alt

উপ-সম্পাদকীয়

কেমন আছে বিত্তহীন মানুষেরা

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

: শুক্রবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩
image

নিজ নিজ পেশায় থেকে কুলি-মজুর, দর্জি, রাজমিস্ত্রি, পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা দেশ ও জাতির সেবা করছেন

সমাজে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের বসবাস। এদের মধ্যে কেউ উচ্চবিত্তের, তাদের সংখ্যা হাতে গোনা। সংখ্যার বিচারে হয়তো হাজারে দুই-একজন হতে পারে। এছাড়া শ্রেণী বিভাজনের মধ্যে যারা অন্তর্ভুক্ত আছেন তাদের মধ্যে মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীন শ্রেণী উল্লেখযোগ্য। এই শ্রেণী বিবেচনায় নিম্নবিত্ত মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৫০%। কর্মজীবী ছাড়া বেকারদেরও বিত্তহীন বলা যেতে পারে। আর যিনি বিত্তহীন তিনি কোন নির্ভরতার জায়গা না পেলে তাকে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামতে হয়। তবে কোন কোন বেকার বা বিত্তহীন পরিবারের কারো না কারো ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে।

দেশের গ্রাম-গঞ্জে-শহরে ভিক্ষুক রয়েছে বেশুমার। ভিক্ষাবৃত্তি এদের পেশা। এ কাজকে কি পেশা বলা যায়? পেশা বলতে তো আমরা সে বৃত্তিকে বুঝি যা গ্রহণের জন্য দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। এ বৃত্তি গ্রহণের কারণে নিয়োগকর্তা তাকে অর্থ দেয়। সেই নিয়োগকর্তার চাহিদামাফিক তার বিদ্যা-বুদ্ধি, মেধা ও দক্ষতার আলোকে সেবা প্রদান করে। আবার নিয়োগকর্তার অধীন না হয়েও একজন পেশা অবলম্বন করতে পারে। যেমন একজন ব্যবসায়ী। শিক্ষা-দীক্ষা ও প্রশিক্ষণের পর অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে শারীরিক-মানসিক পরিশ্রম করে আয়-উপার্জন করেন। তিনি ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে অথবা তার উৎপাদিত পণ্য দিয়ে ভোক্তার প্রয়োজন মেটায়। অন্য কথায়- তিনি দেশ ও জাতির সেবায় নিয়োজিত থাকেন। একইভাবে চিকিৎসক, শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী প্রমুখ নিজ নিজ পেশায় নিয়োজিত থেকে দেশ ও জাতিকে সেবা দিয়ে আসছেন। নিজ নিজ পেশায় থেকে কুলি-মজুর, রিকশাওয়ালা, ভ্যানওয়ালা, সবজিওয়ালা, দর্জি, রাজমিস্ত্রি, পরিচ্ছন্নতাকর্মী প্রমুখ সংশ্লিষ্টজন দেশ ও জাতিকে সেবা দিয়ে আসছেন। কিন্তু একজন ভিক্ষুক? কী তার অবদান? কোন সেবায় তিনি নিয়োজিত? তবে একজন ভিক্ষুকও জাতীয় অর্থনীতির অংশীজন।

বাল্যকালে গৃহদ্বারে এক বৃদ্ধ ভিক্ষুকের আর্তনাদ শুনেছি বেশ কয়েক বছর। নিঃসন্দেহে এরকম ভিক্ষুকেরা স্বেচ্ছায় এ বৃত্তি গ্রহণ করে নাই। তবে বড় বড় শহরে অনায়াসে অর্থোপার্জনের মাধ্যম হিসেবে কেউ কেউ এ বৃত্তি গ্রহণ করে বলে শোনা যায়। এসব ফঁন্দিবাজদের কথা বলছি না। অনন্যোপায় হয়ে যারা এ পথ বেছে নিয়েছে তাদের কথা বলছি। কর্মে অক্ষম, প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার, সবলের অর্থলোলুপতার আগ্রাসী থাবায় সর্বহারা ব্যক্তি, জমিদার ও ধনলিপ্সু ব্যক্তির বুদ্ধির কূটকৌশলে সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া ব্যক্তি, মামলা-মোকদ্দমায় নিঃস্ব হয়ে যাওয়া ব্যক্তি, স্বামী পরিত্যক্তা প্রমুখ ব্যক্তিরা ভিক্ষাবৃত্তির কাজে নিয়োজিত আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব ব্যক্তিরা জুলুম-নির্যাতন ও শোষণের শিকার। নিজেদের অসহায়ত্বকে তারা ভাগ্যলিপি বলে মেনে নিয়েছে।

