ্নিত করা এবং সে অনুযায়ী বিনিয়োগ করা। বর্তমানে ‘ডি-ডলারাইজেশনের’ যুগে ব্রিকস প্রচলিত আন্তর্জাতিক মুদ্রা-ডলারের আধিপত্যকে হ্রাসের জন্য একটি সাধারণ মুদ্রা চালু করার কথা ভাবছে।

জোটটি খুব স্বল্প সময়ে বেশ কিছু সাফল্য অর্জন করেছে এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা তৈরি করেছে। ফলে এটি এখন একটি প্রাণবন্ত সংগঠন হয়ে উঠেছে যেখানে গত দুই বছরে গ্লোবাল সাউথ থেকে ৩২টি দেশ হয় আবেদন করেছে বা ফোরামে যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এসব দেশের মধ্যে সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য আবেদনকারী দেশ। ব্রিকসের মূল সদস্যরাও জোটের শক্তি বাড়াতে জোট সম্প্রসারণের কথা ভাবছে।

ব্রিকসের জন্য চ্যালেঞ্জ

ব্রিকসের সম্প্রসারণ মূলত চীনের প্রস্তাবনা। সুতরাং ভারত জোট সম্প্রসারণকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের প্রতিরোধ করার জন্য চীনের মৈত্রী এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বাড়ানোর একটি চেষ্টা মনে করছে। ভারতও আশঙ্কা করছে যে জোট সম্প্রসারণ এবং নতুন সদস্য-রাষ্ট্র যুক্ত করা ব্রিকসের সিদ্ধান্ত গ্রহণে জোটে চীনের আধিপত্য বাড়াতে পারে। সুতরাং সম্প্রসারণ মার্কিন-মিত্র হিসেবে ভারতের জন্য একটি স্বার্থবিরোধী প্রচেষ্টা হতে পারে। তবে আশার কথা হচ্ছে সম্প্রতি ভারত জোট সম্প্রসারণে রাজি হয়েছে।

আবার ব্রিকসের চূড়ান্ত লক্ষ্য- একটি বিকল্প বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করা ভারতের স্বার্থের ব্যতিরেক হতে পারে, কেননা এ বিশ্বব্যবস্থা রাশিয়া এবং চীনকেন্দ্রিক হবে। তাই প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে এখনো বড় ধরনের দ্বন্দ্ব রয়েছে; যা ব্রিকসের দ্রুত উত্থানকে থামিয়ে দিতে পারে। ব্রিকসকে অবশ্যই এ সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে এবং সমস্ত সদস্যের স্বার্থ মিটমাট করার উপায় খুঁজে বের করতে হবে।

ব্রিকসে বাংলাদেশের সুযোগ

বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই বিকসের ব্যাংক-এনডিবির শেয়ারহোল্ডার। এটি কোনো বহুজাতিক উন্নয়ন ব্যাংকে বাংলাদেশের জন্য প্রথম মালিকানা। ২০২৩ সালের জুনে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিকসে সদস্যপদ পাওয়ার জন্য আবেদন করে।

অর্থনৈতিক দিক থেকে ব্রিকসে যোগদান বাংলাদেশকে ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি উন্নয়ন অর্থায়ন বাড়াতে ও বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সাহায্য করবে। এ ধরনের একটি কার্যকর জোটে যোগদান বাংলাদেশকে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে তার অংশীদারিত্ব বাড়াতেও সাহায্য করবে।

সাধারণ মুদ্রার ব্যবহার বাংলাদেশকে ডলারের ওপর নির্ভরতা কমাতেও সাহায্য করতে পারে। এ ফোরামের মাধ্যমে বাংলাদেশও বহুপাক্ষিকভাবে দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে।

চ্যালেঞ্জ

এই সম্প্রসারণকে চীনা উদ্যোগ হিসেবে বিবেচনা করা হলে, এটি বাংলাদেশকে একটি ‘চীন-ঘেষা’ দেশ হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে। আন্তঃব্রিকস কূটনীতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিতে নতুন চাপ সৃষ্টি করতে পারে; কারণ চীন ও ভারত উভয়ই জোটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাংলাদেশের সমর্থন আশা করবে।