জুলুম-নির্যাতন ও শোষণ, দমন, নিয়ন্ত্রণ ও বিনাশ করা সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব; কিন্তু সবলেরা সমাজ ও রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় ও আনুকূল্যে দুর্বলের প্রতি নির্যাতন নিপীড়ন চালায়। সবলের প্রভাব-প্রতিপত্তি, বিত্ত-বৈভর-প্রাচুর্য, যশখ্যাতি, প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব লাভের প্রতিযোগিতা ও কূটকৌশল অবলম্বন দুর্বলকে নিঃস্ব করে ফেলে। সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্বাহকেরা প্রকৃত দেশপ্রেমিক, নিঃস্বার্থ মানবতাবাদী এবং সাহসী হলে দুর্বলের প্রতি সবলের শোষণ ও নির্যাতন বিনাশ করা সম্ভব হবে। ফলে অনেক দুর্বল ও অসহায় ব্যক্তিকে ভিক্ষুক হওয়া থেকে রক্ষা করা সহজতর হবে।

নিঃসন্দেহে ভিক্ষাবৃত্তি কোন সম্মানজনক পেশা নয়। সম্মান অর্জনের সোপান মনে করেও কেউ এ পেশায় আসে না। বরং এটি একটি লজ্জাজনক পেশা। যদিও অধিকাংশ ভিক্ষুককে আমরা লজ্জা পেতে দেখি না। জীবিকার কাছে, জীবনের কাছে আত্মসম্মানবোধের উপলব্ধি নস্যি হয়ে গিয়েছে। সম্মান নিয়ে তার ভাবনা নেই। বিত্ত-বৈভব প্রাচুর্যের আকাক্সক্ষা তাকে ব্যাকুল-ব্যতিব্যস্ত করে না। পাঁচতারা-তিনতারা হোটেলে রাত্রিযাপনের চিন্তা তার কল্পনাতীত। রেস্টুরেন্টের বাহারি খাবারের স্বাদ তার হৃদয়-কন্দরে দোলা দেয় না। পরিবার নিয়ে রিসোর্টে বছরে অন্তত একবার যাওয়ার স্বাদ তার নেই। ছেলেমেয়ের বিয়েতে গায়েহলুদের অনুষ্ঠান, মাঝে-মধ্যে বিউটি পার্লারে যাওয়া তার নিকট আশাতীত। তবে সে কমিউনিটি সেন্টারে যায়, রিসোর্ট ও বড় বড় রেস্টুরেন্টে যায়। খাবার খেতে নয়, উচ্ছিষ্ট টোকাতে। রেস্টুরেন্ট ও কমিউনিটি সেন্টারের দরজা বন্ধ হয়ে গেলে এরা ডাস্টবিন হতে খাবার কেড়ে নিয়ে খায়। এরা ভিক্ষুক। হ্যাঁ এদের কথাই বলছি। এদের টাকায় আপনার বেতন হয়, এদের টাকায় আপনার স্ত্রীর আলো-ঝলমল শপিংমলে মার্কেটিং চলে। এদের টাকায় আপনার পকেটে থাকে কয়েক লাখ টাকার আইফোন, আপনার ড্রয়িং রুমে জ্বলে ঝাড়বাতি। ছোট কারটি বাদ দিয়ে বড় সাইজের জিপ কিনেন আপনি এদের টাকায়। সরকারি সুবিধায় সুসজ্জিত কেবিনে আপনার চিকিৎসা চলে এদের টাকায়। আপনি অনেক বড় সরকারি আমলা আকাশে উড়ে আপনি বিদেশে পাড়ি দেন এদের টাকায়। একজন সম্মানবর্জিত পেশাদার, হীনকাজে যার আয়-রোজগার তার টাকায় আপনার এত সব চলে। কিন্তু কিভাবে?

পেশা মানুষকে বিশিষ্টতা দান করে। সম্মান এনে দেয়। আবার জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হিসেবেও কাজ করে। এ কারণে মানুষ বেকার থাকতে চায় না। বেকার থাকলে কেবল অর্থোপার্জন হয় না- ব্যাপারটি এখানে শেষ নয়। বেকার থাকলে সামাজিক বঞ্চনা সইতে হয়, আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে পড়তে হয়। এ দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে একটা পেশা অবলম্বন অত্যন্ত জরুরি। এ দেশে প্রচলিত পেশাসমূহের মধ্যে আর্থিক সুবিধা, সম্মান ও মর্যাদায় তারতম্য আছে। এখানে সম্মান মর্যাদা নিরূপিত হয় অর্থের মাপকাঠিতে। যে পেশায় আর্থিক সুবিধা যত বেশি, সেই পেশা তত বেশি সম্মানের। শিক্ষা-দীক্ষা, নৈতিকতা, মানবিকতা, বিচক্ষণতা খুব একটা ফ্যাক্টর না এখানে।

তাই এখানে শিক্ষিত যুবকেরা সর্বোচ্চ আর্থিক সুবিধার পদটি করায়ত্ত করতে চায়। সর্বোচ্চ সুবিধা খাতের প্রথম ধাপ হচ্ছে বিসিএস ক্যাডার হিসেবে নিয়োগ লাভ করা। তাই এ নিয়োগটি লাভের জন্য চিকিৎসা, প্রকৌশল ও সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ও মাস্টার্সধারী গ্র্যাজুয়েটরা প্রাণান্তকর লড়াই করে। খুব অল্পসংখ্যক এ তীব্র প্রতিযোগিতায় নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে সক্ষম হয়। আর বিশাল অংশ সর্বশেষ সুযোগও হারিয়ে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে নন-ক্যাডার সার্ভিসে বা অন্য কোনভাবে নিজেকে টিকিয়ে নেয়। এভাবে ছোট-বড় অনেকেই চাকরি করে। এখানে বড় চাকুরেদের কথাই বলছি। কেননা সর্বদিক দিয়ে তারাই সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে সবচেয়ে বেশি।