এছাড়া পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে এবং সবশেষে, ভারত এবং চীন-রাশিয়ার মধ্যে বিদ্যমান ভিন্নস্বার্থ বাংলাদেশের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।

সম্ভবত, ব্রিকস হলো গ্লোবাল সাউথের একমাত্র প্রাণবন্ত সংস্থা, যা সমসাময়িক বৈশ্বিক বিষয়ে বড় আকারের প্রভাব ফেলে। ফলস্বরূপ, ব্রিকস এখন গত দুই বছর ধরে বেশ আলোচনায় রয়েছে। সম্প্রতি এটি জিডিপির দিক থেকে জি-সেভেনকেও ছাড়িয়ে গেছে; কিন্তু ভারত ও চীনের সম্প্রসারণ বিষয়ে প্রাথমিকভাবে বিরোধী অবস্থান বোঝায় যে, চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের জন্য, ব্রিকসকে অবশ্যই তার চ্যালেঞ্জগুলো প্রথমে সমাধান করতে হবে। এ প্রেক্ষাপটে, চলতি বছরের শীর্ষ সম্মেলনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; কারণ গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা যেমন ব্রিকসের সম্প্রসারণ এবং অভিন্ন মুদ্রা চালু করার বিষয়ে আলোচনা করা হবে। ফোরামটি প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলো- ভারত ও চীন এবং তাদের শীর্ষ নেতাদের আলোচনা এবং তাদের পার্থক্য কমাতে একত্রিত করবে। বাংলাদেশের জন্য ব্রিকস রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি ভালো ফোরাম হতে পারে। তবে যোগদানের সাথে সাথে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার জন্য অবশ্যই প্রস্তুতি নিতে হবে। যদি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরিকল্পনা করা হয় তবে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলাও কঠিন হওয়ার কথা নয়। সবশেষে এ বছরের ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন শুধুমাত্র ব্রিকস নয়, গোটা বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ হবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

একটি সফর, একাধিক সংকেত : কে পেল কোন বার্তা?

দেশের কারা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ইসলামী ব্যাংক একীভূতকরণ : আস্থা ফেরাতে সংস্কার, না দায়মুক্তির প্রহসন?

রম্যগদ্য : চাঁদাবাজি চলছে, চলবে

বায়ুদূষণ : নীরব ঘাতক

ইসরায়েলের কৌশলগত ঔদ্ধত্য

পরিবার : সুনাগরিক ও সুশাসক তৈরির ভিত্তিমূল

শিল্পে গ্যাস সংকট : দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিন

আমাদের লড়াইটা আমাদের লড়তে দিন

ব্যাকবেঞ্চারদের পৃথিবী : ব্যর্থতার গায়ে সাফল্যের ছাপ

আমের অ্যানথ্রাকনোজ ও বোঁটা পঁচা রোগ

শিশুদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি : স্কুল ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা ও সংকট

tab

উপ-সম্পাদকীয়

আসন্ন ব্রিকস সম্মেলন ও বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি

আজিজ পাটোয়ারি

রোববার, ১৩ আগস্ট ২০২৩

আগামী ২২ থেকে ২৪ আগস্ট দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে এ বছরের ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ব্রিকস নেতারা এবং সম্ভাব্য সদস্যপদ আবেদনকারীরা আগামী দিনে বিদ্যমান বৈশ্বিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে- এমন অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে তিন দিনের জন্য বসবে এ সম্মেলনে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর জোহানেসবার্গের সম্মেলনে যোগ দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ এবং অন্যান্য আবেদনকারী রাষ্ট্র যারা ব্রিকসে সদস্যপদ চায় তাদের জন্য শীর্ষ সম্মেলনটি তাৎপর্যপূর্ণ হবে। শীর্ষ সম্মেলনটি ব্রিকসের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ কারণ সম্মেলনের সময় নতুন মুদ্রা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা নিয়ে আলোচনা হবে সদস্যদের মধ্যে। এই প্রেক্ষাপটে, ব্রিকসের বর্তমান চ্যালেঞ্জ এবং ব্রিকসে বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জগুলো মূল্যায়ন করা জরুরি।