চাকরি করে বেতন পাবে, সুযোগ-সুবিধা পাবে এটাই স্বাভাবিক; কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সুযোগ-সুবিধা এবং অর্থের ব্যবধানটা অনেক বেশি। একজন ইউএনও এবং তার পিয়নের কথাই ধরা যাক। উভয়ের বেতন-স্কেলে অনেক ফারাক। মান-মর্যাদা-স্ট্যাটাসেও অনেক ফারাক; কিন্তু দৈনন্দিন খরচ উভয়ের সমান। আলু-পেঁয়াজ, পোটল উভয়ে একই দামে কেনে। উভয়ের একই রকম ক্ষুধা-তৃষ্ণা লাগে। উভয়ের অসুখ-বিসুখ হয়। উভয়ের আত্মীয়স্বজন এবং পারিবারিক ও সামাজিক দায়-দায়িত্ব আছে। উচ্চপদস্থদের ন্যায় নিম্নপদস্থদেরও ছেলেমেয়েদের শিক্ষা-দীক্ষা দিতে হয়। আমি বলছি না যে, এদের মধ্যে শিক্ষা, যোগ্যতা ও দক্ষতায় ব্যবধান নেই। অবশ্যই আছে, তবে নিম্নপদস্থের অনেকেরই মেধা আছে। সুবিধাবঞ্চিত হওয়ার কারণে প্রচলিত শিক্ষার বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে পদের সিঁড়িতে সে পা দিতে পারে নাই; কিন্তু মানুষ হিসেবে তার সম্মান পাওয়ার অধিকার রয়েছে।

ভেবে দেখেছেন কি রিকশাওয়ালা, ভ্যানওয়ালা, সবজিওয়ালা কুলি-মজুর, ড্রাইভার, দর্জি, জেলে প্রমুখেরা সমাজের পদস্থ মানুষের নিকট কেমন আচরণ পায়? পদস্থ ব্যক্তি রেগে গেলে তো আর কথাই নেই। তখন অশ্রাব্য ভাষায় সুচ-তীক্ষ্ম তীর এদের বক্ষ ভেদ করে অন্তরে গিয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়। পদস্থ ব্যক্তির শিক্ষা-দীক্ষা যোগ্যতা-দক্ষতা এবং পদ এ তীর ছোড়া থেকে তাকে বিরত রাখতে পারে না। আর ওরা এ তীর সহ্য করে নীরবে-নিভৃতে। ওরা ধরেই নিয়েছে যে, তারা শিক্ষা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও নিয়তির কাছে হেরে গিয়েছে। তার কাছে ওই হেরে যাওয়া আর এ তীরের ক্ষত কার্য-কারণ সূত্রে যেন অনিবার্যভাবে গাঁথা। শিক্ষা-দীক্ষা, যোগ্যতা, দক্ষতা, পদ-পদবি, বিত্ত-বৈভব, আর্থিক ও সামাজিক সুবিধাসমূহ উচ্চপদস্থ ব্যক্তিকে অহংকারী করেছে। সুবিধাবঞ্চিত মানুষ এদের নিকট তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের পাত্র।

সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্বাহকেরা প্রকৃত দেশপ্রেমিক, নিঃস্বার্থ মানবতাবাদী এবং সাহসী হলে দুর্বলের প্রতি সবলের শোষণ ও নির্যাতন বিনাশ করা সম্ভব হবে

অথচ ভেবে দেখেছেন কি ওই তাচ্ছিল্যের লোকটি আপনাকে প্রতিদিন কতভাবে সেবা দিচ্ছে, কত গভীরে তার প্রতি আপনার নির্ভরতা। চাষি ভাই যদি ফসল না ফলায় আপনি খাবেন কী? জেলে ভাই নিদ্রাহীন রাতে মাছ ধরে আপনার জন্য পাঠায়। আর মাছ বিক্রেতা পাইকারি বাজার থেকে অতি প্রত্যুষে এনে ছিন্নবসনে মলিন বদনে যথাযথ সম্ভাষণে আপনার থলে ভরে মাছ দেয়। দর্জি ভাই আপনাকে স্যুটেড রাখে। রিকশাওয়ালা আপনাকে গন্তব্যে যেতে কতটা সাহায্য করে ভেবে দেখেছেন কি? আপনার কাজের বুয়া মাত্র অল্প কিছু অর্থের বিনিময়ে আপনার ঘরটা পরিপাটি রাখে। ওই অর্থের দশগুণ আপনি রাথরুম বা রান্নাঘরে ফেলে রাখেন। দেখেন রাথরুম আর রান্নাঘরের দুর্গন্ধ দূর হয় কিনা? আর আপনার ড্রাইভার কতভাবে আপনার ও আপনার পরিবারে সাহায্য করে ভেবে দেখেছেন কি? এরা সবাই আপনার চারপাশের মানুষ। আপনার দূরেও অনেক মানুষ আছে যাদের আপনি চেনেন না, যাদের সেবা আপনি বুঝতে পারেন না। ধরুন শহরের পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কথা। সে যদি সুবেহসাদিকের আগে রাস্তাঘাট কয়েক দিন পরিষ্কার না করত, ময়লা-আবর্জনা সাফ না করতো- দুই আঙ্গুলে নাক চেপে কতদিন পারতেন স্যুটেড-বুটেড পরিপাটি অবস্থা বজায় রাখতে?

আপনি বেতন বেশি পান। তাই আপনার এত অহংকার। ভিক্ষুকের অর্থে আপনার মাসিক বেতন হলে আপনার অহংকার করার কিছু থাকে কি? এত বছর চাকরি করলেন সহকারী সচিব থেকে সচিব হলেন। ১৫-৩০ বছরের প্রশাসনিক কাজে অভিজ্ঞতা, রাজস্ব খাত থেকে আপনার মাসিক বেতন হয়, ইয়ারলি ইনক্রিমেন্ট হয়, বোনাস হয়, গাড়ির তেল, যাতায়াত ইত্যাদি সবকিছুইতো রাজস্ব খাত থেকে আসে। তাহলে ভিক্ষুকের অর্থ? হ্যাঁ, ভিক্ষুকের অর্থে আমার-আপনার বেতন-বোনাস হয়। ভিক্ষুক শিল্পপতি নয়, ধনাঢ্য ব্যক্তি না। বছর শেষে রিটার্ন দাখিল করে না। রাজস্ব খাতে আয়কর দেয় না। আবার আয়কর ফাঁকিও দেয় না। তাহলে? শিল্পপতি, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী রাজস্ব খাতে আয়কর প্রদান করে। আর একজন ভিক্ষুক শিল্পপতির পণ্য ব্যবহার করে। থালা-বাটি, কাপ-পিরিচ, বৈদ্যুতিক বাল্ব, ফ্যান সবকিছুই একজন ভিক্ষুক ব্যবহার করে। এমন ভিক্ষুক কি এ দেশে পাওয়া যাবে যার ঘরে খুব অল্প দামের হলেও একটি মোবাইল সেট নেই। অথবা কখনও কখনও সে মোবাইল ফোনে কথা বলে না? নিঃসন্দেহে এসব প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ সূচক। তাই ভোক্তা হিসেবে একজন ভিক্ষুক শিল্পপতির আয়ে, ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর মুনাফায় ভূমিকা রাখে। শিল্পপতি, ব্যবসায়ী প্রমুখেরা রাজস্ব খাতে আয়কর জমা দেন। আর সেখান থেকে আমার-আপনার বেতন আসে। অতএব আমি-আপনি সবার বিবেক জাগ্রত হওয়া উচিত নয় কি?

রাষ্ট্রযন্ত্র যদি দায়িত্বশীল হয়ে যথার্থ সেবকের ভূমিকা পালন করতে পারে তাহলে প্রতিটি মানুষই শ্রম ও কর্মমুখী মানুষে পরিণত হতে পারে; যা দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের দ্বারকে অবারিত করবে। জাতিকে গ্লানিমুক্ত করে স্বাবলম্বী জাতির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করবে। সেই আশা ও প্রত্যয় নিয়ে আমাদের সবাইকে প্রস্তুতি নিতে হবে। তাহলেই আমরা সমৃদ্ধ ও উন্নত জাতিতে পরিণত হতে সক্ষম হব।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ

ধর্মভিত্তিক জোট কোন পথে

ছবি

বিদায় অগ্নিকন্যা

রিমান্ড সংস্কৃতি : আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে একটি মানবাধিকার পরিপ্রেক্ষিত

ছবি

ডেঙ্গুজ্বর : সচেতনতার বিকল্প নেই

ছবি

উন্নয়ন ও পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য রাখা কেন জরুরি

ছবি

মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ ম-ল

নদীর প্রাণ শুশুক, নিরাপদে বেঁচে থাকুক

ভবন নির্মাণ ও বিল্ডিং কোড

রম্যগদ্য : গণতন্ত্রের গলিতে গলিতে হিটলার

রাষ্ট্র সংস্কার ও আদিবাসী

রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যুতে সংবিধান ও অতীত-ইতিহাস

শিক্ষাকে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করার উপায়

দিবস যায় দিবস আসে, নিরাপদ হয় না সড়ক

‘ক্ষুদ্রতার মন্দিরেতে বসায়ে আপনারে আপন পায়ে না দিই যেন অর্ঘ্য ভারে ভারে’

একাকিত্ব : নিজেকে আবিষ্কার ও সৃজনশীলতা বিকাশের পথ

লাগামহীন দ্রব্যমূল্য

বাঁশের বংশবৃদ্ধিতে অন্তরায় বাঁশকরুল সংগ্রহ

একতার অভাবে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে করণীয়

শিক্ষা খাতে দলীয় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব

কোন পথে জামায়াতের রাজনীতি?