এক নজরে ব্রিকস

ব্রিকস হলো গ্লোবাল সাউথ বা বৈশ্বিক দক্ষিণের পাঁচটি উন্নয়নশীল দেশের একটি জোট; যারা ভবিষ্যতে বিশ্ব অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জোটের মূল সদস্য হলো ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা। একসঙ্গে এই পাঁচটি দেশ বিশ্বের জনসংখ্যার ৪৫% প্রতিনিধিত্ব করে, পৃথিবীর ভূখন্ডের ৩০% জুড়ে অবস্থান করে এবং বৈশ্বিক জিডিপির ৩১.৫% তাদের দখলে। ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের জিডিপির ৫০ শতাংশ ব্রিকসের এই পাচটি দেশের দখলে থাকার সম্ভাবনাও রয়েছে।

ব্রিকস একটি অনন্য সংস্থা, কারণ এটি পুরোপুরি গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো নিয়ে গঠিত এবং গ্লোবাল নর্থ বা পশ্চিমা বিশ্বের আধিপত্য হ্রাসের জন্য সাউথ-সাউথ বা দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতার প্রচার করে। ব্রিকসের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আকাক্সক্ষা রয়েছে। জোটের লক্ষ্য মূলত বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণে বৈশ্বিক পর্যায়ে অংশীদারিত্ব এবং ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। এরই লক্ষ্যে, ব্রিকস ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং বিদ্যমান বহুপাক্ষিক উন্নয়ন ব্যাংকগুলোতে পশ্চিমা আধিপত্যকে টক্কর দেয়ার জন্য নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি) প্রতিষ্ঠা করেছে। এছাড়াও ব্রিকসের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগের সুযোগ চিহ্নিত করা এবং সে অনুযায়ী বিনিয়োগ করা। বর্তমানে ‘ডি-ডলারাইজেশনের’ যুগে ব্রিকস প্রচলিত আন্তর্জাতিক মুদ্রা-ডলারের আধিপত্যকে হ্রাসের জন্য একটি সাধারণ মুদ্রা চালু করার কথা ভাবছে।

জোটটি খুব স্বল্প সময়ে বেশ কিছু সাফল্য অর্জন করেছে এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা তৈরি করেছে। ফলে এটি এখন একটি প্রাণবন্ত সংগঠন হয়ে উঠেছে যেখানে গত দুই বছরে গ্লোবাল সাউথ থেকে ৩২টি দেশ হয় আবেদন করেছে বা ফোরামে যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এসব দেশের মধ্যে সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য আবেদনকারী দেশ। ব্রিকসের মূল সদস্যরাও জোটের শক্তি বাড়াতে জোট সম্প্রসারণের কথা ভাবছে।

ব্রিকসের জন্য চ্যালেঞ্জ

ব্রিকসের সম্প্রসারণ মূলত চীনের প্রস্তাবনা। সুতরাং ভারত জোট সম্প্রসারণকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের প্রতিরোধ করার জন্য চীনের মৈত্রী এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বাড়ানোর একটি চেষ্টা মনে করছে। ভারতও আশঙ্কা করছে যে জোট সম্প্রসারণ এবং নতুন সদস্য-রাষ্ট্র যুক্ত করা ব্রিকসের সিদ্ধান্ত গ্রহণে জোটে চীনের আধিপত্য বাড়াতে পারে। সুতরাং সম্প্রসারণ মার্কিন-মিত্র হিসেবে ভারতের জন্য একটি স্বার্থবিরোধী প্রচেষ্টা হতে পারে। তবে আশার কথা হচ্ছে সম্প্রতি ভারত জোট সম্প্রসারণে রাজি হয়েছে।

আবার ব্রিকসের চূড়ান্ত লক্ষ্য- একটি বিকল্প বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করা ভারতের স্বার্থের ব্যতিরেক হতে পারে, কেননা এ বিশ্বব্যবস্থা রাশিয়া এবং চীনকেন্দ্রিক হবে। তাই প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে এখনো বড় ধরনের দ্বন্দ্ব রয়েছে; যা ব্রিকসের দ্রুত উত্থানকে থামিয়ে দিতে পারে। ব্রিকসকে অবশ্যই এ সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে এবং সমস্ত সদস্যের স্বার্থ মিটমাট করার উপায় খুঁজে বের করতে হবে।

ব্রিকসে বাংলাদেশের সুযোগ

বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই বিকসের ব্যাংক-এনডিবির শেয়ারহোল্ডার। এটি কোনো বহুজাতিক উন্নয়ন ব্যাংকে বাংলাদেশের জন্য প্রথম মালিকানা। ২০২৩ সালের জুনে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিকসে সদস্যপদ পাওয়ার জন্য আবেদন করে।

অর্থনৈতিক দিক থেকে ব্রিকসে যোগদান বাংলাদেশকে ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি উন্নয়ন অর্থায়ন বাড়াতে ও বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সাহায্য করবে। এ ধরনের একটি কার্যকর জোটে যোগদান বাংলাদেশকে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে তার অংশীদারিত্ব বাড়াতেও সাহায্য করবে।

সাধারণ মুদ্রার ব্যবহার বাংলাদেশকে ডলারের ওপর নির্ভরতা কমাতেও সাহায্য করতে পারে। এ ফোরামের মাধ্যমে বাংলাদেশও বহুপাক্ষিকভাবে দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে।

চ্যালেঞ্জ

এই সম্প্রসারণকে চীনা উদ্যোগ হিসেবে বিবেচনা করা হলে, এটি বাংলাদেশকে একটি ‘চীন-ঘেষা’ দেশ হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে। আন্তঃব্রিকস কূটনীতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিতে নতুন চাপ সৃষ্টি করতে পারে; কারণ চীন ও ভারত উভয়ই জোটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাংলাদেশের সমর্থন আশা করবে।

এছাড়া পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে এবং সবশেষে, ভারত এবং চীন-রাশিয়ার মধ্যে বিদ্যমান ভিন্নস্বার্থ বাংলাদেশের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।

সম্ভবত, ব্রিকস হলো গ্লোবাল সাউথের একমাত্র প্রাণবন্ত সংস্থা, যা সমসাময়িক বৈশ্বিক বিষয়ে বড় আকারের প্রভাব ফেলে। ফলস্বরূপ, ব্রিকস এখন গত দুই বছর ধরে বেশ আলোচনায় রয়েছে। সম্প্রতি এটি জিডিপির দিক থেকে জি-সেভেনকেও ছাড়িয়ে গেছে; কিন্তু ভারত ও চীনের সম্প্রসারণ বিষয়ে প্রাথমিকভাবে বিরোধী অবস্থান বোঝায় যে, চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের জন্য, ব্রিকসকে অবশ্যই তার চ্যালেঞ্জগুলো প্রথমে সমাধান করতে হবে। এ প্রেক্ষাপটে, চলতি বছরের শীর্ষ সম্মেলনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; কারণ গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা যেমন ব্রিকসের সম্প্রসারণ এবং অভিন্ন মুদ্রা চালু করার বিষয়ে আলোচনা করা হবে। ফোরামটি প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলো- ভারত ও চীন এবং তাদের শীর্ষ নেতাদের আলোচনা এবং তাদের পার্থক্য কমাতে একত্রিত করবে। বাংলাদেশের জন্য ব্রিকস রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি ভালো ফোরাম হতে পারে। তবে যোগদানের সাথে সাথে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার জন্য অবশ্যই প্রস্তুতি নিতে হবে। যদি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরিকল্পনা করা হয় তবে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলাও কঠিন হওয়ার কথা নয়। সবশেষে এ বছরের ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন শুধুমাত্র ব্রিকস নয়, গোটা বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ হবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

back to top