শ্রমিকের উন্নয়ন ছাড়া গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব নয়

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির ভূমিকা

ডিমের জারিজুরি

যোগ্য নেতৃত্ব সমাজ-সংগঠনকে এগিয়ে নেয়

ব্যক্তি স্বাধীনতার সংকট

কিল মারার গোঁসাই

ছবি

শেকড়ের সন্ধানে সাঁইজির ধামে

বৈষম্যের অন্ধকারে নিমজ্জিত প্রকৌশল শিক্ষার আরেক জগৎ

প্রশাসনিক সংস্কারে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা কতটা প্রতিষ্ঠা পাবে?

বাংলার মৃৎশিল্প

প্রবারণা পূর্ণিমার আলোয় আলোকিত হোক মানবজাতি

খেলাপি ঋণের অপসংস্কৃতি

কথার কথা যত কথা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

কেমন আছে বিত্তহীন মানুষেরা

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

image

নিজ নিজ পেশায় থেকে কুলি-মজুর, দর্জি, রাজমিস্ত্রি, পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা দেশ ও জাতির সেবা করছেন

শুক্রবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩

সমাজে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের বসবাস। এদের মধ্যে কেউ উচ্চবিত্তের, তাদের সংখ্যা হাতে গোনা। সংখ্যার বিচারে হয়তো হাজারে দুই-একজন হতে পারে। এছাড়া শ্রেণী বিভাজনের মধ্যে যারা অন্তর্ভুক্ত আছেন তাদের মধ্যে মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীন শ্রেণী উল্লেখযোগ্য। এই শ্রেণী বিবেচনায় নিম্নবিত্ত মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৫০%। কর্মজীবী ছাড়া বেকারদেরও বিত্তহীন বলা যেতে পারে। আর যিনি বিত্তহীন তিনি কোন নির্ভরতার জায়গা না পেলে তাকে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামতে হয়। তবে কোন কোন বেকার বা বিত্তহীন পরিবারের কারো না কারো ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে।

দেশের গ্রাম-গঞ্জে-শহরে ভিক্ষুক রয়েছে বেশুমার। ভিক্ষাবৃত্তি এদের পেশা। এ কাজকে কি পেশা বলা যায়? পেশা বলতে তো আমরা সে বৃত্তিকে বুঝি যা গ্রহণের জন্য দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। এ বৃত্তি গ্রহণের কারণে নিয়োগকর্তা তাকে অর্থ দেয়। সেই নিয়োগকর্তার চাহিদামাফিক তার বিদ্যা-বুদ্ধি, মেধা ও দক্ষতার আলোকে সেবা প্রদান করে। আবার নিয়োগকর্তার অধীন না হয়েও একজন পেশা অবলম্বন করতে পারে। যেমন একজন ব্যবসায়ী। শিক্ষা-দীক্ষা ও প্রশিক্ষণের পর অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে শারীরিক-মানসিক পরিশ্রম করে আয়-উপার্জন করেন। তিনি ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে অথবা তার উৎপাদিত পণ্য দিয়ে ভোক্তার প্রয়োজন মেটায়। অন্য কথায়- তিনি দেশ ও জাতির সেবায় নিয়োজিত থাকেন। একইভাবে চিকিৎসক, শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী প্রমুখ নিজ নিজ পেশায় নিয়োজিত থেকে দেশ ও জাতিকে সেবা দিয়ে আসছেন। নিজ নিজ পেশায় থেকে কুলি-মজুর, রিকশাওয়ালা, ভ্যানওয়ালা, সবজিওয়ালা, দর্জি, রাজমিস্ত্রি, পরিচ্ছন্নতাকর্মী প্রমুখ সংশ্লিষ্টজন দেশ ও জাতিকে সেবা দিয়ে আসছেন। কিন্তু একজন ভিক্ষুক? কী তার অবদান? কোন সেবায় তিনি নিয়োজিত? তবে একজন ভিক্ষুকও জাতীয় অর্থনীতির অংশীজন।

বাল্যকালে গৃহদ্বারে এক বৃদ্ধ ভিক্ষুকের আর্তনাদ শুনেছি বেশ কয়েক বছর। নিঃসন্দেহে এরকম ভিক্ষুকেরা স্বেচ্ছায় এ বৃত্তি গ্রহণ করে নাই। তবে বড় বড় শহরে অনায়াসে অর্থোপার্জনের মাধ্যম হিসেবে কেউ কেউ এ বৃত্তি গ্রহণ করে বলে শোনা যায়। এসব ফঁন্দিবাজদের কথা বলছি না। অনন্যোপায় হয়ে যারা এ পথ বেছে নিয়েছে তাদের কথা বলছি। কর্মে অক্ষম, প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার, সবলের অর্থলোলুপতার আগ্রাসী থাবায় সর্বহারা ব্যক্তি, জমিদার ও ধনলিপ্সু ব্যক্তির বুদ্ধির কূটকৌশলে সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া ব্যক্তি, মামলা-মোকদ্দমায় নিঃস্ব হয়ে যাওয়া ব্যক্তি, স্বামী পরিত্যক্তা প্রমুখ ব্যক্তিরা ভিক্ষাবৃত্তির কাজে নিয়োজিত আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব ব্যক্তিরা জুলুম-নির্যাতন ও শোষণের শিকার। নিজেদের অসহায়ত্বকে তারা ভাগ্যলিপি বলে মেনে নিয়েছে।

জুলুম-নির্যাতন ও শোষণ, দমন, নিয়ন্ত্রণ ও বিনাশ করা সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব; কিন্তু সবলেরা সমাজ ও রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় ও আনুকূল্যে দুর্বলের প্রতি নির্যাতন নিপীড়ন চালায়। সবলের প্রভাব-প্রতিপত্তি, বিত্ত-বৈভর-প্রাচুর্য, যশখ্যাতি, প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব লাভের প্রতিযোগিতা ও কূটকৌশল অবলম্বন দুর্বলকে নিঃস্ব করে ফেলে। সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্বাহকেরা প্রকৃত দেশপ্রেমিক, নিঃস্বার্থ মানবতাবাদী এবং সাহসী হলে দুর্বলের প্রতি সবলের শোষণ ও নির্যাতন বিনাশ করা সম্ভব হবে। ফলে অনেক দুর্বল ও অসহায় ব্যক্তিকে ভিক্ষুক হওয়া থেকে রক্ষা করা সহজতর হবে।

নিঃসন্দেহে ভিক্ষাবৃত্তি কোন সম্মানজনক পেশা নয়। সম্মান অর্জনের সোপান মনে করেও কেউ এ পেশায় আসে না। বরং এটি একটি লজ্জাজনক পেশা। যদিও অধিকাংশ ভিক্ষুককে আমরা লজ্জা পেতে দেখি না। জীবিকার কাছে, জীবনের কাছে আত্মসম্মানবোধের উপলব্ধি নস্যি হয়ে গিয়েছে। সম্মান নিয়ে তার ভাবনা নেই। বিত্ত-বৈভব প্রাচুর্যের আকাক্সক্ষা তাকে ব্যাকুল-ব্যতিব্যস্ত করে না। পাঁচতারা-তিনতারা হোটেলে রাত্রিযাপনের চিন্তা তার কল্পনাতীত। রেস্টুরেন্টের বাহারি খাবারের স্বাদ তার হৃদয়-কন্দরে দোলা দেয় না। পরিবার নিয়ে রিসোর্টে বছরে অন্তত একবার যাওয়ার স্বাদ তার নেই। ছেলেমেয়ের বিয়েতে গায়েহলুদের অনুষ্ঠান, মাঝে-মধ্যে বিউটি পার্লারে যাওয়া তার নিকট আশাতীত। তবে সে কমিউনিটি সেন্টারে যায়, রিসোর্ট ও বড় বড় রেস্টুরেন্টে যায়। খাবার খেতে নয়, উচ্ছিষ্ট টোকাতে। রেস্টুরেন্ট ও কমিউনিটি সেন্টারের দরজা বন্ধ হয়ে গেলে এরা ডাস্টবিন হতে খাবার কেড়ে নিয়ে খায়। এরা ভিক্ষুক। হ্যাঁ এদের কথাই বলছি। এদের টাকায় আপনার বেতন হয়, এদের টাকায় আপনার স্ত্রীর আলো-ঝলমল শপিংমলে মার্কেটিং চলে। এদের টাকায় আপনার পকেটে থাকে কয়েক লাখ টাকার আইফোন, আপনার ড্রয়িং রুমে জ্বলে ঝাড়বাতি। ছোট কারটি বাদ দিয়ে বড় সাইজের জিপ কিনেন আপনি এদের টাকায়। সরকারি সুবিধায় সুসজ্জিত কেবিনে আপনার চিকিৎসা চলে এদের টাকায়। আপনি অনেক বড় সরকারি আমলা আকাশে উড়ে আপনি বিদেশে পাড়ি দেন এদের টাকায়। একজন সম্মানবর্জিত পেশাদার, হীনকাজে যার আয়-রোজগার তার টাকায় আপনার এত সব চলে। কিন্তু কিভাবে?

পেশা মানুষকে বিশিষ্টতা দান করে। সম্মান এনে দেয়। আবার জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হিসেবেও কাজ করে। এ কারণে মানুষ বেকার থাকতে চায় না। বেকার থাকলে কেবল অর্থোপার্জন হয় না- ব্যাপারটি এখানে শেষ নয়। বেকার থাকলে সামাজিক বঞ্চনা সইতে হয়, আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে পড়তে হয়। এ দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে একটা পেশা অবলম্বন অত্যন্ত জরুরি। এ দেশে প্রচলিত পেশাসমূহের মধ্যে আর্থিক সুবিধা, সম্মান ও মর্যাদায় তারতম্য আছে। এখানে সম্মান মর্যাদা নিরূপিত হয় অর্থের মাপকাঠিতে। যে পেশায় আর্থিক সুবিধা যত বেশি, সেই পেশা তত বেশি সম্মানের। শিক্ষা-দীক্ষা, নৈতিকতা, মানবিকতা, বিচক্ষণতা খুব একটা ফ্যাক্টর না এখানে।

তাই এখানে শিক্ষিত যুবকেরা সর্বোচ্চ আর্থিক সুবিধার পদটি করায়ত্ত করতে চায়। সর্বোচ্চ সুবিধা খাতের প্রথম ধাপ হচ্ছে বিসিএস ক্যাডার হিসেবে নিয়োগ লাভ করা। তাই এ নিয়োগটি লাভের জন্য চিকিৎসা, প্রকৌশল ও সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ও মাস্টার্সধারী গ্র্যাজুয়েটরা প্রাণান্তকর লড়াই করে। খুব অল্পসংখ্যক এ তীব্র প্রতিযোগিতায় নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে সক্ষম হয়। আর বিশাল অংশ সর্বশেষ সুযোগও হারিয়ে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে নন-ক্যাডার সার্ভিসে বা অন্য কোনভাবে নিজেকে টিকিয়ে নেয়। এভাবে ছোট-বড় অনেকেই চাকরি করে। এখানে বড় চাকুরেদের কথাই বলছি। কেননা সর্বদিক দিয়ে তারাই সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে সবচেয়ে বেশি।

চাকরি করে বেতন পাবে, সুযোগ-সুবিধা পাবে এটাই স্বাভাবিক; কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সুযোগ-সুবিধা এবং অর্থের ব্যবধানটা অনেক বেশি। একজন ইউএনও এবং তার পিয়নের কথাই ধরা যাক। উভয়ের বেতন-স্কেলে অনেক ফারাক। মান-মর্যাদা-স্ট্যাটাসেও অনেক ফারাক; কিন্তু দৈনন্দিন খরচ উভয়ের সমান। আলু-পেঁয়াজ, পোটল উভয়ে একই দামে কেনে। উভয়ের একই রকম ক্ষুধা-তৃষ্ণা লাগে। উভয়ের অসুখ-বিসুখ হয়। উভয়ের আত্মীয়স্বজন এবং পারিবারিক ও সামাজিক দায়-দায়িত্ব আছে। উচ্চপদস্থদের ন্যায় নিম্নপদস্থদেরও ছেলেমেয়েদের শিক্ষা-দীক্ষা দিতে হয়। আমি বলছি না যে, এদের মধ্যে শিক্ষা, যোগ্যতা ও দক্ষতায় ব্যবধান নেই। অবশ্যই আছে, তবে নিম্নপদস্থের অনেকেরই মেধা আছে। সুবিধাবঞ্চিত হওয়ার কারণে প্রচলিত শিক্ষার বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে পদের সিঁড়িতে সে পা দিতে পারে নাই; কিন্তু মানুষ হিসেবে তার সম্মান পাওয়ার অধিকার রয়েছে।

ভেবে দেখেছেন কি রিকশাওয়ালা, ভ্যানওয়ালা, সবজিওয়ালা কুলি-মজুর, ড্রাইভার, দর্জি, জেলে প্রমুখেরা সমাজের পদস্থ মানুষের নিকট কেমন আচরণ পায়? পদস্থ ব্যক্তি রেগে গেলে তো আর কথাই নেই। তখন অশ্রাব্য ভাষায় সুচ-তীক্ষ্ম তীর এদের বক্ষ ভেদ করে অন্তরে গিয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়। পদস্থ ব্যক্তির শিক্ষা-দীক্ষা যোগ্যতা-দক্ষতা এবং পদ এ তীর ছোড়া থেকে তাকে বিরত রাখতে পারে না। আর ওরা এ তীর সহ্য করে নীরবে-নিভৃতে। ওরা ধরেই নিয়েছে যে, তারা শিক্ষা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও নিয়তির কাছে হেরে গিয়েছে। তার কাছে ওই হেরে যাওয়া আর এ তীরের ক্ষত কার্য-কারণ সূত্রে যেন অনিবার্যভাবে গাঁথা। শিক্ষা-দীক্ষা, যোগ্যতা, দক্ষতা, পদ-পদবি, বিত্ত-বৈভব, আর্থিক ও সামাজিক সুবিধাসমূহ উচ্চপদস্থ ব্যক্তিকে অহংকারী করেছে। সুবিধাবঞ্চিত মানুষ এদের নিকট তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের পাত্র।

সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্বাহকেরা প্রকৃত দেশপ্রেমিক, নিঃস্বার্থ মানবতাবাদী এবং সাহসী হলে দুর্বলের প্রতি সবলের শোষণ ও নির্যাতন বিনাশ করা সম্ভব হবে

অথচ ভেবে দেখেছেন কি ওই তাচ্ছিল্যের লোকটি আপনাকে প্রতিদিন কতভাবে সেবা দিচ্ছে, কত গভীরে তার প্রতি আপনার নির্ভরতা। চাষি ভাই যদি ফসল না ফলায় আপনি খাবেন কী? জেলে ভাই নিদ্রাহীন রাতে মাছ ধরে আপনার জন্য পাঠায়। আর মাছ বিক্রেতা পাইকারি বাজার থেকে অতি প্রত্যুষে এনে ছিন্নবসনে মলিন বদনে যথাযথ সম্ভাষণে আপনার থলে ভরে মাছ দেয়। দর্জি ভাই আপনাকে স্যুটেড রাখে। রিকশাওয়ালা আপনাকে গন্তব্যে যেতে কতটা সাহায্য করে ভেবে দেখেছেন কি? আপনার কাজের বুয়া মাত্র অল্প কিছু অর্থের বিনিময়ে আপনার ঘরটা পরিপাটি রাখে। ওই অর্থের দশগুণ আপনি রাথরুম বা রান্নাঘরে ফেলে রাখেন। দেখেন রাথরুম আর রান্নাঘরের দুর্গন্ধ দূর হয় কিনা? আর আপনার ড্রাইভার কতভাবে আপনার ও আপনার পরিবারে সাহায্য করে ভেবে দেখেছেন কি? এরা সবাই আপনার চারপাশের মানুষ। আপনার দূরেও অনেক মানুষ আছে যাদের আপনি চেনেন না, যাদের সেবা আপনি বুঝতে পারেন না। ধরুন শহরের পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কথা। সে যদি সুবেহসাদিকের আগে রাস্তাঘাট কয়েক দিন পরিষ্কার না করত, ময়লা-আবর্জনা সাফ না করতো- দুই আঙ্গুলে নাক চেপে কতদিন পারতেন স্যুটেড-বুটেড পরিপাটি অবস্থা বজায় রাখতে?

আপনি বেতন বেশি পান। তাই আপনার এত অহংকার। ভিক্ষুকের অর্থে আপনার মাসিক বেতন হলে আপনার অহংকার করার কিছু থাকে কি? এত বছর চাকরি করলেন সহকারী সচিব থেকে সচিব হলেন। ১৫-৩০ বছরের প্রশাসনিক কাজে অভিজ্ঞতা, রাজস্ব খাত থেকে আপনার মাসিক বেতন হয়, ইয়ারলি ইনক্রিমেন্ট হয়, বোনাস হয়, গাড়ির তেল, যাতায়াত ইত্যাদি সবকিছুইতো রাজস্ব খাত থেকে আসে। তাহলে ভিক্ষুকের অর্থ? হ্যাঁ, ভিক্ষুকের অর্থে আমার-আপনার বেতন-বোনাস হয়। ভিক্ষুক শিল্পপতি নয়, ধনাঢ্য ব্যক্তি না। বছর শেষে রিটার্ন দাখিল করে না। রাজস্ব খাতে আয়কর দেয় না। আবার আয়কর ফাঁকিও দেয় না। তাহলে? শিল্পপতি, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী রাজস্ব খাতে আয়কর প্রদান করে। আর একজন ভিক্ষুক শিল্পপতির পণ্য ব্যবহার করে। থালা-বাটি, কাপ-পিরিচ, বৈদ্যুতিক বাল্ব, ফ্যান সবকিছুই একজন ভিক্ষুক ব্যবহার করে। এমন ভিক্ষুক কি এ দেশে পাওয়া যাবে যার ঘরে খুব অল্প দামের হলেও একটি মোবাইল সেট নেই। অথবা কখনও কখনও সে মোবাইল ফোনে কথা বলে না? নিঃসন্দেহে এসব প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ সূচক। তাই ভোক্তা হিসেবে একজন ভিক্ষুক শিল্পপতির আয়ে, ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর মুনাফায় ভূমিকা রাখে। শিল্পপতি, ব্যবসায়ী প্রমুখেরা রাজস্ব খাতে আয়কর জমা দেন। আর সেখান থেকে আমার-আপনার বেতন আসে। অতএব আমি-আপনি সবার বিবেক জাগ্রত হওয়া উচিত নয় কি?

রাষ্ট্রযন্ত্র যদি দায়িত্বশীল হয়ে যথার্থ সেবকের ভূমিকা পালন করতে পারে তাহলে প্রতিটি মানুষই শ্রম ও কর্মমুখী মানুষে পরিণত হতে পারে; যা দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের দ্বারকে অবারিত করবে। জাতিকে গ্লানিমুক্ত করে স্বাবলম্বী জাতির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করবে। সেই আশা ও প্রত্যয় নিয়ে আমাদের সবাইকে প্রস্তুতি নিতে হবে। তাহলেই আমরা সমৃদ্ধ ও উন্নত জাতিতে পরিণত হতে সক্ষম হব।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

back to top